বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। অধিকার ।। সুদামকৃষ্ণ মন্ডল

 

 
 অধিকার
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল 



        হারু মুন্ডার বিটি লছমি বড্ড বেয়াড়া।  বাপের বাড়ি থাকে।  মা পরের ঘরে এখন যায় , আগে বনে বনে ঘুরে ঘুরে কচুশাক, ফল,  মেটে আলু তুলে এনে দিন গুজরান । হারু মুন্ডাকে ওরা মেরে দিল।  দোষ ছিল না কিছুই । মুখার্জি বাবুর বনবাদাড়ে  জমিটা গতর দিয়ে কাটাই করে নিজের চাষযোগ্য কৃষিজমি করেছিল।  তিন বিঘার একটু বেশি । নায়েবের চোখে লেগেছে । মুখার্জিবাবুর হাতে পায়ে ধরে আগলে রাখতে চাইলেও হয়নি।  নায়েব অখিলেশের অনুরোধে কসরৎ করা জমি থেকে উচ্ছেদ করেছে।  অখিলেশের রাঁঢ়ের বেটা অনন্তিয়ার জন্য মুখার্জি বাবু দরদ উথলে দিয়েছে। অখিলেশের রাঁঢ়ের হাত ধরে গভীর রাতে মেয়ে মানুষ মুখার্জি বাবুর জন্য ব্যবস্থা করে দিত।  ফলে অখিলেশের কথা রাখতেই হয় ।  অনন্তকে  তো একেবারে বঞ্চিত করা যায় না।
         সে বছর মা শস্য লক্ষী দুচোখ তুলে তাকিয়েছিল।  তা দেখে মুখার্জি বাবুর চক্ষু চড়ক গাছ । এত ধান দেখে মুখার্জি হারু মুন্ডাকে কাছারিতে ডেকে সহজে বুঝিয়েছে। কাজ হয়নি। তারপর যা করার অখিলেশ করিয়েছে । ফেরার পথে আঁধার সে আক্রান্ত হয় । লোক লাগিয়ে দিল ঘায়েল করতে।  বাদাবনে গেঁওয়া গাছের পাশে হড়কচ আর হোগলা ঝোপ।  তালতলা দিয়ে যে রাস্তা হারু মুন্ডার বাড়ি গেছে।  ফাঁকা রাস্তায় পেয়ে ওই ঝোপের আড়ালে  কোপ দিয়ে ধরাশায়ী। শুধু আর্ত চিৎকারে আঃ শব্দটুকু শুনেছে কেবল নিশাচর পাখি- শ্বাপদেরা।  সকাল হতেই সে কি অভিনয় অকিলেশের ! তা ভুলবার নয় । খবর চাউর হতেই লোকের ভিড় ঠেলে সামনে লছমী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাবাকে দেখে । কী ভয়ংকর সে দৃশ্য  ! চোখে দেখা বীভৎস রূপ। অখিলেশ দেখে বলেছিল,  বৌমা,  যা হওয়ার তো হয়েছে ।  আর কেন ?  যাও- ডেড বডি ছুঁয়ে  আবার অশৌচ হবে কেন ? কই গো ? সৌরভ কোথায় ওকে একটু বুঝিয়ে নিয়ে যেতে বলো।
         অখিলেশের স্ত্রী প্রমীলাকে  নিয়ে পুত্র সৌরভ দাঁড়িয়ে দেখেছিল সেই মর্মান্তিক  দৃশ্য ! লছমী তো সৌরভের বউ। নিম্ন বর্ণের মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল বলেই মেনে নিতে পারেনি । সুচতুরভাবে ঘরছাড়া করেছিল লছমীকে। অনেক কাঠ খড় পুড়ে তবেই না শ্বশুরভিটেয়  ঠাঁই মিলেছিল।  তাও আবার ষড়যন্ত্রের শিকার ভিন্ন ভাবে।
         যখন জানতে পারল অখিলেশের নির্ভেজাল চাতুরিতে তার বাবাকে হারাতে হয়েছে তখন আর শ্বশুরবাড়ি থেকে না জানিয়ে চলে আসে।
          লছমী আর যায় না । মায়ের সাথে থেকে একাকীত্বকে ঘনিষ্ঠ করে । মায়ের বুকের যন্ত্রণা ভাগ করে প্রতিশোধের  আঁচ খোঁজে।
          গ্রামে মাত্র একটা নলকূপ । গাঁয়ের জনসংখ্যার নিরীখে যথেষ্ট নয়।  আজ তিন বছর হল পঞ্চায়েত সমিতির অফিসের তদারকিতে  গরমকালে জলের গাড়ি আসে।  ভোটের বেলায় ওরা বলেছিল ,  বাগদীপাড়ায় একটা কুপ বসাতে হবে ।  ভোটটি দিলে আর সমস্যা থাকবে না । চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ভোটটি দিয়েছে । কিন্তু তারপর আর কারোর দেখা মেলেনি । ওরা  কেউই পুকুরের জল ব্যবহার করে না।  উপরন্তু বাগদী পাড়ার লোকেদের নলকূপ স্পর্শ করা বারণ। গরমকাল ছাড়াও বারো  মাস বঞ্চিত হয় ।
          বামুন - কায়স্থের ঘরের বউদের লাইন পড়ে যায়  । কূপের জল নেয়  উপরন্তু ট্যাংকির জল নেয়।  শেষ পর্যন্ত বাগদী পাড়ার যে কয় ঘরের বউ-ঝি হতাশ হয়ে ফিরে যায়  । সেই দূরের ডোবার জল এনে জলাভাব  মেটায়। কিন্তু পানীয় জল  ? সময়ে সময়ে  ওষ্ঠাগত  প্রাণ বাঁচাতে হাতে তুলে নেয় দূষিত জল।
          শেঠদের বউরা আগে জল নেয়।   তা সে লাইনে যেই থাকুক সরিয়ে দিয়ে কলসি বালতি পাতে।  তারপর   পন্ডা -আচার্য্য - অগস্তি - রায়- মুখার্জী -পাণিগ্রাহীদের পর ট্যাংকিতে আর জল থাকে না। বড়জোর দু-এক ঘরের বাগদি মেয়ে জল নিতে পারে । তাও আবার তলানির নোংরা জল। কুপেও হাত দেওয়া যাবে না । শেঠের মালকিন পঞ্চায়েতের প্রধান।  তার নির্দেশ নিম্ন বর্ণের বউ-ঝি  নলকূপের হাতল  যেন না স্পর্শ করে।  ওদের নাকি জাত যাবে ।
          লছমী কালকে জল পায়নি । এর আগে অনেকে পায়নি । এরা যাবে কোথায়? ফলে লছমী, সরলা, পানতি, মলিনাকে সঙ্গে রেখে রাত থাকতে টিউবওয়েলের  ধারে বসে আছে । কখন শেঠের মালকিন  শিকলের তালা খুলবে আর লছমী সরিয়ে জল নেবে।
           অখিলেশের বউ প্রমীলা তালা খুলে যেই না কলসি বসাতে গেল অমনি তা ধরে সরিয়ে লছমী নিজের কলসি বসিয়ে দিতেই লাগলো শোরগোল । --- দৌড়ে এসে গো--  সর্বনাশ করে দিল ।  জল ছুয়ে সর্বনাশ করে দিল । ছোটলোকের মেয়ে জাত মেরে দিল গো -- দৌড়ে এসো ।
           সানস্ট্রোকে লোক মারা যায় প্রতিবছর। শরীরের রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে মনে হলেও ওদের মনে হয়নি । বাচ্চাগুলো রোগাপটকা ভেদবমিতে ভুগছে  নোংরা জল খেয়ে । এ সময় কে কার খোঁজ রাখে।  কিন্তু ভোটের বেলায় হাতজোড় করে দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা চায় । মুখ্যু মেয়া মানুষ তো নয়  লছমী লেখাপড়া করেছে , পাঁচ ক্লাস কম কি ! সঙ্গিনীদের বুঝিয়েছিল প্রতিবাদ করে লড়াই করে নিজের অধিকার বুঝে নিতে হয়।  জলের কষ্টে রেখে প্রতিবছর ওরা বঞ্চনা করে।
            পাড়াশুদ্ধ লোক দৌড়ে এলো। ওদের রকম সকম দেখে অখিলেশ এগিয়ে এসে বলল,  অ্যাই ছোটলোকের মেয়ে তুই কলে হাত দিলি কেন  ? আমরা এবার থেকে যাব কোথায়? বল আমরা যাব কোথায়?
  ----তুদের বুঝি জীবন আছে মুদের লাই ? হ রে ন্যাতাবাবু ভুটের বেলায় পায়ে ধরিস ?  এখন তুরা কুথায় যাবি দেইখ্যে লে।
---- ঠিক আছে দেখে নেব । সবার আগে তোকে দেখে নেব । কত বাড় বেড়েছিস --
----  আমরাও দেইখ্যে লুব । ভুটটা আইসতে দে।
বাগদি পাড়ার সবাই এসে গেছে। একে একে কলসি বালতি ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে । জলের ট্যাংকি আসতে  সেখানে ওরা গেল না।
---- হিসাবটা সময় হলে নেব  । দেখে নিবি---
----  হিসাবটা পেরধান সাহেবের থেকে কড়ায় গন্ডায় লুব । সময়টা আসতে দে রে ঘাটের মড়া ।  অনেক হিসাব বাকি আছে।

======================

সুদামকৃষ্ণ মন্ডল 
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.