পরেশ চন্দ্র মাহাত
এক
শীতকাল। মোবাইলের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে রাত্রি আটটা বেজে তিরিশ মিনিট। নীলিমা মোবাইলের প্যাটার্ন খুলে ড্যাটা অন করতেই দেখতে পেল মধুরিমা হোয়াটসঅ্যাপে 'হাই' লিখে মেসেজ পাঠিয়েছে। মধুরিমা অনেকদিন পরে‚ প্রায় ছয় মাস আগে মেসেজ করেছিল। আর করেনি। এদিকে নীলিমারও নানা কারণে ব্যস্ত থাকায় মেসেজ করা হয়নি। তাই সে তৎক্ষণাৎ মেসেজের রিপ্লাই দিল 'হ্যালো' বলে। মধুরিমার ড্যাটা অন ছিল‚ তাই সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে এসে লিখল —
"কি রে? কি করছিস?"
"এই কিছু না।"-- নীলিমা উত্তর দিল।
এরপরে তাদের দুজনের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপালাপ ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে। প্রথমে মধুরিমায় লিখল —
"বল্‚ কেমন আছিস?"
"ভালো।"
"তুই…?"
"ফ্যান্টাস্টিক ..!"
"হম্মম…তোর মেয়ে কেমন আছে? বল্?"
"ভালো … তবে একটু সর্দি আছে রে।"
"শীতকাল তো‚ তাই। বাচ্চাদের হবেই। আবার ঠান্ডাটা একটু বেড়ে গেছে তো …তাই।
" হম্মম রে …"
কুশল আদান প্রদান করার পর শুরু হয় মূল আলোচনা। সেই কত বছর হল ‚ প্রায় সাতবছর বি.এড পাস করা। এখন পর্যন্ত তাদের প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটানোর সুযোগ পায় নি—দেওয়া হয়নি। সুযোগ থেকে তাদেরকে বঞ্ছিত রাখা হয়েছে। যে বিস্ফোরণে তাদের সুপ্ত অভীপ্সাগুলি‚ বাসনাগুলি ও ইচ্ছেগুলি মনের আকাশে রামধনুর ন্যায় – জীবনকে উজ্জ্বলদ্যুতি প্রস্ফুটিত করে আনন্দিত করে তুলবে। মনের চাওয়াকে নিমেষে পাওয়াতে রূপান্তরিত করে‚ তাদের জীবনকে রঙিন‚ বর্ণময় ও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে সাহায্য করবে। একজন শিক্ষিত মেয়ের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জীবনকে সুন্দর থেকে সুন্দরতম করে তোলা। আর এই লক্ষ্যকে সফল করতে হলে — অর্থ উপার্জন বাধ্যতামূলক। তাই তাদেরও মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করা‚ সেই মূল ও প্রধান বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে‚ আলোচনা করে —
"হ্যাঁরে … সরকার কি আর নিয়োগ করবে না?"
"সেটাই তো রে!… কি যে হবে?"
"সেই কবে বি.এড পাস করেছি?"
"হমম সাত বছর হয়ে গেল।"
"তবে এই বছর হতে পারে মনে হচ্ছে?"
"কি জানি?"
"মনে হচ্ছে হবে…সামনে ভোট তো?"
"দেখা যাক ! … হলে তো ভালো।"
মধুরিমার মেয়ে ঘুম থেকে উঠায় সে লিখল —
"রাখছি রে? আমার মেয়েটা উঠল। এখনই কান্না শুরু করবে।"
"হমম রাখ…"
"গুড নাইট….সুইট ড্রিমস।"
"স্যাম টু ইউ…"
নীলিমা আর মধুরিমা দুই বান্ধবী‚ তাদের সশরীরে শেষ দেখা হয় বি.এড কমপ্লিট হওয়ার দুবছর পরে পুরুলিয়া টাউনে। নীলিমার টিউশন ছিল পুরুলিয়াতে । তাই টিউশন শেষ হওয়ার পর তার ইচ্ছে হল রাসমেলায় ঘুরে যাওয়ার। আর এদিকে মধুরিমা এসেছিল স্বামীর সঙ্গে। তার বিয়ে হয়েছে বি.এড শেষ হওয়ার এক বছর পরে। তার পেটে সমস্যা ছিল‚ তাই সে নিউ বিশুদ্ধ মেডিক্যালে এক স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাতে এসেছিল। ডাক্তার দেখা শেষ হলে তারও ইচ্ছে হল রাসমেলায় ঘুরে যাওয়ার। আর এই সুযোগে উভয়ের সাক্ষাৎ। নীলিমা একটা মনিহারী দোকানে কিছু কেনাকাটা করছিল। মধুরিমা তাকে দেখতে পেয়ে সামনে গিয়ে পিছন থেকে বলল —
"এই নীলিমা?"
নীলিমা পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল এক সুদর্শন পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে হোস্টেল লাইফের মধুর-মা — মধুরিমাকে। সুদর্শন পুরুষের সঙ্গে ইতিপূর্বে সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু তাতে কি হবে? সে দেখেই অনুমান করতে পেরেছে —সেই জিন্স টি-শার্ট পরা সুদর্শন পুরুষ মধুরিমার স্বামী। বিয়ের সময় নীলিমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। যাওয়া হয়নি – কারণ সেই পড়াশুনা কমপ্লিট হওয়ার পর বাড়ি এলে‚ বান্ধবীদের বিয়েতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে বাড়ির লোকের কাছে পারমিশন নেওয়া আবার অন্যদিকে সব বান্ধবীকে একসঙ্গে পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়— মনের ইচ্ছে থাকলেও তাতে লাগাম লাগাতে বাধ্য হতে হয়। হোস্টেলে থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। সেখানে থাকলে কোন সমস্যা হয় না— সেখানে না বাড়ির লোকের পারমিশনের দরকার পড়ে অথবা বান্ধবীদের একসঙ্গে পাওয়া। তাই নীলিমার যাওয়া সম্ভব হয়নি।
সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠল —
"মধুরিমা! তুই?"
"হ্যাঁ রে!"
তারপরে দুজনের মধ্যে অনেক আলাপ‚ আলোচনা ও সমালোচনা হয় —সেই পূর্বের কলেজ লাইফ ও হোস্টেল লাইফের মধুর হিউমার মিশ্রিত স্মৃতির দিনগুলি রাতগুলি নিয়ে। তারপরে সমস্যা অসমস্যার কথাও বাদ যায়নি। কিন্তু আজ দুবছরের কথা কি অল্প সময়ে শেষ হয়? কিন্তু শেষ তো করতেই হবে? কারণ দুজনেরই বাড়ি ফিরতে হবে। এই মধুর মিলনের পর এল সেই করুন রসাশ্রীত ও বেদনাঘন বিদায়ের পালা। এক্ষেত্রে অবশ্য নীলিমাকেই এগিয়ে আসতে হল –কারনও রয়েছে। নীলিমাকে বাস ধরতে হবে। মধুরিমার অবশ্য সে সমস্যা নেই। তারা মোটর সাইকেলে এসছে। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে নীলিমা জানায় —
"মধুরিমা আসছি রে?"
মধুরিমাও নৈব নৈব চ করে বলে —
"ঠিক আছে… আয় … সাবধানে যাস্ ।"
"হ্যাঁ …বাই ।"
"বাই…। "
নীলিমা তাড়াতাড়ি বাস স্ট্যান্ডে এসে বাস ধরে। বাসের সিটে বসে বসে চিন্তা করতে করতে যায়। বাসের গতিকে তার মনের গতিও পাল্লা দিতে থাকে — সমান তালে চলে। বান্ধবীর এই মধুর অবস্থা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। না মেনে নেওয়ার কারণও রয়েছে। সেও বি.এড করার সময় ভাবত —
"আমার স্বামী হবে লম্বা হ্যান্ডসাম চাকরিওয়ালা। এই মধুর আকাশচুম্বি স্বপ্নাকাশে তখন তার হৃদয় উৎফুল্লিত থাকত।"
কিন্তু চাকরিওয়ালা তো দূরের কথা ! এখনও সে দু'হাতেই রয়ে গেল‚চার হাত আর হল না — হবে কিনা সেটাও তার কাছে অজ্ঞাত। তাই মনে প্রাণে সে মধুরিমার এই অবস্থা মেনে নিতে পারেনি –খুশি হয়নি। বরং মনের অভ্যন্তরে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে সারা শরীরকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। সেই জ্বলন্ত আগুনকে থামানো অসম্ভব হয়ে উঠছে। কিন্তু হিংসে হলে কি হবে? তার তো কিছু করার নেই? উপায়ও নেই? মেনে নিতেই হবে? কপাল বলে তো একটা জিনিষ আছে। বয়স্কদের কাছে আগে শুনত –জন্ম বিবাহ মৃত্যু বিধাতার দান। এটা আগে অবশ্য মানত না‚ সেটা তার কাছে অলীক এবং অবাস্তব মনে হত। বরং সে ঠাট্টা করে হেসে উড়িয়ে দিত। বলত – "বিয়ে হতে আবার সমস্যা কি? আমি চাইলেই হবে।"
এখন সে বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে বুঝতে পারছে –"বিয়ে কত কঠিন বিষয়। আগে যেটা সহজ ভাবত সেটা এখন সহজ নয় ‚ তা সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে।"
এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে জয়পুর বাস স্টপে যে চলে এসেছে ‚ সেটা বুঝতেই পারত না —যদি না বাস কন্ডাক্টর বলে দিত। ফলে সে তাড়াহুড়ো করে বাস থেকে নেমে পড়ে এবং সাইকেলে করে বিকাল পাঁচটার মধ্যে শ্রান্ত শরীরে ও অশান্ত মনে বাড়ি পৌঁছায়।
দুই
মধুরিমার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপালাপ বন্ধ হলে বিছানায় শুয়ে মনে মনে ভাবে এখন সে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে। সে আশা করেছিল চাকরি করবে। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূলতার জন্যে বাস্তবায়িত হল না‚ এখন অব্দি অধরায় থেকে গেল। আবার এটাও সে চেয়েছিল তার বিয়েও হবে চাকরিওয়ালা বরের সাথে। মা বাবার একমাত্র মেয়ে আবার উচ্চ শিক্ষিত‚ রূপও খুব একটা খারাপ নয়—ফলে এই ধরনের আশা করা অবান্তর অসমীচীন ছিল না। তার বাবাও অবশ্য নিশ্চিন্ত ছিল মেয়ে একদিন সফল হয়ে নিজের মনের অভ্যন্তরে সুপ্ত বাসনাগুলি চরিতার্থ এবং বাবার নাম উজ্জ্বল করবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার এমনকি বাবার স্বপ্নও এখন অসম্পূর্ণ ও অধুরায় রয়ে গেল। চাকরির যা অবস্থা তাতে তাকে ভাবনা চিন্তার পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন লক্ষ্য বিয়ে আগে হোক‚ চাকরি পরে হলেও হবে। কারণ বিয়ে একটা নির্দিষ্ট বয়সে হয়ে যাওয়া উচিত। বেশি বয়সে বিয়ে করা বিশেষ করে মেয়েদের অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের সন্তান ধারণের ব্যাপারও রয়েছে — জৈবিক শারীরবৃত্তীয় সমস্যা। বর্তমানে হৃদয়ের কল্পলোকে যে রাজকুমারকে স্থান দিতে চায় নীলিমা — হৃদয়ের সাথে কথোপকথন করে —
"এখন কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে?"
"কোন বিষয়ে?"
"বিবাহের ব্যাপারে?"
"বিবাহের ব্যাপারে তো আগে অন্য ছিল। তখন তো আশা করেছিলাম চাকরিওয়ালা । কিন্তু এখন …?"
"এখন কি ?"
"এখন তো চাকরি হচ্ছে না। সরকার অনেকদিন ধরে নিয়োগ বন্ধ করে রেখেছে। দুয়েকটা হয়েছে তাতে কম্পিটিশন যেমন বেড়েছে তেমনি দুর্নীতিও আকাশছোঁয়া। তাতে যারা পেয়েছে তারা হয়তো আমাকে নাও করতে পারে?"
"তবে কি এই মুহুর্তে সিদ্ধান্তের বদল করা উচিত ?"
"হ্যাঁ অবশ্যয়।"
"তবে কেমন ছেলেকে বিয়ে করা উচিৎ?"
"কেমন আবার বলব? উচ্চ শিক্ষিত বেকার এবং ভালো ছেলে হলেই করে নেব। একটু আন্ডারস্ট্যান্ডিং যেন হয়। তারপরে কি হবে ? সেটা ভবিষ্যতের উপর ছেড়ে দিতে হবে।"
এইভাবে নীলিমা নিজেকে এবং মনকে সন্তুষ্ট করে ‚ চোখে মুখে ঘুমের লক্ষণ দেখা দিলে —ভাবনা চিন্তায় ইতি টেনে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ে।
========================
নাম — পরেশ চন্দ্র মাহাত