ছবিঋন - ইন্টারনেট।
মহেন্দ্রলাল সরকার ভারতবর্ষের প্রথম বিজ্ঞান পত্রিকা এবং এক সমাজচ্যুত গবেষক
অনিন্দ্য পাল
২৯ শে জুলাই, ১৮৭৬ সাল। ১২ নং বৌবাজার স্ট্রিট, কোলকাতা। উদ্বোধন হল এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞান সংস্থা, " ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অব সায়েন্স।" প্রতিষ্ঠাতা যিনি, মাত্র কয়েক বছর আগেও একদল ডাক্তারের অপচেষ্টাতে যিনি সমাজচ্যুত হয়েছিলেন, এমনকি তাঁর ডিগ্রী বাতিল করার জন্যও সেই চিকিৎসক দল উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু, সেই দৃঢ়চেতা এবং অত্যন্ত উদ্যোগী মানুষটাকে তারা চিনতে ভুল করেছিল, এবং তাঁর পথে কাঁটা ছড়াতে গিয়ে নিজেদেরকেই করেছিল কলঙ্কিত। কে সেই মানুষটি?
তিনি ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। ১৮৬১ সালে কোলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এল এম এস ডিগ্রী পেয়ে তিনি চিকিৎসক হন, ১৮৬৩ সালে পান এম ডি ডিগ্রী, এবং তিনি ছিলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশকরা দ্বিতীয় এম ডি ডিগ্রী পাওয়া ডাক্তার, প্রথম এম ডি ছিলেন চন্দ্রকুমার দে । পড়লেন তো অ্যালোপ্যাথি, চিকিৎসাও করতে শুরু করলেন অ্যালোপ্যাথিক পদ্ধতিতে। কিন্তু হঠাৎ একটা ঘটনা তাঁর ডাক্তারি জীবনে অনেক বড় পরিবর্তন এনে দিল। তাঁর হাতে এল উইলিয়ম মরগ্যানের লেখা একটা হোমিওপ্যাথির বই। এই বইটা পড়ে তিনি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে খুব আশাবাদী হয়ে উঠলেন, শুধু তাই নয় তিনি নিজের মত করে গবেষণা ও করা শুরু করলেন। ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন- এর একটি সভায় পাঠ করলেন " চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার ভাবনা " নামে তাঁর গবেষণার ফলাফল। তাতে মূলত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ত্রুটি বিচ্যুতি, ক্ষতিকারক দিকগুলোকে তুলে ধরার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন গুনের কথা বলেছিলেন। এর অবশ্যম্ভাবী ফল যা হবার তা হল, ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে সংস্থা থেকে বহিস্কার তো করলোই, এমনকি তাঁর ডিগ্রী বাতিল করার জন্যও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আর্জি জানালো। শুধু তাই নয়, তাঁকে সমাজচ্যুত করে ধনে প্রাণে মারার ফন্দিও করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারী ডাক্তাররা চক্রান্ত করে মহেন্দ্রলাল সরকারের কাছে রুগী যাতে না যায় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো উল্টো ঘটনা, দিনে দিনে মহেন্দ্রলালের রুগী যেমন বাড়তে লাগল তেমনি সর্বত্র তাঁর কাজের, তাঁর মেধার কদর বেড়ে যেতে লাগলো। ডাক্তারদের সম্মিলিত অপচেষ্টা সত্ত্বেও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর এম ডি ডিগ্রী বাতিল তো করলেন না, উপরন্তু তাঁকে সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে নির্বাচন করা হল।
এর পরই পরবর্তী উপাচার্যের পদে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়, যদিও বৃটিশ সরকার এই পদে একজন ভারতীয়কে বসাতে মোটেও রাজি হল না, সেই পদে তাদের পছন্দের এক সরকারি কর্মচারীকে বসানো হয়েছিল।
সেটা ১৮৬৯ সাল , তিনি ততদিনে অত্যন্ত ব্যস্ত এবং ভরসার একজন বিখ্যাত চিকিৎসক, কিন্তু বরাবর তাঁর মনে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করার ইচ্ছা ছিল। এই ব্যস্ত সময়ে ও তিনি তাই প্রতি রবিবার তাঁর বাড়িতে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, এবং তাঁর এই কর্মসূচী প্রচুর ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষানুরাগী মানুষের মধ্যে একটা ব্যপক সাড়া ফেলেছিল। এর সদর্থক ফল হিসেবে তিনি প্রায় ৮০০০ টাকা অনুদান হিসেবে পেয়েছিলেন। এর মধ্যেই, ১৮৬৬ সালে তিনি " ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন " নামে একটা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন, এটাই সম্ভবত কোন ভারতীয়ের প্রকাশিত প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা। তাঁর অসাধারণ সম্পাদনার গুনে খুব তাড়াতাড়ি সেই পত্রিকাটি তরুণ প্রজন্ম থেকে সমাজের শিক্ষিত, চিন্তাশীল মানুষদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল। ১৮৬৯ সালে ,এই পত্রিকাতে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, " দ্য প্রজেক্টেড সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন" নামে একটা প্রবন্ধ লিখলেন, যেখানে তিনি ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে মানুষের চেতনা জাগানোর চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়, তিনি বিজ্ঞান গবেষণার জন্য যে একটা পরিকাঠামো এবং একটা সুব্যবস্থা আছে এমন গবেষণাগার দরকার, সেই বক্তব্য ও খুব জোরালো যুক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেন। ১৮৭০ সালে "হিন্দু পেট্রিয়ট " পত্রিকায় " দ্য অবলিগেশনস অব দি হিন্দু কমিউনিটি টু সায়েন্টিফিক এডুকেশন " প্রবন্ধে সরাসরি দেশের মানুষের কাছে, ভারতীয় বিজ্ঞান প্রসারের জন্য উপযুক্ত গবেষণাগার তৈরি করার জন্য সাহায্য চাইলেন। সাড়া পড়ে গেল দেশের জন্য প্রাণপাত করা অন্য মানুষদের মধ্যে, যাদের মধ্যে ছিলেন -ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, আব্দুল লতিফ, ফাদার ই লাঁফো, ভিজিয়ানা গ্রামের মহারাজ, এঁরা প্রত্যেকেই বাড়িয়ে দিলেন যথা সম্ভব সাহায্যের হাত। আবার ১৮৭২ সালের কাছাকাছি সময়ে বহরমপুর কলেজে বি. এ কোর্স চালু করার জন্য রায় লচপৎ সিং বাহাদুর
নামে এক ধনী চল্লিশ হাজার টাকা দান করেন, কিন্তু সেই টাকা লেফটেন্যান্ট গভর্নর রিচার্ড টেম্পল দান করেন মহেন্দ্রলালের বিজ্ঞান গবেষণার পরিকাঠামো তৈরির জন্য। এই ভাবেই অর্থের সংস্থান হতেই তিনি ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন " ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অব সায়েন্স "। এই গবেষণাগারে গবেষণা করেই ১৯২৮ সালে সি ভি রামণ আবিষ্কার করেন রামণ এফেক্ট যার জন্য তিনি ১৯৩১ সালে পেলেন নোবেল পুরস্কার। এছাড়াও সরসীলাল সরকার, রসিকলাল দত্ত , কারিয়া মাণিক্যম শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, ডঃ মেঘনাদ সাহা এখানে গবেষণা করেন।
১৮৩৩ সালে ২রা নভেম্বর হাওড়া জেলার পাইকপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মহেন্দ্রলাল। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান আর আট বছর বয়সে হারিয়েছেন মাকে। বড় হয়েছিলেন কলকাতার নেবুতলায়, মামার বাড়িতে। ঠাকুরদাস দের কাছে ভালো ইংরাজি শিখে তিনি ১৮৪০ সালে ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। ১৮৪৯ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ভর্তি হন কোলকাতা মেডিকেল কলেজে, মেডিসিন নিয়ে পড়ার জন্য। মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়া কালীন ডা আর্চারের উঁচু ক্লাসের পড়ানো শুনে সেই শ্রেণির ছাত্রদের কে ডাক্তার আর্চারের করা প্রশ্নের খুব সুন্দর উত্তর দেন, ফলে আর্চারের সুনজরে পড়ে যান মহেন্দ্রলাল। এরপর ১৮৬০ সালে, মেডিসিন, শল্যচিকিৎসা এবং মিডওয়াইফারি তে অনার্স নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাশ করেন।
তিনি শুধু চিকিৎসক ছিলেন, তা নয় ভালো শিক্ষক ও ছিলেন , ১৮৯৪ সাল থেকে তিনি কালটিভেশন অব সায়েন্সে উদ্ভিদবিদ্যা পড়াতেন, তাঁর হাতধরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য গিরীশচন্দ্র বসু, ডা. সহায়রাম বসু, বনওয়ারিলাল চৌধুরী ,ডা নীলরতন সরকার এই কালটিভেশন অব সায়েন্সে যুক্ত হন। ১৮৭৭ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে সাম্মানিক ম্যাজিস্ট্রেট করে, ১৮৮৩ সালে দেয় সি আই আই উপাধি। আবার ১৮৯৭ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে "ডক্টর ইন ল" উপাধি দেয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভক্ত এবং চিকিৎসক ছিলেন, এমনকি পরমহংসের গলার ক্যান্সার তিনিই ধরেছিলেন, পরমহংসকে বহু বার অনুরোধ ও করেন যদিও তিনি ডাক্তারের কথায় গান বা কথা বলা বন্ধ করেন নি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই পরমহংসের ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে, মারাও যান।
যাইহোক, ভারত এবং বাঙালির এই গর্বের মানুষ, ১৯০৪ সালের, 23 শে ফেব্রুয়ারি, ৭২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান।
==========================