দেবযান : চল্লিশ পেরিয়ে
অরবিন্দ পুরকাইত
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে উৎপল দত্তের সম্পাদনায় 'দেবযান' সাহিত্য পত্রিকার 'চল্লিশ পেরিয়ে' সংখ্যা (৪০-৪১তম বর্ষ, ২০২২—২৩)। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ছাড়াও রয়েছে দেবযান-এর ভাবনা-সূচনা থেকে তার যাত্রাপথকে ফিরে দেখার আয়োজন। 'যেনো মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা। তখন লেটার প্রেসের যুগ। জিঙ্কের আধারে চিমটে দিয়ে একটা একটা অক্ষর গাঁথা হচ্ছে আর আমরা অবাক হয়ে দেখছি। সারাদিন বসে। কখন মেশিনে চড়বে এই অক্ষরমালা আর ছেপে বেরিয়ে আসবে আমাদের নিজেদের লেখা। এমনও হয়েছে, এতো কষ্ট করে গাঁথা কথামালার বন্ধন মেশিনে চড়ানোর সময় গোটাটাই ভেঙে পড়ে গেলো। যিনি গেঁথেছেন, তিনি নির্বিকার। কিন্তু, আমাদের মনে হতো বুঝি আমাদের হৃদয়ই ভেঙে পড়লো। আবার গাঁথা আবার মেশিনে চড়ানো। এইভাবে এতোগুলো বছর কিভাবে যে পেরিয়ে এলাম!'— 'সম্পাদকের কলম'-এ লিখেছেন শ্রী দত্ত। আমরা জানি সন্তোষকুমার দত্তের সম্পাদনায়— লিটল ম্যাগাজিনের চলার সচরাচর স্বভাব অনুযায়ীই— প্রায় তিন দশক সুনামের সঙ্গে চলেছে দেবযান। বছর চারেক বিরতির পর তার পুনর্যাত্রা শুরু হয় তাঁর পুত্রের হাতে, যিনি এ পত্রের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টাও। তো সেই দেবযান-এর ভাবনা যে দুই বন্ধুর মধ্যে প্রথম উদয় হয়, বর্তমান সম্পাদক ছাড়া সেই দ্বিতীয় স্বপ্নসন্ধানী প্রদীপ দাসের "ত্রৈমাসিক 'দেবযান' / উৎস পথের রূপরেখা" শীর্ষক এ সংখ্যার সর্ববৃহৎ লেখাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখাটি সম্বন্ধে এখানে বেশি কিছু বলার নয়, কেবল এইটুকু বলি যে দেবযান-কেন্দ্রিক আলোচনার বৃত্তে এই লেখাটির আসন পাকা হয়ে গেল। সলতে পাকানো এবং দীপ্যমান থাকার বেশ কিছু কথা এই প্রথম কিঞ্চিৎ বিশদভাবে প্রকাশ পেল। সাড়াজাগানো এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী 'কল্লোল', 'কালি-কলম' ও 'প্রগতি'র আয়ুস্বল্পতা উল্লেখ করে লিখেছেন শ্রী দাস, "তুলনায় না গিয়েও বলতে পারি দেবযানের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় নি, একমাত্র সন্তোষদার জন্যই। প্রথম দিকে আমাদের সঠিক নির্বাচনকে তাই বাহবা দিতেই হয়। নিজেরাই নিজেদের কুর্নিশ জানালেই বা মন্দ কি? এত কিছুর পরেও তাই আজও আমরা (আমি, উৎপল) ভাবতে পারি এই 'দেবযান' আমাদের সেই স্বপ্নের 'দেবযান'। 'দেবযান' একান্ত ভাবেই আমাদের সকলের। 'দেবযান' সন্তোষদার। শুধুমাত্র 'দেবযান'স্বপ্নে বিভোর হয়ে উৎসপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন অনেকটা পথ চলে এসেছি।" জয়দীপ চক্রবর্তী "'দেবযান', স্পর্ধার চল্লিশ বছর" শীর্ষক লেখায় লিটল ম্যাগাজিনের— যাকে 'সমান্তরাল পত্রিকা' বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি— ধরনধারণ উল্লেখের মাধ্যমে সম্পাদক হিসাবে সন্তোষকুমার দত্তের আপসহীনতা এবং চাটুকারিতাকে পাত্তা-না-দেওয়া মনোভাব, প্রবীণ থেকে নবীনদের লেখা প্রকাশ করলেও মনোনয়নে মান বজায় রাখায় মনোযোগিতা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটিকে বর্তমান সম্পাদকের দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উল্লেখ করেছেন। গৌতম মণ্ডল শুনিয়েছেন "'সুচেতনা'ও 'দেবযান' সম্পর্কের রজতজয়ন্তী প্রসঙ্গে দু'কথা"। সুচেতনা-পত্রে সন্তোষকুমারের লেখাজোখা-সাক্ষাৎকার, সুচেতনা-র প্রকাশ-অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি-ভাষণদান ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে লেখাটিতে, বর্তমান সময়ে লিটল ম্যাগাজিন 'সজীব-সচল রাখা কতখানি কঠিন' তার উল্লেখ-সহ। সন্তোষকুমার দত্তকে মাতুলজ্ঞানে সম্মান ও সম্বোধনকারী পুরঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাঁর "'দেবযান' ও প্রাবন্ধিক সন্তোষকুমার দত্ত" লেখায় অতি সংক্ষেপে শ্রী দত্তের সাহিত্যের উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে প্রবন্ধসাহিত্য প্রসঙ্গে কিছু কথা ও সন্তোষকুমারকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে যোগ্য সম্মান না-দেওয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। আজ পর্যন্ত প্রকাশিত দেবযান-এর একটিও সংখ্যা যাঁর অপঠিত থাকেনি, প্রবীণ সেই রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও দেবযান-এর ঘরে বেড়ে-ওঠা নবীন অনুরাগ দত্তের লেখা ভাল লেগেছে। এ সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছে এ পত্রের প্রথম সংখ্যা থেকে 'প্রধান সম্পাদকের প্রতিবেদন'। হরেক কর্মের অভিজ্ঞতাঋদ্ধ, ঋজু মেরুদণ্ডের অধিকারী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 'রূপদর্শী' গৌরকিশোর ঘোষকে নিয়ে শঙ্করপ্রসাদ নস্করের 'সাংবাদিক কথাশিল্পী গৌরকিশোর ঘোষ (সাম্প্রতিক সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে)' লেখাটি মূল্যবান। বিশেষত বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে। লেখাটির শুরুতে গৌরকিশোরের জন্মসাল ১৯২২-এর জায়গায় ১৯৩২ হয়ে গেছে ছাপার ভুলে। মধুসূদনকে নিয়ে সম্পাদকের 'আগুনের দিকে পতঙ্গের মতো এক উচ্চাকাঙ্খী কবি' লেখাটি এক কথায় অনবদ্য। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সাবলীল গতিতে তরতরিয়ে পুরো জীবনবৃত্তটি চমৎকার তুলে ধরেছেন তিনি যথাযথ মূল্যায়নে। কবিতা কয়েকটি বেশ ভাল লেগেছে— অমল কর (রোদের পৃথিবী), বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (স্বপ্নদোষ), হাননান আহসান (ভাঙার খেলা), আনসার উল হক (রোদ খেয়েছে চাঁদের আলো), শান্তিব্রত চট্টোপাধ্যায় (চিরন্তন ভিসা), সত্যব্রত চক্রবর্তী (তবুও পৃথিবী সুন্দর), কাশীনাথ ভট্টাচার্য (লোভ হয়), সুনীল দাস (সে যত আমার পথ), প্রিয়জিৎ ঘোষ (গীতবিতান), শুক্লা চট্টোপাধ্যায়ের (আলোর ভুবনে এসো)। সাগর চট্টোপাধ্যায়ের 'দ্য বার্থ ডে/জন্মদিন' ও আশীষ আদিত্যর 'নিঃসঙ্গতা' নামের গল্প মোটামুটি ভাল লাগল।
উৎপল দত্তের প্রচ্ছদ স্মৃতি-সহযোগী। প্রুফ-দেখা আরও মনোযোগ ও সময় দাবি করছে।
পত্রিকার নাম : দেবযান
সংখ্যা : চল্লিশ পেরিয়ে, ৪০-৪১তম, ২০২২—২৩
সম্পাদকের নাম : উৎপল দত্ত
প্রকাশস্থল : বৈদ্যপাড়া রোড, ডাক— বারুইপুর, জেলা— দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
মূল্য— একশো টাকা।
=================
আলোচক - অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক — গোকর্ণী,
থানা — মগরাহাট,
জেলা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।