ভূতের গল্প ।। আত্মার শান্তি ।। উত্তম চক্রবর্তী
ছবিঋন- ইন্টারনেট।
আত্মার শান্তি
উত্তম চক্রবর্তী
ঋক হলঘরের ডানদিকে কমন বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে গিয়েই চমকে উঠল। সামনে ওর ঘরের ভিতরের আয়নায় দেখতে পেল হলঘর থেকে ওর ঠিক পিছনেই কে যেন একজন হেঁটে আসছিল তখন। সারা বাড়ি অন্ধকার, শুধু হল ঘরেই একটা হাল্কা আলো জ্বলছে। ওদিকের ঘরে দাদা বৌদি আর ওদের মেয়ে টূম্পা ঘুমোচ্ছে। ঋক ওর থিসিসের কাজ শেষ করে অনেক রাতে শুয়েছে। রাত সাড়ে তিনটায় বাথরুম যাবার জন্য উঠে গেছিল। কই, তখন তো কোন ছায়া বা সেরকম কিছু দেখেনি ঋক ? তাহলে কি ওর চোখের ভুল ? ঋক আবার গিয়ে শুয়ে পড়ল চাদর মুড়ি দিয়ে।
ঋকের কিছুতেই ঘুম আসছিল না। ওর পুলিশ অফিসার দাদা ব্যাঙ্ক থেকে লোণ নিয়ে দমদম মতিঝিলে এই টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটটা কিনেছে মাত্র দুই মাস আগে।,পাঁচ বছরের পুরানো সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্লাট । খুব সস্তায় বেঁচে দিয়ে দেশে ফিরে গেছেন এর আগের বিহারী মালিক। ঋক ফ্লাটের ব্যাপারে দাদার সাথে এসেছিল ডিল ফাইনাল করতে। তখনই নিচের ঘরের ভাড়াটে ঋককে আলাদা করে ডেকে বলেছিল,' এই ফ্ল্যাটটা নিচ্ছেন মশাই। ঐ বিহারী ভজন লালের বৌ কিন্তু ঐ হল ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় শাড়ী পেঁচিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। বুঝে শুনে ডিল করবেন দাদা। আমরা এখন রোজ রাতেই ওপরের ঐ ফাঁকা ঘরে হাঁটা চলার শব্দ পাই।'
বিহারী ভজন লাল তখন বাড়িটা ছেড়ে কাজি পাড়ায় একটা ভাড়া বাড়িতে থাকত। বলেছিলেন এটা বেঁচে দিয়েই ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে দেশে চলে যাবেন। হয়ত তাড়া ছিল তাই ফ্লাটখানা বেশ সস্তায় দিচ্ছেন ভেবেই কারো কথায় কাণ না দিয়ে দুইভাই সেদিন ডিল ফাইনাল করেছিল। কিন্তু এরপর রোজ রাতেই ঋক হল ঘরে প্রায়ই খুটুস খাটুস আওয়াজ পায়। ভাবে বিড়াল বা ইঁদুর হবে হয়ত। বেশি রাত পর্যন্ত পড়াশুনা শেষ করে শুয়ে পড়ে। কিন্তু আজ তাহলে ওটা কিসের ছায়া ছিল যে ওর পিছনে আসছিল ?
কিছুতেই আর ঘুম আসছিল না বলে ঋক উঠে আবার গেল বাথরুমে। হল ঘরে সেই ডীম লাইট জ্বলছে। ঋক বাথরুমে ঢুকে দরজা আঁটকে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল। চারিদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে ঋকের কানে এলো কেউ যেন ধীর পায়ে হেঁটে হল ঘর থেকে এসে দরজার ওপাশে দাঁড়াল। ঋক কোনদিনই ভূত প্রেত মানে না। কিন্তু আজ ওর যেন একটু গা টা ছম ছম করে উঠল। মুখ ঘুড়িয়ে একটা গলার কাশির আওয়াজ করে ঋক বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। কই, কেউই তো নেই। ঋক আবার হেঁটে হল ঘর পেরিয়ে ওর ঘরের দিকে এগোয়। ঋকের ঘরে ওদিকের দেওয়ালে একটা আয়না লাগানো ওয়াল আলমারি আছে। ঋক পরিষ্কার দেখতে পেল ওর ঠিক পিছনে হলঘরের হাল্কা আলোকে পিছনে রেখে একটা ছায়া এগিয়ে আসছে। ঋক দাঁড়িয়ে পড়ে, ছায়াটাও দাঁড়িয়ে পড়ে। ঋক ইচ্ছা করেই ডান দিকে ঝোঁকে, ছায়াও ডান দিকে ঝোঁকে। ঋক আলমারির আয়নায় চোখে রেখে একবার ডান দিক একবার বা দিক করতে থাকে।
সেই ছায়াটাও কিন্তু ওর সাথে সাথে ঝুঁকছিল তখন। ঋক হটাত পর পর দুবার ডান দিকে ঝুঁকে পড়তেই লক্ষ্য করল সেই ছায়া ভুল করে বাঁদিকে ঝুঁকেই আবার সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এবার ঋক লক্ষ্য করল যে এটি একজন মহিলার ছায়া। ঋক ওর ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে ঐ অন্ধকারে দরজার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল,' আপনি যেই হোন, আমাকে আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন। আগে বলুন আপনার নাম কী ?' ঋক একটা বিদেশি ম্যাগাজিনে পড়েছিল আত্মা বা ভূত নাকি কখনো মানুষের ক্ষতি করতে চায় না। শুধু অতৃপ্ত আত্মা বদলার মনোভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই মহিলার আত্মাও কি ওকে কিছু বলতে চাইছে ? তাহলে কি নিচের ঘরের লোকটা ঠিকই বলেছিল যে এই ফ্ল্যাটে ভূত আছে ?
ঋক লক্ষ্য করল ছায়াটা দরজায় দাঁড়িয়ে ওর দিকেই মুখ করে নিচু স্বরে কাঁদছে। ঋক বুঝতে পারে যে এই মহিলাই হয়ত সেই মহিলা যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। ঋক শান্ত গলায় বলে,' আপনি কাঁদবেন না। আমি আপনার কথা শুনে যা ব্যবস্থা নেবার ঠিক নেব। বলুন তো ঠিক কী হয়েছিল, আর কেনই বা আপনি আত্মহত্যা করতে গেছিলেন ?'
মহিলার ছায়া দেখে বয়স আন্দাজ করা যাচ্ছিল না। তবে বিহারী মালিকের একটা ছেলে ক্লাশ নাইনে পড়ে আর একটা মেয়ে ক্লাশ ফাইভে পড়ে শুনেছিল সেদিন। তার মানে ওর স্ত্রীর বয়স নিশ্চয়ই চল্লিশের কাছাকাছি ছিল। এই বয়সে আত্মহত্যা সে করেছিল মানে নিশ্চয়ই কিছু মানসিক অশান্তি ছিল যার পরিণতিতে ইনি আত্মহত্যা করাই সঙ্গত মনে করেছিলেন। তারই অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মহিলার গলার আওয়াজ শোনা গেল এবার। ফ্যাস ফ্যাসে গলায় নিচু স্বরে বলল,' আমার নাম মুনিয়া লাল। আমার স্বামী আমাকে গলা টিপে খুন করে ঝুলিয়ে রেখেছিল সেদিন। আমি মোটেই আত্মহত্যা করিনি। ঐ শয়তানটা আরেকটা মেয়েছেলের সাথে থাকবে বলে আমাকে সরিয়ে দিল। এবার আমার ছেলে মেয়েকে দেশে রেখে এসে ঐ মেয়েছেলের সাথে কলকাতায় ঘর করবে ওর অন্য আরেক বাড়িতে। আমি ও শাস্তি না পাওয়া অবধি শান্তি পাবো না।'
সব শুনে ঋক চমকে উঠল। মহিলার ছায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,' আপনি আমাকে শুধু ঐ আরেকজন মহিলার নাম বলুন আর সাথে মদন বাবুর অন্য বাড়িটার এড্রেসটাও বলুন। আমি এবার যা ব্যাবস্থা নেবার নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি এবার ঠিক সুবিচার পাবেন।' ঋক মনে মনে ভাবে কালই দাদাকে বলে লালবাজারে একটা কমপ্লেন রেজিস্টার করতে হবে। ঋক বালিশের পাশ থেকে ওর মোবাইল বের করে ডকুমেণ্ট ফাইলে হাত রাখে। এখন লাইট জ্বালিয়ে কাগজে কিছু লেখা যাবে না। মোবাইলের আলোয় ঐ আত্মার কোন অসুবিধা হবার কথা নয়।
ছায়ামূর্তি ঋককে সেই মহিলার নাম ও ভজন লালের বরানগরের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিল। ঋক লক্ষ্য করল মহিলা অদৃশ্য হবার আগে হাত জোড় করে ওকে শেষ কথা 'অনেক ধন্যবাদ আপনাকে' বলেই হাওয়ায় মিলিয়ে মুক্তি পেল যেন।
পরদিনই দাদার নির্দেশে বরানগর থানা এরেস্ট করে ভজন লাল ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে ওর ণৈণাণ পাড়ার বাসা থেকে। পুলিশের কঠিন জেরার মুখে পড়ে ভজন লাল ওর স্ত্রীকে খুনের কথা স্বীকার করে, এবং ওর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায়। কিন্তু ভজন আজ পর্যন্ত জানতে পারলো না পুলিশকে এসব কে জানাল ? এটাতো একেবারেই গোপন ব্যাপার ছিল এতদিন !
--------শেষ----------
Uttam Chakraborty.
Bangalore.