ধারাবাহিক উপন্যাস ।। সামান্য মেয়ে ( পর্ব-৬ )।। রনেশ রায়
অবস্থা একটু স্বাভাবিক হলে পরে বুড়ির বিয়ে হয়ে যায় নিধিরামের মেজ ছেলে কালুরামের সঙ্গে। কালুরামরা পাঁচ ভাই দুই বোন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তিন ভাই ছোট। একজন কালুরামের ঠিক পরের জন মানুরাম এখানে থাকে না। সে ক্যানিং শহরে বাচ্চা বউ নিয়ে থাকে। বিএ পাশ করে একটা প্রাথমিক স্কুলে মাস্টারির চাকুরী করে। তার বাবার সঙ্গে কোনদিন বনে না। বাবার ব্যবসা পত্র চাল চলন ভালো লাগে না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে বিয়ের আগেই। আর ছোট দু ভাই পড়াশুনা করে। দাদা একটা ব্যবসা করে যেটা নিজের। কালুরাম বাবার সঙ্গে পরিবারের ব্যবসা দেখে। মহাজনী কারবারে খোদ্দেরের থেকে ঋণ ফেরত নেওয়া বন্ধকী জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করতে বাবাকে সাহায্য করা তার কাজ। দাদার বউ আর দুই ছেলে। শশুর শাশুড়ি নিয়ে জনা বারোর সংসার। সাবেকি বাড়ি। পাঁচটা ঘর। কালুরামের জন্য একটা ঘরের বরাদ্দ। সে বুড়িকে নিয়ে সে ঘরে। যৌথ পরিবার। অবিভক্ত হাঁড়ি। দুদিন যেতেই বুড়ি বুঝেছে হাঁড়ি সামলানোর দায়িত্ব তার। হাঁড়ি বসানো হাঁড়ি ধোয়া মাজা ঘর ধোয়া সব কাজের ভার তার ওপর। বাড়িতে বুড়ির হাঁড়ি সামলানোর ভার ছিল মায়ের সঙ্গে যৌথভাবে। এখানে অবশ্য বড় জা জানিয়েছেন তিনি আছেন ও যেন চিন্তা না করে। মাতৃসম বড় জা যদি মায়ের জায়গাটা নেয় তবে মঙ্গল। সেটা বুড়ি বোঝে। তাহলে সে সবটা বুঝে নেবে। বাড়িতে তো ঘাটে গিয়ে সব কাজ করতে হয়। এখানে বাড়ির মধ্যে কুয়ো টিবয়েল। সুতরাং অসুবিধে হবে না। স্বামীকে একটু আপন করে নিতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে সে স্বামী সম্পর্কে যা শুনেছে ! অবশ্য বিয়ে করে অনেকেই ঠিক হয়ে যায়। বুড়ি বুক বাঁধে। তবে নীলুর নামটা বুকের মধ্যে খচ খচ করে। ওর চেহারাটা ভেসে ওঠে। আর ওর তো দোষ নেই। ও তো অপেক্ষা করছিল। বরং বুড়ির জন্য বাবা এমন কি প্রিয় দাদুর সঙ্গেও বিবাদ। ভাবতেই বুড়ির কষ্ট হয়। তবে এখানে সবাই তাকে সানন্দে গ্রহণ করেছে। ছোট দেওররা অল্প সময়ে আপন হয়ে গেছে। ননদরা এখানে ধারে কাছে কেউ থাকে না। যে যার সংসার নিয়ে। কাজেই মানিয়ে চলতে হবে। কাজের মধ্যে থেকে সংসারে একাত্ম হতে পারলে নীলুর গ্রহটাও কেটে যাবে। আর এতে যদি বাবার সংসারটা বেঁচে যায়।
বুড়ি সংসারের হাল ধরেছে। চন্ডীপাট থেকে জুতো সেলাই সব। বাজারটা বাদ দিয়ে। ওটা শ্বশুর এখনও করেন।এতে উনার খুব উৎসাহ। উনি খাদ্য রসিক। তাই একেকদিন উনার ইচ্ছেমত একেকরকম রান্না। শ্বাশুড়ি আছেন। কিন্তু উনার স্বাস্থ্য ভালো নয়। তাই রান্নাঘরে বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। সেজে গুঁজে বড় বউ উপস্থিত থাকেন। কথাবার্তায় খুব মিষ্টি। তদারকিতে খুব পারদর্শী। তবে গতরের জোর কম। সেটা বুড়িকেই পুষিয়ে দিতে হয়। মশলা বাটা রান্না করা ধোয়া মোছা সব। সকালে সাতটার মধ্যে হেসেলে হাজিরা। সকালের খাবার ব্যবস্থা করে ভাত বসাতে হয়। দেওররা স্কুল যাবে স্বামী ভাসুর শ্বশুর কাজে বেরোবে। অবশ্য সাতটার মধ্যে শ্বশুর নিয়মিত বাজার পৌঁছে দেন হেঁসেলে। সব কাজ সেরে খাওয়া দাওয়া সারতে তিনটে চারটে। এরই মধ্যে বড় বউয়ের সঙ্গে গল্প শাশুড়ির সেবা ঘর পরিষ্কার কাপড় জামা পরিষ্কার করা। নামে মাত্র ঘর মোছার একজন লোক আছে।
বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। বুড়ির সংসার বেশ চলছে। ও এখন ছমাসের সন্তান সম্ভাবা। তবে হেঁসেলে ছুটি নেই। সন্তান সম্ভবা মায়ের নাকি ছুটি নিতে নেই। যত কাজের মধ্যে থাকবে তত সন্তান ভালো থাকবে, নিজে সুস্থ থাকবে। তাই শাশুড়ি বড় জা শ্বশুর সবার নিদান ও যেন রান্নাঘরে অনুপস্থিত না থাকে। সেই নিদান মেনে চলে বুড়ি। তবে বছরখানেকের এই সংসারের অভিজ্ঞতা আর এ বাড়ির আর বাড়ির সদস্যরা তাকে অনেক কিছু জানতে সাহায্য করেছে।
বড় বউয়ের বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। তিনি নিজে বিয়ে পাশ। তবে তাঁর স্বামী স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেন নি। বড় বউ কথা বার্তায় পরিপাটি যদিও একটু দাম্ভিক। কেউ কিছু বললে তার জবাব দিতে জানেন । নিজে বাড়িতে কোনটা করবেন নিজেই ঠিক করে নেন । যেমন রান্নাঘরে তদারকির কাজ। উনার তদারকিতে বুড়ির মেহনত। আরও একটা ব্যাপার স্বামী ওনার কথার ওপর কোন কথা বলতে সাহস পান না। বললেই উনি বাপের বাড়ি চলে যাবেন। খুব সম্ভবত বড় বউয়ের এসব জেনে শ্বশুর নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বুড়িকে এ বাড়িতে এনেছেন। উনার নাকি সমাজে মর্যাদা বোধটা খুব তীক্ষ্ণ ছিল। আর টাকায় সন্মান কেনা যায়। তাই ছেলের বিয়েতে যৌতুক চাই অনেক। যত যৌতুক তত পাত্রের দর। কিন্তু বড় বউয়ের ব্যাপার তাঁকে শিখিয়েছে গরিব ঘরের বউ এনে তাকে দাসী করে রাখা যায়। আর মেয়েদের শিক্ষা না থাকলে হেঁসেলে তাদের মন বসে। এ দুটো গুনই বুড়ির মধ্যে আছে। সে গরিব আর তার তেমন শিক্ষা নেই। বড় লোকের বৌ আনলে বিপদ যেটা বড় বৌয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে। তবে বড় বউ এর সঙ্গে বুড়ি মানিয়ে নেয়।মানিয়ে নেওয়াযটা বুড়ির বলতে গেলে বাধ্যবাধকতা। তার বাপের বাড়ির জোর নেই। আর মেহনতে তার আপত্তি নেই। বড় বউ যেখানে বড় সেখানে তাঁর তদারকিতে সে কাজ করলে তার সম্মানহানি হবে বলে সে মনে করে না।বড় বউএর সঙ্গে সে মানিয়ে নিয়েছে বলে বড় বউ তাকে স্নেহের চোখেই দেখেন । পরিবারের কার কি হাল চাল তা তিনি বুড়িকে সব খুলে বলেন । কিছুটা ঠোঁট কাটা দাম্ভিক হওয়ায় বরং বুড়িকে কোন রাখঢাক না রেখে সবই অবলীলায় বলেন । কাউকে তোয়াক্কা করেন না। আর নিজেকে বাঁচিয়ে চলার জন্য পরিবারের সব কথা বুড়ির জানাও দরকার। তাতে বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত অবস্থার মোকাবিলা করতে তার সুবিধা হয়। বাড়ির সব সদস্যদের চরিত্র যেন বড় বউএর নখদর্পণে। শ্বশুর কেমন বুড়ির স্বামী কেমন এমন কি তাঁর নিজের স্বামী কেমন সেটা বড় বউ রসিয়ে কষিয়ে বুড়িকে জানান । নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বড় বউএর মূল্যায়ণ বুড়ি মিলিয়ে নিতে পারে। বুড়ি দেখে সে কিছুদিনের মধ্যে সংসার আর সংসারের সদস্য সম্পর্কে যতটুকু অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তা বড় বউএর অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়। বিশেষ করে তার স্বামী আর শ্বশুরের চরিত্র চাল চলন সম্পর্কে।
এই অল্পদিনের মধ্যে বুড়ি বোঝে যে তার স্বামী বদলাবার নয়। তার সম্পর্কে দিদি অর্থাৎ বড় বউ যা বলেছে তা যেন অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।যে গুন মানুষের রক্তের মধ্যে ঢুকে যায় তা শুধরাবার নয়। বিয়ের পর দুদিন স্বামী সংযত ছিল। বুড়ি ভেবেছিল ও স্বামী সম্পর্কে যা শুনেছে হয় সেটা ভুল নয়তো ও নিজেকে শুধরে নিচ্ছে। কিন্ত দুদিন পর থেকে সে নিজ মহিমায়।মিলে যায় বড় বউ এর সাবধান বাণী। বুড়ির বোঝাটা ভুল। বরং তার গুণগুলোর কথা জেনে বুঝে তাকে যা মনে হয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর সে। শুধু জুয়া মদ নয় অন্য অনেক গুণ আছে। তার জন্য সে ঠিকমত বাড়ি ফেরে না। পুরোন জামা ছেড়ে নতুন জামা পড়ার অভ্যাস তার। আর কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন পুরোন হয় তার কাছে। সে সব সময় নতুনের সন্ধানী। তার নিজেকে বাঁচাবার অস্ত্র শুধু মুখের বচন নয় লাঠি ঝাঁটা সব। যার তার সঙ্গে থাকতে হয় এসব খেয়েই থাকতে হয়। বুড়ি এই কয়েকমাসের মধ্যে সেটা হারে হারে টের পাচ্ছে।প্রায় প্রতিদিনই অশান্তি। সে কোথায় যায় কেন ফেরে না তা জানার অধিকার বুড়ির নেই বলে সে জানিয়ে দেয়। জানতে চাইলে লাঠি ঝাঁটা । কথায় কথায় বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ির ক্ষমতা নিয়ে হাজার কটূক্তি।এই অল্প সময়ে বুড়ির এটাই মনে হয়েছে ওরকম স্বামী বাড়ি ফেরার থেকে না ফেরাই ভাল।যে ভাগাড়ে সে যায় সেটাই তার উপযুক্ত জায়গা।
আর যে ব্যাপারটা নিয়ে দিদি বুড়িকে সতর্ক করে দিয়েছেন সেটা হলো শ্বশুরের শকুনের দৃষ্টি। দিদির থেকে সেটা জানতে পারায় বুড়ি তার কাছে কৃতজ্ঞ। বুড়ি নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারে। ইতিমধ্যে নিজেই বুঝেছে যে বাপ বেটা এ ব্যাপারে কেউ কম যায় না। আর এটা স্বীকার করতেই হয় যে স্নেহ করে বলেই হোক আর অন্য কোন কারণেই হোক দিদি তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে এ ব্যাপারে ও অসুবিধেয় পড়লে দিদির সাহায্য সে পাবে। আর দিদিকে যে ওরা ভয় করে ইতিমধ্যে বুড়ি সেটা বুঝে গেছে। দিদি এ ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতা তাকে সবিস্তারে বলেছে। বুড়ির মত একটা গরীব পরিবারের বউ এর কাছে দিদির এই অভয় তার কাছে বড় হাতিয়ার। সে দিদির কাছে যেটা জানলো শিখল সেটা কম কিছু নয়। সে জানালো যে তার শ্বশুর নারী আসক্ত। হলেই হল, বয়সে কিছু আসে যায় না। বড় বউয়ের সঙ্গে ষষ্টি নষ্টি করতে গেলে বউয়ের বাবার ইশারায় তাকে জেল খাটতে হয়। সেখানে সে অর্থের জোরে পেরে ওঠে নি। সমানে সমানে খেলতে গিয়ে হারতে হয়েছে। তাই এখানে বুড়ির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় নামতে চাওয়ার জন্য বিয়েতে পণ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত। এখন তার কাছে শিক্ষা কাঞ্চনের থেকে কামিনী বেশি দামি। বুড়ির এই পরোক্ষ জ্ঞান লাভের জন্য সে দিদির কাছে ঋণী।এরই মধ্যে বড় জা বুড়ির এই উপকারটা করেছে।
আরেকটা বিষয় যেটা তার পাওয়ার ভান্ডার পূর্ণ করে যার সম্পর্কে না বললে বুড়ির এ সংসারের কাহিনী সম্পুর্ন হয় না সেটা হল এই বাড়িতে চাকুরীরত রক্ষীর পরিবার। রক্ষীর নাম পরিমল সর্দার। সে তার বউ আর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকে। মেয়ে দুটির বয়স একজনের চোদ্দ একজনের ষোল। গ্রামের স্কুলে পরে। ওরা এই বাড়ির মালিক নিধিবাবুর সমগোত্রীয় জাতের দিক থেকে। নিম্নবর্গীয় তপশিলি জাতি। তবে ওদের সঙ্গে পরিচয় করে বুড়ি বোঝে ওরা আর্থিক দিক দিয়েও বুড়ির বাপের বাড়ির জাতিভুক্ত অর্থাৎ গরিব জাতি। রক্ষীর স্ত্রীর নাম ক্ষমা। এই পরিবারটাই সব দিক থেকে বুড়ির খুব কাছের। এ কদিনের মধ্যেই যেন নিকট আত্মীয় হয়ে গেছে। ক্ষমা দেবীর বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি। বুড়ির থেকে বেশ কিছুটা বড়। উনাকে বুড়িদের সংসারের বেশ কিছু কাজ করতে হয়। ঘর পরিষ্কার বাগানের কাজ প্রয়োজনে বাড়িতে যে ক্ষেত আছে তাতে কাজ। পরিবারের কাজে ও যুক্ত থাকায় ওর সঙ্গে বুড়ির যোগাযোগ রোজের। ও বুড়ির খুব ঘনিষ্ট। বড় বউ এদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। আর রান্নার তদারকি বাদে অন্য কাজে তার মাথাব্যথা নেই। ক্ষমার কাছে আলাপ চারিতায় বুড়ি এবাড়ির অনেক কিছুই জেনেছে যা বড়বৌ ওকে বলে নি। হয়তো পরিবারের গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে বলে নি। ক্ষমার দুই মেয়ের সঙ্গেও বুড়ির সখ্যতা। তাদের কাছে শ্বশুরের বামাচারিতার গল্প ও শুনেছে। তার কুদৃষ্টির অনুগ্রহ থেকে মেয়েরাও বাদ যায় নি। তবে যে ব্যাপারে বুড়ি প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছে সেটা হলো নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে আবার একটা জাতিভেদ আছে। নিধিবাবু ওদের নিম্নবর্গের মধ্যে নিম্নবর্গ ভাবেন বলে ক্ষমা বা তার মেয়ের ওদের রান্নাঘরে ঢোকা বারণ। ওদের ছোঁয়া নিধীবাবুরা খান না। তাই রান্নাঘরে বুড়ির অবাধ সাম্রাজ্য অবশ্য বড়বৌয়ের তদারকিতে। এ যেন আর্থিক স্বাচ্ছন্দের দৌলতে তফসিলি লি হয়েও নিধীবাবুরা তফসিলি ব্রাহ্মণ। শুধু ঘরে নয় ঘরের বাইরেও তারা তফসিলিদের মধ্যে উঁচু জাতের। সরকারের যত সংরক্ষণের সুবিধা কোটা তার সুযোগ এই আর্থিক দিক থেকে বিত্তবান তফসিলি ব্রাহ্মণরা ভোগ করে। পঞ্চায়েতে মোড়ল বৃত্তি এদেরই আয়ত্তে। গরীব তপসিলিরা তফসিলিই রয়ে যায়।
অবশ্য সে আরও জেনেছে যে তার ছোট দেওর দুটো ভালো, সত্যি বুড়িকে ভালোবাসে ওকে আগলে রাখে। এটা এ বাড়িতে বুড়ির সত্যিকারের পাওনা।সময়ে অসময়ে বুড়ির পাশে থাকে ওরা। একটু অবসর পেলে ওদের সঙ্গে গল্প হয়। স্কুলের গল্প বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে গল্প সংসারের গল্প। ওরাই বাপের বাড়ির সঙ্গে ওর যোগাযোগের মাধ্যম। বুড়ি সময় পায় না বাপের বাড়ি যাবার। ওরাই ও বাড়ির খবর এনে দেয়। ওদের সঙ্গ পেলে বুড়ির ভালোই কাটে। ওদের কাছ থেকেই বুড়ি এ বাড়ির কীর্তি কাহিনী যেমন জেনেছে ওদের দাদার গুনাগুন সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। দেওরদের যে ভাই ওদের আলাদা থাকে সেখানে ওকে নিয়ে গেছে। ওই বৌদির সঙ্গে ওদের বন্ধুর মত সম্পর্ক। ওদের সঙ্গে আলোচনায় বুড়ি বুঝেছে ওরা একটু আলাদা। ওদের জীবন যাপন অন্যরকম। দাদা স্ত্রী আর বাচ্চাকে নিয়ে প্রাচুর্যের মধ্যে না থাকলেও সুখে আছে।
খুব ছোট করে বলতে গেলে এই জানা বিষয়গুলো নিয়েই শশুরবাড়িতে বুড়ির সংসার। এসব নিয়ে রোজের যে ঘটনা এই একবছর যা ঘটেছে তার বিবরণ দিতে গেলে একটা মহাভারত হয়ে যাবে। সেখানে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। মাতৃ বন্দনা পুজো আর্চা কোনোটাই সংসারে বাদ যায় না। আর এই পরিবারের প্রাচুর্যের মধ্যে যেন গুমরে মরে গরিবের আর্ত কান্না। দেখা যায় বাসন কোষণ থেকে শাশুড়ি বউ মেয়েদের গয়না সবই কিভাবে মহাজনী কারবারের সাফল্যের সাক্ষ্য বহন করে। আর এই কল্যানে এ বাড়িতে মা লক্ষ্মীর সাক্ষাৎ উপস্থিতি। লক্ষ্মীর কৃপাকে স্মরণ করা হয় মহাসমারোহে। লক্ষ্মীর এই গরিমায় মা সরস্বতী বোধ হয় ক্ষুব্ধ। তাঁর এ বাড়িতে প্রবেশ বন্ধ। এছাড়া আছে স্বামী, স্বয়ং রাক্ষস। এই বৃহৎ সংসারের মধ্যে বারো বাই পনেরো ঘরের মধ্যে বুড়ির একান্ত নিজের সংসার। আদরের সোহাগের এই সংসারে বুড়ির স্বর্গসুখ। মহামান্য স্বামী ঘরে থাকলে রাতেই দেখা পাওয়া যায় তাকে। দিনে নয়। দিনে বুড়িরও সময় নেই কালুরামেরও সময় নেই। এই রামের বংশে বুড়ি একজন সম্রাজ্ঞী সন্দেহ নেই। আর রাতে রোজ স্বামী বাড়ি আসেন না। সেটা বোধ হয় বুড়ির কাছে আশীর্বাদ। কারণ রাতে বাড়ি থাকলে এই মদ্যপ স্বামীর ঘরে লাঞ্ছনা ছাড়া বিশেষ কিছু জোটে না। বাক্যালাপে মধুর বাক্য বর্ষণ এ ঘরে। তার সঙ্গে লাঠি ঝাটার সঙ্গত। আর স্বামী বর্ণনা দেয় বিভিন্ন নারী দেহের সৈষ্ঠব যা বুড়ির শরীরে অনুপস্থিত। তারই মধ্যে তাঁর অনুগ্রহে গর্ভের সন্তান। বুড়ির এত পাওনা সহ্য হয় না। তাকে সন্তান প্রসবের জন্য বাপের বাড়ি যেতেই হবে। তখন সে ঠিক করবে সে কি করবে।তাই বুড়ির এই সংসার উপাখ্যান আপাতত তোলা থাক।
ক্রমশ----------