যেমন কর্ম তেমন ফল
মিঠুন মুখার্জী
মুখার্জী বাড়ির বড় ছেলের সম্পত্তি ও টাকা-পয়সার প্রতি ছিল ভীষণ লোভ। বড় বউ সুষমাও স্বামীর যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন। তাদের দুজনেরই একা খাওয়া একা পাওয়ার প্রবণতা ছিল প্রবল। তাই ভাই রবিনকে সবসময় তারা সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করতেন। বৃদ্ধ বাবা-মার কানে সবসময় ছোট ভাই সম্পর্কে বিষ ঢালতেন তারা--- যাতে তাদের কাছেও সে খারাপ হয়ে যায়। এক সময় প্রতাপশালী পিতার দাপটে বাড়িটি গমগম করত। দুই ছেলে ও বউদের বুক ঠান্ডা হয়ে যেত। এখন বৃদ্ধ পিতা-মাতা বড় ছেলে ও বউকে যমের মতো ভয় পান। কোনো কথা বলার আগে চারিপাশ দেখে নেন, ওরা কেউ আসছেন না তো। ছোট ছেলের প্রতি হওয়া অন্যায়ের কথা তারা সব জানেন, কিন্তু কিছু করতে পারেন না। অথচ এবাড়ির সমস্ত সম্পত্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতার।
বাবার একটা মস্ত ব্যবসা আছে। সেটাকে বাবা ও বড় ভাই মিলে দেখাশোনা করেন। ছোট ভাই বাংলায় ডাবল এম.এ করেও চাকরি পাননি। এক কথায় বেকার। বাড়িতে সামান্য কয়েকটি ছাত্রছাত্রী পড়ান। বাবার ব্যবসা বড় ছেলে ছককষে বাবার কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে লিখিয়ে নেন। একবারও ছোট ভাইয়ের কথা চিন্তাও করেন না। আত্মস্বার্থ সিদ্ধি এখনকার মানুষের মূলনীতি। বাবা-মা ছোট ভাইকে একটা সামান্য জায়গা ব্যবসা করার জন্য লিখে দিলে তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। ওই জায়গাটিতে পরবর্তীকালে মনের মত বাড়ি করার স্বপ্ন ছিল তাদের দুচোখে। কিন্তু সে আশায় জল পড়ে যায়।বাবা-মা তাদের সম্পত্তি কাকে দেবেন সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু বড় বউ-ও তার স্বামী সব একা ভোগ করতে চান। প্রতিনিয়ত ভাই ও ভাই বউয়ের সাথে ঝামেলা বাঁধানোর চেষ্টা করেন তারা। ছোট ভাই রবিন বাবা-মার এই চুপচাপ থাকা দেখে ভাবেন---"বাবা-মা বেঁচে থাকতে এরা আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করলে, তারা না থাকলে কি করবেন!! এক মুহূর্তের জন্য তারা এ বাড়িতে তাদেরকে থাকতে দেবেন না।"
বাবা ও মা পড়েন ভীষণ সমস্যায়। বাবার ইচ্ছা তারা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন সংসারকে ভাঙবেন না। অর্থাৎ হাড়ি আলাদা হবে না। কিন্তু বর্তমানে এটা সম্ভব নয়। কেউ কারো কাছে নত হয়ে থাকতে চান না। একদিন ছোট ভাই রবিনের ছয় বছরের মেয়ে আরাধ্যা বাড়ির সামনে বাথরুম করায় বড় বউ তার উপর প্রচন্ড রেগে গিয়ে উলফাল বলতে থাকেন। এই নিয়ে রবিনের সঙ্গে বৌদির তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। বড় বউ সুষমার এমন মুখ, যে কেউ সাধারণত তাকে নাড়াতে চান না। পাড়ার সবাই তাকে খুব ভালো করে চেনেন। কাউকে সে মানেন না। পেয়েছিলেন তার মায়ের ধারা। তার মা-ও ছিল এমন মুখরা। সেই বিষয়টার রেশ বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকে। একদিন ছোট বউয়ের একটা নতুন দামি ব্লাউজ ছিঁড়ে যায়। দেখে মনে হচ্ছিল কে যেন ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছেন। এই নিয়ে ছোট বউ কান্না করেন। সে ছোট ছেলেকে জানালে, ছোট ছেলে ছেঁড়া ব্লাউজ নিয়ে গিয়ে মাকে দেখান। কারো নাম না নিয়ে তিনি বলনে---"কেউ যদি ইচ্ছা করে ব্লাউজটা কেটে থাকেন, তবে তার মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে।" বড় বউ কথাটি কোনভাবে শুনে নেন। তারপর সেই দিন বাড়িতে যা কান্ড ঘটিয়েছিলেন তা মুখে বলার না। নিজের গায়ে মেখে নিয়ে ছোট ছেলে রবিনের সঙ্গে ঝামেলা শুরু করেন। কাঁদতে কাঁদতে রবিনের নাম ধরে সে একই অভিশাপ দেন। রবিন বলেন---"আমি কারো নাম ধরে কিছু বলিনি, আর উনি আমাকে সরাসরি অভিশাপ দিলেন!!" বিষয়টা রবিনেরও খুব খারাপ লেগেছিল। তিনি মনে মনে সংকল্প করেন, দাদাদের ছায়া পর্যন্ত মারাবেন না। বড় বউ এতই ধূর্ত ও বদমাইশ যে, রবিনের অধিকারেও হস্তক্ষেপ করতেন। পাড়ার লোকের কাছে রবিন সম্পর্কে এমন এমন কথা বানিয়ে বলতেন, যা শুনে সকলে অবাক হতেন। সুষমার পেটের মধ্যে মিথ্যা কথা ও মাথার মধ্যে শয়তানি বুদ্ধি ছিল প্রবল। সমস্ত কিছুর মধ্যে নিজের স্বামীর অবদানকে শুধু দুচোখে দেখতে পেতেন। আর কারোর কোনো ভূমিকা তার দুচোখে ঠেকতো না। এমনকি শ্বশুরের অবদানকে অস্বীকার করে বড় বউ সবাইকে বলতেন---"বাড়ি ও ব্যবসা যা দেখছন সবই আমার স্বামী করেছেন। শ্বশুরের তেমন কোন অবদান নেই। ও না থাকলে ভোদাই ছোট ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরমশাই এসব করতে পারতেন না।" নিজের মানসিকতার পরিচয় নিজেই সকলের সামনে তুলে ধরেন বড়বউ। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে রবিনের বাবা ব্যবসার জন্য কি করেছেন, আশেপাশের সবাই তা জানেন। ফলে বড় বউ সুষমার কথা কেউ বিশ্বাস করেন না।
কথায় বলে 'লোভে পাপ পাপে মৃত্যু'। কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়। সম্পত্তি ও টাকার লোভ বড় বউ ও বড় ছেলেকে পাগল করে তুলেছিল। তাই কখনো কাউকে মানুষ জ্ঞান করতেন না তারা। বড় ছেলে একদিন বাবাকে বলেছিলেন---"আপনার আর ব্যবসা দেখতে হবে না। আমি একা দেখতে পারবো। আপনার তো বয়স হয়েছে। তেমন কোনো কাজেও আপনি লাগেন না। আমি না থাকলে এ ব্যবসা চলবেও না। আপনি তো তেমন টাকা পয়সা দ্যান নি। এই ব্যবসায় যা করেছি সবই আমি।" বড় ছেলের এই কথা শুনে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন---"এতদিন দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছি।" বাবা বুঝেছিলেন বড় ছেলের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিলে, তিনি এই ব্যবসা দুদিনও টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। মদ খেয়ে আর লটারি কেটে শেষ করে দেবেন। তাই ব্যবসা পুরোপুরি ছাড়েন নি। একদিন সামান্য একটি বিষয় নিয়ে বড় ছেলে ছোট ছেলেকে অকথ্য গালিগালাজ করেছিলেন। এই সকল কথা সভ্য সমাজে কখনো মুখে আনা যায় না। অহংকারের ঝাঁজ ছিল সেই সকল কথায়। ছোট ভাই রবিনকে মারতেও গিয়েছিলেন বড় বউয়ের কথায়। কিন্তু বাবা-মা ও পাড়ার লোক থাকায় তা পারেননি। কথায় বলে---"ভয় থেকে মুক্ত হলে ভাবনায় ভগবান জাগে।" রবিন একটুও ভয় পাননি। বরং মনে মনে দাদা সম্পর্কে ঈশ্বরকে বলেছিলেন--- "ওনার অহংকার যেন একদিন চূর্ণ হয় ঈশ্বর। মানুষকে উনি মানুষ জ্ঞান করেন না।" ওনার গালিগালাজ শুনলে কোনো মানুষই ওনাকে ভালো বলেন না। নিজের ছেলে-মেয়ে দুটিকে মানুষ করতে পারেননি। তারা মানুষ হবেই বা কি করে! ছোটরা বড়দের কাছ থেকেই শেখে। মাতাল বাবার সন্তানও হয়েছিল একপ্রকার নেশাখোর। কোন নেশাই তেমন বাকি ছিল না। বাবা-মাকে তোয়াক্কাই করে না সে। তেজ ও কথা বলার ধরন দেখলে সকলেরই মাথা গরম হবে। মনে হবে---"ওইটুকু ছেলের এমন আচরণ!" টেনে গালে চড় মারতে ইচ্ছে হবে। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই দাদু-ঠাকুমার লাই পেয়ে সকলের মাথায় উঠেছে ছেলেটি। মেয়ের মেজাজ সপ্তমে। পান থেকে চুন খসলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে। মাঝে মাঝেই বড় বউ স্বামীর মুখে মুখে কথা বলায় রামশ্যাম মার খান। তবুও লজ্জা হয় না। কথায় বলে না 'মরলেও স্বভাব যায় না'।
'গায়ে মানে না আপনি মোড়ল '। পাড়ার লোকেরা দীর্ঘ সময় বড় বউকে দেখে ও ওনার সাথে মিশে মানুষ হিসেবে উনি কী রকম তা বুঝে গেছেন। তাই বেশিরভাগ মানুষই ওনাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরতে ওস্তাদ উনি। সংসারে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সব করার চেষ্টা করেন। নরম স্বভাবের শাশুড়িকে এতোদিন ধরে বুঝে নিয়েছেন। তাই তাঁকেও গুরুত্ব দেন না। বরং বিভিন্ন কাজ করার জন্য শাশুড়িকে আদেশ করেন। নিরীহ শাশুড়ি সংসারে অশান্তির ভয়ে মাথানত হয়ে সব কাজ করেন।
আজ থেকে বাইশ বছর আগে বড় বউ সুষমা এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন। তখন রবিন অস্টম শ্রেণীর ছাত্র। প্রথম পাঁচ-ছয় বছর সুষমার আসল রূপটি কারো সামনে আসে নি। রবিনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই ছিল। নিজের অনেক কাজ রবিনকে দিয়ে করিয়ে নিতেন তিনি। চিরকালই অন্যকে হুকুম করতে খুব ভাল পারেন ইনি। সুষমার ছেলে সৌভিতকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা, বাড়িতে সৌভিতকে রাখা, সংসারের বিভিন্ন ফাইফরমাস খাটা, সবই করতেন রবিন। শ্বশুরের সাথে সুষমার প্রতিদিন অশান্তি হতো। মাথা গরম করে তিনি বাপের বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকতেন। মাথা গরম করে মুখে যা খুশি বলতেন সুষমার শ্বশুর। সেই অশান্তিও যাতে ঠান্ডা হয়ে যায় সেজন্য রবিন তার বাবাকে বোঝাতেন। যেখানেই ঘুরতে যেতেন তিনি ভাইপোর জন্য কিছু না কিছু কিনে আনতেন। পুজোর সময় পরিবারের সকলকে কিছু না কিছু উপহার দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ইনকাম সোর্স বলতে প্রাইভেট টিউশন।
সারা জীবন রবিনকে কম ঠকান নি এরা। বেশ কিছু বছর পর সুষমার গর্ভে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। মেয়ের নাম দেন সৃজনী। মেয়ে হওয়ার আগে থেকেই রবিনের সঙ্গে সুষমার সাংসারিক ঝামেলা বাঁধে। রবিন তার বৌদি সুষমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তবুও দাদার ছেলে-মেয়ের প্রতি তার ভালোবাসা একটুখানিও কমে নি। সৃজনীর জন্যও রবিন কম করেন নি। তবে আগের থেকে সে অনেক সচেতন ছিলেন। কোলে করে নিয়ে গিয়ে ভাইজির ছবি তুলে আনা, কাজের সময় তাকে আগলে রাখা সবই করেছেন। অথচ মানুষ কত বেইমান। রবিনের বিয়ের একবছর পর যখন মেয়ে আরাধ্যা হল,তখন সুষমা হিংসায় জ্বলে গেলেন।কারণ তার ছেলে-মেয়ের আদরে ও সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে আর একজন অংশীদার এসেছে তাই। অবাক করার বিষয়, মেয়েটিকে একদিনের জন্যও ধরেন নি সে। মায়ের ও রবিনের শত ব্যস্ততার মাঝে আরাধ্যা অবহেলায় অনাদরে বড় হয়ে ওঠে। তাছাড়া রবিনের মাও মন্দিরের কাজের চাপে বাচ্চাটির দিকে নজর দিতে পারেন নি। অথচ সুষমার দুই ছেলে-মেয়ে দাদু-ঠাকুমার ও কাকার সহযোগিতায় বড় হয়ে উঠেছিল। সুষমা ও তার স্বামীর সন্তানদের বড় করতে তেমন কোন চাপ কোনোদিন নিতেই হয় নি। অথচ বার বার ব্রাত্য রবিনের পরিবার।
আজ রবিনের মেয়ের বয়স সাত বছর। অনেক কিছুই ও এখন বুঝতে পারে। তবে বাবা-মার প্রতি হওয়া ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান এখনো ওর আসে নি। ছোট হওয়ায় বাবা-মার বারন করা সত্ত্বেও অনেক কাজ করে সে। ছোট বলে রবিনরা কিছু বলেন না। তবে মনে মনে রবিন ভাবেন, যেদিন ও বুঝতে শিখবে সেদিন থেকে তাদের অমতের কাজ অবশ্যই করবে না। সুষমা ও রবিনের দাদা আরাধ্যাকে লোক দেখানো ভালোবাসেন। এই বিষয়টি আরাধ্যর বাবা-মা দুজনেই বোঝেন। মাঝে মাঝে আরাধ্যার প্রতি রেগে গিয়ে গালাগাল করেন সুষমা ও তার স্বামী। পাড়ার লোকেরাও এই মেকি ভালোবাসার বিষয়টিও জানেন। রবিনের বাবার উপর তারা রেগে যান। কেউ কেউ বলছেন --- " রবিনের বাবার রবিনের প্রতি আচরণ দেখলে রাগ হয়। ওনার দুচোখ আছে। যার জন্য কোনোদিনও কারো কাছে একাটা কথাও শুনতে হয় নি, সেই অবহেলিত ও মানসিক অত্যাচারিত হয় বেশি।অথচ আজ ত্রিশ বছর ধরে যে ছেলের জন্য প্রতিটি পদে পদে মানসম্মান হানি হয়েছে, বাড়িতে লোক এসে ঝামেলা করে গেছে , বাবার সঙ্গে মারামারি করেছে, লোকে মাতাল তকমা সেঁটে দিয়েছে সেই ছেলেই তার নয়নের মনি। এগুলি যোগ্য বিচার নয়।" আবার কেউ কেউ বলছেন --- "শুধু দুই ছেলে নয় দুই বউমার ক্ষেত্রেও আছে দুই চোখ। ছোট বউ শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য প্রাণপাত করলেও সংসারে তার কোনো নাম নেই। অথচ বড়বউ লোকদেখানো একটু কাজ করলেই তার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। তাছাড়া বড়বউ এই সংসারে অনেক আগে এসে সকলকে বুঝে গেছেন। বয়সের ভাড়ে ও বুদ্ধির জোরে ছোটবউ তার কাছে শিশু।"
বড় ছেলে রথীন ও বড় বউ সুষমার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ছোটছেলে রবিন একসময় আলাদা হয়ে যান। বাবাকে বলেছিলেন-- " আজ চল্লিশ বছর আপনি আমাদের চালাচ্ছেন। আজ আপনার বয়স হয়েছে। আমিও হয়তো আর বছর কুড়ি বাঁচব। তা আপনাদের বাকী জীবনটা আমাকে সেবা করার সুযোগ দিন। আজ থেকে আপনারা দুজন আমার কাছে খাবেন। আপনাকে এই আটষট্টি বছর বয়সে আর খাটতে হবে না।" বাবা রবিনের কথায় রাজি হন নি। তিনি বলেছিলেন --- " না বাবা, আমরা কোনো ছেলের কাছে খাব না। আমাদের বুড়ো-বুড়ির মন্দিরের ভোগে হয়ে যাবে। তোমরা আলাদা খেলে খাও।" রবিন বুঝেছিলেন বাবা অভিমান করে এই কথা গুলো বলছেন। তিনি চান না এই বেঁধে রাখা সংসারটা আলগা হয়ে যাক। কিন্তু রবিনের আত্মসম্মান রবিনকে হাড়ি আলাদা করতে বাধ্য করেছিল। দাদার প্রতিটি মুহূর্তে অশ্রাব্য গালাগাল মেনে নিতে পারেননি সে। এই অপমান তার মনে প্রতিটা মুহূর্তে খুবই বাজত।
ছোটছেলে রবিনের কথাগুলো বাবা মেনে না নিলেও, বড় ছেলে রথীনের সংসারে টাকা দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করেন। বড় বউ সুষমা বড় সুযোগ পেয়ে যান ছোটছেলে রবিনদের নামে মগজ ধোলাই করার। সব জেনে শুনেও চুপ করে থাকেন তারা। এখনকার দিনে নিজের ছেলের থেকে বউমা বেশি আপনার হয়ে যায়। বাবা-মাও কখনো কখনো ভুল করেন। কিন্তু তারা সন্তানের কাছে ধরা দেন না। বাংলার প্রতিটি সংসারে আজ একই দশা।
রবিন বাড়ির মধ্যে চুপচাপ থাকেন। কারণ 'জোর যার মুলুক তার'। আজ রবিনের এই দশার জন্য সে তার বাবাকেও দায়ি করেন। দুটো ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তিনি সারাজীবন বড় ছেলের কথা ভেবে গেছেন। ছোট ছেলে পড়াশোনা করে চাকরি না পেলে কি করবে -- তা ভাবেন নি। পাড়ার লোকেরাও সব জানেন। তিনি রবিনকে লঘু পাপে গুরু শাস্তি দেন। "একবার আমের সিজনে রাত এগারোটার সময় রবিনকে বাজার থেকে আম কিনে আনতে বলেন। রবিন তখন হাফপ্যান্ট পরে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। বাবাকে তিনি বলেন---"বাবা আমি এখন খাতা দেখছি, কালকে খাতাগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের দিতে হবে। একটা বড় আম আছে, আপনার হয়ে যাবে।আজ আর আম আনতে হবে না।" রবিন এমন কথা বলে নিজের বিপদ ঢেকে এনেছিলেন। বাবা সকলের সামনে তাকে এমন গালাগালি দেন যে রবিন অবাক হয়ে ঘন্টা খানেক বসে ছিলেন আর দুচোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়েছিল। সাত বছর বাবা তার সঙ্গে কথা বলেননি। রবিন আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেন না এটা কেমন পিতৃসুলভ আচরণ। সকলের সামনে ছোটছেলেকে অপমান করে আনন্দ পেতেন রবিনের বাবা। কয়েকদিন লোকজনের সামনে এমন গালাগালি তিনি দিয়েছিলেন যে মনের কষ্টে ও লজ্জায় তিনি কয়েকবার বাড়ি ছেড়ে পিসিদের বাড়ি চলে যান। নিজের ছেলেদের সঙ্গে এমন ব্যবহার কেউ করেন!!
তাছাড়া দুটো বউকেই তিনি পছন্দ করে এ বাড়িতে এনেছিলেন। কিন্তু দুজনের সঙ্গে দুরকম ব্যবহার কেন? ছোট বউয়ের সামান্য খুঁত পেলে ধুয়ে কাপড় পড়িয়ে দেন, কিন্তু বড় বউয়ের শত অপরাধও মাপ হয়ে যায়। গত হোলির দিন বড় বউ মদ খেয়ে বাড়ির সামনের তিন রাস্তার মোড়ে বেলাল্লাপনা করেও কোনো শাস্তি পান না। আবার পাড়ায় কারোবাড়ি যাওয়ার জন্য ছোটবউকে শ্বশুর-শাশুড়ির ভৎসনা সহ্য করতে হয় বছরের পর বছর। এ কেমন বিচার! এখনকার বেশিরভাগ সংসারেই এমনটি চলছে। আজকের সংসারে যে যত তেল দিতে পারে তার আদর ও কদরটাই বেশি।
একদিন মেঘ না চাইতে জলের মতো বড় বৌমা সুষমার ছেলে সৌভিত লাইন পাড়ের একটি মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি আনে। সুষমা দেখে আগুন হয়ে যান। বাড়িতে তাকে ঢুকতে দেয় না সে। কিন্তু দাদু-ঠাকুমা নাতির মুখের দিকে চেয়ে বড় ছেলে ও বড় বউকে বুঝিয়ে ঘরে তোলেন। সৌভিতের দাদু সুষমাকে বলেন---"লোক হাসিয়ে লাভ নেই। বিয়ে করেই যখন ফেলেছে, তখন মেনে নাও। কার ভাগ্যে কি আছে কেউ বলতে পারে না। তোমার ছেলের বাউন্ডুলেপনা এই মেয়েই ঠিক করে দেবে। আমরা অশান্তি চাই না। আর কদিন আমরা বাঁচব। আমার অনুরোধটি রাখো।" শশুরের কথা রেখেছিলেন সুষমা। কিন্তু মেয়েটির পরিবার ও মেয়েটিকে তার পছন্দ হয় না। কোন মতে নিজেদের মধ্যে বৌভাত সেরেছিলেন তিনি। রবিনরা এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই করেন নি। শুধু ঈশ্বরের কাছে বলেছিলেন--- " বড়বউকে যেন এই মেয়েটি উচিত শিক্ষা দেয়। এবার যেন ওনার অন্যের পিছনে লাগা বন্ধ হয়। যেমন কর্ম তেমন ফল লাভ করেন উনি।"
ঈশ্বর রবিনের কথা সত্যি সত্যি শুনেছিল। এক সপ্তাহ যেতে না যেতে বৌমার প্রতিটি কাজে খুঁত বের করে ঝামেলা করেন সুষমা। বৌমা চুপচাপ সব সহ্য করে চোখের জল ফেলে। সুষমা বুঝতে পারেন--- 'এই মেয়েকে সে উচিত শিক্ষা দিতে পাড়বে। এ খুবই নরম প্রকৃতির মেয়ে।' কিন্তু তার চিন্তা যে কতটা ভুল তা বুঝতে পাড়েন বিয়ের দুসপ্তাহ পর থেকে। একদিন রাতে সুষমার বৌমা তার ছেলের সাথে মায়ের এই আচরন নিয়ে তুমুল ঝগড়া করে। সে বলে--- "আমি এখনি আত্মহত্যা করব। তোমার ভবিষ্যৎ যদি আমি নষ্ট করে দিতে না পাড়ি তবে আমিও বিপাশা নই। তোমার মা কী ভেবেছে আমাকে, আমার উপর মানসিক অত্যাচার করবে আর আমি মুখবন্ধ করে সব মেনে নেব। সেগুরেবালি। ওনাকেও আমার টাইট দিতে বেশি সময় লাগবে না। উনি 'ঘুঘু দেখেছেন ঘুঘুর ফাঁদ দেখেন নি'।" সৌভিতের চোখে জল দেখা যায়। সে বিপাশাকে বলে --- " আমি মার সঙ্গে কথা বলব। তুমি এমনটি করো না। লোকে জানলে ছিঃছিঃ করবে।" সৌভিতের কথা শুনে বিপাশা বলে --- " আমি এই দুই সপ্তাহ এসে বুঝে নিয়েছি তোমার মাকে। তাছাড়া এ পাড়ার মানুষের কাছ থেকে আমি তোমাদের সবার ইতিহাস জেনে নিয়েছি। সবার পিছনে লাগা তোমার মার অভ্যাস। অত্যন্ত লোভী ও একাসেরে মহিলা। তোমার কাকা-কাকিমার মতো মানুষের পিছনে লেগে এসেছেন চিরদিন। তারা নরম প্রকৃতির মানুষ বলে তোমার মার সঙ্গে পেড়ে ওঠেন নি। তাছাড়া শ্বশুর-শাশুড়িকে চিরকাল হাত করে সর্বস্ব দখল করার খেলায় মেতে উঠেছেন উনি। বঞ্চিত করতে চান অন্যদের। তোমার বাবাও ভালো মানুষ নন। মদ খেয়ে নিজের ও এই পরিবারের মান-সম্মান নষ্ট করেছেন বারংবার। সেও তোমার মার মতো মানসিকতার। ভাই-বোনকে ঠকিয়ে একা ভোগ করতে চান। আমি জানি, আমি লাইন পাড়ের মেয়ে বলে তোমার মা আমাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু আমিও যে মানুষ সেটা উনি বোঝেন না।" এরপর সৌভিত বিপাশাকে বলে --- " তাহলে তুমি কী চাও? কী করব আমি?" বিপাশা বলে --- " তুমি তোমার মাকে বলে দিও উনি যেন আমার পিছনে না লাগেন, তাহলে উনাকে আমি উচিত শিক্ষা দিয়ে দেব। আমি কিন্তু তোমার কাকা-কাকিমার মতো নই। তুমি ভালোকরেই জানো আমি অন্যায় সহ্য করি না।"
ছেলের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সবকিছু শোনেন সুষমা। বুঝতে পারেন এ মেয়ে সুবিধার নয়। এর সঙ্গে পেড়ে ওঠা যাবে না। তাই পরের দিন সকালে ছেলেকে ডেকে মনের কষ্টে বলেন ---" আজ থেকে তোরা আলাদা থাক। তোর বউয়ের সব কথা গতকাল আমি শুনেছি। ও আমাদের সঙ্গে সংসার করতে পাড়বে না। তাছাড়া ওর কথা আমি সহ্য করতে পাড়ছি না।" ছেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে পড়ে উভয় সংকটে। একদিকে মা, অন্যদিকে বউ। মার আচরন ও চরিত্র অবশ্য ছেলের অজানা নয়। কিন্তু সে কিছু বলতে পাড়ে না। মায়ের কথা মতো বাড়িতে কাকাদের মতো হাড়ি আলাদা করে নেয়। একমাত্র ছেলে মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়। কাকা রবিন সমস্ত বিষয়টা শুনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলেন----- " আপনি আছেন প্রভু। এই দিনটির জন্যই বসে ছিলাম। যেমন কর্ম তেমন ফল।"
=====================