গল্প ।। প্রতিফল ।। অভিক
প্রতিফল
অভিক
অনেক বছর আগের কথা । তখন এখানে ছিল বিঘার পর বিঘা উর্বর ধানী জমি, এখনকার মতো ইতস্ততঃ ইটভাঁটা আর অনুর্বর জমিতে ছড়িয়ে থাকা আগাছা ছিল না | আজকের দিনে সেকথা হয়তো বিশ্বাস করাও শক্ত !
সেবার প্রচন্ড গরম আর একদম বৃষ্টি নেই | অনেকটা এবারের মতন | সূর্যের প্রখর তাপে মাটি ফুটিফাটা , পুকুর ডোবা সব শুকিয়ে গেছে | একমাত্র গ্রামের মধ্যেখানের গভীর কুয়োটির তলার দিকে কিঞ্চিৎ জল এখনো অবশিষ্ট | রোজ চণ্ডীমণ্ডপে গ্রামবৃদ্ধদের আসর বসে | সমস্ত সময় ধরে চলে ভাগ্যের প্রতি দোষারোপ | "ঈশ্বর বৃষ্টি না দিলে খাজনা দেবে কি করে?" "না খেতে পেয়ে মরতে হবে যে !" ইত্যাদি |
গ্রামের ধারে শ্মশানের ঠিক আগের লাগোয়া কুঁড়ে ঘরটিতে এক সন্ধ্যায় দেখা গেলো প্রদীপের ক্ষীণ আলো | কৌতূহলী লোকেরা দেখতে পেলো রক্তাম্বর পরিহিতা এক তরুণীকে | কপালে বিরাট লাল রঙের টিপ , খোলা চুল মুখের অনেকটা ঢেকে রেখেছে | গায়ে ছাই মাখা |
গ্রামের মোড়ল মশাই একদিন ওখানে গিয়ে নিজেদের দুরবস্থার কথা বললেন |
সন্ন্যাসিনী কথা বলে উঠলেন, কি ভরাট আর গম্ভীর কণ্ঠস্বর-"তোদের গ্রামে আমি বৃষ্টি নামাতে পারি , কিন্তু তার দাম দিতে হবে |"
বৃদ্ধ মোড়লমশাই বিস্মিত হলেন | তার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে এক গা ছমছমে হাসি হেসে উঠলেন সাধিকা |
"বিশ্বাস হচ্ছে না, না? বেশ তবে পরীক্ষা হয়ে যাক | সফল না হলে এক পয়সাও নেবো না | কিন্তু বৃষ্টির দাম দিতে হবে |"
গ্রামবৃদ্ধ উত্তর দিলেন -"মা , আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় | আমরা কোথা থেকে দাম দেব ?"
"বৃষ্টির পরে ফসল হলে, বৃষ্টির দাম অর্ধেক ফসলের দাম |"
মোড়লমশাই রাজি হলেন |
বহু খুঁটিনাটি লক্ষণ অলক্ষন মেলানোর পর একটি জমি পছন্দ করলেন তান্ত্রিক সাধিকা |
জমির চারপাশে আগুন জ্বেলে এক অদ্ভুত সুরে নেচে নেচে গান শুরু করলেন | এক অদ্ভুত ঘুমপারানিয়া সুর, আর ঝোলা থেকে একটা বাঁশি বের করে তা বাজাতে লাগলেন |
এক অদ্ভুত ভালো লাগায় চারদিক যেন ভেসে গেলো |
কোথা থেকে ঠান্ডা হাওয়া ভেসে এলো | আকাশের তারাদের ঢেকে ফেললো কালো মেঘের দল |
আকাশ চিরে ঝলসে উঠলো বিদ্যুৎ; বৃষ্টি নামলো, অঝোরধারায় !
বৃষ্টি চললো রাত থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত | গ্রাম যেন আবার প্রাণ ফিরে পেলো |
কিন্তু ওই তান্ত্রিক সন্ন্যাসিনীকে পরেরদিন আর দেখা গেলো না |
সেবার ফসল উঠলো একেবারে গোলা ভরে | খাজনা মিটিয়ে বেঁচে গেলো বেশ কিছু টাকা | এরকম ফসল যে শেষ কবে হয়েছে তা গ্রামের অতিবৃদ্ধ মানুষরাও মনে করতে পারলেন না |
কার্তিক অমাবস্যার বিকেলে ফিরে এলেন সন্ন্যাসিনী |
"তোমাদের চাহিদা আশাকরি পূর্ণ হয়েছে | এবার প্রতিশ্রুতিমতো আমার দক্ষিনা মূল্য আমাকে অর্পণ করো |"
মোড়লের তিন ছেলে গ্রামের যুবকদের সাথে নিচুস্বরে কি যে বলাবলি করছিলো |
বড় হেসে উঠলো |
মেজো বলে উঠলো ,"জানিনা কি মন্ত্রতন্ত্র করে বৃষ্টি নামিয়েছিলি , কিন্তু এখন তো যা হবার হয়ে গেছে | ফসল বেচার টাকাও ঘরে এসে গেছে সবার | এখন টাকা দিয়ে আর হবে কি ?" বলে হেসে উঠলো এক লোভী মানুষের মতো | গ্রামের অনেকে তার সাথে হাসিতে যোগ দিলো |
বৃদ্ধ মোড়ল মাথা নেড়ে বলতে যাচ্ছিলেন যে কাজটা বোধহয় ভালো হলো না | কিন্তু ছোট ছেলে কিছু বলার আগেই তাঁকে থামিয়ে দিলো |
সাধিকার চোখ যেন জ্বলে উঠলো | "এবার তোমরা বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য পাবে |"
বড় ছেলে বললো -"যা ভাগ ! নাহলে ডাইনিকে কিভাবে পুড়িয়ে মারে , জানিস তো ?" চোখের ইঙ্গিতে দুজন গ্রামের যুবক ওঁর হাত ধরতে গেলে, চমকে গেলো | যেন আগুনে হাত দিয়েছে |
অট্টহাস্য করে উঠলেন তান্ত্রিক |"কি ধরবি না ? ক্ষমতা আছে পিশাচসিদ্ধকে ধরার ?"
কার্তিক অমাবস্যার রাতে আবার শোনা গেলো অদ্ভুত সুরের গান আর বাঁশির সুর | কিন্তু এবারের সুর মনখারাপ করে দেয়- অমঙ্গলের আশংকা ডেকে আনে | সবাই যেন রূপকথার কাঠির ছোঁয়াতে ঘুমিয়ে পড়লো |
পরদিন সকাল থেকে আকাশভাঙা বৃষ্টি | দুদিন পর বৃষ্টি থেমে গেলে দেখা যায় গ্রামের সব জমি আগাছাতে ঢেকে গেছে | যতই চেষ্টা করো এমনি পুড়িয়ে দিলেও আগাছা মাটির নিচ থেকে যেন গজিয়ে ওঠে | আর কোনোদিন ওই গ্রামের জমি চাষযোগ্য করা গেলে না | জনবসতিপূর্ণ গ্রাম অভিশাপে এক পরিত্যক্ত জায়গাতে পরিণত হলো !
=========================
CV Raman Nagar, Bengaluru, KA-560093
Avik