ধারাবাহিক উপন্যাস ।। সামান্য মেয়ে (পর্ব - সপ্তম ) ।। রনেশ রায়
৭
পরস্ত্রী
নীলুর পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখনও সে বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পড়াশুনা আর অন্য কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাড়িতে বুড়িকে নিয়ে বিশেষ করে বাবার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। সম্পর্কটা জানাজানি হবার পর বাবা রীতিমত খড়গ হস্ত। এর জন্য দাদুকে যথেষ্ট অপমানিত হতে হয়েছে। সেটা নীলু মেনে নিতে পারে নি। মা-ও ব্যাপারটা যে মেনে নিয়েছেন তা নয়। তবে তিনি নীলুকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে এ ধরণের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা শক্ত। এই সমাজে মায়ের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক বলে মনে হলেও বাবার সঙ্গে তার বিরোধ কারণ বুড়ির পরিবার গরিব বলে তাঁরা বাবার কাছে মানুষই নন। তাছাড়া আনুষ্ঠানিক বিচারে অশিক্ষিত।
পরিবারের সাথে বিরোধ নীলুকে পরিবার থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সে বন্ধুবান্ধব নিয়ে সময় কাটায়। অনেক সময় বাড়ি ফেরে না, বাড়িতে থাকলে পড়াশুনা নিয়ে থাকে। আর সে একটা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যারা দেহ ব্যবসায়ী মেয়েদের অধিকার সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে লড়াই করে, তাদের মুক্তির কথা ভাবে। সেই সূত্র ধরে নিষিদ্ধ পল্লীতে তাদের যাতায়াত। তার এম এ তে অধ্যয়নের বিশেষ বিষয় এইসব মেয়েদের শিল্প সাহিত্য প্রতিভা। এই নিয়ে সে লেখালেখি করে। এদের বাস্তব জীবন যেন ওকে জীবনটাকে দেখার ব্যাপারে নতুন একটা চোখ দিয়েছে। সে আমাদের স্বীকৃত সমাজের সঙ্গে এই সমাজটার পার্থক্য বোঝে। একটু গভীরে ঢুকে বুঝতে চেষ্টা করলে চমকে ওঠে। আমাদের সমাজটা স্বীকৃত কিন্তু এই সমাজটা ব্রাত্য যদিও আমাদের সমাজের শিক্ষিত অশিক্ষিত গরিব বড়লোক সব স্তরের মানুষের জৈবিক চাহিদা মেটাবার জন্যই অর্থের মাধ্যমে লেনদেনে গড়ে উঠেছে এই বাজার। এটাও পণ্যের বাজার। মেয়েরা এই বাজারে মাছ মাংস শাক সবজির মত পণ্য। ফল ফুল সবজি এমন কি বিশেষ ক্ষেত্রে মাছ মাংস দেবতার প্রাঙ্গনে উৎসর্গের দ্রব্য হলেও তা বাজার থেকে এনে ঘরে তুললেও একটা জ্যান্ত মানুষ একই সেবা করেও অর্থাৎ মানুষের চাহিদা মেটালেও এই সমাজে অস্পৃশ্য ব্রাত্য হয়ে যায়। মূল সমাজে তার জায়গা হয় না। সভ্য জগতে এ এক অদ্ভুত স্ববিরোধিতা। এই দেহব্যবসায়ী মেয়েদের সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েরাও ব্রাত্য।
অনেকদিন পরে নীলু সুন্দরবনের সে গ্রামে। দিদিমা বেশ কিছুদিন মারা গেছেন। তখন পরীক্ষা থাকায় আসতে পারে নি। তাছাড়া বুড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা নেই। সে এখন পরস্ত্রী। ও জেনেছে যে ওর বিয়ে হয়ে গেছে সেই নিধিরামের ছেলের সঙ্গে। বলতে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবাকে বাঁচাতে। দু বছর আগে যে ভয়ঙ্কর ঝড় তুফান তাতে ওদের ঘর ভেঙে যায়। বাবাকে নিধিরাম টাকা দেয় ঘর করে নিতে। সে টাকা শোধ দিতে পারে না বাবা। তারপর চাপে পড়ে বাধ্য হয় মেয়েকে ও বাড়িতে সমর্পণ করতে। নীলুর খুব ইচ্ছে জানতে ও কেমন আছে। কিন্তু কি করে জানবে। এদিকে দাদুর শরীর ভালো না। তার দুই ছেলে এখন আলাদা থাকে। দাদু বড় ছেলের সঙ্গে ওর স্ত্রী আর তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে। এখানে নীলুর আর আগের মত টান নেই। তাও দাদুর স্নেহ ধন্য সে। দাদুর কাছে বুড়ি আর বুড়ির পরিবারের খবর পায়। বুড়ি শ্বশুর বাড়িতে ভালো নেই। পরিবারের সব কাজ। তার ওপর জামাইয়ের উশৃঙ্খল জীবন। বুড়িকে মদ্য অবস্থায় কুৎসিত গালাগালি আর মারধর করে। এই নিয়ে গ্রামের মানুষজন বিরক্ত। ওকে সাবধান করলেও কিছু আসে যায় না ওদের। শুনে নীলুর মন খারাপ। নিজেকে দায়ী করে। ও যদি ওর ব্যাপারে যত্নশীল হতো ওর নিজের সিদ্ধান্তে কঠিন থাকত তবে মেয়েটার এই পরিণতি হোত না। ওর ইচ্ছে করে ওকে একবার দেখার।
বিকেল না হতেই নীলু সেই পুকুর পাড়ে। অতীত স্মৃতি তাকে তাড়া করে। এখানেই বুড়ির সাথে আলাপ। সেই ঝড় তুফান। বৃষ্টিস্নাতা বুড়ি যেন সামনে দাঁড়িয়ে। সেই দুর্যোগে ওই ওর পরিত্রাতা হয়ে উঠেছিল । বুড়ির জন্য জলে ভেসে যায় নি। মনে পড়ে এই সবুজ বনানী। নিটোল পুকুর, যে পুকুরের জলের ছায়ায় সে আবিষ্কার করেছিল বুড়ির শরীরের সৌন্দর্যরাশি। তা আজ কেমন ধূসর। এই শীতের বিকেলে সূর্যের রেশমিতে পাতা ঝরে গেছে। গাছের মাথা ন্যাড়া । প্রকৃতি কেমন বিষণ্ণ। তার প্রকৃতি প্রেম যেন আজ বিরহ বেদনায় আক্রান্ত। অন্যমনস্ক নীলুর হঠাৎ চোখে পড়ে কে এক মহিলা কাপড় কাঁচছে। মনে পড়ে এই সময় বুড়ি কাপড় কাঁচত বাসন মাঝতো তারপর শরীরটাকে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিত কোন যেন পরিচিত এক ভঙ্গিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীলুর মন বলে এই তো সেই বুড়ি। কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে। সেই টান টান শরীর ভেঙে পড়েছে। মাত্র কিছুদিনের মধ্যে এ কি চেহারা হয়েছে! দাদু বলেছেন বুড়ি ভালো নেই। এই ভালো না থাকার প্রত্যক্ষ নিদর্শন। ওদিকে বুড়িও নীলুকে লক্ষ্য করেছে। না চেনার কিছু নেই কারণ নীলু একই রকম আছে। দুবছরটা কোন সময় নয়। এরপর কোন ভনিতা না করে বুড়িই এগিয়ে আসে। জানতে চায় ওর খবর কি। দুজন পাশাপাশি আগের মত। বুড়ি জানায় ওর অবস্থা। ও বাধ্য হয়েছিল বিয়ে করতে। তারপর সেই অত্যাচার। কিছুদিন হল তার বাবা মারা গেছে। সে সন্তান প্রসবের জন্য বাপের বাড়িতে আসে। শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছে আর ফেরার ইচ্ছে নেই। ছোট তিন ভাইবোন আর মা। মা বাবুদের বাড়িতে কাজ করে। শ্বশুরবাড়ি জোর করছে ফেরার জন্য। তারা বিনে পয়সায় পাওয়া এরকম এক বান্দিকে হারাতে রাজি না যে সংসারের কাজ করে আবার অপদার্থ একটা মানুষের কামনা চরিতার্থ করে। তার বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। রোজগার বাড়াতে কি করবে ভেবে পায় না। এক এক সময় ভাবে মায়ের কাছে সন্তানকে রেখে নিজে শহরে গিয়ে একটা কাজ বেছে নেবে। বুড়ি জানতে চায় নীলু কি করছে। নীলু জানায় ওর পড়াশুনা শেষ হয়ে গেছে। একটা চাকরি খুঁজছে। ভেঙে সবটা বলে না। নিজের সংগঠনের কাজ বা বাড়ির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়।
বুড়ির সঙ্গে নীলু বসে আলাপচারিতায়। কতদিন পর তারা মুখোমুখি। যতই হোক বুড়ি এখন বিবাহিতা পরস্ত্রী। তাই সম্পর্কের এই দূরত্ব ঘনিয়ে উঠেছে পরস্পরের আচরণে। যেন না দেখা হওয়ার ছায়ায় দুজন বসে। কত পরিচিত তাও অজানা সংশয়, অপরিচিতির আঁধার ঢেকে রাখে দুজনকে। নীলু ইতিমধ্যে জেনেছে বুড়ির শ্বশুর বাড়িতে বিড়ম্বনার কথা। সে শ্বশুর আর শ্বশুরবাড়ির পরিচয় আগেই জানত। চায় নি যে সেখানে বুড়ির বিয়ে হোক। কিন্তু গরিবের নিয়তি এসে ভর করেছিল বুড়ির উপর। সে না চাইলেও এই পরিণতি যেন তার জন্মসূত্রে লেখা হয়ে যায়। বুড়ির নিজেকেই বিয়েতে মত দিতে হয়। নীলুর জন্য অপেক্ষা করতে পারে নি। তাই নীলুকে দোষ দেওয়া যায় না। আবার অবস্থার পাপচক্রে বুড়িকে যা করতে হয়েছে সেটা সংসার দেবতার জন্য তার আত্মবলিদান। বুড়িরা ভাবে হয়তো পরজন্ম তাদের এই বলিদানের মূল্য কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেবে। বুড়ির এই অসহায় অবস্থার জন্য নীলু ব্যথিত। তার মনে হয় তার এ ব্যাপারে আরও যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল। বুড়িকে আরও মনের জোর জুগিয়ে অবস্থার মোকাবিলায় সাহায্য করা উচিত ছিল।আজ যেন নীলুর নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। ওর সঙ্গে যদি দেখা না হত, ওরা প্রেমের গাঁট ছড়া না বাঁধতো দুজনে বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ না হত তবে হয়তো বুড়ি তাদের সমগোত্রীয় কোন ভালো ছেলের পানিগ্রাহী হতে পারত যে বুড়িকে অবলীলায় গ্রহণ করত। দুঃসাহস দেখিয়ে বুড়িকে সঙ্গী করে নিয়ে যেতে পারত। অসম সম্পর্কের জালে বন্দী থাকত না যেমন স্বীকার করুক বা না করুক নীলু ছিল। দাদু দিদার সঙ্গে তার বাত বিতন্ডার কথা মনে পড়ে। বুড়ির মধ্যে যে সংশয় ছিল সেটা সম্পর্কে বুড়ি বলেছে। তার মনে পড়ে সেই ঝড়ের সন্ধ্যে। বুড়ি কেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল? তার না হয় বিপদ হত কিন্তু এই প্রেমের অপমৃত্যু তো হত না। আবার সে ভাবে প্রেম তো নৈসর্গিক। সে সাগরের ঢেউ নিজের খেয়ালে বয়ে চলে চিরন্তন। তাই সংসার পাতা হলো না বলে তা মিথ্যা হয়ে যায় না। বুড়ির মনে পড়ে প্রথম আলাপের সে সন্ধ্যে। ওদের সম্পর্কের টান পোড়েনে সেটাই শাশ্বত চির সত্য। বাকিটা জীবনের কথার কথা। কিছুটা গুটিয়ে থাকা সংকোচে আপ্লুত নীলু নিজেকে সংযত রেখে বুড়িকে প্রশ্ন করে :
------কেমন আছো ?
বুড়ি যেন এমন প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল। আপাত নিরীহ এই প্রশ্ন যে তার যন্ত্রনা বাড়ায় তা আর বাইরে থেকে কে বুঝবে? সে খুব শান্তভাবে উত্তর দেয়:
----- ভালোই
নীলুর পরে প্রশ্ন:
------ এখানে কতদিন থাকবে?
বুড়ি যেন হঠাৎ জ্বলে ওঠে । বুকের আগুন যেন কথার পাথরটা ঘষে জ্বালিয়ে দেয়:
------ কেন? এখানে যেখানে ভালোই আছি সেখানে যাব কেন? এটাই তো আমার বাড়ি।
------ আর তোমার শ্বশুর বাড়ি?
------ শ্বশুর বাড়ি কোথায়? ওটা তো হারামের বাড়ি।
নরম স্বভাব বুড়ির মুখে এরকম কর্কশ কথা নীলু আশা করে নি। আর হারামের বাড়ি এসব কি অকথ্য ভাষা ! নীলু বোঝে না যে বুড়ির বিবাহোত্তর অভিজ্ঞতা ওকে এসব শিখিয়েছে। স্বামী ওকে কথায় কথায় হারামির বাচ্চা আরও কত মধুর সম্বোধনে সম্বধিত করে তা তো নীলু সবটা জানে না। স্কুলের ক্লাসে বুড়ির পড়া মুখস্ত হত না কিন্তু শ্বশুরবাড়ির স্কুলের সব পাঠ ওর মুখস্ত। নিধিবাবুদের মত ভদ্র বাড়ির সব বউরা সবাই এইভাবে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। তারপর পুকুরঘাটে বা কলতলার বিবাদে এগুলো ব্যবহৃত হয়। এগুলো তাদের সুখ দুঃখের বারোমাস্যার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় । কিন্তু নীলুর কানে এটা তার রুচির সঙ্গে সংগত করে না। কেমন যেন বেসুরো লাগে। নীলু অস্বস্তি বোধ করে। বুড়ি নিজেও লজ্জিত হয়। নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা চালে এবার বলে:
------ তোমার খবর কি? এখন কি করছ? বাড়িতে কে কেমন আছ?
বুড়ি কিছুটা জানে। তাও আরও জানতে চায়। নীলু বাড়িতে থাকে না, তেমন কাজকর্ম করে না সেটা সোমার কাছে শুনেছে । সোমার সঙ্গে ওর দেখা হয় কখনও বা। সৌম্যের সঙ্গে সোমার বিয়ে হয়ে গেছে। ও মধ্যে মধ্যে বাপের বাড়ি আসে। সোমার সঙ্গে বুড়ির সখ্যতা বজায় আছে।
নীলু বিশেষ কিছু বলতে চায় না। তাও সে বলে:
------- কেন সোমার কাছে শোন নি? আমি তো জানি সোমার সংগে তোমার সম্পর্ক আছে, দেখা হয় মধ্যে মধ্যে।
বুড়ি এবার মোক্ষম উত্তর খুঁজে পায়। বলে:
----- তবে তো তুমিও আমার কথা জানো। না কি ও আমার সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলে না। আমি তো সত্যি তোমাদের মধ্যে বাদের খাতায়।
বুড়ির শ্লেষটা নীলুর বুকে কতটা বাঁধলো সেটা বোঝা গেল না ওর নির্বিকার চাহুনিতে। তবে ও নিশ্চয় বুঝেছে নানা যন্ত্রনায় ভারাক্রান্ত বুড়ির শরীরটা নেতিয়ে গেলেও ওর বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার ধারটা বেড়েছে। বিড়ম্বনা নিয়েই নীলু বলে:
------ হ্যাঁ সোমা বলেছে কিছুটা। আমার খুব কষ্ট হবে ভেবে বোধ হয় সবটা বলে নি। বলেছে তুমি বাচ্চা হবে বলে এখানে এসেছ। তোমার মেয়ে হয়েছে। তোমার বাবা অসুস্থ তাই তুমি এখানে আছ। কিন্তু তোমার শ্বশুর বাড়ি সম্পর্কে কিছু বলে নি। তাই আমি জিজ্ঞাসা করলাম। তুমি রাগ কর না।
অবশ্য নীলুর এটাও গোজামিল দেওয়া কথা। সোমা না বললেও নীলু ওর দাদুর কাছে শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে শুনেছে। ওখানে মানিয়ে নেওয়া শক্ত ও জানে। তাও ওর জানার ইচ্ছে বুড়ির শ্বশুর বাড়ি সম্পর্কে, ও ওখানে কেমন আছে সে সম্পর্কে। এতক্ষনে বুড়িও কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। চাক বা না চাক একটা সম্পর্ক তো হয়েছিল । আর এমন একটা সম্পর্ক যা ভোলা যায় না। যাকে কেন্দ্র করে দুজনের সম্পর্কে দুজনের আগ্রহ মনের মধ্যে চির নবীন থাকে। বুড়ি অনেক সহজ হয়ে বলে:
----- আমার শ্বশুর বাড়ির কথা আর বল না। পয়সা আছে কিন্তু ওরা মানুষ নয়। শ্বশুর আর আমার স্বামী তো দুটি রতন। সব গুনের অধিকারী। আর ওরা আমাকে বাড়ির দাসী বলে ভাবে। স্বামীর শরীরের দাবি মেটাব আর বিনা পয়সায় বাড়ির কাজের লোক হয়ে থাকব। আমি বিয়ের আগেই আমার এই ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলাম বাবা মা ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে। বড়দা মারা গেল আর ছোড়দা কোথায় হারালো। আমাকে সেজন্য সব জেনে বিয়েতে মত দিতে হয়। এখন দেখি বাপ ছেলে দুই সমান। তবে বড় জায়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলাম। খাটা খাটনীতে আমার আপত্তি নেই। ওটাতে আমি ছোট বেলার থেকেই অভ্যস্ত। ছোট দেওয়রদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। ওদের যে ভাই আলাদা থাকে সে আর তার স্ত্রী আমাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু আসল লোকটা নকল হলে কি করে চলে বল।আমার বাচ্চা হলে তাকে নিয়ে আমি সংসারে টিকে থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু ওটা যে ওই মেজবাবু মানে আমার স্বামীই হতে দিল না। ঝাঁটা লাঠি আর গালাগালির দাপট যেমন বেড়ে চলেছিল তা অসহ্য। তারপর বাচ্চা হবে বলে তার কোন আবেগ নেই। বরং মেয়ে হলে আমার দুর্গতি আরও বাড়বে আর মেয়েটাও ওদের কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না। বাপের বাড়ির জোর থাকলে লড়াইটা চালানো যেত। আর সেটা তো আমার নেই। বড় বউ এর আছে, সেখানে খাপ খুলতে পারে না। তাই আমি চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। এখন বাচ্চা নিয়ে অন্তত মানসিক শান্তিতে আছি। তবে আমাদের আর্থিক যা অবস্থা সেটা মেরামত করতে দুবেলা খাবার জোটাতে আমাকে কোন কাজ ধরতে হবে। মেয়েকে এখানে মায়ের কাছেই রাখব। সে সব যাক। এবার তোমার কথা বল। বিয়ে করলে না কেন? আর শুনেছি চাকরি বাকরি তেমন কর না। তোমরা ভালো ছেলে ভালো চাকরি বাকরি করে সব গুছিয়ে থাকতে পারতে সেটা করলে না কেন?
নীলু জানে সব কেনর উত্তর থাকে না। যেমন ওরা কেন জোট বাঁধতে পারলো না তার উত্তর নেই। নীলু কেন গুছিয়ে সংসার করলো না তারও সঠিক উত্তর নেই। তবে অজুহাত আছে। যেমন বুড়িকে পেল না একটা অজুহাত হতে পারে। তবে কেন সুমনার সাথে সম্পর্ক টিকল না? কোন উত্তর নেই। এর পরেও সম্বন্ধ করে একটা চালিয়ে নেওয়ার মত ব্যবস্থা কেন করলো না তার সঠিক উত্তর নেই। নীলুর মা তো কয়েকটা সম্পর্কের কথা বলেছিলেন। তবে ও এখন যে কাজ নিয়ে আছে সেটা অজুহাত হতে পারে। বুড়িকে এখনকার কাজটা নিয়ে কোন কিছু নীলু বলে না। তবে আর সবটা বলে। সুমনার সংগে সম্পর্ক বাবার সঙ্গে বিরোধ করে বাড়ি ছেড়ে একা থাকা সব।
ক্রমশ----------