ধারাবাহিক উপন্যাস ।। সামান্য মেয়ে ( শেষ পর্ব) ।। রনেশ রায়
৯
বিরহ মিলনে
বছর পনের কেটে গেছে। এখন নীলুর বয়স চল্লিশ বা তার কাছে। সুন্দরবনে দাদু মারা গেছে। তার সেখানে আর যাওয়া হয় না। খবর পেয়েছে বুড়ি কলকাতায় কোথাও কাজ করে। তার রোজগারে সংসার চলে। কলকাতায় নীলুর অলিতে গলিতে যাতায়াত হলেও এই লোক অরণ্যে কোথায় বুড়িকে খুঁজে পাবে? তাও ভাবে কখনও যদি দেখা হয়। আর দেখা হলেই বা কি ! ওর সাথে আর কি সম্পর্ক আছে? নীলু মগ্ন থাকে দেহব্যবসায়ীদের সংগঠনের কাজ নিয়ে। সমাজ সেক হিসেবে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়াই তার ইচ্ছে। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও বাবার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই। আর দেহ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ সেটা তো সভ্য সমাজে পাতে পড়ে না।ওতে একটা অস্পৃশ্যতার ছোঁয়া আছে যেটা বাবার সংস্কৃতিতে ব্রাত্য। তাই সে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে উত্তর শহরতলিতে থাকে। টিউশনি করে নিজের ভালোই চলে যায়। আর ওর পড়ানোতে যথেষ্ট সুনাম। তাই অসুবিধে হয় না। বিয়ে করে নি। এরই মধ্যে জীবনের একটা পর্যায় সে পার হয়ে এসেছে যেটা আমাদের অজানা। এম এ পড়তে পড়তে নীলু যখন মেয়েদের এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ শুরু করে তখন ওর ক্লাশের রিনা বলে একটি মেয়ে ওই সংগঠনে কাজ করত। তখন নীলুর বুড়ির সঙ্গে সেই সম্পর্ক। মেয়েটি কাজকর্মে দক্ষ। ও নীলুকে পছন্দ করত। বিষয়টা যেন আর না গড়ায় তাই নীলু রিনাকে বুড়ির কথা বলে। রিনা বোধ হয় এই অসম সম্পর্ক টিকবে না বলে অনুমান করে। নীলুর সংগ ধরে থাকে। নীলু ওকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। তারপর বুড়ির সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ পড়লে ওর বিয়ে হয়ে গেলে রিনার সঙ্গে নীলুর সম্পর্কটা গড়ে ওঠে। দুজনে একসঙ্গে কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়। নীলু ভাবে ওর সঙ্গে বিবাহিত জীবনটা গড়ে তুলবে যেটা দুজনকে সংগঠনের কাজে সাহায্য করবে। কিন্তু এম এ পরীক্ষায় রিনা খুব ভালো ফল করে। বিদেশে গিয়ে পড়াশুনা করার জন্য স্কলারশিপ পায়। সে সেটা গ্রহণ করে। বিদেশে যাওয়ার পর কিছুদিন দুজনের মধ্যে চিঠিতে যোগাযোগ থাকে। রিনা ওখানে ডক্টরেট করে চাকরি পায়। আর দেশে ফেরে না। শোনা যায় ও পিএইচডির গাইডকে বিয়ে করে অক্সফোর্ডের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে। আর নীলু এখানে বুড়ির স্মৃতি নিয়ে আর সংগঠন নিয়ে দিন যাপন করছে। রিনার পাট চুকে যায়।
নীলুর চিন্তাজগতে একটা বিষয় বার বার ঘুরে ফিরে আসে। এই নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা বন্ধুদের সঙ্গে বিবাদ হয়। প্রশ্ন জাগে এই সংগঠনের কাজ দেহব্যবসায়ীদের কতদূর সাহায্য করতে পারে? নীলুর মনে হয় এই পিছিয়ে পড়া সমাজে বঞ্চিত বিচ্ছিন্ন মেয়েদের মধ্যে একটা অধিকার বোধ জাগিয়ে তোলা যায় এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন সরকারি সুবিধা আদায় করা যায়। এদের সন্তানদের সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। নীলু মনে করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটা করা যায়। শান্তিপূর্ণ পথে আন্দোলনকে অস্বীকার করা যায় না। সীমাবদ্ধতা থাকলেও গণতন্ত্রের পরিসরে এটা করা প্রয়োজন। আবার অনেকে মনে করে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নেওয়া যায় না। নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের পথে এই সংগ্রাম একটা সমঝোতার পথ মাত্র। সমাজ পরিবর্তনের লড়াই ছাড়া এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নেই। শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে একে যুক্ত হতে হয়। কিন্তু দেহ ব্যবসায়ীরা শ্রমিক শ্রেণী নয় তাই তাদের লড়াইকে ঠিক শ্রেণীসংগ্রাম সেটা সঠিক অর্থে বলা চলে না যদিও এটা শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু এক শ্রেণীর দ্বারা অন্য এক শ্রেণীকে উৎখাতের লড়াই এটা নয়। এই নিয়ে বিতর্ক চলে।
এখানে কর্মসূত্রে নীলুর দেবুর সঙ্গে আলাপ। পুরো নাম দেবকুমার সেন। নীলুর সমবয়সী। এক অদ্ভুত মানুষ। ওর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কৌতূহল থাকলেও নীলু এখন আর জানতে চায় না। প্রথম প্রথম নীলু জানতে চাইলেও ও সেটা এড়িয়ে যেত। যেন বিষয়টা অনভিপ্রেয় দেবুর কাছে। ও অনেকটা ভবঘুরে মানুষ। বলা চলে এক পরিব্রাজক। সারা ভারত ঘোরা।ভারতের কোন অঞ্চলে কাদের বাস তা যেন নখদর্পনে। বেশ কয়েকটা ভাষা তার রপ্ত। দলিতদের আদিবাসীদের জীবনের নানা বিষয় নিয়ে যখন আলোচনা করে তখন যেন নীলুর পরিচয় ঘটে যায় যাদের সম্বন্ধে আলোচনা ও করে সে মানুষগুলোর সঙ্গে। তাদের জীবন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও জানে। যা জানে তার থেকেও ভালোভাবে তাদের উপস্থিত করে আলোচনায়। তাদের জীবনযাপন খাদ্যাভ্যাস শিক্ষা প্রাপ্তির সুযোগ সুবিধা পারস্পরিক সম্পর্ক তাদের সুখ দুঃখ সবই উঠে আসে আলোচনায়। নীলু এক গভীর জীবন বোধের স্পর্শ পায় যার কিছুটা হলেও ও পেয়েছিল সুন্দরবনে দাদুর গ্রামে। মনে হয় বিভিন্ন অঞ্চলের গরিব মানুষের জীবন যেন একটা অক্ষ ধরে পরিক্রমা করে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। আর রুটি রুজি আর্থিক বৈষম্য ধরেই যেন এই অক্ষ পথ। নীলুর মনে পড়ে বুড়ি আর দারিদ্রক্লিষ্ট একটা নিম্নবর্গের পরিবারের কথা। বুড়ি এখন কোথায় কি করছে ওর জানা নেই। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর সংসার কি ভাবে চলছে কে জানে। ওর দাদাদের সঙ্গে নীলুর পরিচয় নেই। তবে শুনেছে এক দাদা বেপাত্তা। তবে বুড়িদের সংসারের হাল এখন কে ধরেছে জানা নেই। হয়তো এখানেই কোথাও বুড়ি কারো বাড়িতে কাজ করে সুন্দরবনের ওই পরিবারের অন্ন সংস্থান করে। যে আদিবাসী মেয়েদের কথা দেবু বলে তাদেরই মত।
এই মানুষটার নেশা যেন কিছু সময় ধরে একটা অঞ্চলে থেকে সেটা চেনা হয়ে গেলে নতুন অঞ্চলে যাওয়া। বোধ হয় ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে হাজির হয়েছে। ও নিজেই বলেছে যে এখানে দেহ ব্যবসায়ী মেয়েদের জীবন সম্পর্কে ও জানতে চায় যেটা এখনও ওর অজানা। সেইজন্য নীলুদের সাহায্য ওর দরকার। এখন দেবু নীলুদের সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। নীলু লক্ষ্য করেছে যে ওর যে থাকার জায়গা এখানে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে সেখান থেকে ও খুব একটা বেরোয় না। আর খুব অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত হয়ে গেছে এখানকার মেয়েদের সাথে আর তাদের সন্তানদের সাথে। সংগঠনের পরামর্শ নিয়ে বাচ্চাদের জন্য স্কুলটার দায়িত্ব নিয়েছে। ওখানে ও শিক্ষক একই সঙ্গে পরিচালক। অন্য যারা পড়াতে আসে তাদের দেখভালের দায়িত্বও ওর ওপর। এ হেন একটা মানুষ যেন এ ধরণের সংগঠনের সম্পদ। দেবুর সঙ্গে কথা বলতে বসলে কথা যেন শেষ হয় না। নানা কথার মধ্যে উঠে আসে সংগঠনের কথা গরিবমানুষের মূল সমস্যার কথা। দেবু নীলুকে বোঝায় একটা ব্যবস্থার সঙ্গে কিভাবে মানুষের রুটি রুজির প্রশ্ন জড়িত তাদের শিক্ষা দীক্ষা সংস্কৃতি জড়িত। এমন কি যে দেহ ব্যবসায়ীদের জীবন নিয়ে ওদের ভাবনা সেটাও একটা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। এই প্রসঙ্গে এই মেয়েদের অধিকার তার জীবন জীবিকা কিভাবে জড়িত আছে ব্যবস্থাটার সঙ্গে সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা উঠে আসে সংস্কারের সঙ্গে ব্যবস্থা বদলের সম্পর্ক নিয়ে। দেবু বলে ব্যবস্থাটা চায় কিছু সুযোগসুবিধা আদায়ের মধ্যে যেন অধিকারের দাবির লড়াইটা সীমাবদ্ধ থাকে। এর বাইরে যেন সমাজ বদলের দাবিটা না ওঠে। নীলুর মনে হয় দেবু যেন কার্ল মার্কস সমাজ বদলের যে কথা বলেন সেটাই বলতে চায়। তবে মার্কসের কথা কথায় কথায় তোলে না। এসব বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্ক হয় না সেটা নয়।
নীলু মধ্য কলকাতায় একটি নিষিদ্ধ পল্লীতে সংগঠনের কাজ করে। ওদের আন্দোলন গতি পেয়েছে। দেহব্যবসায়ীদের নানা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এখন নতুন করে তাদের ছেলেমেয়েদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া তাদের মূল স্রোতের শিক্ষাব্যবস্থায় যে কোন প্রতিষ্ঠানে বিনা খরচায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেবার দাবি ওঠে। এতদিন ওদের জন্য পৃথক কয়েকটা স্কুলে দায়সারা ভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাকে সার্বজনীন করার দাবি ওঠে। দেহ ব্যবসায়ীদের ছেলেমেয়েদের জন্য সব শিক্ষার দুয়ার খুলে দেবার দাবি তোলা হয়। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ না দিলে তাদের সামাজিক স্বীকৃতি কার্যত অস্বীকার করা হয়। এ ব্যাপারে হাওড়ার একটা নিষিদ্ধ পল্লীতে ফুলকি নামে এক মহিলার নেতৃত্বে আন্দোলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওদের সঙ্গে একত্রে নীলুরাও নিজেদের কর্মস্থলে আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়। যে ব্যাপারে ফুলকির সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব পড়ে নীলুর ওপর। ফুলকিকে নীলু চেনে না। শুনেছে ও নাকি খুব ভালো সংগঠক। নিজে একজন দেহ ব্যবসায়ী ছিলেন এখন সর্বক্ষনের সংগঠক। নীলু হাওড়ায় নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় দেবুকে। ঠিকানা ধরে ফুলকিকে খুঁজে পায়। যে নিয়ে যায় সে ফুলকির দরজায় নীলুদের পৌঁছে দেয়। নীলু দরজায় কড়া নাড়ে। এক মহিলা দরজা খুলে দাঁড়ায়। সুন্দর ছিমছাম চেহারা। দেখেই নীলু চেনে। সেই বুড়ি দাঁড়িয়ে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। অবাক হয় নীলু। ও এখানে ! ওর মনে পড়ে বুড়ি বলেছিল শ্বশুর বাড়ি থেকে রেহাই পাবার জন্য আর সংসার খরচ টানার জন্য ও কলকাতায় কোন কাজ ধরবে। তবে এটাই কি এই সেই কাজ। কে এর সন্ধান দিল ! বুড়িও নীলুকে চেনে। একটু শ্লেষের ভঙ্গিতে বলে: কি তুমি? পরস্ত্রীর দুয়ারে !
নীলুর মনে পড়ে সেই পুকুর ঘাটে যখন শেষ দেখা। বুড়ি তাকে তার দুরবস্থা থেকে বাঁচাতে অনুনয় করেছিল তাদের পরস্পর সম্পর্কের দাবিতে। নীলু সেই সম্পর্ককে মূল্য দেয়নি l তখন সে বুড়িকে বলেছিল বুড়ি পরস্ত্রী। তাকে সে কিভাবে সাহায্য করবে? আইনে আটকাবে। নীলু বোঝে আজ সঠিক মুহূর্তে সঠিক জবাবটা দিয়েছে বুড়ি। আজ এটা তার প্রাপ্য। সে রাগ করে না। বরং বুড়ির প্রতি অনুরাগে যেন সিক্ত হয়। হাসতে হাসতে বলে,
"আমাকে বসতে দেবে তো? অনেক কিছু আলোচনার আছে। তুমিই তো ফুলকি? তোমার সঙ্গে সংগঠনের হয়ে কথা বলতে এসেছি।" এরই মধ্যে ও লক্ষ্য করে বুড়িকে শেষ দেখায় যে বুড়িয়ে সে দেখেছিল সেটা আজ আর নেই। শরীরে মাংস লেগেছে। মুখে চাকচিক্য। সে যেন কোন এক যৌবনের বুড়ি।
ওদের সামনেই দেবু দাঁড়িয়ে। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কথায় এত ব্যস্ত যে ওরা দেবুর কথা ভুলে যায়। বুড়ির সম্বিত ফিরতেই ও মাথা তুলে দেবুর দিকে দেখে। আর এক বিষ্ময় যেন ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। অবাক হয়ে তাকায়। দেবু ইশারায় জানায় ও যেন ওদের ঘরে নিয়ে ঢোকে। তখনও নীলু দ্বিতীয় বিষ্ময়টা বোঝে না।
ফুলকি নীলুদের নিয়ে ঘরে বসে। ভেতরে গিয়ে দেবুর দিকে তাকিয়ে বলে :
------ তুই এখানে? দেবু বলে:
------ আমারও তো একই প্রশ্ন ।
ওদের মধ্যে কথা আর বিশেষ এগোয় না। নীলু পরস্পর সম্বোধন শুনেই বোঝে ওরা ভাই বোন। নীলুকে না চিনলেও এই হারিয়ে যাওয়া দাদার কথা শুনেছে। আজ বুঝলো ওই কানু।
কে কেমন আছে জানতে চেয়ে কথা শুরু হয়। বুড়ি জানায় বছর বারো তের হল সে এখানে আসে। এক দালাল চাকরি দেবে বলে আনে। তবে চাকরি নয় এই ব্যবসার সুযোগ করে দেয়। আর এই ব্যবসার আয়ে এতদিন তার সংসার চলত। নিজের হেসে খেলে চলে যায়। এখন বাড়িতে রোজগেরে কেউ নেই। বুড়িকে সংসারের খরচ পাঠাতে হয়। বুড়ি ফুলকি নামে এখানে এখন এই মেয়েদের সংগঠক। নিজে দেহ ব্যবসার কাজ ছেড়ে দিয়ে এই সংগঠন নিয়েই আছে। মেয়েদের দেখাশোনা করে। এখান থেকে ও আর বাড়ি ফেরে না। আর সমাজে সে এখন ব্রাত্য । সন্মান নিয়ে থাকতে পারবে না। সব শুনে নীলু বলে:
''তুমি আমার সঙ্গে চল। এখন আর তুমি পরস্ত্রী নও। এই সংগঠনে কাজ করে আমি অনেক শিখেছি। জেনেছি কে পরস্ত্রী আর কে নিজের স্ত্রী। তুমি চল আমার সঙ্গে থাকবে। দুজনেই সংগঠনের কাজ করব।" কানুর উপস্থিতি দুজনের মধ্যে কোন বাধা হয় না। আর লুকোনোর কি থাকে এদের ক্ষেত্রে। জীবিকার দৌলতে সবই যেখানে উলংগ।
নির্দ্বিধায় বুড়ি বলে:
"সেটা আজ সম্ভব নয়। আমি জানি এই মেয়েদের আমি মুক্তি দিতে পারব না। কিন্তু ওদের ছেড়ে চলে গেলে আমার বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। এখানে আমি স্বাধীনভাবে সম্মানের সঙ্গে আছি। আর এই মেয়েরা এদের ছেলেমেয়েরা আমাকে যে সন্মান দেয় সে সন্মান স্বীকৃতি আমি কোনদিন তোমাদের সমাজে পাই নি, পাব না। তাছাড়া আমার মেয়ে আমার সঙ্গে এ বাড়িতে। ও এখন সমাজের অন্ধকার জগতের মেয়ে। স্কুলে পড়ে। তবে ওকেও সমাজ গ্রহণ করবে না। না চাইলেও জীবিকার জন্য এই ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার দরকার হতে পারে। আর বলত শ্বশুর বাড়িতে বউয়ের পরিচয়ের আড়ালে আমি কে ছিলাম ! একজন বিনা পয়সার বান্দি যাকে দাসী ছাড়া কিছুই বলা যায় না। ক্রীতদাসকেও পয়সা দিয়ে কিনতে হয়, দেহ ব্যবসায়ীকে দেহের সেবা দেওয়ার বিনিময়ে পয়সা দেওয়া হয়। কাজের লোককে মাইনে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাকে কিছু না দিয়ে সব করিয়ে নেওয়া হত। নামে মাত্র বাড়ির বউ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক দুশ্চরিত্র লম্পটকে দেহ দিতে হত। সেটাও কার্যত এক ধরণের ধর্ষণ। এমন কি তোমার সঙ্গে বিয়ে হলেও তোমার বাড়ি আমাকে কি দিত? আজ সমাজ আমাকে যাই বলুক আমি জানি আমি আমিই। আমার নিজস্ব সত্তা আছে। এমনকি খোদ্দেররাও আমাকে সমীহ করে। আর মেয়েদের মুক্তির জন্য আন্দোলনে নেমেছি। জানি এই ব্যবস্থার বদল না হলে এদের মুক্তি সম্ভব নয়। তবে সেতু বানাতে কাঠবেড়ালির কাজটা তো করতে পারি।"
সব শুনে নীলু থ বনে যায়। জীবন সম্বন্ধে কি গভীর বোধ। মেয়েদের অধিকার তাদের সম্মানের সম্পর্কে এ কি প্রত্যয় ! আর সবটাই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া। কথা না বাড়িয়ে কিছুটা সংগঠনের কথা কিছুটা আন্দোলনের কথা বলে ফেরার জন্য নীলু উঠে দাঁড়ায়। মনে হয় দুজনের মধ্যেকার এতদিনের অসম সম্পর্ক যেন সমতা অর্জন করেছে। আজ সত্যিকারের সামাজিক মর্যাদার নিরিখে দুজনে একই আসনে। কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াইয়ের ময়দানে। সেখানেই তাদের প্রেমের সার্থকতা। একজন আরেকজনকে চিনে নেওয়া। কানুও এখানে যা জানার জন্য এসেছে তার বেশ কিছুটা জানা হয়ে যায় বোনের জীবন জীবিকার কথা শুনে।
-------------------
সমাপ্ত