গল্প ।। অবসানে ।। দীপক পাল
অবসানে
দীপক পাল
সমুদ্রের বেলাভূমিতে বসে দূরের দিকে দৃষ্টিটা ছুঁড়ে দিতে ভালো লাগে। উতল হাওয়ার ধাক্কাটা যদি খুব বেশি না থাকে তবে তো কথাই নেই। ঘণ্টার পার ঘন্টা সমুদ্র তীরে বসে থাকা যায়। দূরে কয়েকটা নৌকা ঢেউয়ের তালে উঠছে আর নামছে। যখন নামছে তখন মনে হয় এইবার বোধহয় ডুবে গেলো।
কিন্তু পরক্ষনেই ঢেউয়ের ওপরে তাকে দেখা যায়। নৌকাগুলো পারের দিকে আসছে না আরও দূরে চলে যাচ্ছে ঠিক ঠাহর হয় না। দৃষ্টির ভ্রম বলা যায়। অপরাহ্নের রোদ এখন অভ্র রং ধরেছে। জলে পরে চিক চিক করছে, আবার ঢেউয়ের জন্য ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শেষে রোদের রং পাল্টাতে শুরু করেছে। দিনটাও বড় হয়েছে অনেক। ঢেউগুলো একে একে আছড়ে পড়ছে আমার থেকে অদূরে। অভিবাদন করছে যেন আমায়। এটা ভাবতে গিয়ে মনে হলো যে একটু আগেও ভেতরে যে একটা ছটফটানি ছিল তা যেন একটু স্তিমিত হয়েছে। অবশ্য এটা কোনো আশ্চর্য ব্যাপার নয়। সমুদ্রের বিশালতার কাছে মানুষ আর মানুষের চাওয়া পাওয়া ইত্যাদি সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে যায়।
আমি এখন শর্মিলার জন্য অপেক্ষা করছি কারণ সে আমাকে ঠিক এখানেই আসতে বলেছিল। সে আরও বলেছিল সে বিকেল চারটার সময় আসবে। আমি যেন আরো আগে এসে যাই। আমি এখানে তিনটার পরেই এসেছি। সেই থেকে এখানেই বসে আছি। ও বলেছে এসে যদি আমাকে দেখতে না পায় তবে তৎক্ষণাৎ ফিরে যাবে। তাই এ জায়গা ছেড়ে উঠিনি। অথচ এদিকে চারটে বেজে গেছে।
এখনো তো এলো না। একটা ফোন করবো নাকি। না থাক, করবো না। যদি রাগ করে। শর্মিলা কিন্তু এলো একটু পরেই। এসে ধপ করে বসে পড়লো আমার পাশে। বললো অনেকক্ষণ এসেছি কিনা। বললাম, ' না, এইতো '।
প্রায় দেড় বছর পর আবার আমাদের দেখা হলেও মনে হয় আবেগ চেপে রেখে দুজনে চুপচাপ হয়ে গেলাম। সেদিনকার কথা কখনো ভোলার নয়। নতুন ক্যামেরায় ছবি তুলছিলাম সেইদিন। ফটো তুলতে তুলতে একসময় দেখেছিলাম এক দল মেয়ে খুব হৈহৈ করে স্নান করছে। ওদের ওই হুটোপুটি করে স্নান করা দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম। ওদের মধ্যে শর্মিলাকে দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। একটু জলে নেমে ওর একটা চুপি চুপি ফটো তুলেছিলাম যাতে ওরা কেউ দেখতে বা বুঝতে না পারে। কিন্তু আমার ধারণা যে ভুল ছিল তা একটু পরেই টের পেয়েছিলাম আমি। এক বন্ধুর সাথে উপরে উঠতে উঠতে আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ' বাহ্ আপনার ক্যামেরাটা কি সুন্দর তাই না? বিদেশি নিশ্চয়। একটু দেখতে দেবেন?' আমার খুব খটকা লেগেছিল। তবু দিলাম ওর হাতে। দু হাতে নেবার পর ডান হাত দিয়ে সেটা ধরে বাম হাত দিয়ে সমুদ্রের দিকে দেখিয়ে বলেছিল, ' যদি ক্যামেরাটা ওই দিকে ছুঁড়ে দি তাহলে কি হয়?' আমি বলেছিলাম, ' কেন, ফেলবেন কেন?'
- তাহলে আমার অনুমতি না নিয়ে আপনি আমার ফটো তুলেছেন কেন?
আমি কিছু বলার আগেই একটা বড় সড় ঢেউ এসে আমাদের ডিস ব্যালেন্স করে দিয়েছিল আর তার সাথে শর্মিলার হাত থেকে ক্যামেরটা জলে পরে গিয়েছিল। হা হা করে আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে ক্যামেরাটা টুপ করে জল থেকে তুলে নিয়েছিলাম। কাউকে কিছু না বলে একবার ওদের দিকে তাকিয়ে জল থেকে উঠে গিয়েছিলাম। ওদের দেখেছিলাম পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে।
সেদিনই বিকালে সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের বেশ ভিড় ছিল। অনেকেই জলে পা ডুবিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আর যখন এক আধটা বড়ো ঢেউ আসছিল, তখন তারা হই হই করে নিরাপদ জায়গায় ছুটে যাচ্ছিল। একটু পরে যখন জোয়ার এসে গেলো তখন নুলীয়ারা সবাইকে সমুদ্রের কাছে থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল। ঢেউগুলো প্রচন্ড আওয়াজ করে পারে ভেঙে পড়ছিল তারপর সারা বালিয়ারী ফেনায় ভরে যাচ্ছিল। শর্মিলা ওর সেই বন্ধুর সাথে কখন এসে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল টের পাইনি আমি। তারপর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিল, ' জানেন সকালে আপনার সাথে আমি খুব খারাপ
ব্যাবহার করেছিলাম। তার ওপর আপনার সখের ক্যামেরাটা জলে ফেলে দিয়ে আপনার অশেষ দুর্গতির কারণ হয়েছি। তার জন্য আমি আপনার ক্ষমা প্রার্থী। সকালে ওই ঘটনার পর থেকে আমি একটুও স্বস্তি পাচ্ছি না। ' আমি বলেছিলাম, ' দেখুন আপনার অস্বস্তির কোন কারণ নেই। আমি আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার ফটো তুলেছিলাম। এটা তো একটা অপরাধ। আপনার রাগ হাওয়া তো খুব স্বাভাবিক।
আর ক্যামেরাটা জলে পরে যাওয়া একটা অ্যাক্সিডেন্ট। ওই বড়ো ঢেউটা এসেই তো আমাদের সবাইকে ডিস ব্যালেন্স করে দিয়েছিল। কি করা যাবে আর বলুন '। ও বলেছিল, 'কিন্তু ক্যামেরাটা কি হবে '? ' ওটা স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে জমা দিয়েছি। ওখানে বলেছে বিশেষ কিছু হয় নি একটু হিট দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কালকেই ডেলিভারি দিয়ে দেবে। কোনো চিন্তা করবেন না। আপনারা যান এনজয় করুন '।
হঠাৎ আমার বাহুতে একটা চাপ অনুভব করতেই শর্মিলার দিকে তাকালাম। ' কি হঠাৎ চুপ চাপ হয়ে গেলে কেনো সম্বিত? কি ভাবছো?' এতো অন্যমনস্ক ছিলাম যে জবাব দিতে একটু দেরি হয়ে গেল। শর্মিলা আমার নাম ধরে ডাকলো, 'তুমি' বললো, এতেই আমি খুশি হয়েছি খুব।বললাম, 'তুমিওতো চুপ করে আছো '।
- আমি সেই সব দিনের কথা ভাবছিলাম জানো।
- আমিও তো তাই।
- আচ্ছা সম্বিত তোমার সেদিনের কথা মনে আছে যেদিন আমরা দুজনে সান রাইজ দেখতে বেরিয়ে ছিলাম অথচ মেঘের আড়াল হেতু সানরাইজ দেখতে পারি নি।
- মনে নেই আবার। তারপর তোমার ঝিনুক কুড়োনো ছুটোছুটি করে বালিয়াড়িতে। বলেছিলে এত সুন্দর ঝিনুকগুলো তুমি অ্যকুরিয়ামে সাজিয়ে রাখবে যাতে মাছেরা খুশি হয়।
- আমি সেইগুলো সব সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
- এমা কেন?' আমি খুব অবাক হলাম।
- তুমি কোথায় চলে গেলে আমি জানতে পড়লাম না। তাই আমার খুব রাগ হয়েছিল।' মুখে ওর আঁধার জমলো।
- ফোনে তো তোমাকে সবই বলেছি শমি। বলো, আমার কি কোনো উপায় ছিল?
- না তা ছিল না।
- তবে। তোমার মনে আছে বালিয়াড়িতে আমাকে একটা অন্তত কাঁকড়া ধরে দেবার বায়না করেছিলে?
- তা আবার মনে নেই।' খিলখিল করে হেসে উঠলো সে।
সমুদ্রের বালিয়াড়িতে অসংখ্য কাঁকড়ার বাস। গর্তে তারা লুকিয়ে থাকে। এমনিতে কাঁকড়াগুলো গর্তের কাছে ঘাপটি মেরে থাকে কিন্তু মানুষের পদশব্দ পেলেই নিমেষে গর্তে ঢুকে পড়ে। আমি শর্মিলাকে বলেছিলাম ওদের ঠিক এভাবে ধরা যায়না। আর আমার পক্ষে তো সম্ভবই না। ও বলেছিল তাহলে বাজারে এতো দেখা যায় কি করে? তবু আমি চেষ্টা করেছিলাম। কাছে গিয়ে পা তুলে ওদের ওপর প্রচন্ড আঘাত করছিলাম। কিন্তু পা সরিয়ে দেখছিলাম, সব ভো ভা। এদিকে রোখ চেপে গিয়েছিল। নতুন উদ্যমে আবার শুরু করেও একটাও ধরতে পারিনি, এদিকে পেটে হাত চেপে শর্মিলার কি হাসি সেইদিন।
- ওইদিনই বিকেলে তোমার গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার গলা এত সুন্দর, তুমি কোথাও নিশ্চয় গান শিখেছো।
- হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম আমি ভারতীয় সঙ্গীত পরিষদে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ক্লাসিক্যাল গান শিখি।
- তুমি বলেছিলে, আর কদিন পরে তোমার রবীন্দ্র সংগীতের ফাইনাল। সেদিন তুমি গেয়েছিলে, যে ছিল আমার স্বপন চারিনী তারে বুঝিতে পারি নি, দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে। সমুদ্রে তখন চলছিল
জোয়ার, আর প্রচন্ড ঢেউয়ের সাথে ছিল খুব হাওয়া। হাওয়ায় তুমি তোমার চুলগুলো সামলাচ্ছিলে।
- জানো আমি ক্লাসিক আর রবীন্দ্র সংগীত দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। আমি এখন নিজেই শেখাতে পারি।
- খুব খুশি হলাম তোমার এই কৃতিত্বে। তোমাকে উপহার দেওয়া উচিৎ আমার।
এদিকে সমুদ্রে জোয়ার আসায় আর বসে থাকা গেলো না, উঠতে হলো। উঠে আমরা হাঁটতে থাকলাম।
- জানো শমি, সেদিনই মাঝ রাতে বাবার ওই ফোন পেয়ে মনটা আমার একদম ভেঙে গিয়েছিল। জানো মা আমায় বলেছিল মাত্র তো তিন দিনের ব্যাপার, তোর তো কোথাও যাওয়া হয় না, ঘুরে আয় যা। ফিরে এসে দেখবি আমরা ভালই আছি। মা কিন্তু কথা রাখে নি। অন্য দিকে তোমার সাথে আলাপ হওয়া সত্বেও আমরা পরস্পরের ঠিকানা তো দূরের কথা, ফোন নাম্বারও রাখি নি। এমন বোকামি করার শাস্তিও পেয়েছি আমরা।
- এদিকে আমি তোমার ওপর ভীষন রাগ করেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি আমায় ঠকিয়েছ। আমি তোমাকে ঠিক চিনতে পারিনি। রঞ্জনার ফোন পেয়ে আমি তাই ভীষন অবাক হয়েছিলাম। তোমার ফোন পাওয়ার জন্য অধীর ভাবে অপেক্ষা করছিলাম। ভাগ্যিস রঞ্জনার সাথে তোমার সেদিন দেখা হয়েছিল।
- মায়ের সব কাজ সারা হয়ে যাবার পর ভাবলাম এই ভাবে আর কতদিন চলবে। যা হারাবার তা তো আমি হারিয়েছি, তা তো আর ফিরে পাবো না তাহলে শুধু শুধু ভেবে কি করবো। তাই আবার মূল স্রোতে ফিরে গেলাম। অফিসে যাওয়া আসা ছাড়া বন্ধুদের সাথে আগের মত আড্ডা দেওয়া, সিনেমা থিয়েটার দেখা একসাথে, ক্যারাম পেটানো ইত্যাদি। ওদিকে বাবাও মর্নিং ওয়াকের কিছু বন্ধু জুটিয়ে নিয়েছে।
সন্ধ্যেবেলাও বন্ধুদের সাথে তাস খেলে কাটাচ্ছে। জীবন কি থেমে থাকে? থাকে না।
- তোমার ফোন পেয়ে আমার কি মনে হলো জানো? তোমার সাথে আলাপ হয়েছিল দীঘায়, এই দীঘায় তোমাকে হারিয়েছিলাম। তাহলে এই দীঘাতেই বা কেন আমরা আবার শুরু করবো না। ফোনে তো তুমি তোমার সম্বন্ধে সবই বলেছ। আমার কর্মস্থলও কাঁথি। অতএব আমার মনে হলো এটাই সেরা জায়গা
আমাদের পক্ষে দেখা করার।
- আমার একটা অভ্যাস আছে, পার্ক স্ট্রিটে আমার অফিস থাকা সত্বেও আমি পার্ক স্ট্রিট মেট্রোতে না উঠে হেঁটে যাই ধর্মতলা পর্য্যন্ত। তারপর মেট্রো সিনেমা হলের কাছে যে মেট্রো স্টেশনটা আছে সেখান থেকে মেট্রোয় চাপি। এই কারণেই সেদিন বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে আসা রঞ্জনার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের এর পর কোথায় দেখা হবে?
- এখন আমি কাঁথির হোস্টেলে ফিরে যাবো। কাল খুব সকালে তুমি আর আমি কলকাতায় যাবো।
সামনের সপ্তাহ আমি ছুটি নিয়েছি। কলকাতায় গিয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী ভবিষ্যত ঠিক করবো। ঠিক আছে? তোমার কি অন্য কোনো চিন্তা আছে?
- না। ঠিক আছে।
কথা বলতে বলতে ওরা বাস স্টন্ডে পৌঁছে গেলো। কাল সকালের বাসের ওরা টিকিট কেটে নিলো।
শর্মিলা উঠবে কাঁথি বাস স্ট্যান্ড থেকে। ওকে একটা বাসে তুলে দিলাম। বাসে উঠে হাত নাড়ালো। আমিও নাড়ালাম। বাস চলে গেলো। যতদূর দেখা যায় দাঁড়িয়ে দেখলাম। কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। সমুদ্রের জলোচ্ছাসের শব্দ খালি শুনতে পাচ্ছি।
===============
Address:-
----------
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata-700104.
----------