ছবিঋন- ইন্টারনেট
টাইটান থেকে টাইটানিক
মনোরঞ্জন ঘোষাল
আমার তৈরী আশ্চর্য মাছ যখন টাইটানিকের খোঁজ পেয়েছিল, তখন অদ্ভূত ভাবে একটি পাথর খণ্ডকে ঐ টাইটানিকের ভাঙা টুকরোর পাশে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। তখন ব্যাপারটি নিয়ে তেমন চিন্তা ভাবনা করি নি। নিছক একটা পাথরের টুকরো সেখানে পড়ে আছে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু ঐ খানে ঐ ভাবে একটা পাথরের টুকরো পড়ে থাকবে কেন? এই প্রশ্নটি তখন মাথায় আসে নি।
আজ একবার মাছের ঐ ক্যামেরা ফুটেজ দেখতে বসে ঐ দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ মনে এমন প্রশ্নের উদয় হল।
সত্যিই তো সমুদ্রের তলায় এমন ছোট আকারের পাথরের টুকরো ঐ ভাবে থাকা সম্ভব না। ঐ জায়গাটির আশেপাশে বিস্তির্ণ এলাকায় কোন ডুবো পাহাড় নেই। থাকলে ওটি তার ভাঙা অংশ বলে মনে করে নেওয়া যেত। আবার আদিম কাল থেকে ঐ পাথরের টুকরোটি ঐ খানে ছিল ধরে নিলে, এত দিনে তার চারিপাশে বালির স্তর জমে ভরে যেত। তাহলে সেটিকে অমন বালির উপরে পড়ে থাকতে দেখা যেত না।
নানান বিশ্লেষণে বুঝলাম, পাথর খণ্ডটি হালেই কোথাও থেকে এসে এখানে পড়েছে। আবার পড়বি পড় ঐ টাইটানিকের ভাঙা টুকরোর কাছে। যদিও ছবি দেখে আমার পাথরটিকে পার্থিব বলে মনে হচ্ছে না। তবু সেটাতো এমনি এমনি বললে চলবে না। তার সপক্ষে উপযুক্ত যুক্তি খাড়া করতে হবে।
তবে আমার মনটা কেমন যেন একটা সম্পর্কের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছে। কেবল মনে হচ্ছে ঐ পারটির সঙ্গে টাইটানিকের কোন সম্পর্ক আছে বোধহয়!
কী সেই সম্পর্ক আর কে বলতে পারবে তার সম্পর্কে দু কথা? ভাবনা শুরু হল। হতে পারে সে পাথরটি টাইটানিকের মধ্যেই রাখা ছিল। তবে তার সম্পর্কে কোথাও কোন লেখালেখি খুঁজে কেউ পায় নি। কিন্তু আমাকে যে জানতেই হবে।
তাই ঠিক করলাম একটি ঐ জাহাজ যাত্রীর মুখ থেকেই আমাকে শুনে নিতে হবে এ সম্পর্কে।
অনেক লোক বেঁচে ফিরেছিল সেই ধ্বংস হওয়া টাইটানিক থেকে। তাদের বেশির ভাগ ধনী। তারা ঐ সব ছোট খাঁটো ব্যাপারে কিছু জানবে না। যদি কোন কর্মকর্তাদের পাওয়া যেত তবে তাদের কাছে এমন গোপন কিছু অজানা কথা জেনে নেওয়া যেতে পারত। খোঁজ করে দেখলাম তেমন কোন কর্মকর্তা আর বেঁচে নেই।
টাইটানিক থেকে বেঁচে ফিরেছেন যাঁরা তাদের সকলের একটি লিস্ট বের করে তাদের সম্পর্কে ভাল করে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। তাদের সকলেই প্রায় আজ মৃত। তাছাড়া তারা কেউ ঐ গোপন কিছু বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে বলে আমার মনে হল না।
প্রায় সব লোকের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে। শেষের দিকে কয়েকটা মহিলার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া বাকি। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে। যে আশা নিয়ে কাজে হাত দিয়েছি তার সাফল্যের কোন চিহ্ন চোখে পড়ছে না।
হঠাৎ একটি নাম আমার চোখে লেগে গেল। মেরিনা উইলিয়াম। লণ্ডনে তাঁর বাড়ি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের নন। আবার ঐ টাইটানিকে ঝাড়ু লাগানোর কাজ করতো। তখন কম বয়স ছিল বলে শিশুদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্য জাহাজে। এখন তাঁর বয়স আটাত্তর বছর এবং জীবিত।
সম্পূর্ণ তথ্য ঘেঁটে মনটা আমার আনন্দে ভরে উঠল। আমি তো ঠিক এমনটি চেয়েছিলাম। আর পেয়েও গেলাম। ঠিক করলাম মেরিনা উইলিয়ামের সঙ্গে দেখা করতে যাব।
আমারতো যাওয়া আসার সময় লাগে না। যখন আমি আমার মতে কাজ করতে ইচ্ছুক। যখন অন্য কারোর ডাকে কোথাও যেতে হয় তখন ওদেরকে দেখাতে হয় যে, আমিও ওদের মত মানুষ। আমিও ওদের মত সাধারণ। কোন অসাধারণ গুণ আমার নেই।
তখন আমি সাধারণ মানুষের মতই চলি। কিন্তু এখানে আমাকে কাউকে কিচ্ছু দেখানোর নেই। আমি কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি তা কাউকে বলতে হবে না। আমার ফোটন যানে করে আমি নিমেষেই লণ্ডনে পাড়ি দিতে পারি। শুধু ফোটন যানে ওঠা আর নামাটা সব লোক চক্ষুর আড়ালে হলেই হবে।
মেরিনা ঐ জাহাজ ডুবি ঘটনার পর থেকেই ফেমাস হয়ে গিয়েছে। তাই গুগুলে সার্চ করে তার বাসস্থান ও হাল হকিকত জেনে নিতে এতটুকুও অসুবিধা হল না। পাওয়া ঠিকানা মত গুগুল থেকে লোকেশন বের করে নিলাম। তার পর ফোটন যানে চেপে রওনা দিলাম লণ্ডনে।
লণ্ডন শহরটিতে প্রচুর জনবসতি। ফোটন যানে চেপে মুহূর্তে আমি নির্ধারিত লোকেশনে পৌঁছে গিয়ে দেখলাম, সেখানে আমার নামার মত কোন ফাঁকা জায়গা নেই।
তাহলেই যে বিপদ। আমার নামা ওঠা যে কাউকে দেখানো যাবে না। আর আমি ফোটন যানের ভেতরে বসে থাকলে তো কেউ আমাকে দেখতে পাবে না। তাহলে কি করি? কি করি? এমনটা ভাবছি। হঠাৎ নজরে পড়ল একটি ছোট মাঠ আর তার পাশে থাকা এক প্রকাণ্ড দেবদারু গাছটিকে।
তখন মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আর নামার কোন অসুবিধা নেই। আস্তে আস্তে ফোটন যানটিকে সেই দেবদারু গাছের কাছে নিয়ে গেলাম। একটা ডাল দেখে ফোটন থেকে সেখানে লাফিয়ে নেমে পড়লাম। একটু গাছে শব্দ হয়েছিল। তবে ওখানের ব্যাস্ত লোকজনের নজর সে দিকে গেল না।
ধীরে ধীরে ডাল ধরে দেবদারু গাছ বেয়ে নীচে নামতে থাকলাম।
বেশ কিছুটা নীচে নেমে দেখি, এ কী বিপদ! সেই গাছের তলায় এক নিউটন গোছের ছোকরা খাতা পেন ছড়িয়ে বসে। এ কী আপদ! আপেল গাছ হলে না হয় ঠিক ছিল। তাই বলে দেবদারু গাছের তলায় বাপু বসে তুমি কী আকর্ষণ আবিস্কার করবে? তার থেকে বাপু একটু সরে গিয়ে বস না।
যেই মনে মনে বলা না অমনি কাজ শুরু হল। দেখি তখনই সে তার বই খাতা সব গুছিয়ে নিতে শুরু করল। সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরে হাঁটা দিল সেখান থেকে। যাক বাবা আপদ বিদেয় হল।
আমি তখন ধীরে ধীরে গাছের উপর থেকে একেবারে নীচে নেমে এলাম। নেমে আমার ঘড়িতে সেখানের সময় আর লোকেশন মোড অন করে, মেরিনার ঘরের দিকে যেতে শুরু করলাম।
এতটা ফেমাস হবার পরও মেরিনা বিবাহ করেন নি। তাঁর পিসতুতো দাদার কাছে সে থাকে।
বেশ কিছুটা পথ হেঁটে এসেছি। সামনে একখানা ছোট বাগান বাড়ির দিকে আমার ঘড়ি মেরিনার লোকেশন চিহ্নিত করতে লাগল।
দুম দাম যেখানে খুশি এখানে ঢুকে গেলে চলবে না। তা ছাড়া আমি আবার বিদেশী। তার একটু বেচাল দেখলে পুলিশের হাতে তুলে দেবে। সেও এক ঝামেলা।
পাশে এক ভদ্রলোককে রাস্তায় দেখতে পেলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করে নিলাম।
" এই টি কী মেরিনা উইলিয়ামের বাড়ি?"
সে বলল- "ইয়েস।"
আর কোন অসুবিধা নেই। এবারে আমি সেই বাড়িতে ঢুকতে পারি। মেরিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
চারিদিকে ছোট ছোট গাছ পালায় সাজানো একটি সুন্দর বাগান। তার ঠিক মাঝে একটি ছোট ঘর। ঠিক বাগান বাড়ির মত।
ঘরের সামনে এক খানা কাঠের তৈরী সৌখিন দরজা। তার এক পাশে লাগানো রয়েছে কলিং বেল।
সোজা এগিয়ে গিয়ে দরজার পাশের কলিং বেলটিকে টিপে দিলাম। ভেতরে পাখি ডাকার মত একটা সুন্দর শব্দ বেজে উঠল। তার পর শুনতে পেলাম কে যেন ভীতর থেকে দরজার দিকে হেঁটে আসছে।
তার পর খট করে আওয়াজ হয়ে দরজাটি খুলে গেল। দরজা খুলতে দেখলাম সামনে দাাঁড়িয়ে এক বয়স্ক ভদ্র মহিলা। আন্দাজ করলাম উনিই মেরিনা উইলিয়াম।
সুন্দর কণ্ঠস্বরে হালকা হাসি মুখে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- "কাকে চাই মাই ডিয়ার?"
শুনে আমি অবাক! "আপনি বাংলা বলছেন?" জিজ্ঞেস করলাম আমি।
"হ্যাঁ মাই ডিয়ার। আমার বাবা ইংরেজ ছিলেন বটে, তবে আমার মা ছিলেন বাঙালি। তাই আমি বাংলা জানি। আর আমার বলতে ভালোও লাগে। এখনতো এখানের তৃতীয় ভাষা বাংলা।"
মনে মনে ভাবলাম, এ এক অদ্ভূত চাহিদা। আমাদের বাঙালিরা ইংরেজি শেখার জন্য মত্ত। আর ইংরেজরা বাংলা। যাক তবু বেঁচে থাক বাবা বাংলা তা ইংরেজদেরই মুখেই থাক না কেন।
তবে আমি বাপু ইংরেজির থেকে বাংলায় কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। হাজার হোক বাঙালি। মনে মনে কিছুটা আনন্দিত হলাম এই ভেবে যে, যাই হোক দু দণ্ড কথা বলে অন্তত শান্তি পাওয়া যাবে।
জিজ্ঞেস করলাম, " আপনি মেরিনা উইলিয়াম? "
"ইয়েস মাই ডিয়ার।" একটা সুন্দর মিষ্টি হাসি মুখে তিনি আমাকে উত্তর দিলেন।
আমি বললাম, "তাহলে আমার আপনাকেই দরকার।"
"কেন? মাই ডিয়ার। আমি জানতে পারি কী?"
"নিশ্চয়ই। আমি সেই জন্যই তো আপনার কাছে সুদুর ভারত থেকে এসেছি।" আমি বললাম।
"আমি তো বুঝে গেছি যে তুমি ভারতীয় এবং বাঙালি। তবে আমার কাছে তোমার কী জানার আছে তা বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু কী?"
"না ম্যাডাম। আমার টাইটানিক সম্পর্কে কয়েকটা জিজ্ঞাসা আছে।"
"ও! টাইটানিক! এতদিন পর। এখন তো সব কিছুই জানাজানি হয়ে গেছে। তোমাকে আমি নতুন করে কি জানাতে পারি?"
"না না। আপনাকে আলাদা করে কিছু বলতে হবে না। আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, আপনি তার যথাযথ উত্তর দেবেন।"
"বেশ ঠিক আছে। তবে জিজ্ঞেস করো। তার আগে কি একটু চা খাবে?"
" না। এখন আর চা খাওয়ার মুড নেই।" আমি উত্তর করলাম।
এবার তিনি আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। ঘরটি বাহিরে থেকে ছোট দেখালেও ভেতরটা বেশ বড়। একেবারে ঘরের মাঝে একটি কাঁচের টি টেবিল ও তার চারিদিকে হালকা বাদামি রঙের মোড়কে ঢাকা কাঠের সোফা সাজানো রয়েছে। আমাকে তার একটিতে বসতে বলে তিনি পর পারে একটিতে গিয়ে বসে পড়লেন। দু জনে একেবারে সামনাসামনি হয়ে বসে পড়লাম।
এই বার আমার জিজ্ঞাসা একটি একটি করে নিবেদন করলাম তার নিকটে।
জিজ্ঞেস করলাম, "জাহাজ ডুবির সময় আপনি সজ্ঞান ছিলেন?"
"ইয়েস মাই ডিয়ার।" তিনি উত্তর করলেন।
"যখন ধাক্কাটি লাগে তখন আপনি জাহাজের ঠিক কোথায় ছিলেন? মানে জাহাজটি তো খুব বড় আর বহু তল ছিল, তাই।"
"আমাদের তো ভেতরের ফ্লোরে থাকার কথা। তবে তখন পার্টি চলছিল বলে আমাকে ডেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আমিও তখন আনন্দে সমুদ্র যাত্রাটি উপভোগ করছিলাম।"
"তাহলে আপনি ঘটনার সব টুকুই দেখেছেন? "
"বোধ হয় মাই ডিয়ার।"
"আচ্ছা কোন পাথর জাহাজে রাখাছিল কী?" আর কোন ভনিতা না করে সরাসরি প্রশ্নটা করে ফেললাম।
"পাথর! আগে ছিল না। পরে অবশ্য একটা পাথর জুটে গিয়ে ছিল।"
"ঠিক বুঝলাম না। একটু খুলে বলবেন?" আমি বেশ আগ্রহী হয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম।
"তুমি কী ভাবে জানতে পারলে মাই ডিয়ার। এই খবর তো কোথাও প্রকাশ পায় নি?"
"আমি টাইটানিকের অনুসন্ধান কারী দলে ছিলাম। টাইটানিকের ভাঙা অংশ যেখানে পাওয়া গিয়েছে, সেখানে একটি পাথরের চাঁই দেখা গেছে। আমার অনুমান সেটি পার্থিব কোন পাথরের টুকরো না। হতে পারে বড় রকমের উল্কার অংশ, যা জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সেই থেকেই আমি এটির সত্যতা অনুসন্ধান করে চলেছি।"
"এক্সেলেন্ট মাই ডিয়ার! এক্সেলেন্ট! তোমার নজরের আর বুদ্ধির তারিফ করতেই হবে। যে একমাত্র তুমি, এই বিষয়টি যার নজর এড়িয়ে যেতে পারেনি। আমিও এই ঘটনাটিকে ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার বলায় আবার মনে পড়ে গেল।"
"ঘটনা! মানে আলাদা আরোও একটা ঘটনা ঘটেছিল?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"ইয়েস মাই ডিয়ার। আমি বেশ আনন্দে জাহাজের ডেকের সামনের দিকে বাতাস খেয়ে চলেছি। কি বিশাল সমুদ্র আর তার উত্তাল জলরাশি। উফ! কী ভয়ানক! অথচ সুন্দর। মন সেই দৃশ্য ছেড়ে আর কোথাও যেতে চাইছে না। এদিকে আকাশে মেঘ উঠেছে। মাঝে মাঝে আলোর ঝলকানি আর বজ্রের শব্দ ধেয়ে আসছে। তার দাপটে ডেকের সকলে ভয়ে খোলা আকাশের নীচে ছেড়ে যে যার ঘরে ঢুকে গেল। আমি তাতে ভয় পেলাম না। আমি মোটা একটা কাছি চেন ধরে দাঁড়িয়ে মেঘের সেই তাণ্ডব দেখছি। হঠাৎ একটা পাথরের খণ্ড ছুটে এলো আকাশ থেকে। ঠিক তখন মেঘের মধ্যে দিয়ে আমি শনি গ্রহটিকে একবার দেখতে পেলাম বলে মনে হল। বেশ পরিষ্কার দেখলাম তার বলয় রয়েছে। আমিও কিছুটা লেখাপড়া শিখেছিলাম। তা দিয়ে আমার বুঝতে অসুবিধা হল না যে ঐ গ্রহটি শনি। তবে পাথরের টুকরোটি ঐ শনির গা থেকে ছিটকে এলো বলে মনে হল না আমার। মনে হল অন্য কোথাও থেকে ছিটকে এলো যেন!"
আমিও ঠিক অমনটা মনে করছিলাম। তাই বেশ আগ্রহ সহকারে তার বলা কথাগুলো শুনছিলাম। তাই এই কথার শেষে তিনি একটু চুপ করে গেলে, জিজ্ঞেস করলাম, "তার পর?"
"তার পর আর কী? পাথরটা ছুটে এসে আছড়ে পড়ল একেবারে জাহাজের উপর। জাহাজটি ছিল বেশ বড় আর তেমন মজবুত। তাই তার আছড়ে পড়ার আঘাতে জাহাজটি একটু দুলে গেল বটে, তবে ক্ষয় ক্ষতি কিছু হল না। পাথরটি পড়ার পর অদ্ভূত ভাবে আকাশের মেঘ যেন কোথায় উড়ে চলে গেল।
একটা কিছু আছড়ে পড়েছে। ভেতরে সকলেই অনুভব করেছে। তাই কিছুলোক হুড়মুড় করে বাহিরে বেরিয়ে দেখতে এল। তারা দেখল সেই পাথর খণ্ডকে। সকলেই মনে করল উল্কা পড়েছে। তার পরে সেই পাথর খণ্ডটিকে ক্রেনের সাহায্যে জাহাজের একটি ধারে সরিয়ে রেখে দেওয়া হল। ঐ পাথর সরিয়ে দেওয়ার হুল্লোড়ে হিমশৈলের দিকে আমোল দিতে পারে নি ক্যাপ্টেন। তবে আমার মনে হয় ঐ পাথরটি ছিল কাল! কী অদ্ভূত ব্যাপার জানো মাই ডিয়ার, যারা সামনে গিয়ে ঐ পাথরটি দেখেছিল তারা কিন্তু কেউ সে কথা বলার জন্য বেঁচে ছিল না। সবাই মারা যায়। তাই ঐ ব্যাপারে কোন কথাই আজও বলা হয়ে ওঠে নি। হয়তো আমি এক মাত্র বেঁচে আছি শুধু ঐ কথা বলার জন্য!"
"না না। ওসব অবৈজ্ঞানিক কথা। ও কথার কোন যুক্তি নেই।" বললাম আমি।
" নো মাই ডিয়ার নো। ইউ আর রঙ। তুমি ভুল বলছ মাই ডিয়ার। এখনও অনেক ঘটনা ঘটে যা বিজ্ঞান যুক্তি দিয়ে ব্যাখা করতে পারে না। এই যেমন এতদিন পর তুমি হঠাৎ এই কথা জানতে চাইলে কেন? হয়তো তোমার মধ্যে দিয়েই তিনি কিছু একটা প্রচার করতে চাইছেন!"
আমি দেখলাম উনি কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়ছেন। তাই আমি ওনার সঙ্গে আর কোন দ্বন্দে গেলাম না। আমার যা জানবার ছিল তা জানা হয়ে গেছে। এবার আমাকে এই কথাগুলিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। তাই আর অহেতুক সময় সেখানে বসে নষ্ট করলাম না।
"অনেক কিছু জানতে পারলাম আপনার কাছে। এখন আসি? পরে আবার কখনও গল্প করতে চলে আসবো।" বলে বাহিরে চলে এলাম।
তার পর হেঁটে চলে গেলাম সেই মাঠের দিকে। দেখলাম সেখানে একটিও লোকজন নেই। ফোটন যানটিকে গাছে থেকে নামিয়ে তাড়াতাড়ি চড়ে বসলাম সেটির ভেতর। তার পর নিমেশেই পৌঁছে গেলাম বাড়ি।
মনটা তখন আনচান করছে। ল্যবরেটরিতে গিয়ে টেলিস্কোপের মাথাটা তাক করতে হবে শনির দিকে। দেখতে হবে তার কোন টুকরো ছিঁড়ে এসেছে কি না।
পাথরের টুকরোর ছবিটি আমি আগে থেকেই আমার পিসিতে লোড করে নিয়েছিলাম। এবার ল্যাবে গিয়ে মিলিয়ে দেখতে হবে যে সেটি কার টুকরো।
সময় বুঝে ল্যাবে ঢুকে পড়লাম। তার পর টেলিস্কোপের মুখটি তাক করলাম শনির দিকে।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শনির ছবিকে দেখতে লাগলাম। না। কোথাও কোন টুকরো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার নিশান দেখতে পেলাম না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল টাইটানের নাম।
শনির তথা এই সৌর জগতের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ টাইটান। আর টাইটানিক ছিল তেমনই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ। তাই বোধহয় মিল করে জাহাজটির নাম রাখা হয়েছিল টাইটানিক।
সুতরাং নাম সংক্রান্ত একটা ইগোইং লিঙ্ক ঐ টাইটান ও টাইটানিকের মধ্যে না থাকার কোন কারণ আমার মাথায় এল না। তখন আমি আমার টেলিস্কোপের মুখটি ঘুরিয়ে তাক করলাম টাইটানের দিকে।
বেশ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করছি। মনে মনে আমি ঠিক করেই নিয়েছি যে ঐ টাইটানিকের উপর আছড়ে পড়া পাথরের টুকরোটি টাইটানের অংশ হবেই।
কোথাও কোন ভগ্ন অংশ কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। মাথাটা আবার ভারী হতে শুরু করছে। ঠিক সেই সময় একটা ফাটল টাইটানের গায়ে দেখতে পেলাম।
জবিটিকে আরো জুম করতে লাগলাম। তখন নজরে পড়ল একটা গর্ত! ঠিক পাথরের টুকরোর আকারের বলে মনে হল। তখন সেই ছবিটিকে স্থির করে সেখানে ঐ পাথরের ছবিটি বসিয়ে দিয়ে দেখলাম। হুবহু ঐ মাপের গর্ত। একেবারে ফিট হয়ে বসে পড়েছে পাথরের টুকরোটি ঐ গর্তে!
এবার মাথায় আর এক চিন্তা ভর করে বসল। কেবলই মনে পড়তে লাগল মেরিনা উইলিয়ামের সেই কথা! "পাথরটি ছিল কাল!"
তবে কী সত্যিই পাথরটি কাল। ঐ কাল ধেয়ে এসেছিল টাইটানিককে ধ্বংস করার জন্য!
কেমন যেন বিশ্বাস করতে মন মানছে না। কিন্তু প্রমাণ? সে তো ঐ দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবার আমার এলিয়েন বন্ধু একবার বলেছিল যে, জীব আর জড় বলে মহাবিশ্ব প্রকৃতিতে কিছু আলাদা করা নেই। ফলে দুটি জীবের মধ্যে যেমন দ্বন্দ বাধে, তেমন দুটি জড়ের মধ্যেও দ্বন্দ বাধে। হয়তো তেমনই কোন দ্বন্দ বেধেছিল ঐ টাইটান আর টাইটানিকের মধ্যে। তাই টাইটানের অস্ত্র ছুটে এসেছে সোজা টাইটানিকে তাকে ধ্বংস করার জন্য।
তাৎক্ষণিক বলবিদ্যার ধারণায় টাইটানিকের ঐ অস্ত্রে কোন ক্ষতি হয়নি বটে, কিন্তু তার গোপন প্রভাব যে অব্যর্থ তা কারোর জানা ছিল না। তারই প্রভাবে লক্ষভ্রষ্ঠ হয়ে জাহাজটি হিমশৈলকে ধাক্কা মারে।
যখন সব ঘটনা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে পড়ল, তখন গণিতের মত যেন সব অঙ্কের উত্তর মিলে যেতে লাগল। আমার এতটুকু বুঝতে অসুবিধা হল না যে, টাইটানিকের ধ্বংস হওয়াটা নিছক একটা দূর্ঘটনা নয়। এটির পিছনে ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্র! যে ষড়যন্ত্রের মাষ্টার মাইণ্ড টাইটান!
এই কথাটি মেরিনা আমাকে বলেছিলেন। তাই আমার সত্য উদ্ঘাটনের কিছুটা পথ প্রদর্শক উনি। ওনাকে আগে সেই সত্য খবরটি জানিয়ে দেবার দরকার' ভেবে ল্যাবের বাহিরে বেরিয়েছি। তখনই কানে খবর ভেসে এল, রেডিওতে বলছে মাত্র ঘন্টা দুই আগে মেরিনা উইলিয়াম মারা গিয়েছেন!
আমি খবরটি শুনে একেবারে চমকে গেলাম! মেরিনার মুখের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে চলেছে। তবে কি এই ঘটনা প্রকাশ করায় কোন বাধা আসবে!
যাক বাবা যা হবার হয়ে গেছে। এই নিয়ে আর এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে না মনে করে এটি এখানেই ইতি করে দিলাম।
===========================
মনোরঞ্জন ঘোষাল
আত্মারামপুর
পশ্চিম রামেশ্বরপুর
বজ বজ
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা