গল্প ।। ব্রাত্য কবির ক্রুদ্ধ কবিতা ।। শংকর ব্রহ্ম
ব্রাত্য কবির ক্রুদ্ধ কবিতা
শংকর ব্রহ্ম
ফ্যাকাশে সাদা মুখ। উঁচু চোয়াল। চিমসানো গাল। হঠাৎ দেখে মনে হয়, যেন তার দু'পাশ দিয়ে, অনেকটা নীচু পর্যন্ত চেঁছে ফেলা হয়েছে। তবু চেহারায় বেশ ধার আছে। মাথাটা বিড়ালের মতো ছোট । চোখ দু'টি ধূসর। চশমার ফাঁক দিয়ে বিষণ্ণ দেখায় সেই চোখ।
ইনি হচ্ছেন সেই কবি, যিনি লিখেছেন,
"ঈশ্বরের আর্তনাদ", " চাঁদের আনবিক জীবাশ্ম",
"কীট-পতঙ্গের দিনলিপি", "চারপেয়ে কাব্য", "কবিতার সঙ্গে সহবাস" ইত্যাদি কাব্যগন্থ।
আর তাছাড়া তার দশ বছর আগের লেখা, "বিশ্বাসের অপমৃত্য" যা সে সময় খুব আলোড়ন তুলেছিলেন।
আমি ভাবলাম কী আপসোসের কথা, এমন একটা গর্তের মধ্যে সেই কবিকে বাস করতে হচ্ছে। আজকের দিনে এমন হওয়ার তো কথা ছিল না। যেখানে দেখা যায় তরুণ স্মার্ট কবিরা সরকারী বেসরকারীর গ্রান্ট পেয়ে, পুরস্কার পেয়ে, সুন্দর সুদৃশ্য বাড়িতে, নরম গদীতে শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন, শৌখিন পোষাক পরে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর এই কবি বাস করছেন কিনা, বাস অযোগ্য এক ইঁদুরের বিবরে।
কবি মরচে পড়া দরজার কড়া নাড়ার শব্দে, নীচু ছাদে মাথা ঠুকে যায় বলে মাথা নীচু করে, পিঠ কুঁজো করে নিয়ে লম্বা পা ফেলে এক চিলতে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর আমায় দেখে বলল, কি চাই?
আমি বললাম, আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি ।
- আমি কাউকে সাক্ষাৎকার দিই না।
- কেন?
- আমার খুশি।
বলেই তিনি জানলা বন্ধ করে দিয়ে, জানলার কাছ থেকে সরে যাচ্ছিলেন।
আমি বললাম, শুনুন স্যার। বেশ সাক্ষাৎকার দিতে হবে না। আমি আপনার অনুরাগী একজন ভক্ত পাঠক হিসাবে, "বিশ্বাসের অপমৃত্য" - নিয়ে কিছু কথা জানতে চাই।
বইটির নাম শুনে, তিনি চোখ তুলে, গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকলেন। তারপর আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করে নিলেন। শেষে নড়বড়ে পলকা কাঠের দরজাটা খুলে দিয়ে বললেন, ভিতরে আসুন।
ঘরে ঢুকতে গিয়ে, আর একটু হলে মাথাটা ঠুকে যাচ্ছিল ছাদের সঙ্গে, সামলে নিলাম।
ঘরে ঢুকে দেখলাম। দশ বাই দশ ফুটের একটা ঘর, চার দেওয়ালে ঠাসা বই। একটা পুরনো খাট। আর লজঝড়ে একটা পুরনো জরাজীর্ণ সোফা।
আগেই দেখেছিলাম, বাইরে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো আছে একটা সাইকেল। জলকাদা ডিঙোবার মর্চে-পড়া যন্ত্র, দু'চাকার বাহনটির কতদিন কোন যত্ন নেওয়া হয়নি।
আমাকে সোফায় বসতে বলে, তিনি খাটে
ধুপ করে বসে পড়লেন। তার এই করুণ অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল । ভাবলাম, একজন কবির পক্ষে এভাবে বাস করা সত্যিই দুঃসহ।
তিনি হঠাৎ চিমসে মুখটা খুলে বললেন,
তাড়াতাড়ি বলুন কি জানতে চান? আমার কাজ আছে অনেক।
চর্মসার ওই পাজর ভেদ করে কথাগুলি বেরিয়ে এলো যে রকম গম্ভীর স্বরে, তা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
আমি বিনীত সুরে বললাম, কিছু মনে করবেন না। আমি শুনেছিলাম আপনার
"বিশ্বাসের অপমৃত্য" - কাব্যগ্রন্থটি 'বাঙলা সাহিত্য সংসদ' কতৃক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তারপর কি এক অজ্ঞাত কারণে সেটি
সঞ্জীবন হাজরাকে দেওয়া হয়।
শুনে তিনি হো হো করে এমন হেসে উঠলেন যেন সারা ঘরটা কেঁপে উঠলো।
তারপর হাসি থামিয়ে বললেন। সে এক মজার ব্যাপার। শুনুন তবে -
আমি খবরের কাগজ থেকে খবরটা জানতে পারি প্রথম (তারা আগে থেকে আমাকে কিছু জানায়নি)। তাতে আমার মনে ক্ষোভ জমে ছিল।
তার দু'দিন পরে একজন কর্মকর্তা এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে । এখানে তো তাকে বসানো যায় না। তাই তাকে নিয়ে পাড়া ছাড়িয়ে একটু দূরের, পাঁচমাথার মোড়ের নামী চায়ের দোকানটাতে গিয়ে বসলাম। দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে তাকে বললাম, বলুন, কি বলতে চান?
তিনি কোন রাখঢাক না রেখেই বললেন, আমরা আপনাকে পুরস্কার দিতে চাই , এক শর্তে।
- কি রকম? জানতে চাই আমি।
- দেখুন আপনি পুরস্কার মূল্য যে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবেন, তার থেকে কুড়ি হাজার টাকা আমাদের সংস্থার উন্নতিকল্পে দান করতে হবে। তবেই আপনাকে পুরস্কারটি আমরা দিতে পারব।
শুনে আমার পিত্তি জ্বলে উঠল।
আমি তাকে বললাম, আপনারা পুরস্কারটি আপনাদের কোন পেটোয়া নপুংসক কবিকে ধরে নিয়ে গিয়ে দিন, যে আপনাদের এমন ঘৃণ্য শর্তে রাজী থাকবে। এ ধরণের পুরস্কার গ্রহণ করতে আমি ঘৃণা বোধ করি। বলে লোকটিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলাম।
পরে শুনেছি, সঞ্জীবন হাজরা পঁচিশ হাজার টাকা
দিয়েছিল ওদের ওই সংস্থাকে , হা হা হা....
যেন এটাও একটা হাসির ব্যাপার।
আমি তাকে বললাম, তারপরও তো আপনার আরও পাঁচটা বই বেরিয়েছে
- তো?
- সেগুলি সরাকারী পুরস্কার কমিটিতে পাঠাননি?
- আমার কি দায় পড়েছে? দরকার হলে তারা খুঁজে নেবে।
আপনি পুরস্কার পেতে চান না?
- কবিকে পুরস্কার দেবেন কারা? এই রকম সব ভন্ড কুলাঙ্গার ঘৃণ্য ধান্দাবাজেরা? সে পুরস্কারের কী মূল্য আছে? হয় তো কিছু টাকা পাওয়া যাবে, তাতে কি? আমি তো টাকার জন্য লিখি না। কবিতাকে আমি পণ্য ভাবি না।
এরপর আমি তাকে কি প্রশ্ন করব? ভেবে বিভ্রান্ত বোধ করি।
তিনিই আবার বলতে শুরু করেন, এই বেশ আছি। নিজের খেয়াল খুশি মতোন লিখি। কারও কোন ধার ধারি না। অভাব থাকলেও আমি ভিখিরি কবির মতো কারও কাছে হাত পাততে যাই না। স্বাধীনসত্তা নিয়ে বেঁচে আছি, পরম আনন্দে।
- তবে আপনার চলে কি করে? আপনার বই তো বিক্রি হয় না শুনেছি। আপনি কোন দলের নন, কোন পত্রিকার সম্পাদক আপনাকে লোক-চক্ষুর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন না, আপনার বইয়ের প্রকাশক আপনার বইয়ের বিজ্ঞাপনে দিতে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেন না , যারা পুরস্কার দিয়ে থাকেন, আপনার প্রথম বইয়ের কথা বাদ দিলে, তারা আপনার নাম পর্যন্ত জানেন না।
- তো? আমি তেত্রিশ হাজার দেব-দেবী পাঠক নিয়ে বাঁচতে চাই না। আমার তেত্রিশজন বোদ্ধা পাঠক থাকলেই যথেষ্ট।
এরপর আর কি প্রশ্ন করা যায় ভেবে, আমি বিমূঢ় বোধ করি।
তিনি আবার বলতে শুরু করেন, লেখেন তো অনেকে, সত্যিকারের কবি ক'জন বলুন তো?
রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দ দাশ ছাড়া
আর ক'জন খাঁটি কবি পেয়েছি আমরা বলতে পারেন?
জীবদ্দশায় তাঁর ক-খানা বই বেরিয়েছে? ক'টা
পুরুস্কার পেয়েছেন তিনি? দারিদ্রে কেটেছে তার সারা জীবন, তবু তিনি মুচলেখা দিয়ে লেখেননি কোথাও। আপন মনে কবিতা লিখে গেছেন কোন প্রত্যাশা ছাড়াই প্রাণের তাগিদে। কবিতা ছিল তার কাছে প্রাণ-বায়ুর জন্য সংগ্রাম।
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে মাত্র কুড়িটা টাকা ধার চেয়েছিলেন একবার, পূর্বাশায় লেখা দিয়ে শোধ করে দেবেন বলেছিলেন। কী অসহায় করুণ অবস্থায় কেটেছে তাঁর। আমি তো তার চেয়ে অনেক ভাল আছি, দু'তিনটে ছাত্র পড়াই সাইকেলে চড়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে, তাতে যা পাই, তা দিয়েই আমার চলে যায়।
সজনীকান্ত দাস তো জীবনানন্দকে শনিবারের পাতায় ধুয়ে দিতেন। হা হা হা। তা'তে জীবনানন্দের ছেঁড়া গেছে।
এবার আমি কিছুটা সংকোচ নিয়ে তাকে বললাম, সমালোচকরা বলেন, আপনার কবিতা নাকি অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট।
দু'পায় ভর দিয়ে আচমকা তিনি উঠে দাঁড়ালেন। পুরো কাচ ভেদ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন এমন ভাবে যেন কোন প্রাণীতত্ববিদ চেয়ে আছেন মাইক্রোস্কোপে। তার চশমা পরা বিড়ালের মতো মাথাটা এগিয়ে এলো।
'বেরিয়ে যান' - গর্জন করে উঠলেন তিনি, তার মুখ কুঁচকে গেল, পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠল চোখদু'টি। তারপর অনেকটা জল নির্গত হওয়া নলের মতো তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো -
-'সমালোচক'? নিজেদের কিছু করার মুরোদ নেই যাদের। নপুংসক। খাসি কোথাকার। তারা যখন সকালের খাবার খেতে বসে তখন নিয়ে নেয় একটা কবিতা, সেটা দুধ মেশানো চায়ে ডোবাতে থাকে, যতক্ষণ না সেটা তাদের দাঁতহীন মাড়ির পক্ষে যথেষ্ট নরম হয়ে ওঠে। এবং যে মানুষটি শতবর্ষ আগে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের জন্য ক্রীতদাসের মতো খেটে গেল, যখন তার অস্থি-মজ্জা অনেক আগেই হজম করে ফেলেছে মাটি, তখন তার হাড় খুঁজে বের করে এরা চ্যাচাতে থাকে, ইউরেকা ইউরেকা। হাড়ের ভিতর তিনটে ঘুণপোকা পাওয়া গেছে।
তিনি আবার বলতে শুরু করেন, যারা জীবনকে
কৃত্রিম ভাবে যাপন করে, তারাই আসলে অশ্লীল।
যৌনতা জীবনের অঙ্গ। যৌনতা বাদ দিয়ে জীবন চলে না। কবিতাও চলে না। প্রেম বরং কৃত্রিম, আমাদের নিজেদের সৃষ্টি। প্রাণের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক খুব বেশী নেই। ওটা জীবনে না হলেও চলে, অন্যান্য প্রাণীদের জীবন যাপন লক্ষ্য করলেই সেটা আপনি বুঝতে পারবেন। প্রেম থেকে তাদের বংশ বিস্তার হয় না।
- শিল্প সাহিত্যে যৌনতা কি অপরিহার্য?
- জীবনে যদি অপরিহার্য হয়, তবে শিল্প সাহিত্যে তা ব্রাত্য থাকবে কেন?
জানেন 'ক্যাম্পে' কবিতাটা লেখার পর, অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে, জীবনানন্দকে কলেজের চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়।
যত সব গাড়লের দল। ও রকম একটা কবিতা
কোন দিনও লিখতে পারবে তারা?
জীবনানন্দর কবিতার ভাব ভাষার আধুনিকতা রবীন্দ্রনাথও ঠিক মতো বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয় না আমার। তাঁর কবিতাকে 'চিত্রকাব্য' - আখ্যা দিয়েই তিনি দায় মুক্ত হয়েছেন।
'ছাতকুড়ার মতো রোদ লেগে আছে ডুমুর পাতায়'
কিংবা-
' করুণ শঙ্খের মতো স্তন তার'
এমন নিবিড় অনুধাবন জীবনানন্দ ছাড়া আর কারও মধ্যে পাবেন বলুন?
চিলির কবি নিকানো পারার নাম শুনেছেন তো?
- নামটা শুনেছি।
- তার কোন কবিতা পড়েছেন?
- না, এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি।
- পাবলো নেরুদার পর নিকানোর পাররা স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী কবি। তবে তার একটি কবিতা শুনুন, স্প্যানিশ ভাষা তো বুঝবেন না। বাংলায় অনুবাদ শুনুন
কবিতাটির নাম, সতর্ক-বার্তা।
শুনুন তবে -
" প্রার্থনা করা যাবে না
নাক ডাকা যাবে না
থুতু ফেলা যাবে না
প্রশংসা করা যাবে না
হাঁটু গেড়ে বসা যাবে না
উপাসনা না
চিৎকার না
কাশি না
এই চৌহদ্দিতে ঘুমনো নিষেধ
রোগের চিকিৎসা না
কথা বলা না
যোগাযোগ না
স্বরসঙ্গতি না
পালানো যাবে না
ধরা যাবে না কিছু
দৌড়ানো একেবারেই নিষিদ্ধ
সিগারেট টানা যাবে না
যৌনসঙ্গম একদম না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মুক্তি যেখানে মূর্তি হয়ে থাকে। "
(পিনোশের শাসন কালের বিভীষিকা ফুটে উঠেছে এখানে।)
- এটাকে তো কি আপনি অশ্লীল কবিতা বলবেন?
- এভাবে, এই ভাষায় , আমাদের বাংলা কবিতা লেখা হয় না।
- কবিতার আবার বাংলা স্প্যানিশ কি? পোযেট্রি ইজ পোয়েট্রি।
আমি তার কথার কোন উত্তর দিতে পারি না।
তার মুখের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।
তিনি আবার বলতে শুরু করেন -
তবে তাঁর আর একটি কবিতা শুনুন। এরকম কবিতা কি বাংলায় লেখা হচ্ছে?
কবিতাটির নাম - ম্যানিফেষ্টো
" মহোদয়া ও মহাশয়গণ
এটা আমাদের শেষ কথা
আমাদের প্রথম ও শেষকথা
কবিরা অলিমপাস থেকে নেমে এসেছেন
আমাদের বুড়োবুড়িদের জন্য
কবিতা ছিল বিলাসের জিনিস
কিন্তু আমাদের জন্য
এটার একটা বুনিয়াদ প্রয়োজন
আমরা কবিতা ছাড়া বাঁচতে পারি না
আমারা বুড়োবুড়ির থেকে আলাদা
আর আমি বেশ শ্রদ্ধা সহকারেই বলছি
আমরা মনে করি
একজন কবি রাসায়নিক নন
একজন কবি অন্য যে কোনো মানুষের মতন
একজন রাজমিস্ত্রি যে দেয়াল গাঁথে
যে দরোজা আর জানালা তৈরি করে
আমরা কথা বলি
প্রতিদিনের ভাষায়
আমরা গুপ্ত চিহ্ন বিশ্বাস করি না
তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার
একজন কবি বেঁচে থাকেন তার কবিতায়
আমরা সৃষ্টিকর্তা কবিকে
আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করি
সস্তা কবি
গ্রন্থাগারের ইঁদুর কবি
এই সব বাবুদের আমরা বর্জন করি
আর আমি তা শ্রদ্ধা সহকারেই বলছি
তাদের অভিযুক্ত ও বিচার করা দরকার
আমাদের জন্য নয়
হাওয়ায় দুর্গ খাড়া করার জন্য
জায়গা আর সময় নষ্ট করার জন্য
যাহোক-তাহোক শব্দ জড়ো করার জন্য
প্যারিসের সাম্প্রতিক ফ্যাশান অনুযায়ী
ভাবনাচিন্তা মুখের ভেতরে জন্মায় না
তা হৃদয়ের হৃদয়ে জন্মায়
আমরা অগ্রাহ্য করি
রোদচশমা কবিতা
তরোয়াল আর ফতুয়া কবিতা
বড়ো ডানা কবিতার ছায়াকে
পরিবর্তে আমরা পছন্দ করি
খোলা চোখের জন্য কবিতা
ঢাকা না-দেয়া বুকের কবিতা
নগ্ন মাথার কবিতা
আমরা মায়াপরী আর শুশুক-দেবতায় বিশ্বাস করি না
কবিতাকে এরকম হতে হবে
ঝর্ণায় ঘেরা এক যুবতী
কিংবা কোনো কিছুই হবে না
সুতরাং এখন রাজনীতির এলাকায়
ওনারা আমাদের দাদুদিদারা
আমদের ভালো দাদুদিদারা !
প্রতিসরিত হওয়া আর ছড়িয়ে-পড়া
যখন তাঁরা কাচের স্ফটিকের ভেতর দিয়ে গেলেন
তাঁদের কয়েকজন সাম্যবাদী হয়ে গেলেন
আমি জানি না তাঁরা সত্যই তা ছিলেন কিনা?
ভেবে নেয়া যাক তাঁরা সাম্যবাদী ছিলেন
আমি একটা ব্যাপার জানি
তারা ঘাসভূমির কবি ছিলেন না
তারা ছিলেন শ্রদ্ধেয় বুর্জোয়া কবি
তারা কেমন ছিলেন তা বলা জরুরি
সময়ে সময়ে
তারা জানতেন কেমন করে জনগণের হৃদয়ে প্রবেশ করতে হয়
প্রতিবার তারা যদি তা পারতেন !
তারা শব্দ আর কাজের মাধ্যমে নিজেদের ঘোষণা করতেন
পথনির্দেশিত কবিতার বিরুদ্ধে
বর্তমানকালের কবিতার বিরুদ্ধে
শ্রমিকশ্রেনীর কবিতার বিরুদ্ধে
মেনে নেয়া যাক তারা সাম্যবাদী ছিলেন
কিন্তু কবিতা হয়ে উঠেছিল দুর্বিপাক
সেকেণ্ডহ্যাণ্ড পরাবাস্তববাদ
থার্ডহ্যাণ্ড ডেকাডেন্টিজম
সমুদ্রের ফেরত-পাঠানো পুরোনো কাঠের পাটাতনের মতোন
বিশেষণ কবিতা
নাকিসুর আর কুলকুচির কবিতা
স্বেচ্ছাচারী কবিতা
বই থেকে জড়ো করা কবিতা
বিপ্লব শব্দের ওপর নির্ভর করা কবিতা
পরিস্হিতি অনুযায়ী তা হওয়া উচিত ছিল
বিপ্লবের ধারণায় নির্ভর কবিতার বজ্জাত গোষ্ঠীচক্র
আধডজন নির্বাচিতদের "আত্মপ্রকাশের চরম স্বাধীনতা"
এখন আমরা নিজেরাই জেরা করে জানতে চাই
এসব তারা কিসের জন্য লিখেছিলেন,
পাতিবুর্জোয়াদের ভয় দেখাবার জন্য?
যত সব ফালতু সময় নষ্ট !
পাতিবুর্জোয়ারা প্রতিক্রিয়া জানায় না
যদি না তা সেটা তাদের পেটের ব্যাপার হয়
তারা কবিতার ফলে আঁৎকে উঠবে !
এটাই অবস্থা দাঁড়িয়েছে
তারা যখন সমর্থন করেছিল
এক গোধূলীর কবিতা
এক রাতের কবিতা
আমরা সমর্থন করেছিলুম
এক ভোরের কবিতা ।
এটাই আমাদের বার্তা
কবিতার ঔজ্বল্য
সকলের কাছে পৌঁছোনো দরকার সমানভাবে
কবিতা সকলের জন্য
আর কিছু নয় সহকর্মীবৃন্দ
আমরা অগ্রাহ্য করি
আর আমি তা শ্রদ্ধা সহকারে বলছি
ছোটো-দেবতা কবিতা
পবিত্র গরু কবিতা
ক্ষ্যাপা ষাঁড় কবিতা
আমরা বিরোধিতা করি
মেঘের কবিতা
শক্তমাটি কবিতা
ঠাণ্ডা মাথা উষ্ণ হৃদয়
আমরা নিশ্চিতভাবে শক্তমাটির
কফি কবিতার বিরুদ্ধে চাই প্রকৃতির কবিতা
বৈঠকখানা কবিতার বিরুদ্ধে চাই রাস্তার মোড়ের কবিতা
সামাজিক প্রতিবাদের কবিতা
কবিরা অলিম্পাস থেকে নেমে এসেছেন ।
সেইরকমই কিছু
পাররা হাসেন যেন তাঁকে নরকে নির্বাসিত করা হয়েছে
কিন্তু কবেই বা কবিরা হাসেননি?
তিনি অন্তত ঘোষণা করছেন যে তিনি হাসছেন
তারা যেতে দেয় বছরগুলোকে
যেতে দেয় বছরগুলো কারণ
অন্তত মনে হবে তারা যাচ্ছে
আমি প্রকল্পের ভান করি না
সবকিছু চলে যায় যেমন চলে যাচ্ছে
এখন উনি কাঁদতে আরম্ভ করেন
ভুলে যান যে উনি একজন অ্যান্টি-পোয়েট।"
তার ভরাট গলায় কবিতাটি যেন এই ছোট-কুঠরিতে গমগম করে বাজছিল। আমি মোহিত হয়ে শুনছিলাম।
এরপর আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আপনার একটা কবিতা শোনাবেন?
- আমার কবিতা শুনবে?(তার গলার স্বর শুনে মনে হল, তিনি খুশি হয়েছেন) শুনুন তবে -
কবিতার নাম, মেরা দেশ মহান হায়!
" এই সেই মহান দেশ ভারতবর্ষ
যেখানে গরীবরা আরও গরীব হয়
ধনীরা টাকার কালো পাহাড়ে চড়ে বসে
এখানে কত লোক যে অনাহারে মরে
কেউ তার হিসাব রাখে না।
এই সেই মহান ভারতবর্ষ
যেখানে মেকি বিপ্লবী আর বুর্জোয়ারা
একপাতে খায়
বিপ্লবের নামাবলী গায়
ভাইয়ের রক্তে বহুবার
হোলিখেলা হয়েছে এখানে
বুর্জোয়ারা চোখে ধূলো দিয়ে
প্রয়োজনে সতর্ক বিপ্লবী বুলি কপচায়
আসলে হারাণ মাষ্টারের পোলারাই শুধু
এখানে প্রতিবিপ্লবী
আর সকলেই আদর্শবান সৎ।
এই সেই মহান ভারতবর্ষ
যেখানে রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি হয়ে যায়
নৈতিক পতনে বহুলোক,
নেতা থেকে দালাল ও বেশ্যারা
অর্থ লোভে এই দেশ
অনায়াসে বেচে দিতে পারে,
এখানকার লোক এতই মূর্খ ও নির্বোধ যে
ক্রোধেও সে নির্বাক প্রতিবাদহীন
প্রতিভাবানেরা এখানে অনাহারে মরে
ভাল লোকেরা নানা ভাবে অপদস্ত হয়
নির্ঝঞ্ঝাট মানুষের উপর
যত সব ঝঞ্ঝাট তুলে দেয় পড়শীরা
নামাবলী গায়ে এখানকার সমস্ত সাধুরা
আসলে বিখ্যাত চোর।
এই সেই মহান ভারতবর্ষ
যেখানে নির্বিচারে ওষুধ ও বেবীফুডে
ভেজাল মেশানো হয়
অন্ধদের উপর লাঠি চলে নির্বিচারে
এখানে নিয়মিত নারী ধর্ষণ হয়
বধূ হত্যা হয় প্রায়ই
অসহায় বন্দীদের গেলে দেওয়া হয় চোখ
কেটে নেওয়া হয় জিভ
তবু বড় বড় ভাষণ
আর আশার বাণী শুনিয়ে
এখানে অনায়াসে ভোটে জেতা যায়।
এই সেই মহান ভারতবর্ষ
যেখানে স্বজন পোষণ নীতি চলে সর্বত্র
ঘুষ দেওয়া নেওয়া
এখানে রীতিমত অপরিহার্য
ন্যায় নীতির আশা করা
ভীষণ রকমের অন্যায়।
এই সেই মহান ভারতবর্ষ
যার মাথায় হাত বুলিয়ে
অনেকেই করে খাচ্ছে কিছু
এই সব দেখে শুনে বুঝে
আমাদের মতো সব মূর্খ নাগরিক
ঠাপে ঠাপ মেরে যাচ্ছি শুধু।
এবার ইংরেজী ভারশনটা শুনুন একবার
This is that great country named India
Where the poor are poorer
The rich stay on the black hill of money
How many people here die of starvation?
No one keeps track of that.
This is the great India
Where fake revolutionaries and bourgeoisie
Eats in one way
Sing the names of the revolution
Many times in my brother's blood
Destruction has been played here
The bourgeoisie with dust in our eyes
If necessary, caution is used in revolutionary words
In fact, only son's of Haran Master
Here is the counter-revolutionary
And other everyone is ideally honest.
This is the great India
Where Nobel Prize of Rabindranath Tagore is stolen
Many in moral decay,
From leaders to brokers and prostitutes
This country is greedy for money
Can sell effortlessly,
The people here are so stupid and ignorant
Even in anger he is speechless without protest
Talented people die of starvation here
Gentlemen are humiliated in many ways
On the carefree people
Neighbors give up all the trouble
All the saints here wear names
In fact they are famous thives.
This is the great India
Where indiscriminate drugs and baby food
The adulterants are mixed
The stick goes blind on the blind
Regular women are raped here
Brides are often killed
Eyes are given to helpless prisoners
The tongue is cut off
Yet the big speeches
And by hearing the message of hope
Here, the vote can be won effortlessly.
This is the great India
Where the principle of kinship goes everywhice.
Bribery
Is essential here as usal
To expect justice
Terrible injustice.
This is the great India
Turning his hand on his head
Many people are eating something
Seeing and hearing all this
All stupid citizens like us
We are just going to beat step by step.
কবিতাটা পড়া শেষ করে, হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, এবার কেটে পড়ুন দেখি। অনেক সময় নষ্ট হলো আমার।
আমি তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে আসব ভেবে মাথা নীচু করতেই, তিনি দু'পা সরে গিয়ে মৃদু হেসে বললেন, এসবে আমি ঠিক অভ্যস্ত নই। পারলে আমার কবিতা পড়বেন।
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
Kolkata - 700 084.