মাম্মা
আরতি মিত্র
সাদা গাড়িটা চোখের সামনে থেকে আড়াল হতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন উমা। শুভ্রা আজ চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। শুভ্রা তার বড় মেয়ে। অর্থাৎ বাড়ির বড় সন্তান।
সংসারটাকে সব দিক থেকে আগলে রেখেছিল সে। হাইস্কুলের চাকরীটা পাবার আগে দিনরাত প্রাইভেট টিউশন করত। বাড়ি ফিরত রাত দশটায়। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে নিজের পড়াশুনা নিয়ে মেতে থাকত।
আজ সেই ঘরের লক্ষ্মী কি পর হয়ে গেল? না না এসব কি আবোল তাবোল ভাবছে উমা? মেয়েদের ওটাই তো নিজের ঘর।
মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে হয়েছে তাকে। জমিদার বাড়ি বলে কথা ! জমিদার বাড়ির ছোট ছেলে সুনির্মলের সঙ্গে শুভ্রার বিয়ে। সাদা গাড়িটা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল পুরনো জমিদার বাড়ীর দিকে।
এখন উমার চিন্তা কতদিনে শোধ হবে সেই ঋণ, যা আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বাধ্য হয়েই ধার নিতে হয়েছে জমিদার বাড়িতে জাঁকজমকের সঙ্গে বিয়ে দিতে গিয়ে।
শুভ্রা সবই জানে। সে আপত্তি জানিয়েছিল এভাবে ধার করে খরচ করে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য। বলেছিল, এ ভাবে তোমাকে ঋণে ডুবিয়ে, আমি জমিদার বাড়ির বউ হতে চাই না মা। তুমি এই বিয়ে ভেঙে দাও। উমা তার কোন কথাই শোনেনি।
মধ্যবিত্ত পরিবারে যা ঘটে, বুকে পাথর চেপে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন উমাদেবী। নিজেকে শক্ত রেখেছিলেন যাতে মেয়ের চোখ অশ্রুসিক্ত না হয়, তাই ভেবে নিজের কান্না আপ্রাণ চেষ্টায় চেপে রেখেছিলেন হৃদয়ের ভিতর। কিন্তু এখন আর তিনি নিজেকে সংবরণ করতে পারছেন না।
বাড়ীর বড় বলে ভাইবোনদের জন্য নিজে বিয়ে করবে না এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শুভ্রা।
মা জোর করেই বিয়ে দিলেন তাকে অনেক খরচ করে। উমা ভাবে, শুভ্রা সুখী হবে তো? অবশ্য মেয়েকে নিয়ে তার এই চিন্তা অমূলক। সব পরিবেশেই শুভ্রা নিজেকে মানিয়ে নিতে জানে।
শহর ছাড়িয়ে গাড়ী এগিয়ে যাচ্ছে শহরতলীর দিকে, অবশেষে পৌঁছলো পুরোনো জমিদার বাড়ীর গেটে। আড়াইশো বছরের পুরনো বাড়ি। প্রথমে মন্দিরে ঢুকে গোপালকে প্রণাম জানিয়ে তাকে প্রবেশ করানো হল বাড়িতে।
নানা নিয়মকানুন পালনের পর, শেষে নিজের ঘরে এসে ঢুকল শুভ্রা। মনের মধ্যে ভাললাগা বা মন্দলাগা কোনও অনুভূতিই এখন জাগছে না তার। যেন শুধুই কর্তব্যই পালন করে যাচ্ছে সে।
সংসারে থাকলেও সাংসারিক জীবনের বাইরে সারাদিন কাটত শুভ্রার। সুতরাং সংসারের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে কোন ধারণাই তার ছিল না।
একটা অন্য জগতে এসে উপস্থিত হয়েছে যেন সে এখন। এরপরে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য কে জানে?
দ্বিরাগমনের সময় শুভ্রা ফিরে এল বাড়িতে। উমার মনে আনন্দ আর ধরে না। এইকটা দিন তার ভীষণ মন খারাপ নিয়ে কেটেছে। একসময় শুভ্রাকে একা পেয়ে উমা জিজ্ঞাসা করল, কি রে মা ওদের বাড়ির লোকজন কেমন?
শুভ্রা বলল, কেমন যেন।
- মানে?
- আমি ঠিক তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না ।ছাড় এসব, বল তুমি কেমন আছ?
আমি খুব ভাল আছিরে মা।
শুভ্রা মুচকি হেসে বলল, আমাকে ছেড়ে?
- না রে মা, তোর কথা সবসময় মনে পড়ে, বলে উমা শুভ্রাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল।
এসব প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা। উমা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই দু'বছর আগে মারা গেছেন। শুভ্রা এই দু'বছরে সবার কাছে করা মায়ের ঋণ শোধ করে দিয়েছে। গতবছর শুভ্রার একটি মেয়ে হয়েছে। মুখখানা দেখতে ঠিক তার মায়ের মতো। শুভ্রা নিশ্চিৎ তার মা-ই তার কাছে মেয়ে হয়ে ফিরে এসেছে। তাই সে মেয়েকে তার মায়ের মতোই 'মাম্মা' বলে ডাকে।
-----------------------------
Arati Mitra.
267/3 Nayabad
Garia--700094