৮ -এর দশকে আমি তখন বরানগর মোহন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এর ছাত্রী ছিলাম। সাতের দশকে নকশাল আন্দোলনের জন্য পশ্চিমবাংলায় বরানগর ,দমদম, আটাপাড়া বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল।
১৯৪৭ এর দাঙ্গায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থী দ্বারা গঠিত কলোনী এলাকায়( নোয়াপাড়া আধুনা মেট্রো স্টেশন) মোহন গার্লস হাই স্কুল অবস্থিত ছিল।
বরানগরের কয়েকটি বিখ্যাত স্কুলের মধ্যে নিজেদের স্থান তৈরি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আরএন চ্যাটার্জির বোন ইতিহাসে এমএ অত্যন্ত সুন্দরী মেমদের মতন দেখতে নিঃসন্তান বেলঘরিয়ার বাসিন্দা আপাদমস্ত বামপন্থায় বিশ্বাসী রমা মুখারজি।
মোহন গার্লস স্কুলটিকে নিজের সন্তানের মতন আগলিয়ে রাখতেন ।তাকে এই কাজে সাহায্য করতো স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক থেকে চতুর্থ শ্রেণীর সকল কর্মচারীরা!
৮ এর দশকে আমি পাঁচ বছর এই স্কুলের ছাত্রী ছিলাম ।তার আগে অর্থাৎ ক্লাস ফোরে এই স্কুল সংলগ্ন 'নগরবাসী কেজি 'স্কুলের ছাত্রী থাকায় দীর্ঘ ছয় বছর এই স্কুলের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ।
পাঁচীর ঘেরা বিশাল মাঠ এবং দোতলা স্কুল বিল্ডিং এলাকায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল। এই স্কুলে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা পাস করলে বোর্ড এক্সামে অবশ্যই পাস হবে সাফল্যের সাথে ।
একথা গার্জেন মহলে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল এবং গার্জিয়ানরা চাইতেন যেমন করেই হোক এই স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। প্রধান শিক্ষিকা স্কুলের প্রশাসন বিভাগ চালিয়েও ছাত্রীদের পড়াশোনার দিকে বিশেষ নজর রাখতেন নিজের নির্দিষ্ট ক্লাস ছাড়াও নাইনের ক্লাস
যখন কোন ক্লাসে দিদিমণি আসছেন না সেই ক্লাসে নিজেই যেতেন এবং ছাত্রীদের পড়া ধরতেন না পারলে স্কুল ছুটির পর আটকে রেখে পড়া তৈরি করে তবেই তাদের বাড়ি ছাড়তেন।
ছুটির পর দিদিমণিরা চলে গেলেও প্রধান শিক্ষায়ত্রী ছটা পর্যন্ত থেকে চেষ্টা করতেন বাচ্চারা যাতে তৈরি হয় !একটি স্কুল কে কতটা ভালবাসলে সেই স্কুলের জন্য অতিরিক্ত এতটা সময় দেয়া যায়! রমা মুখার্জিকে না দেখলে বোঝা যেত না!
আমার প্রিয় শিক্ষিকাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রীমতি কল্যাণী সেন ,বাংলা ,ভূগোলে এমএ হাতের কাজও বিশেষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।
দিদিমণি আমাদের অষ্টম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য ও ভূগোল ক্লাস নিতেন। অতি সুন্দরভাবে বাংলা সাহিত্যের অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝাতে বাংলা মানে বইয়ের কোনদিনই প্রয়োজন হয়নি।
আজও মনে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দেনাপাওনা ''শাস্তি' গল্পের নায়িকাদের কি চরম হেনস্থা হতে হয়েছিল। বিয়ের পর মেয়েদের যে পরিবার আপন বলা হয়। তার কাছে। অর্থাৎ শ্বশুরবাড়িতে এমন কি মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে তাদের!
লেখক গল্পের মাধ্যমে মানুষের লোলুপতা প্রকাশ করেছেন তার সুন্দর ব্যাখ্যা আমাদের সামনে তুলে ধরতেন কল্যাণী দিদি। দিদিমণি সবসময় পিছনের বেঞ্চের মেয়েদের পড়া ধরতেন ।আপ্রাণ চেষ্টা করতেন তাদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা, ভূগোলও খুব ভালো বোঝেন। পড়ানোর সময় কেবল বইয়ের পড়া পড়াতেন না চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন যাতে ছাত্রীদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটে ।
এমন ভাবেই একদিন বলেছিলেন মৃতদেহ বহনকারী কাচের গাড়ি সম্পর্কে ।আটের দশকে আমরা যারা সিঁথির মোড়ের বাসিন্দা ছিলাম শবযান ,বা মৃতদেহ বহনকারী কাচের গাড়ি দেখিনি !
এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র চালু ছিল খুব স্বল্প সংখ্যক অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে ।
দিদিমণি একদিন ক্লাসে বলছিলেন মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মাকে শান্তি দিতে উচিত সম্মানের সঙ্গে মৃতদেহকে নিয়ে যেতে ।
অন্তিম যানে।
একদিন স্কুলে আসার পথে দিদিমণি দেখেছিলেন কিছু মানুষ অত্যন্ত অযত্নে মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে ,সঙ্গে চিৎকার করে হরিনাম করছে! এই ঘটনা তাকে অতি কষ্ট দিয়েছিল। তিনি তাদের বারণও করেছিলেন ,তাদের দ্বারা অসম্মানিত হয়েছিলেন!
তার কাছ থেকেই শিখেছিলাম রাস্তায় অন্যায় দেখলে কিভাবে প্রতিবাদ করা যায় ।
তার কাছ থেকেই শিখেছিলাম মৃত্যুর পর আত্মার শান্তির জন্য শেষ যাত্রায় কিভাবে চলা উচিত ।এবং কাচের গাড়ির উপযোগিতা।
ছোটবেলা থেকে আমি একটু দুষ্টু ছিলাম। মনের মত বিষয়গুলো যত্ন করে পড়তাম। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় নিজের মতামত মিশিয়ে দিতাম ।অঙ্কেও ভালো ছিলাম ।
হয়তো এইসব কারণে কল্যাণী দিদির খুব কাছাকাছি হতে পেরেছিলাম ।
ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ঘটনার কথা বলতে যা পরবর্তী জীবনে চলতে সাহায্য করেছে।
খুব সাধারণ পোশাক লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়ে আসতেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে পান থাকায় ঠোঁট দুটো লাল থাকতো।
নবম শ্রেণীতে আর একজন সুন্দর দিদিমনির দর্শন পেয়েছিলাম মনোরমা দিদি। খুব সুন্দর অংক বোঝাতেন।
তার কাছে ক্লাস টেনে মাঝে মাঝে যেতাম স্টাফ রুমে অংক শিখতে। কোনদিনও আপত্তি করেননি,তার ক্লাস টেনে ক্লাস নয় বলে !
তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল কল্যাণী সেন। যার কথা প্রতিমুহূর্ত মুহূর্তে মনে পড়ে ।
বিষয়ের এতটা গভীরে যেতেন যেন চরিত্রগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠতো ।
আমি নিজেও ২৫ বছর শিক্ষকতা করছি কল্যাণী দিদির পড়ানোর পদ্ধতি আজও সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারিনি!
ক্লাসে গন্ডগোল সৃষ্টিকারী ছাত্রীদের বুদ্ধি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে তার লুকানো প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোই একজন টিচারের প্রকৃত কাজ, তাহা কল্যানী দিদির কাছ থেকেই শিখেছিলাম।
আজ তিনি পৃথিবীর অপর প্রান্তে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন !
যদি সুযোগ পেতাম স্টুডেন্ট হয়ে প্রকৃত শিক্ষকের কাজগুলো পুনরায় শিখতাম।
---------------------
কলমে:: মম মজুমদার ।