ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
ফেসবুক পোস্ট
সোমা চক্রবর্তী
নয় এ মধুর খেলা-
তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা......
তা একেবারে কম দিন তো নয়। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে একসঙ্গে, এক ছাদের নীচে বাস করা, সুখে, দুখে, ঝড়ঝঞ্ঝায় একসাথে পথ চলা, একই কর্তব্য ভাগ করে নেওয়া। তার সবটুকুই মধুর নয়, সহজও নয়।
আজ, ৩১শে ডিসেম্বর। আজ মানুষটার জন্মদিন। আশি বছরের জন্মদিন। আমিও তার কাছাকাছি। এত বড় একটা জীবন কখন যে কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। হঠাৎ মনে পড়লে চমকে উঠে ভাবি, 'আচ্ছা, আমার বয়স কত? পঁচাত্তর নাকি পঁচিশ? ওই পঁচিশের আশেপাশেই না আমার দেখা হয়েছিল মানুষটার সঙ্গে?' তবু মনে হয়, এই তো, যেন সেদিনের কথা। হয়তো সকলেরই এরকম মনে হয়, তাই না?
আমার মেয়ে মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা মা, বাবার সঙ্গে তোমার তো সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছিল। বাবার মধ্যেই তুমি তোমার মনের মানুষকে খুঁজে পেলে? আর যদি না পেয়ে থাকো, তাহলে এই এত বড় জীবনটায় তুমি অন্য কারোর প্রেমে পড়নি কখনও? অন্তত মনে মনে? কারোর না? বিয়ের আগেও না? অথবা তোমাকেও কারোর ভালো লাগেনি বলতে চাও?"
কি করে ওদের বোঝাই, আমাদের সময়টা তো ঠিক এখনকার মতো ছিল না। আমাদের ভাবনা চিন্তার ধরনটাই ছিল আলাদা রকমের। আমাকে কারোর ভালো লাগলেও, তাতে সাড়া দেবার কথা কোনদিন মনে মনেও ভাবতে পারিনি। সবাই বলত আমি নাকি বেশ সুন্দরী। খুব যত্ন করে গানটা শিখেছিলাম। ভালোই গাইতে পারতাম। কলেজের ছাত্রদের দলে, দাদার বন্ধুদের মধ্যে কিম্বা প্রতিবেশী ছেলেদের চোখে অপার মুগ্ধতা বুঝতে পেরেছি অনেক সময়ই। বুঝতে পেরে ভালো লাগার বদলে লজ্জা আর ভয় পেয়েছি বেশি। সংকোচ হয়েছে। আমাদের সময়ে মেয়েদের মনের কথা থাকাটাই যেন একটা সংকোচের কারণ ছিল। এতদিন পরেও তাই নিজের মেয়েকে বলতেও সংকোচ হয় যে, কলেজে বাংলা সাহিত্যের তরুণ অধ্যাপক সঞ্জীবন সেন ক্লাসে আমার দিকে তাকিয়েই 'রাধার বিরহ' বোঝাতেন। সেই সময়টায় ওঁর চোখের পলক পড়ত না। তারপর, সেই কবেকার এক পড়ন্ত বিকেলে, ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ করেই কলেজ স্ট্রীটের রাস্তাগুলো সব মিছিলের জন্য আটকে দেওয়া হয়েছিল। চারিদিক লোকে লোকারণ্য। সেদিন তো ভীষণ বিপদেই পড়ে গিয়েছিলাম। এম এ তে সদ্য ভর্তি হয়েছি। তখনও পথঘাট ভালো চিনি না। কোনদিক দিয়ে বেরোব, বুঝতে পারছি না। কফি হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক শুধু তাকাচ্ছি। হঠাৎ দেখি, কোথা থেকে যেন দাদার ছোটবেলার বন্ধু অরুদা এসে ভিড়ের মধ্যে সোজা আমার হাতটা ধরল। অরুদা স্কুলে দাদার সাথে এক ক্লাসে পড়ত। তখন মাঝে মাঝে এসেছে আমাদের বাড়ি। তবে, কথা হয়নি কোনদিন। শুনেছিলাম, স্টেশনের ওদিকটায় ওদের বাড়ি ছিল। সেই অরুদা সেদিন অলিগলি রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে নিয়ে গিয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল বাড়িতে- শিয়ালদা থেকে হাতি বাগান হয়ে। অরুদা তখন ডাক্তারী পাশ করে নীলরতন সরকার কলেজ হাসপাতালে চাকরিতে ঢুকেছে। আবার, আমাদের পাশের বাড়ির ঝিমলিকে টিউশন পড়াতে গেলে প্রতি সন্ধ্যায় ঝিমলির দাদা সৌম্য চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে আসত মায়ের অসুখের অজুহাতে। ওদের মা ছিলেন চির রুগ্ন। প্রায় বারো মাসই শয্যাশায়ী থাকতেন। চায়ের কাপ টেবিলে রাখার সাথে সাথে যে বিনীত অনুরোধ সে রেখে যেত রোজ, তা যে আমি বুঝিনি, এমনটা তো নয়!
কিন্তু আমার মনের কথা? না। মনের কথা নিয়ে ভুলেও নাড়াচাড়া করিনি কখনও। শুধু জানতাম, এসব আমার কাজ নয়। বাবা-কাকা, পরিবারের লোকজন যা ঠিক করবে, তাই হবে। আর প্রেম? তাও তো হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত! পরিবারের লোকেরা আমার জন্য ঠিক করল এই মানুষটাকে। কথায় কথায় বিয়ের আগেই শুনেছিলাম, এ নাকি দেশভাগের দগদগে আঘাত সয়ে, অনেক কিছু হারিয়ে, এই দেশে আসা একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। পেশায় একজন ব্যারিস্টার। যথেষ্ট রাশভারী মানুষ। খুব ছোট বেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়েছে। অনেক দুঃখকষ্ট সয়ে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। মফস্বল শহরের এক প্রান্তে এক কামরার একটা ছোট্ট বাড়ি- তার নিজের উপার্জনে তৈরি। তার ভাইবোন, দাদা দিদিরা সবাই তখন নিজেদের মতো থিতু। সবাই আমাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আসা যাওয়া দেখাসাক্ষাৎ প্রতি নিয়তই হয়। কিন্তু সবসময় বাড়িতে মানুষ বলতে তো মাত্র আমরা দু'জন। এমন একগুঁয়ে, জেদী আর অভিমানী মানুষটাকে একা সামলাবো কি করে? আমারও যে বয়েস তখন একদমই অল্প। কাজে কাজেই আমার অস্ত্র হয়ে উঠল ধৈর্য। অনেকেই বলে, সারাজীবন বলে এসেছে, "তোমার কি ধৈর্য!" মনে মনে হাসি আমি। ধৈর্য না ধরলে উপায় ছিল?
যাই হোক, মানুষটাকে চিনতে চিনতেই তো কেটে গেল বিয়ের পরে প্রথম দিকের দিনগুলো। প্রেম রইল মনে। ওপরে জেগে থাকল কর্তব্য আর স্নেহ। বিয়ের আগের সঞ্চয়িতা খানা, আগে যেই বই ছিল আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী, যেটা আমি এ বাড়িতে আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম জামাকাপড়ের ট্রাঙ্কে ভরে, তার সঙ্গে রোজকার লেনদেন ক্রমশ কমে যেতে লাগল। সঞ্চয়িতার সঙ্গে আমার হাতের সান্নিধ্যের মুহূর্তগুলো উধাও হয়ে গেল। বইয়ের তাকে আমার প্রাণের সখা পড়ে রইল। মাসের পর মাস তার মলাট ওল্টানো হতো না আর। আমি ব্যস্ত থাকতাম অন্য জায়গায়, সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে। সেই সব দিনে, বসন্ত এসে ঘনীভূত হয়েছিল কেবল আমার গুন গুন করা গানের ভেতর। ওই একটা জায়গায় কিছুতেই বিচ্ছেদ হতে পারেনি। বালিশে-বিছানায়, আদরে-অভিযোগে, হাঁড়িতে-কলসীতে বয়ে যেত চোরা স্রোত -
আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা
প্রিয় আমার ওগো প্রিয়.......
বড্ড অসুখে পড়ত মানুষটা। শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। অ্যাকিউট ব্রংকাইটিস যাকে বলে। বিয়ের পর এসেই দেখলাম, অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যায় আর ঠান্ডা লাগলেই প্রচণ্ড কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ে গলা থেকে। সারাজীবন নিজের যত্ন করেনি তো একদিনও। কিসের ওপর যে তার এই বিপুল অভিমান প্রথম প্রথম তার তল পেতাম না আমি। পরে অবশ্য বুঝেছি একটু একটু করে। অভিমান তার নিজের ভাগ্যের ওপর, অভিমান তার নিজের লোকেদের ওপর- অকালে যাদের এই মানুষটার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ভাগ্য। বাইরে থেকে যুক্তিগ্রাহ্য লাগুক বা নাই লাগুক, একসঙ্গে থাকতে থাকতে আমি যেন এই ধাঁধার মতো মানুষটার মনের তল খানিকটা হলেও পেয়েছিলাম। অথচ, বাইরের দূরত্ব এতটাই যে, সে কথা তাকে কোনদিন বলে উঠতে পারিনি। তবে, আমি তার কথা খানিকটা বুঝতে পারলেও, সে আমাকে বোধহয় কোনদিন বুঝতে পারেনি। আজ পর্যন্ত বুঝতে চেয়েছে বলেও মনে হয় না। হয়তো চেষ্টাই করেনি কোনদিন। নিজেকে সর্বদা বন্দী করে রেখেছে একাকীত্বের এক কঠিন কারাগারে। হয়তো মানুষটার দুর্জয় অভিমান, অকারণ অভিমানই এর কারণ। কিম্বা হয়তো মনে মনে জেনেছে, মুখে স্বীকার করেনি। সঠিক উত্তর আমার কাছেও নেই। এক জীবনে একটা মানুষকে কতটুকুই বা চেনা যায়? আদৌ চেনা যায় কি? দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাস করার পরও?
যাই হোক, যে কথা বলছিলাম, বিয়ের পর সঠিক ভাবে মানুষটার চিকিৎসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলাম আমি। অনেক বুঝিয়ে, বড় ডাক্তার দেখিয়ে, দীর্ঘদিন চিকিৎসা করিয়েছিলাম জোর করে। এই রোগের সবচেয়ে বড় ওষুধ হলো যত্ন। সেটাই প্রাণপণে করেছি। একটু একটু করে ভালো হয়েছিল অবস্থা। গলা থেকে রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়েছিল। তবু, একটা ফুসফুস একেবারেই অকেজো হয়ে গিয়েছে ততদিনে। এখনও তাই, নানারকম নিয়মে, সাবধানে রাখতে হয় মানুষটাকে। এর ওপর ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে, আমার নিজের স্কুলের চাকরি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পারিবারিক আর সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য। এইসব নিয়েই কেমন করে যে এতগুলো বছর পার হয়ে গেল! একসঙ্গে একটা অতিমারী ও কি ভাবে যেন পার করে দিলাম আমরা।
আমার বাপের বাড়ি শহরে। সেখানে আজীবন থেকেছি বিজলী আলো, পাখা আর কলের জলের সুবিধার মধ্যে। বিয়ে হয়ে এসে পড়লাম মফস্বলে। যেখানে বিজলী আলো তো দূর, রান্নার আর স্নানের জলের জন্যও টিউবওয়েল পাম্প করতে হতো। সেই সময়, দিনের বেলাতেও একটা মানুষের মুখ সচরাচর দেখা যেত না। আর আমি সারাজীবন থেকেছি আত্মীয়-স্বজন, ভাইবোনদের নিয়ে গমগমে একটা পরিবেশে। যেখানে হাসিতে গানে গল্পে আনন্দের সাগর থেকে বাণ আসত দিনরাত। সব জায়গা ছেড়ে, এক টুকরো জমি কিনে এই মফস্বলে বাড়ি করেছিল মানুষটা তার ভাইবোনদের কাছাকাছি থাকবে বলে। বিশেষ করে তার দাদা। বাবা-মা মারা যাবার পর যে দাদা তাকে মানুষ করে তুলেছে। এত অসুবিধা, এত পরিশ্রম- তাও তো কত সহজেই হাসিমুখে সবকিছু মানিয়ে নিলাম। আমার কাছে ভালোবাসা মানে এটাই।
আজ লিখতে বসে কতদিনের কত কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। মানুষটার প্র্যাকটিস ছিল শিয়ালদা কোর্টে। বাড়ি থেকে কয়েক ঘন্টার দীর্ঘ রাস্তা। এখনকার মতো যাতায়াত ব্যবস্থা তো উন্নত ছিল না তখন। আর সেই সময় নিজস্ব গাড়িও ছিল না তার। গাড়িঘোড়া সবই অবশ্য হয়েছে, তবে সে অনেক পরে। একবার প্রচন্ড ঝড়জলের রাতে ওভারহেডের তার ছিঁড়ে মফস্বলের সব ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছিল। সারারাত বাড়ি ফিরল না মানুষটা। অবশ্য না ফেরার কারণটা সেই রাতে কিছুই জানতে পারিনি। খবর যে নেব, টেলিফোন কোথায়? কাউকে খবর দেব যে, তাও কীভাবে? পাঁচ বছরের ছেলে আর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে সারারাত উদ্বিগ্ন হয়ে জেগে বসে আছি। সকাল না হলে কিচ্ছু করার নেই। আমার কাছে ভালোবাসা মানে এইসব দিবারাত্রির কাব্য।
সেটা ছিল আশির দশক। স্কুলে বসে টিফিনের সময় ইন্দিরা গান্ধীর খবরটা পেলাম। ওঁকে ওঁর নিজের নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি করেছে। অবস্থা সঙ্কটজনক। তিনি তখন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি দিয়ে সব দিদিমণি মাস্টারমশাই বেরিয়ে পড়ল বাড়ির উদ্দেশ্যে। ততক্ষণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। দোকানপাট, রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। গাড়ি চলাচল প্রায় থেমে গিয়েছে। চারিদিক থেকে গন্ডগোলের খবর আসছে। আমাদের স্কুলের বড় দিদিমণি আমাকে বললেন, সেই দিনটা ওনার বাড়িতে থেকে যেতে। কারণ, ওনার বাড়ি স্কুল থেকে খুব কাছে। আর আমার বাড়ি সবচেয়ে দূরে। অন্য কয়েকজন সহকর্মীও একই কথা বলেছিলেন। কি একটা কারণে মানুষটা সেদিন বেরোয়নি। আমি জানতাম যে, বাড়িতে সে আর ছেলেমেয়েরা নিরাপদে আছে। তবু কেন যেন, সেই বিপদের দিনে ওদের ছেড়ে বাইরে থাকতে মন সায় দেয়নি। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেও না। সেদিন কি ভাবে যে শেষ পর্যন্ত অর্ধেক রাস্তা হেঁটে আর বাকিটা আরও বিভিন্ন উপায়ে পার হয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছেছিলাম, তা শুধু আমিই জানি। সে সব কথা লিখতে গেলে আর একটা কাহিনী হয়ে যাবে। আমার কাছে ভালোবাসা মানে এই অনুভূতিটুকু।
কখনও মুখে কিছু বলত না মানুষটা। কিন্তু হাবে ভাবে আমি ঠিক বুঝতে পেরে যেতাম। বাবা আর মা যতদিন ছিলেন, বছরে একবার, বড়জোর দু'বার বাপের বাড়ি যেতাম। ফিরতে দু-এক দিন দেরী হলেই সে কি রাগ। রাগের কারণ দেখাতে বলত, "ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে।" আচ্ছা, রাগ না অভিমান? কে জানে! কোনদিনই কারোর হাতের রান্না তার পছন্দ নয়। এমনকি মেয়ের রান্নাও নয়। সেটাও মুখে নয়, আকারে ইঙ্গিতে বোঝানো। রান্নার লোক রাখলেও অসন্তুষ্ট ভাব। যদিও আমার শরীরের কথা ভেবে আজকাল আর কিছু বলে না। ছেলেমেয়েরা কখনও হাসে, কখনও রাগ করে। "মায়ের রান্না ছাড়া আর কিছু বাবার মুখে রুচবে না"- বলে ওরা। হোটেল বা রেস্তোরাঁর বেশি তেল-ঝাল-মশলাদার খাবার খেতে একদমই পছন্দ করে না। তাই আজ এই জন্মদিনের দিনটায় ওসব জায়গা থেকে খাবার আনতে ছেলেকে বারণ করেছি।
তাকে নিয়ে কেউ হৈ চৈ করুক, এ তার পছন্দ নয়। কেক কাটা? পায়েস বানানো? উঁহু! তাই সেই সবকিছু পরের দিনটায় করা হয়। উপলক্ষ্য ইংরেজি নববর্ষ। তাই, সব বুঝলেও কিছু বলতে পারে না। এই দিনে নীরবে শুধু ভালোমন্দ কিছু রান্না করি বরাবর। যা ভালো খায় মানুষটা। তবে, এখন তো আর শরীর সাথ দেয় না খুব একটা। হাঁটু ব্যথা। চোখেও বিস্তর সমস্যা। কোলেস্টেরল আর ব্লাড প্রেসার হাই। তবুও, আজকের দিনটায় নিজের হাতে বানিয়েছি ফ্রায়েড রাইস, পালং পনির, কড়াইশুঁটি দিয়ে মাখা মাখা ফুলকপির তরকারি, পোস্তর বড়া, নারকেলের বড়া, চাটনি আর রসপুলি। মানুষটা মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন হলো। ছোট মেয়ে রান্নাগুলো টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে একটা ছবি তুলে নিল। ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ সবাই মিলে বলল, "মা, তুমি কিছু একটা লেখো। রান্নার ছবির সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট করব।" এটা কি আবার ফেসবুকে দেবার মতো একটা কথা? কে জানে বাবা! নিজের মানুষের জন্য রান্না করেছি। এটা কিই বা এমন বড় বিষয়? ওরা বলল, "আজকাল সবাই দেয়। এমনটাই হয়।" কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। মনের যে কথাগুলো এত বছরেও একান্ত কাছের মানুষটাকেই বলা হলো না, সেই কথা ফেসবুকের মাধ্যমে সবাই জেনে যাবে! একটু দ্বিধা, খানিকটা সংকোচ। শেষ পর্যন্ত বললাম, "আচ্ছা, লিখে রাখব কয়েক লাইন"।
কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখি, অনেক কথাই ভিড় করে আসছে মনের মধ্যে। হয়তো অনেক দিন ধরে প্রকাশের দাবী নিয়ে বসেছিল আমারই নিভৃতে। একটা যেন নেশা ধরিয়ে দিল কথাগুলো। দলে দলে এসে জুটতে লাগল আর আমিও লিখে গেলাম- এলোমেলো যা কিছু মনে এল। এই লেখা আদৌ কি পড়ার মতো হলো? কেউ কি শেষ পর্যন্ত পড়বে এ লেখা? পড়লেও, কে কে পড়বে? জানি না। তবে, ওই মানুষটা কিন্তু পড়বে না। সে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। কম্পিউটারের তো প্রশ্নই ওঠে না। এখনও তার যা কিছু ফোন আসে, সবই সেই পুরোনো ল্যান্ড লাইনে। তবু লিখলাম। লিখতে বেশ ভালোই লাগল। আপনাদের পড়তে কেমন লাগবে জানি না। ওরা কোথায় কোথায় পোস্ট করবে, তাও জানি না। এখনও ভালো নেটা নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি আমি। কি করেই বা উঠব? এক জীবনে কম বদল, কম নতুন জিনিস তো দেখলাম না। সব কি আর শেখা যায়? তাই এই না পারাটাও একরকম ভাবে মেনে নিয়েছি আমি।
অনেক কথা হয়ে গেল। আজকের মত এখানেই শেষ করি। আগামী বছর এই দিনে না হয় আবার কিছু লিখব। আপনারা যারা এই লেখা পড়বেন, সবাই প্রার্থনা করবেন, মানুষটা যেন সুস্থ থাকে। ভালো থাকে। আর আপনারাও ভালো থাকবেন।
------------------------------
________
ঠিকানা: বারাসাত,
উত্তর ২৪ পরগণা।