গল্প ।। মধুরেণ সমাপয়েৎ ।। দীনেশ সরকার
মধুরেণ সমাপয়েৎ
দীনেশ সরকার
ঘড়ির কাঁটা রাত্রি বারোটা ছুঁই-ছুঁই । রমা পড়ার পাট চুকিয়ে বই-পত্তর গুছিয়ে শোওয়ার ব্যবস্থা করছে । মোবাইলটা বেজে উঠলো । এত রাত্রে কে ফোন করতে পারে ! Unkhown number ! রমা ফোনটা ধরতেই ভেসে এলো ---
'হ্যালো, আপনি রমাদেবী বলছেন ?'
'হ্যাঁ, বলছি ।'
'আপনি ফোনটা কাটবেন না প্লীজ । আপনার সাথে আমার ভীষণ দরকার ।'
'আপনি কে বলছেন ?'
'আমি অনি মানে অনিন্দ্য ব্যানার্জী । কালকে যার আপনাদের বাড়ী যাওয়ার কথা আছে ।'
'ওঃ, আপনি সেই মূর্তিমান । তা এত রাতে আমাকে ফোন করছেন ? কি ব্যাপার ?'
'বড় বিপদে পড়ে এত রাতে আপনাকে ফোন করছি রমাদেবী । আপনাকে বিরক্ত করার জন্য মাপ চেয়ে নিচ্ছি । শুধু আপনিই পারেন আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে । তাই এত রাতে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি ।'
'সে তো বুঝলাম । কিন্তু বিপদটা কি সেটা তো বলবেন ?'
'সেটা বলবো বলেই তো আপনাকে এত রাতে ফোন করেছি । শুনুন না, কাল তো আমার আর আমার মায়ের আপনাকে দেখতে যাওয়ার কথা আছে । দেখাশোনার পরে আপনি শুধু বলবেন আপনার পাত্র পছন্দ হয় নি ।'
'কেন, আমি কেন মিথ্যা বলবো ? আপনার ছবি দেখে তো আমার খুব পছন্দ হয়েছে । হ্যান্ডস্যাম, ভালো কোম্পানিতে ভালো চাকরি করেন । বিয়ের বাজারে লোভনীয় পাত্র । তারচেয়ে আপনি আমাকে দেখে আপনার মাকে বলে দেবেন, আপনার পাত্রী পছন্দ হয় নি ।'
'না-না-না, তা কি করে হবে । রমলা মাসির ভাসুরের ছেলের বিয়েতে আমার মা আপনাকে দেখেই তো পছন্দ করে বসে আছে । তাই তো রমলা মাসিকে দিয়ে আপনাদের বাডিতে খবর পাঠিয়েছে । আপনাদের মোবাইল নাম্বার নিয়েছে । ওই বিয়েতে আমারও যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু ওই সময় অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছিলো তাই যেতে পারিনি । তাছাড়া আপনার ছবি মা আমাকে দেখিয়েছে । ভালোই তো ।'
'তা হলে সমস্যাটা কোথায় সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না । কেন আমাকে বলতে বলছেন পাত্র পছন্দ হয় নি ?
'কারণ, এই বিয়েটা আমি করতে চাই না ।'
'তা সেটা খোলাখুলি আপনার মাকে বললেই তো ল্যাটা চুকে যায় ।'
'আপনি যত সহজ ভাবছেন, ব্যাপারটা অত সহজ নয় । মায়ের মুখের উপর কোনো কথা আমি বলতে পারি না । মাকে আমি কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চাই না । খুব ছোটবেলায় একটা দুর্ঘটনায় আমি বাবাকে হারিয়েছি । বাবা ছিলেন হাই স্কুলের টিচার । স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রাকের ধাক্কায় বাবার মৃত্যু হয় । তারপর শুরু হয় মায়ের জীবন সংগ্রাম । বাবারই স্কুলে পিয়নের চাকরি করে আমায় বড় করে তুলেছে । পড়ার বাইরে আমাকে কোনোদিন কিছু করতে দেয় নি । তাই তো আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি । একটা নামী কোম্পানীর সেলস্ ম্যানেজার হতে পেরেছি । তাই মাকে আমি কোনোদিন কষ্ট দিতে পারবো না ।'
'সে তো বুঝলাম । কিন্তু এই বিয়েটা না করার কারণ কি অন্য কোনো মেয়ের সাথে মেলামেশা আছে । তা সেটা তো আপনার মাকে বললেই হয় । উনি ঠিক বুঝবেন ।'
'আরে না-না-না, সে সব কিছু না । আমি বরাবরই মেয়েদের থেকে একটু দূরে দূরেই থাকি । আর আমার মতো ভীতুর কাছে কোন্ মেয়ে এসে আলাপ করবে বলুন ।'
' আপনি ভীতু ! হি-হি-হি ---'
' আপনি হাসছেন যে ।'
'হাসবো না ? ফটো দেখে তো আপনাকে স্মার্ট, হ্যান্ডস্যাম লাগে । কোম্পানির সেলস্ ম্যানেজার । আর আপনি বলছেন ভীতু !'
' আপনি হাসবেন না প্লীজ । দেখুন, আমার কোম্পানীর কাজের ব্যাপারে আমি ১০০ শতাংশ ফিট । কিন্তু ওই মেয়েদের ব্যাপারে আমি ভীষণ ভীতু ।'
' ঠিক আছে । বিয়ের পরেই না হয় সাহসী হবেন ।'
'আপনি মজা করছেন ?'
' ছিঃ ছিঃ ছিঃ মজা কেন করবো । ছেলেরা বিয়ের পরে বৌয়ের পাল্লায় পড়েই তো সাহসী হয় ।'
'উঃ, আমি ঠিক আপনাকে বোঝাতে পারছি না । শুনুন না, আপনাকে আমি বন্ধু মনে করে খুলেই বলছি । প্লীজ, আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচান । শুনুন না, বিয়ের কথা ভাবলে আমার কেমন হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় । ভীষণ নার্ভাস লাগে । কত দায়-দায়িত্ব । আমি যদি দায়-দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে না পারি । তার উপর দোকান-বাজার করা । এটা আনো রে ওটা আনো রে । ওসব আমি পারবো না । তারচেয়ে এই ভালো আছি । পড়াশুনা আর অফিস ছাড়া আমি আর কিচ্ছু জানি না । আমি কোনোদিন কোনো দায়িত্ব পালন করি নি । যা করার সব আমার মা-ই করে । ও সব দায়িত্ব-টায়িত্ব পালন করতে আমি পারবো না । বিয়ের কথা ভাবলে আমার হাতে –পায়ে ঘাম ঝরে । তারপর ধরুন যাকে বিয়ে করবো, সে যদি আমার মা-কে অসম্মান করে, আমার মা-কে তার যোগ্য সম্মান না দেয় । আমি এ সব সহ্য করতে পারবো না । আমার মা-ই আমার সব । মায়ের অসম্মান আমি কোনমতেই মেনে নিতে পারবো না । তার ওপর কোম্পানীর কাজে মাঝে মাঝে আমাকে বাইরে যেতে হয় । যাকে বিয়ে করবো সে যদি এসব মেনে নিতে না পারে । তাই প্লীজ, এ বিয়েটা আপনি cancel করে দিন ।'
'আচ্ছা আপনি যাকে বিয়ে করবেন সে আপনার মাকে অসম্মান করবে, এটা ধরে নিচ্ছেন কেন ? উল্টোটাও তো হতে পারে ।'
'তা হতে পারে । কিন্তু যদি না হয়, তখন আমি কি করবো ।'
'কিন্তু আপনার মা তো চিরদিন থাকবেন না, তখন আপনাকে কে দেখাশোনা করবে ?'
'তখনকার চিন্তা তখন করা যাবে । এখন তো আপনি আমাকে বাঁচান । প্লীজ রমাদেবী, আমাকে এখন বাঁচান । এই দেখুন না আমার হাত-পা দিয়ে কেমন ঘাম ঝরছে । আপনাকে বন্ধু ভেবে এতগুলো কথা বললাম । প্লীজ—প্লীজ ।'
' হুঁ, কথা দিতে পারছি না । চিন্তা করে দেখি ।'
'প্লীজ—প্লীজ । Good night.'
'Good night.'
পরের দিন রাত্রি বারোটা নাগাদ আবার রমার মোবাইল বেজে উঠলো । রমা শান্ত গলায় বললো
'হ্যালো ।'
'হ্যালো রমা দেবী, আমি অনি বলছি । ঘুমাচ্ছিলেন নাকি ।'
'না ঘুমাই নি । কি বলবেন বলুন ।'
' আপনি ওভাবে কথা বলছেন কেন । আপনার শরীর খারাপ না কি ।'
'না-না, শরীর ঠিক আছে । মনটাই ঠিক নেই । কি বলবেন বলুন ।'
'জানেন রমা দেবী আপনাকে thank you না বলে আমি রাত্রে ঘুমাতে পারছি না ।'
'তা কি জন্যে thank you ? '
'বাঃ, আপনি আমার এতবড় উপকার করলেন, আমাকে বন্ধুর মতো বিপদ থেকে বাঁচালেন আর আপনাকে আমি thank you জানাবো না ।
' ওঃ, খবরটা তাহলে আপনার কাছে পৌঁছে গেছে ।'
'একটু আগে মা গম্ভীর মুখে বলে গেল, তোর রমলা মাসি ফোন করেছিলো । এ বিয়ে হচ্ছে না । জানেন রমাদেবী, খবরটা শুনে না আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না । তাই তো এত রাত্রে আপনাকে ফোন করলাম । আনন্দ হলে আগে বন্ধুকে জানাতে হয় না । আপনাকে যে আমি আমার বন্ধু বলে মনে করি । রমাদেবী, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, যদি অভয় দেন ----'
'কি, বলুন ।'
'না, বলছিলাম কি যেখানে আমার মা রাজী, আপনার বাবা-মা, দিদি-জামাইবাবু রাজী, সেখানে বিয়েটা আপনি কি করে cancel করলেন ?'
'এর জন্য আমাকে অনেক অপ্রিয় কথা শুনতে হয়েছে, অনেক অশান্তি হয়েছে । তাই তো মন মেজাজ ঠিক নেই । আপনারা চলে যাওয়ার পরে মা–বাবা যখন আপনার গুনকীর্তনে ব্যস্ত তখন আমি বোমাটা ফাটালাম ।'
'বলেন কি ?'
'আমি বললাম, আমি এখন বিয়ে করবো না । সামনে আমার M. A. পরীক্ষা । ভালো করে পরীক্ষা দেবো, তারপর Ph.D. করবো । নিজের পায়ে দাঁড়াবো, তারপর বিয়ের কথা ভাববো । মা তো রেগে আগুন, বললো, সেদিন যখন তোকে ফটো দেখালাম, তখন তো তুই একথা বলিস্নি । তখন তো অমত করিস্নি । তখন অমত করলে আমরা আর এগোতাম না । যখন দুপক্ষের দেখাশোনা হয়ে গেছে, কথাবার্তা হয়ে গেছে, শুধু দিনস্থির করতে বাকি তখন তুই বলছিস্ বিয়ে করবি না । আমি বললাম, বিয়ে তো আর হয়ে যায় নি । তখন বলিনি কারণ আমি অত ভাবিনি । এখন আমি ভেবে দেখলাম আগে নিজের পায়ে দাঁড়ানো তারপর বিয়ে । তাই আমি এ বিয়ে করতে পারবো না । মা তো রেগে গজ-গজ করতে লাগলো । বললো, আমি তোর রমলা পিসির কাছে মুখ দেখাবো কেমন করে ! যা বলার ফোন করে তুই রমালা পিসিকে বলবি । আমি বললাম, ঠিক আছে, তোমাদের কাউকে কিচ্ছু বলতে হবে না । রমলা পিসিকে যা বলার আমি বলছি । দিদি আমাকে অনেক বোঝালো, দেখ, এতভালো ছেলে সচরাচর পাওয়া যায় না । তার উপর পরিচিতের মধ্যে । রমা, তুই রাজি হয়ে যা । এ বিয়েতে অমত করিস্ না । আমি বললাম, নারে দিদি, আমি এখন পড়বো । এখন আমি বিয়ে করতে পারবো না ।'
'আপনার রমলা পিসি মানে আমার রমলা মাসিকে আপনি ফোন করলেন ?'
'না করে উপায় কি বলুন । আপনার জন্য আমাকে তাও করতে হলো । নিজের মুখে নিজের বিয়ে ভাঙার কথা রমলা পিসিকে বলতে হলো । রমলা পিসি শুনে রেগে গিয়ে আমাকে যাচ্ছেতাই করে গালি-গালাজ করলো । আমাকে কি বললো শুনবেন ? বললো, এত ভালো সম্বন্ধ নিয়ে এলাম, তাও তোর পছন্দ হলো না । তোর কপালে কানা-খোঁড়া-কালা ছেলে জুটবে, নয়তো চরিত্রহীন এমন ছেলে জুটবে যে তোকে সারা জীবন জ্বালাবে । আমি যতই বলি, পাত্র পছন্দ, কিন্তু আমি এখন বিয়ে করবো না । আগে নিজের পায়ে দাঁড়াবো তারপর বিয়ে করবো । কিন্তু কে কার কথা শোনে, রমলা পিসি একনাগাড়ে আমাকে যাচ্ছেতাই করে বলতে লাগলো । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, তারপর বললাম, পিসি আমি রাখছি ।'
'ইস্, আমার জন্য আপনাকে এতগুলো খারাপ কথা শুনতে হলো ।'
'এ ছাড়া আর কি উপায় আছে ব্লুন । বন্ধুর জন্য তো এটুকু শুনতেই হয় । যাক্, আপনি খুশি তো ।'
'খুশি, কিন্তু আপনার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । আমার জন্য আপনি সবার কাছে অপ্রিয় হলেন ।'
'কি আর করা যাবে বলুন । যাক্, অনেক রাত হয়েছে । এখন আপনি শান্তিতে ঘুমান । Good night.'
'Good night.'
দিন গড়িয়ে চললো । গঙ্গা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেল । মাস দুয়েক বাদে মাঝ রাত্রে আবার রমার মোবাইল বেজে উঠলো -----
'হ্যালো, রমাদেবী, আমি অনি বলছি ।'
'হ্যাঁ বলছি, ব্লুন ।'
'Sorry, আমি আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালাম । Extremely sorry.'
'না-না সরি বলার মতো কিছু হয় নি । আমি এখনো ঘুমাই নি । কি বলবেন বলুন ।'
'কি বলবো রমাদেবী । আমি আবার বিপদে পড়েছি । আমার মা তার ছেলের বিয়ে দিয়েই তবে ছাড়বেন ।'
'বেশ তো করেই ফেলুন না বিয়েটা । আপনার মা খুশি হবেন ।'
'আপনি মজা করছেন রমাদেবী ।'
'এ মা, মজা কেন । আমি তো ঠিক কথাই বলছি । সব মা-ই তো চায় তার ছেলে বিয়ে করে সংসারী হোক ।'
'কিন্তু, আমি তো আপনাকে বলেছি, আমি কেন বিয়ে করতে চাই না । এই দেখুন না, মা যখন থেকে বলেছে আগামী রোববার মেয়ে দেখতে যেতে হবে, তখন থেকেই আমি কেমন নার্ভাস ফিল করছি । আমার হাত পা দিয়ে ঘাম ঝরছে । তাই তো আপনার কথা মনে পড়লো । আপনি আমার একমাত্র বন্ধু যে আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে । যার সঙ্গে আমি মন খুলে কথা বলতে পারি । এর আগে আপনি আমাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলেন । এবারও আপনাকেই আমাকে বাঁচাতে হবে ।'
'এ ক্ষেত্রে আমি আপনাকে কি করে বাঁচাবো ? সেবার আমি নিজে পাত্রী ছিলাম তাই নিজেকে বলি দিয়ে আমি আপনাকে বাঁচিয়েছিলাম । এখানে আমার কি করণীয় আছে ।'
'অত-শত আমি জানি না । আপনি আমার বন্ধু, তাই বন্ধুর বিপদে আপনাকেই এগিয়ে আসতে হবে ।'
'কি মুশকিল, আমি আপনাকে কি ভাবে সাহায্য করবো ?'
'সে আমি জানি না । আপনি একটু ভাবলেই ঠিক একটা উপায় পেয়ে যাবেন । শুনুন না, আমার মায়ের আর এক বান্ধবী অনুভামাসি এই সম্বন্ধটা এনেছে । পাত্রীর নাম শ্যামলী গাঙ্গুলী । C. U.তে M. A.(Bengali) 1st Year. আপনি M.A.(Bengali) 2nd. Year মানে আপনার থেকে এক বছরের জুনিয়ার ।
ওরা থাকে ২৬/২, মুক্তারাম বাই লেন, কলকাতা ১২ । আপনি যে ভাবেই হোক এই বিয়েটা আটকান । মা এর মধ্যে একদিন আমাকে না বলে অনুভামাসির সঙ্গে গিয়ে শ্যামলীকে দেখে পছন্দ করে এসেছে । অতএব, বুঝতেই পারছেন আমার পক্ষে না বলা আর সম্ভব নয় । রমাদেবী, যা হোক একটা কিছু করুণ । আমি আপনার উপর অনেক ভরসা করে বসে আছি ।'
'ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায় । আমাকে একটু ভাববার সময় দিন । জানি না কিছু করতে পারবো কিনা ।'
'আপনাকে কিছু একটা করতেই হবে । আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতেই হবে । শুনুন, আজ মঙ্গলবার, রোববারে দেখতে যাওয়ার আগেই আপনাকে কিছু একটা করতে হবে । হাতে মাত্র চার দিন সময় । প্লীজ রমাদেবী, আপনি কিছু করুন ।'
'বললাম তো দেখছি কি করা যায় । এখন আপনি ঘুমাতে যান --- Good night.'
'Good night.'
রমা অনেক ভেবেও কিছু ঠিক করতে পারলো না কি করে বিয়েটা আটকাবে । শেষে ঠিক করলো কাল ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে শ্যামলীর সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে । ওকে বুঝিয়ে বললে ও নিশ্চয় অনিন্দ্যর সমস্যাটা বুঝবে । একটা ক্লাস শেষ হতেই রমা শ্যামলীকে খুঁজে বার করে বললো ----
'আমি রমা মুখার্জী ।'
'থাক্-থাক্ । তোমার পরিচয় আর দিতে হবে না । তুমি Cultural Programme এ ভালো গান গাও । University Sports Meet-এ তুমি Champion. তোমার রেজাল্ট ভালো, স্যারেরাও তোমার কথা বলেন । তোমায় কে না চেনে বলো । বলো, কি বলছিলে ।'
'শোন্ না শ্যামলী, তোর সাথে আমার একটু দরকার আছে । নিতান্তই ব্যাক্তিগত । আজ তোর ক্লাস কখন শেষ হবে ?'
' আজ ৩টে ৪৫এ । লাস্ট ক্লাসটা করবো না ।'
'ঠিক আছে । আমরা তাহলে আজ ৩টে ৫০এ কফি হাউসের গেটে মিট করছি । তারপর কফি খেতে খেতে গল্প করা যাবে ।'
আবার প্রায় মাঝ রাতে রমার মোবাইল বেজে উঠলো ।
'হ্যালো রমাদেবী, আমি অনি বলছি । আপনি অসাধ্য সাধন করেছেন । উঃ, আপনাকে যে কি বলবো । আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না ।'
'তা এত আনন্দিত হওয়ার কারণটা কি ?'
'আনন্দিত হবো না ? একটু আগে মা এসে গম্ভীরস্বরে বলে গেল, রোববার মেয়ে দেখতে যেতে হবে না । তখনই আমি বুঝেছি আপনি ঠিক কিছু একটা করেছেন । বন্ধুকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন । বলুন, আনন্দ হবে না ? এই খবরটা আপনাকে না জানাতে পারলে রাত্রে আমি ঘুমাতে পারবো না ।'
রমা বুঝলো ওষুধে কাজ হয়েছে । শ্যামলী বেঁকে বসেছে ।
'যাক্, যখন বিপদ্মুক্ত হয়েছেন, তখন নিশ্চিন্তে ঘুমান ।'
'ঘুমাবো তো । কিন্তু ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে এই অসাধ্য সাধনটা আপনি কি করে করলেন ।'
'কি হবে আপনার জেনে । আপনার বিয়েটা তো আটকানো গেছে ।'
'তবু,জানতে ইচ্ছে করছে ।'
'আজ কফি হাউসে দুজনে কফি খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প-গুজব করলাম । শ্যামলীকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যাতে ও এই বিয়েটা না করে । কিন্তু আপনার অনুভামাসি ওদের বাড়িতে আপনার এমন গুনকীর্তন করেছেন যে শ্যামলী আপনাকে বিয়ে না করে ছাড়বেই না । শেষে আমাকে আমার মোক্ষম অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে হলো ।'
'ঠিক বুঝলাম না । কি করলেন ?'
'যখন বুঝতে পারলাম শ্যামলী কিছুতেই এই বিয়ে থেকে পিছোবে না তখন মোক্ষম চালটা দিলাম । বললাম, অনিন্দ্যর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে । অনিন্দ্য আমাকে ভালোবাসে । এ বিয়ে করে তুই সুখী হতে পারবি ?'
'আমার জন্য আপনি এত বড় একটা বদনাম নিজের ঘাড়ে নিলেন ?'
'কি করবো বলুন । এ ছাড়া তো বিয়ে ভাঙার আর কোনো পথ খোলা ছিল না । বন্ধুর জন্য না হয় একটু বদনামের ভাগীদার হলাম । যাক্ আপনি ঘুমাতে যান । Good night'.
'Good night.'
পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ যখন রমা ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তখন মোবাইলটা বেজে উঠলো-----
'হ্যালো রমাদেবী, আমি অনি বলছি । আপনাকে আমার ভীষণ দরকার । আজ ইউনিভার্সিটি যাচ্ছেন তো ?'
;হ্যাঁ, এই একটু পরেই বেরোবো । কি ব্যাপার বলুন তো ।'
'আজ আপনার ক্লাস কখন শেষ হবে ?'
'আজ ৪-৩০ পর্যন্ত ক্লাস আছে । কি হয়েছে বলবেন তো ।'
'ফোনে সব বলা যাবে না । অনেক সময় লাগবে । আমি এখন অফিসে । আমি ঠিক ৪-৩০ কফি হাউসের গেটে আপনার অপেক্ষায় থাকবো । Bye----'
'Bye.'
এখনও কফি হাউসে তেমন ভীড় জমেনি । ফাঁকা ফাঁকাই আছে । একটা টেবিলে দুজন মুখোমুখি বসলো । অনি কফি আর স্ন্যাকসের অর্ডার দিল । অনিকে কেমন উদভ্রান্তের মতো লাগছে । রমা জিজ্ঞেস করলো ----
'আপনার আজ কি হয়েছে বলুন তো । অমন লাগছে কেন । আপনার মা ভালো আছেন তো ।'
'মা-ও ভালো নেই আমিও ভালো নেই । রমাদেবী, আপনাকে আজ আমার সঙ্গে একটিবার আমাদের বাড়ি যেতে হবে । আমার মাকে একটু বোঝাতে হবে । প্লীজ, আপনি না করবেন না ।'
'আহা, কি হয়েছে সেটা তো আমাকে বলবেন ।'
'আজ সকালে অনুভামাসি ফোনে মাকে খুব অপমান করেছে । বলেছে, তোর ছেলের যখন অন্য মেয়ের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা আছে, তখন আমাকে মেয়ে খুঁজতে বলেছিলি কেন ? আমি এখন শ্যামলীর বাবা-মার কাছে মুখ দেখাবো কেমন করে ! মা তো আকাশ থেকে পড়লো । মা-তো ভাবতেই পারে না তার ছেলের সঙ্গে কোন মেয়ের সম্পর্ক আছে । মা বললো, তুই কি বলছিস অনুভা ? অনুভামাসি আরও তেড়েফুঁড়ে বললো, ঠিকই বলছি । তোর ছেলে যে অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে সেটা তোকে কোনোদিন বলেনি ? তবে শোন্, তোর ছেলে যে মেয়ের সাথে প্রেম করছে সেই মেয়ে কাল কফি হাউসে বসে শ্যামলীকে সব বলেছে । শ্যামলীকে এই বিয়ে করতে নিষেধ করেছে । যা, ছেলেকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর গে যা । আমি অফিসে বের হওয়ার আগে খাওয়ার টেবিলে বসতেই মায়ের রাগ গিয়ে পড়লো আমার উপর, বললো, হ্যারে অনি, আমি কি তোর কোনো কাজে কোনোদিন বাঁধা দিয়েছি ? আমি তোকে বার বার বলেছি তোর যদি কোনো মেয়েকে ভালো লাগে আমাকে বল্, আমি তার সাথেই তোর বিয়ে দেব । তাহলে আমাকে এই অপমানটা হজম করতে হলো কেন ? তোর অনুভামাসি কেন বললো তুই অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছিস্ ? আমি বললাম, মা, এ সব সত্যি নয়, কোনো মেয়ের সাথেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই । কিন্তু মা আমার কোনো কথাই শুনলো না । একেবারে ধনুকভাঙা পণ করে বসলো । মা বললো, তাহলে অনুভা অমন কথা বললো কেন ? আমি সব বুঝেছি । শোন্ আনি, আমি এই অন্ন-জল ত্যাগ করলাম । এ অপমান আমার আর সহ্য হচ্ছে না । তুই যাকে ভালোবাসিস্ সেই মেয়েকে আমার সামনে এনে হাজির করবি তবেই আমি অন্ন-জল গ্রহন করবো । আমারও রাগ হলো, আমি বললাম, তুমি না খেলে আমিও খাব না । আমি উঠে পড়তেই মা বলে উঠলো, অনি, শোন্ বাবা, খাবার ফেলে যাস্ নে বাবা।
'ইস্, আমার জন্য আপনাদের মা-ছেলের মধ্যে এত কান্ড ঘটে গেছে । আমার এত খারাপ লাগছে এখন ।'
'জানেন রমাদেবী, আজ আমি আমার মাকে সব চেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছি । তাই সারাদিন আমার এত খারাপ লাগছে আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না । তাই, একটিবার আপনাকে আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ি যেতে হবে । আমার মাকে একটু বোঝাতে হবে, অনুভামাসি যা বলেছে তা ঠিক নয় । আমি বিয়ে করতে চাই না তাই আমার কথা মতো আপনি শ্যামলীকে ওই সব কথা বলেছেন । প্লীজ, রমাদেবী, আপনি একটিবার আমার সঙ্গে চলুন ।'
'ঠিক আছে চলুন ।'
কলিং বেল বাজাতে আজ রাণুদি দরজা খুলে দিল । রাণুদি অনিদের বাডির বহু পুরানো কাজের মেয়ে । অনি জিজ্ঞেস করলো, 'মা কোথায় ?' রাণুদি জবাব দিল, 'ঘরে শুয়ে আছে ।' অনি জিজ্ঞেস করলো,'মা খেয়েছে ? ' রাণুদি বললো, 'না ।' অন্য দিন অনির ফিরতে রাত হয় । রাণুদি বাড়ি চলে যায় । ওনির মা-ই দরজা খুলে দেয় । আজ আগে ফিরেছে তাই রাণুদি দরজা খুলে দিল । অনি 'মা, মা' বলে মায়ের ঘরের দিকে এগোলো। পিছনে রমা । অনির গলা পেয়ে অনির মা বিছানায় উঠে বসলো । অনি ঘরে ঢুকলো, পিছনে রমা । রমাকে দেখে অনির মা বলে উঠলো, 'ও মা, এ-তো রমা । এসো, এসো মা, আমার এই বিছানায় বোসো ।' রমা বিছানায় বসতেই অনির মা বললো-----
'তলে তলে এত ! তাহলে আমাদের সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলে কেন মা ।'
'মাসিমা, আমার কথা শুনুন ।'
'আমি কোনো কথা শুনবো না মা । অনি এদিকে আয় তো বাবা । দেখি মা তোমার হাতটা দেখি ।'
'মাসিমা, আমার কথা একটু শুনুন, একটু বোঝার চেষ্টা করুন ।'
'আমার সব শোনা বোঝা হয়ে গেছে মা ।'
অনির মা অনির হাত আর রমার হাত নিজের হাতের উপর নিয়ে বললো,'এই আমি দু-হাত এক করে দিলাম । আমাকে আর কষ্ট দিও না মা । আমার এই পাগল ছেলেটাকে একটু দেখো মা । ওর মনটা ভীষণ নরম । এখন আমি শান্তিতে মরতে পারবো ।'
অনি বলে উঠলো, 'এ তুমি কি করলে মা ।'
অনির মা বললো, 'ঠিক করেছি । এই হাত যেদিন তুই ছাড়বি সেদিন আমি আত্মহত্যা করবো ।'
মা ছাড়া অন্য কোনো নারীর স্পর্শ অনি কোনোদিন পায় নি । রমার হাতের স্পর্শে অনির শরীরে শিহরণ খেলে গেল । অনি রমার দিকে তাকাতেই রমা চোখ নামিয়ে নিল । অনির মা দু-জনকে বুকে টেনে নিল । শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো ।
দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর।