অনন্যা ঘোষাল মুখার্জি
কাঁটা ডানদিকে এগোতে থাকে, একশো...একশো কুড়ি ....একশো চল্লিশ ....স্টিয়ারিং বামদিকে ঘোরালেই সলিল সমাধি । নীচে বর্ষার দামোদর ফুলে ফেঁপে তার সহস্র বাহুর বিস্তৃতি নিয়ে গর্জন করে চলেছে। মুহূর্তের দুর্বলতায় চোখের পাতা কেঁপে ওঠে, মোহিনীর শ্যামা আর রাই এর কথা মনে হতে। কিন্তু পেছনে নারী খাদকের দল....তাদের অনেকগুলো দু চাকার শব্দ...এদের হাতে বলি হওয়ার চেয়ে দামোদর শ্রেয়।এক্সেলারেটরে পা দিতেই
ভীষণ শব্দে গাড়ির গতি পাল্টে গেল। বন্দুকের আওয়াজ... সজোরে ধাক্কা... ডুবতে লাগল মোহিনী, ....অসংখ্য তারকা খচিত, পুঞ্জীভূত, অসীম অন্ধকারে। শুধু আবছা ভাবে ভেসে রইল একটা "ওঁ"।
ভালবাসার ফল্গুধারা নিরলস বয়ে যায়....স্হান-কাল-পাত্র-প্রকৃতি নির্বিশেষে। মাটির মাধ্যাকর্ষণ শক্তি শুধু শেকরে টেনেই রাখে না, বাঁচিয়ে ও রাখে।বেঁচে থাকার রসদ মোহিনী কুড়িয়ে নিয়েছে প্রকৃতি থেকে, তার কর্ম থেকে । মাটির গন্ধ টেনে নিয়ে যায় তাকে সুগনিবাসার অরণ্যে... নিস্তব্ধতাই যেখানে মুখর। সহস্র না-দেখতে-পাওয়া-চোখগুলো যেখানে পথের বন্ধু। পদচিহ্ন মুছে যায় ঝরা পাতার সমারোহে; স্নিগ্ধ হয়ে যায় নাংসাই নদীর ছোঁয়ায়। কখনো পাকবিড়ঢ়ার জৈন মন্দিরে চলে যায় সে। মোহিনী শুনতে পায় সমবেত মন্ত্রোচচারণ....অনাহত নাদ যেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক ওঁ কারে রূপায়িত হচ্ছে, ভগ্নপ্রায় ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি।আকস্মিক নিম্নচাপে আবহাওয়া বেশ মনোরম। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সময়ের নিয়মে পটভূমি পাল্টায়। মোহিনী এখন চুলে পাক, চোখে চশমা। তবু কুমারী সেতুর ওপর দিয়ে যেতে গিয়ে, গাড়ি না থামিয়ে পারল না মোহিনী। কংসাবতীর ওপর চৈত্রের অসময় শ্রাবণ.....চোখের আরাম, মনের অবগাহন। পুরিহাসা পেরিয়ে বরাবাজারের হেরবোনা গ্রামে যেতে দেখা হয়ে গেল সেদিন সাহেবের সাথে। অনেক দিনের বন্ধু, বনদপ্তরের রেঞ্জার, সাহেব মিশ্র। পুরুলিয়ায় এমন কোন বনাঞ্চল নেই, যেখানে সাহেবের যাতায়াত নেই। অজানার হাতছানি, অচেনার নিশিডাক যেন এইসব মানুষের নিত্য সঙ্গী। পেশাকে নেশা করে বেঁচে থাকা মোহিনী শিখেছে সাহেবের ই কাছে।
কবে প্রথম দেখা, মনে পড়েনা আজকাল এসব। সেই সময় অখিলেশদা ছিলেন বাঘমুণ্ডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অফিসকর্মী ; সাহেব ছিলেন অযোধ্যা হিলটপ বনদপ্তরে। অখিলেশদা ও তার স্ত্রী মালাদেবী, তাদের যথাসর্বস্ব দিয়ে শবরদের স্কুল চালাতেন। ওনারা মাঠা গ্রামে অনেক সাহায্য করেছিলেন মোহিনীর এনজিও কে। সেই সময় তারা গেছিলেন মাঠা পাহাড়েরচূড়ায় অবস্থিত এক আশ্রমে। বছরে একবার এখানে ভক্তের সমাগম হয়। সারা বছর দু তিন জন সন্ন্যাসী থাকেন। লাইব্রেরিতে সাজানো নানা বই: আয়ুর্বেদিক, মার্কসবাদী, নেতাজীর জীবনী, তিব্বতের তন্ত্র রহস্য প্রমুখ। চোখ আটকে গেছিল একটা মলাটে: বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব:ওঁ কার।
"ধরাধরেংদ্রনংদিনীবিলাসবংধুবংধুর
স্ফুরদ্দিগংতসংততিপ্রমোদমানমানসে
কৃপাকটাক্ষধোরণীনিরুদ্ধদুর্ধরাপদি
ক্বচিদ্দিগংবরে মনো বিনোদমেতু বস্তুনি"
উদাত্ত কন্ঠে ভেসে আসছিল উপাসনা কক্ষ থেকে শিব তাণ্ডব স্তোত্র। মঙ্গলারতি ...ঈশ্বরের। কিন্তু অনেক খুঁজেও মোহিনী পায়নি তার ঈশ্বরকে, সেই ওঁ কারের অধিকারীকে।
বয়স বাড়ে, স্মৃতির বোঝা ও বাড়ে। অনেক বছর পর জঙ্গলমহলের স্মৃতি রোমন্থন শুরু, সাহেব এর সাথে । উঁকিঝুঁকি মারে... শবরদের নিয়ে কাজ করা বান্দোয়ানের গ্রাম... কেতকী , রাজোগ্রামের কার্রু, কুচিয়া...আহড়রা গ্রাম পার হয়ে সিরকাবাদে কলাবনি মোড়ের রামদার চা আর গরম পকোড়া, ...রিমা, মহুয়া, রাজা, জিতের সাথে লাহাডুংরির পলাশ উৎসব। শাল,সেগুন, পলাশ, অর্জুন ঘেরা অযোধ্যা পর্বতমালার আশ্রিত লাহাডুংরি পেরিয়ে অযোধ্যা হিলটপ স্বাস্থ্যকেন্দ্র।সেখানেও হত অনেক যৌথ সভা, বনদপ্তর ও স্বাস্থ্যদপ্তরের সাথে আদিবাসী উন্নয়ন প্রকল্পে। কর্মকাণ্ড অনেক কমে যায়, যখন মাওবাদী আখ্যা পাওয়া অখিলেশদা উধাও হয়ে যান।
আড্ডার রেশ কেটে যায় ফোনের কর্কশ শব্দে। কোন এক জরুরী তলবে সাহেবকে যেতে হবে। বুলেটের স্পিড তুলে নিমেষে মিলিয়ে গেলেন রেঞ্জার সাহেব। মুহূর্তের দৃষ্টি বিভ্রম হয়ত....সাহেরের বেল্টের নীচ থেকে ঝলসে উঠল -.32 বোর...বিদ্যুতের ঝলকানিতে চোখ আটকে গেল রিভলবারে... স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা "ওঁ"।
--------------------
অনন্যা ঘোষাল মুখার্জি