বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

অণুগল্প ।। সত্যের দোতারা ।। চন্দন মিত্র


 ছবিঋন- ইন্টারনেট

 সত্যের দোতারা

 চন্দন মিত্র

 

বাউল-ফকির মেলায় ঘোরাফেরা করতে করতে আমাদের ভিতরেও গান গাওয়ার ঝোঁক সংক্রমিত হয়। কিন্তু প্রথাগত গান না-শিখলে যা হয়, কণ্ঠে সুর খেলে না, তাল কাটে। সপ্তাহে কম করে তিন-চারদিন মূলত সন্ধ্যাবেলায় আমাদের দলবদ্ধ বেসুরো চেঁচামেচিতে পাড়া সরগরম হয়ে ওঠে। বাদ্যযন্ত্র বলতে একটা ঢোলক, একটা ডুবকি আর করতাল। এর মধ্যে নরেশ তার অফিসের এক কলিগের সঙ্গে কথা বলে একটা  প্রোগ্রাম ধরে ফেলে। শুধু প্রোগ্রাম নয়, টাকার বিনিময়ে প্রোগ্রাম, আমাদের প্রোগ্রামের ঠিক পরেই উঠবে মুম্বাইয়ের শিল্পীরা। শুনে তো আমরা আকাশ ত্থেকে পড়ি। নরেশকে প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করার কথা বললে, সে বলে কোনোভাবেই তা সম্ভব নয় অ্যাডভান্স নেওয়া হয়ে গেছে। বলেই একটা কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট মানিব্যাগ থেকে বের করে দেখায়। কলেজের বন্ধু কৌশিক এসে ভরসা যোগায়। সে বহুদিন থেকে তবলা বাজায়, অনেক বড়ো-বড়ো অনুষ্ঠানও করেছে। 

    মাসদুয়েক সময় হাতে আছে। রিহার্সাল শুরু হল। কয়েকদিন পরে সত্য তার বাবাকে  বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বউবাজার থেকে একটা দোতারা কিনে আনে। আমাদের রিহার্সাল জমে গেল। শেষের দিকে আমাদের পাড়ার মাইকম্যান বাপিদাকে রাজি করিয়ে রীতিমতো বক্স বাজিয়ে ফাইনাল রিহার্সাল শুরু হল। সত্য যে কোন তালে দোতারা বাজায় সে সত্যই জানে। আমাদের তো দোতারা সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই নেই, ফলে আমরা স্পিকটি নট। কেবল কৌশিক মাঝেমধ্যে তাকে ধমকায়। 

    এমনিতে ডিসেম্বরের সন্ধ্যা; তার ওপর স্টেজ, মিউজিক সিস্টেম ও দর্শকাসনের বহর দেখে আমাদের ঠ্যাং কাঁপতে শুরু করল। ক্লাবের ছেলেদের আতিথেয়তায় কফি আর স্ন্যাক্সের স্বাদ নিয়ে আমরা আরও ভয় পেয়ে গেলাম যদি স্টেজে উঠে ঘাবড়ে যাই, যদি গাইতে গাইতে ভুলে যাই।  কৌশিক বসল তবলায়, সত্য দোতারায়; করতাল, ডুবকি হাতে আমরা চারজন গায়ক। আমাদের  অনুরোধে বাপিদাও সঙ্গে ছিল। বাপিদা বসল স্টেজের ঠিক সামনে ওদের মাইকম্যানের পাশে। প্রথমে শুরু করলাম সমবেত আসর বন্দনা। সাউন্ড-ফিডব্যাক আসতে লাগল। কিন্তু দোতারার  আওয়াজ আমাদের কানে পৌঁছাল না। বাপিদার দিকে চোখ পড়তে দেখি সে মাইকম্যানকে সত্যর দিকে দেখিয়ে ওর মাইক্রোফোনের ভল্যুম বাড়াতে বলছে। কিন্তু কোনোভাবেই দোতারার আওয়াজ আর কানে আসে না। সত্যর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি সে নিছক বাজানোর ভঙ্গিমা করে চলেছে। সত্যর মাইক্রোফোনের ভল্যুম যত বাড়ে ততই সে দোতারার তারের থেকে হাতের দূরত্ব বাড়ায়; কিন্তু বাজানোর অভিনয়টি নিখুঁতভাবে চালিয়ে যায়। দর্শকমণ্ডলী অবাক হয়ে দ্যাখে সত্য  দোতারা বাজিয়ে চলেছে কিন্তু কানে আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে না। আমি কিন্তু সত্যের এহেন আচরণে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। কারণ আমি জানতাম জনরোষের ভয়ে অনেকসময় সত্যকে নীরবতা পালন করতে হয়।      

===============================

চন্দন মিত্র

ভগবানপুর (হরিণডাঙা),        

ডায়মন্ড হারবার,

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.