সাত পাকে বাঁধা
সুপ্তা আঢ্য
মরেও শান্তি নেই গোবিন্দর। বেঁচে থাকতে দজ্জাল গিন্নীর ঝাঁটাপেটা না সহ্য করতে পেরে পাশের তেঁতুল গাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল বলে মরার পর গলার হাড়টা একটু বেঁকে গেছে।এছাড়া মুণ্ডু নিয়ে গর্দানখানা ঠিকঠাকই আছে। ভেবেছিল মরার পর এই তেঁতুলগাছেই বাকী ভূতজীবনটা শান্তিতে কাটাবে।মরে গিয়ে পুঁটির মায়ের প্রতি টানটা একটু বেড়েছে।আহাগো!শাখা সিঁদুর খুইয়ে কী দশাটাই না হয়েছে। যতই গালমন্দ করুক, রাতের বেলা একটু আদর সোহাগ তো করত। তা একদিন রাত্তির বেলা পুঁটির মায়ের টানে জানালা দিয়ে হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকতেই হ্যারিকেনের আবছা আলোয় ছায়াটা দেখা যেতেই এমন চেঁচামেচি শুরু করে দিল যে ভয়ের চোটে ওর হাড়ে কাঁপন ধরে গেল। তারপর ওঝা ডেকে এমন সব কাণ্ড করল যে ওর ওখানে থাকাই দুষ্কর হয়ে পড়ল। দজ্জাল মেয়েমানুষটাকে বোঝাতেই পারল না যে ও ওর সোয়ামী,মরে গিয়েও ওকে ভুলতে পারেনি। তবে এবারও পুঁটির মাকে ভুলে নতুন করে সংসার পাতবে ভূতজনমে।
বাড়ির পাশের তেঁতুলগাছ ছেড়ে গোবিন্দ এখন শ্মশানের পাশের বাঁশবাগানে থাকে।এখানে ওর কিছু বন্ধুও হয়েছে-----মেছো,মামদো,স্কন্ধকাটা আরও কতজন।বেহ্মদত্যিটার সাথেও বন্ধুত্ব করবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তার যা দেমাক কাউকে পাত্তাই দেয় না। এখানে এসে গোবিন্দ বেশ ভালোই আছে। পুঁটির মাকে আর অতটা মনে পড়ে না।চারপাশে কত সুন্দরী পেত্নী,শাঁকচুন্নীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের কাছে পুঁটির মা কিছুই নয়----ওই তো গোলগাল চেহারা। আর এদের তো হিরোইনদের মতো জিরো ফিগার না কী যেন বলে----তাই।
কী সুন্দর পোড়া কাঠের মতো চেহারা, ধবধবে সাদা মূলোর মতো লম্বা লম্বা দাঁত,ভাঁটার মতো চোখ-----দেখলেই মনে হয় তাকিয়ে থাকি। আর কী সুন্দর পায়ে আলতা পরে,মাথার খুলিতে টকটকে লাল সিঁদুর পরে থাকে।হাতভর্তি চুড়িগুলো যখন হাড়ে লেগে আওয়াজ করে----তখন যে কী মিঠে লাগে শুনতে তা আর বলবার নয়।গোবিন্দ বাঁশগাছের ডগায় বসে পা নাচিয়ে নাচিয়ে দোল খায় আর ভূতসুন্দরীদের দেখে স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে।ওর বন্ধুদের সকলেরই গার্লফ্রেন্ড আছে,শুধু ও ই একা।তবে ইদানীং এক শাঁকচুন্নী সুন্দরীকে ওর বেশ মনে ধরেছে। গোবিন্দর মনে হয় শাঁকচুন্নীরও ওকে ভালো লাগে।তাইতো ওকে দেখলেই ভাঁটার মতো চোখগুলো নিয়ে কী মিষ্টি করে যে তাকায়----দেখলেই প্রাণটা জুড়িয়ে যায় গোবিন্দর।
মামদো আর মেছো বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাপারটা নজরে রেখেছিল।একদিন শাঁকচুন্নী যখন বাঁশগাছের ডগায় বসে মাথার উকুন বাছছিল,ভাব বিভোর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল গোবিন্দ। তখনই কাঠির মতো আঙুল দিয়ে ওর কঙ্কালে খোঁচা দিয়ে বলল"কীঁ বঁন্ধু,ওঁকে পঁছন্দ বুঁঝি!"
"হ্যাঁ---মানে----সেঁরকম কিঁছু নঁয়----তঁবে---"
"আঁমি বুঁঝেছি বঁন্ধু,আঁমাদের শাঁকচুন্নী বঁড়ো ভাঁলো----পূঁণ্যিমে রাঁতের চাঁদনী আঁলোয় কীঁ সুঁন্দর নাঁকী সুঁরে গাঁন গাঁয়!শুঁনলে হাঁড়গুলো জুঁড়িয়ে যাঁয়।তাঁ দোঁস্ত,কীঁ ঠিঁক কঁরছ,বিঁয়েই কঁরবে তোঁ----তাঁহলে কঁথাটা পাঁড়ি।"
পুঁটির মায়ের সঙ্গে সংসার করার পর থেকে বিয়ের সাধ মিটে গেছিল গোবিন্দর। তবে ওই শাঁকুকে দেখার পর থেকেই মনটা আকুলিবিকুলি করে একটা সুন্দর ছোট সংসারের জন্য। মনিষ্যিজন্মে তো আর শান্তি পায়নি,তা এই ভূতজন্মে যদি একটু শান্তি পায়!নাকের গর্তটা দিয়ে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল"তাঁ বঁলে দেঁখ।আঁমি বিঁয়েতে রাঁজী।কিঁন্তু ওঁ রাঁজী হঁবে তোঁ!"
"হঁবে নাঁ মাঁনে-----আঁলবৎ হঁবে।"
গোবিন্দর শাঁকুও রাজীই ছিল,শুধু একবার বলার অপেক্ষায় ছিল।যতই হোক,শাঁকচুন্নী হলেও মেয়েভূত তো----নিজে মুখে বলতে লজ্জা লাগে না! আর তাছাড়া গোবিন্দই বা কম কিসে,গলায় দড়ি দিয়ে মরা ভূত----কত সাহসী!সাহস না থাকলে কেউ গলায় দড়ি দিতে পারে! আর তাছাড়া বয়েসটাও বেশী নয়,বেশ মানাবে শাঁকুর সাথে।ভূতবর আর ভূতকনে রাজী হতেই মামদো,মেছো আর স্কন্ধকাটা গেল বেহ্মদত্যিটার কাছে বিয়ের পুরুত ঠিক করতে।
সন্ধ্যে হতেই বাঁশবাগানে বেশ হইহই পড়ে যায়----বিয়ে বলে কথা।ভূতসুন্দরীরা ছাইভস্মের ফেসপ্যাক মেখে মুখটাকে আরও উজ্জ্বল করার চেষ্টা করছে।মেনুও ঠিক হয়ে গেছে।বাঁশপাতায় লিখে কার্ড ছাপানোও হয়ে গেছে।গোবিন্দর ভূত বন্ধুরা যখন বিয়ের কাজে ব্যস্ত,গোবিন্দ তখন শাঁকুর লম্বা কাঠির মতো হাড়ের আঙুলে হাড় লাগিয়ে বাঁশগাছের ডগায় বসে শেষ শুক্লপক্ষের চাঁদ দেখতে দেখতে দোল খাচ্ছে আর শাঁকুর গানে বিভোর হয়ে ওর কাঁধে খুলি রেখে নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখছে।
ভরা অমাবস্যার রাতে বিয়ের ঠিক হয়েছে। শাঁকুর সাথে প্রেম করতে করতে কবে যে বিয়ের দিন চলে এল খেয়ালই হয়নি গোবিন্দর। অমাবস্যার সন্ধ্যে হতেই মামদো মেছোরা গোবিন্দকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল।কপালে গঙ্গা মাটির বদলে কাদার টিপ,গলায় ছোট ছোট খুলির মালা,মাথায় হাড়ের টোপরে বেশ দেখাচ্ছে গোবিন্দকে।ওদিকে কনেও বিয়ের জন্য তৈরী হচ্ছে। পরনে রক্তপেড়ে শাড়ী ,গলায় খুলির মালা,কপালে নকশা,নাকের গর্তে একটা নথ গোঁজা,খুলির পাশ থেকে কানের কাছে দু-দিকে ছোট হাড় কানের দুলের মতো করে ঝুলছে,দুপাটি দাঁতের ওপরে নীচে লাল টকটকে লিপস্টিক লাগানো,দু-হাতের হাড়ভর্তি চুড়িতে গোবিন্দর শাঁকুকে আজ যে দেখবে সেই ওই অসামান্য রূপের ডালি দেখে ভিরমি খাবেই।অন্য ভূতসুন্দরীরাও মনের মতো করে সেজেছে। আর তাই দেখে ভূতহিরোদের পাঁজরের ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে।ভূতসমাজে তো আর নিয়মকানুনের বাড়াবাড়ি নেই,তাই যে যার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে হাড়ে হাড় ঠেকিয়ে বসে আছে।
বাঁশগাছের মাথায় বিয়ের মণ্ডপ সাজানো হয়েছে।বরকনে দুটো ডালে বসবে আর পুরুতমশাই শূন্যে দুলতে দুলতে বিয়ে দেবেন।চারিদিক থেকে ভূতসুন্দরীরা নাকীসুরে উলুধ্বনি দিচ্ছে।বাঁশগাছের নীচ থেকে শেয়ালগুলোও চিৎকার শুরু করেছে।বাঁশগাছের মাথায় দাঁড়িয়ে বরকনে মালা থুড়ি হাড়বদল সেরে যেইনা গোবিন্দ সিঁদুরটা শাঁকুর খুলিতে পরাতে যাবে,অমনি একটা ঝাঁটা উড়ে এসে লাগল গোবিন্দর খুলিতে আর তার সাথে খনখনে গলায়কে যেন বলে উঠল "ওঁরে অঁলপ্পেয়ে মিঁনসে,তুঁই বেঁ কঁরে আঁমার সঁতীন আঁনবি ভেঁবেছিস? আঁমি মঁরে সেঁটা আঁর হঁতে দিঁচ্ছি নাঁ।"এই গলার আওয়াজে গোবিন্দ থতমত খেয়ে বলল "পুঁ---পুঁটির মাঁ তুঁমি !এঁখেনে কেঁমন কঁরে এঁলে!"
"তুঁই কীঁ ভেঁবেছিস মঁরে পাঁর পেঁয়ে যাঁবি।তিঁনদিনের জ্বঁরে মঁরলুম আঁর তোঁকে খুঁজতে খুঁজতে এঁখেনে চঁলে এঁলুম।আঁমি কোঁথায় সোঁয়ামী শোঁকে কেঁদে ভাঁসাচ্ছিলুম,আঁর তুঁমি মিঁনসে এঁখেনে দ্বিঁতীয় সংসার পাঁততে বঁসেছ! ওঁগো আঁমার এঁখন কীঁ হঁবে গোঁ-----কেঁ কোঁথায় আঁছ গোঁ----"বলে নাকীসুরে কাঁদতে কাঁদতে শাঁকচুন্নীর কাছে তেড়ে গিয়ে বলল"এঁই সঁর বঁলছি। এঁ আঁমার সোঁয়ামী।"
শাঁকচুন্নীও কম যায় না-----ভাঁটার মতো চোখদুটো ঘুরিয়ে বলল"উঁ-----কেঁ এঁল রেঁ ।ওঁ আঁমার সোঁয়ামী হঁবে।কঁই সিঁদুরটা তাঁড়াতাড়ি পঁরাও----রাঁত যেঁ শেঁষ হঁয়ে যাঁবে।"
"ওঁ আঁমার সোঁয়ামী ছিঁল,এঁখনও তাঁই থাঁকবে। উঁ----,উঁড়ে এঁসে জুঁড়ে বঁসেছে।"
"সেঁ তোঁ মঁনিষ্যি জঁন্মে ছিঁল,এঁখন তো ভূঁত জঁন্ম।সঁব নঁতুন কঁরে শুঁরু হঁবে।আঁর তুঁই যাঁ ঝঁগড়ুটে,তোঁর জ্বাঁলাতেই তোঁ ভূঁতের পোঁ পাঁলিয়েছে।আঁবার তোঁর গঁলাতেই মাঁলা দেঁবে ভাঁবলি কেঁমন কঁরে!"
"কীঁ----আঁমি ঝঁগড়ুটে!কেঁ বঁলেছে এঁকথা।ঝেঁটিয়ে বিঁষ ঝেঁড়ে দেঁব।ওঁই মিঁনসে বুঁঝি বঁলেছে,কোঁথায় সেঁ?এঁই অঁলপ্পেয়ে,সাঁমনে আঁয়।"
পুঁটির মাকে দেখে বিয়ের শখ ষোলোআনাই প্রায় শেষ গোবিন্দর। মামদোর পিছনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসেছিল। পুঁটির মায়ের চেঁচামেচি শুনে শেষ চেষ্টা করতে সামনে এসে বলল"শোঁনো পুঁটির মাঁ,তুঁমি বেঁচে থাঁকতে আঁমার ইঁস্ত্রী ছিঁলে ঠিঁকই,কিঁন্তু এঁখন তোঁ সেঁসব চুঁকে গেঁছে। আঁর তুঁমি তোঁ আঁমাকে পঁছন্দই কঁরতে নাঁ। আঁমি এঁখন শাঁকুকে বেঁ কঁরে নঁতুন সংসার পাঁতব।"
"তঁবে রেঁ মিঁনসে,মঁরে গিঁয়ে বঁড্ড বাঁড় বেঁড়েছে।ঝাঁটার মাঁর ভুঁলে গেঁলি।দাঁড়া দেঁখাচ্ছি মঁজা----আঁমাকে ছেঁড়ে নঁতুন সংসার---"বলতে বলতে গোবিন্দ আর শাঁকচুন্নীকে হাতের ঝাঁটাটা দিয়ে পেটাতে শুরু করল।পুঁটির মায়ের ঝাঁটার ভয়ে মামদো,মেছোরা এগোতে সাহস পাচ্ছিল না।এই ফাঁকে বেহ্মদত্যিটাও কোথায় সটকে পড়েছে।পুঁটির মা ঝাঁটা নিয়ে ওদের তাড়া করতেই শূন্যে তিনজনে বনবন করে ঘুরতে লাগল।কিছু বোঝা যাচ্ছিল না শুধু মাঝে মাঝে পুঁটির মায়ের নাকীসুরের হুঙ্কার আর ঝাঁটার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
জ্বরে ভুগে মরায় পুঁটির মায়ের হাড়গুলো একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল।তাই জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটু থামতেই শাঁকুর হাত ধরে গোবিন্দ সোঁ সোঁ করে উড়ে পালিয়ে যে কোথায় গেল পুঁটির মায়ের মোটা খুলিতে সেটা ঢুকলোই না।এদিকে শেষ রাতের অন্ধকার মুছে চারিদিকে আলো ফুটতে শুরু করতেই মেছো,মামদো,বেহ্মদত্যি আর ভূতসুন্দরীরা যে কোথায় ফট করে হাওয়া হয়ে গেল কারোর আর চিহ্ন পাওয়া গেল না। এরপর গোবিন্দ আর শাঁকুর কী হল,পুঁটির মা-ই বা নিজ অধিকার ছাড়লো কিনা সেটা জানতে পাঠককূলকে মাঝরাতে বাঁশবাগানে যেতেই হবে। ততক্ষণ আমার কথাটি ফুরোলো।
========================
Supta Auddy
23/1 Dixon Lane
Kolkata 700014