অণুগল্প ।। মানসীর ঘরসংসার ।। দীনেশ সরকার
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
মানসীর ঘরসংসার
দীনেশ সরকার
মানসী আমার বাড়ির কাজের মেয়ে মানে পরিচারিকা। বছর ছয়েক আছে। আমার বড় ছেলে যখন সবেমাত্র তিন মাসের তখন থেকেই আছে। মানসী রোজ সকালে সাইকেলে আসে আর সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে যায়। আমার দুই ছেলে বড়টি ছয় আর ছোটটি দুই। আমার ছেলেদের এখন তাদের মায়ের চেয়ে মানসীদিদিকে বেশী করে চাই। মানসী এখন আমার পরিবারেরই একজন।
হঠাৎ মানসী সেদিন আমার স্ত্রীকে বললে, 'কাকিমা, সামনের মাস থেকে আমি আর কাজে আসবো না। তোমরা অন্য কাজের লোক দেখে নাও।'
কথাটা আমার কানে পড়তেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কেন রে কি হ'লো তোর ? কাজে আসবি না কেন ?'
'শ্রাবণ মাসের আঠারো তারিখে আমার বিয়ে।'
'বাঃ! এ-তো খুব ভালো খবর রে ! তা পাত্র কোথাকার, কি করে ?'
'আমাদের পাশের গেরামে বাড়ি। কাঠচেরাই কলে কাজ করে।'
'তা বেশ ! তুই চিন্তা করিস্ না। তোর ভালো বিয়ে হোক, তুই সুখে থাক এইটাই আমরা চাই।'
আসলে সব মেয়েই স্বপ্ন দেখে, তার বর হবে, ঘর হবে, একটা সংসার হবে । মানসীরও বর, ঘর, সংসার হবে এ-তো খুব ভালো কথা। যদিও জানি মানসী চলে গেলে আমার স্ত্রীর খুব অসুবিধা হবে। দূটো বাচ্চা নিয়ে সংসার সামলাতে হিমশিম খাবে। নতুন কাজের মেয়ে কবে যোগাড় করতে পারবো তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
মানসী যেদিন চলে গেল আমি ওর প্রাপ্য ছাড়াও আরও কিছু টাকা ওর হাতে তুলে দিলাম আর আমার স্ত্রী তার কানের একজোড়া সোনার দুল ওকে উপহার দিলো।
দিন কুড়ি-পঁচিশ পরে একদিন সকালে মানসী এসে হাজির।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কিরে তুই ?'
মানসী বললে, 'তোমরা কি কাজের লোক পেয়েছো ?'
আমি ভাবলাম ও হয়তো কোনো কাজের লোকের সন্ধান এনেছে। তাই বললাম, ' নারে এখনও পাইনি।' মানসীর গলা পেয়ে আমার স্ত্রীও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
মানসী বললে, 'তবে আর কাজের লোক খুঁজতে হবে না। আমি কাজ করবো।'
'তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কিছু বলবে না !'
'আর শ্বশুরবাড়ি ! ও পাট আমার চুকেবুকে গেছে।'
'কেনো রে, কি হ'লো ?'
'বিয়ে হয়েছিলো। শ্বশুরবাড়িও গিয়েছিলাম। বর বললে, এখন বর্ষাকাল, কাঠচেরাই বন্ধ। তাই একমাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। এখানে এখন ধান রোয়ার কাজ চলছে। ক'টা দিন মাঠে কাজ করি। সেইমতো ধান রোয়ার কাজে যাচ্ছিলো। সেদিন কাজ করার সময় কাদাজলের মধ্যে ওকে সাপে কাটে। ধরাধরি করে ওকে বাড়ি নিয়ে আসে। আমি নতুন বউ, তবু আমি বলেছিলাম হাসপাতালে নেওয়ার কথা। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না। শ্বশুরমশাই ওঝা ডেকে আনলো। ওঝা যখন হাল ছেড়ে দিল তখন ওরা হাসপাতালে নিয়ে গেল। পথেই সব শেষ।
এবার সব দোষ গিয়ে পড়লো নতুন বউয়ের উপর। বউ অপয়া, অলক্ষ্মী তাই তাদের ছেলের এমন অপঘাতে মৃত্যু হলো। তুমিই বলো কাকু আর কি সে বাড়িতে থাকা যায়। চলে এলাম বাবার কাছে।'
'বেশ করেছিস্।' মনে মনে বললাম, 'হায় রে আমাদের সমাজব্যবস্থা ! আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই আছি। একচুলও এগোতে পারিনি।'
আমার বড় ছেলে স্কুলে। ছোটটা ঘরের মধ্যে খেলছিলো। মানসীর গলা পেয়ে ছুটে এলো, 'মানথী দিদি, তুমি আমাদেল ফেলে কোতায় গিয়েথিলে ? আল দাবে না তো ?'
মানসী আমার ছোটছেলেকে কোলে তুলে আদর করে বললে, 'না সোনাবাবু, আমি আর কোত্থাও যাবো না।''
দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর।