এলাকার একমাত্র বড় মাঠটায় এসে হাজির হয় বিনায়ক ওরফে বিল্টু।স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সামান্য কিছু খেয়েই বেরিয়ে পড়েছে সে বাড়ি থেকে।রোদের তেজ এখনো তেমন কমেনি।মাঠটা পুব পশ্চিমে লম্বা।পুব দিকে মাঠের ধার ঘেঁষে এলাকার বাসিন্দাদের যাওয়া আসার রাস্তা।বেশি চওড়া নয়।চার চাকা গাড়িগলো যেতে আসতে পারে কোনো মতে।রাস্তার পুব সীমানা বরাবর উত্তর দক্ষিণে সারিবদ্ধ বহুতল।এমনই এক বহুতলের তিন তলার ফ্ল্যাটে থাকে বিল্টুরা।বিল্টুর প্রিয় বন্ধু ঋদ্ধি ওরফে বুবাই।তারও এতক্ষণে আসার কথা।কেন যে দেরি করছে বুবাই! বুবাইরা থাকে মাঠের উত্তর দিকের দোতলা তিনতলা বাড়ির দঙ্গলের একটাতে।মাঠের উত্তর দিকেও পুব পশ্চিম বরাবর রাস্তা। এই রাস্তাটা চওড়া।বড় ট্র্যাকও ঢুকতে পারে অনায়াসে।এ দিকে কোনো বহুতল নেই।ব্যক্তিগত মালিকানার বাড়ি সব।রাস্তার পাশ দিয়ে উত্তর দক্ষিণ বরাবর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে অঢেল বাড়ি।দুটো বাড়ির সারির মাঝে অপ্রশস্ত রাস্তা।মিশেছে মাঠের পাশের চওড়া রাস্তায়।এমন সারিবদ্ধ বাড়ির লাইন দশ-বারোটা।
মাঠের মাঝবরাবর এমনই একটা গলিতে ঢুকতে বাম হাতে দুটো বাড়ির পর বুবাইদের তিনতলা বাড়ি।নিচের তলা ফাঁকা।ওদের বাড়িতে অতিথি এলে থাকতে দেওয়ার দুটো ঘর ঢুকতে দুপাশে।মাঝে একটা বেশ বড় বসার ঘর।একপাশে একটা বড়সড় গাড়ি রাখার ঘর।সেখানে ইস্পাত রঙের একটা দামি চারচাকা গাড়ি।বুবাইরা দূরে কোথাও গেলে এই গাড়িতেই যায়।একটা বুলেট বাইক।বুবাইয়ের বাবা সেটা চেপেই রোজ কাজে যান।আর আছে ছোটো একটা স্কুটি।বাজার কিম্বা কাছাকাছি কোথাও গেলে এটাতেই যান বুবাইয়ের বাবা।বুবাই বা তার মা ও মাঝেমধ্যে কাছেপিঠে কোথাও যায় পিছনে বসে।বুবাইরা বেশ বড়লোক।তার বাবা সরকারি ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা।তাদের অনেক টাকা।কিন্তু তার কোনো ছাপ পড়ে না তাদের ব্যবহারে।বিল্টু তো প্রায় দিনই মাঠে খেলার পর বুবাইয়ের সঙ্গে যায় ওদের বাড়ি।তার মা বাবা বেশ পছন্দ ও করেন তাকে।যত্ন করে খাওয়ান এটা সেটা।তারা দুজনেই পড়াশুনা করে ন্যাশানাল ইংলিশ স্কুলে।সেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে।দেখতে দেখতে অষ্টম শ্রেণি হয়ে গেল।বুবাইয়ের তুলনায় বিল্টুর রেজাল্ট একটু ভালো হয় প্রতি বছর।অবশ্য বুবাইয়ের রেজাল্টও বেশ ভালো।দুজনে স্কুলে যায় আসে একসঙ্গে।একবার তো টিফিনের সময় বুবাই পেটের ব্যথায় বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল।হেডস্যার স্কুলের গাড়িতে বুবাইকে বাড়ি পাঠিয়েছিলেন তাকে সঙ্গে দিয়ে।সেবার বুবাইকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সঙ্গেই ছিল বিল্টু।তার পর থেকে ওদের বাড়িতে তার কদর বেশ বেড়েছে।
বিল্টুরা তেমন বড়লোক নয়।মার কাছে শুনেছে তার বাবা সরকারি অফিসে কাজ করে।মাইনে যা পায় তাই দিয়ে তাদের চলে যায় মোটামুটি।অবশ্য কিছু জমানোর ব্যবস্থা করেছে মা।তার ভবিষ্যতের জন্যেই নাকি জমানো।মা কেবল বলে---ভালো করে পড়াশুনো কর।অনেক বড় হতে হবে তোকে।বড় কিছু করতে হবে।সে দিন হয়তো আমাদের অবস্থা আরও একটু ভালো হবে।বাবা এ নিয়ে কোনো কথাই বলে না তাকে।কেবল স্কুলের জন্যে পয়সা লাগলে কোনো কথা না বাড়িয়ে দিয়ে দেয় বাবা।এলাকায় অবশ্য ভালো মানুষ,সৎ ভদ্রলোক হিসেবে বাবার বেশ সুনাম।ভালোই লাগে বিল্টুর বাবার প্রশংসা শুনতে।মনে মনে ভাবে সে--বাবার মতোই সৎ ভদ্র মানুষ হতে হবে তাকে।কিন্তু বুবাই তো এলো না এখনো।বলেছিল তো--বাড়ি ফিরে আধা ঘন্টার মধ্যেই চলে আসবে মাঠে।কি হল বুবাইয়ের?গতকাল খেলতে গিয়ে চোট পেয়েছিল একটু পায়ে।ফুটবল খেলায় অমন তো হতেই পারে মাঝে মধ্যে।অবশ্য আজ স্কুলে যাওয়ার সময় দেখাচ্ছিল ওর ডান পা-টা একটু ফুলেছে।বেশ ব্যথা।তবে কি-----?
মাঠে এক এক করে অন্য ছেলেরা ও এসে পৌঁছোচ্ছে।খেলার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে সবাই।কেবল বুবাইয়ের দেখা নেই।মাঠের দক্ষিণ দিকটায় চোখ বোলাতে থাকে বিল্টু।অনেকটাই ফাঁকা জমি।ছোটো ছোটো প্লটে অল্প উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।প্লটগুলোতে আগাছার জঙ্গল হয়ে আছে।বাবা বলেছিল বিভিন্ন এলাকার লোকেরা কিনে ফেলে রেখেছে প্লটগুলো।পরে হয়তো বাড়ি করবে।নয়তো বিক্রি করবে ভালো দামে।এই এলাকায় জমির দাম বেশ বেশি।শুনেছে বিল্টু।
মাঠের পশ্চিম সীমানা দিয়ে চলে গেছে বাস রাস্তা।বাস ছাড়াও বিভিন্ন গাড়ি চলে রাস্তা দিয়ে।ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত।রাস্তার পশ্চিম দিক বরাবর দোকানের সারি।কত রকমের দোকান!রেষ্টুরেন্টও আছে কয়েকটা।দোকানের পিছন দিকটায় ছোটো ছোটো কিছু কারখানা।প্লাষ্টিক,টিনের বিভিন্ন জিনিস তৈরি হয়।বোর্ড-কাগজের কারখানাও আছে একটা।আর আছে কিছু লেদ কারখানা।অনেক মানুষ কাজ করে সেখানে।সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে আটটা পর্যন্ত।পুরো এলাকাটা বেশ সরগরম সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত।
গোলপোষ্টের পিছনে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা গাড়িতে চোখ আটকে যায় বিল্টুর।বুবাইদের গাড়ির মতোই দেখতে।তবে কি বুবাইরা আজ কোথাও যাবে?কাল তো শনিবার।স্কুল নেই।পরদিন ও না।কিন্তু বুবাই তো কিছু বলেনি তাকে!একসঙ্গেই তো স্কুলে গেল,ফিরল।মাঠে আসবে বলল।বুবাই কি যাওয়ার কথা জানত না আদৌ?না কি লুকিয়ে গেল?কেমন যেন লাগে বিল্টুর।আজ পর্যন্ত এমন করে নি তো বুবাই!পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বিল্টু গাড়িটার দিকে।কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গাড়িটা।কালো কাঁচগুলো সব বন্ধ।ভেতরে কেউ আছে কি না বোঝার পথ নেই।কিন্ত গাড়িটা বুবাইদের গাড়ির মতো একই রঙের হলেও আকারে একটু পার্থক্য আছে মনে হচ্ছে।দরজার হাতল গুলোও অন্য রকম।বুবাইদের গাড়িটা ভালো করেই দেখেছে সে বেশ কয়েকবার।তাতে বুঝতে পারে--এটা বুবাইদের গাড়ি নয়।খুব অবাক লাগে বিল্টুর।গাড়িটা এখানে দাঁড়িয়ে কেন?ভাবতে থাকে বিল্টু।কোনো কারণ মাথায় আসে না তার।এর আগে দু'একটা গাড়ি যে এখানে দাঁড়ায়নি তা নয়।তবে সে তো দুপুরের দিকে।ছুটির দিনে।কিছু খাওয়ার জন্যেই গাড়ি থামাতো আরোহীরা।এই শেষ বিকেলে এ গাড়িটা দাঁড়িয়ে কেন এখানে?গাড়ির নম্বর প্লেটে চোখ পড়ে বিল্টুর।পড়তে থাকে সে---WB 25 B 0325।এই নম্বরের গাড়ি তো এ পাড়ায় বা বুবাইদের পাড়ায় কারুর আছে বলে মনে হয় না।তাদের পাড়ায় তিনটে মাত্র চারচাকা।আর বুবাইদের পাড়ায় পাঁচ/ছয়টা।সেগুলোর নম্বর তো বহুবার চোখে পড়েছে বিল্টুর।নম্বরটা আরও একবার মনে মনে পড়ে নেয় বিল্টু।বুবাইয়ের দেখা নেই তখন ও।বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যের দিকে।একবার ভাবে বুবাইদের বাড়ি যাবে সে।কি ঘটেছে জানার জন্যে।অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ির কাছ থেকে সরে আসতে গিয়ে তার বুটের ডগায় ঠোক্কর খায় একটা লোনা ধরা ইঁটের টুকরো।সামনের দিকে পাক খেতে খেতে ছুটে যায় সেটা কিছুদূর।টুকরোটার লাট্টুর মতো পাক খাওয়াটা বেশ মজাদার মনে হয় বিল্টুর।এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নেয় টুকরোটা।উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে একটু এগোয় ও সামনে।তার পর কোন খেয়ালে সেটা হাতে নিয়েই বসে পড়ে প্রথম বাড়িটার রাস্তা-পাশের ড্রেনের কিনারায়।ড্রেনের ঢালাই ঢাকনায় টুকরোটা দিয়ে ঘষে ঘষে লিখে ফেলে---WB 25 B 0325।
চমকে ওঠে বিল্টু বুবাইয়ের ডাকে---কি করছিস রে বিল্টু ড্রেনের পাশে বসে?কি লিখছিস ওসব?অ্যালজেব্রার ফর্মুলা নাকি?
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় বিল্টু।হাতের ইঁটের টুকরোটা ছুঁড়ে দেয় মাঠের দিকে।বলে---ওরে না---না,তুই আসছিস না।সময় কাটতে চাইছিল না।খেলা শুরু হতে চলল।আজ আর আমরা সুযোগ পাব?এত দেরি করলি কেন তুই?
---আর বলিসনে ভাই!চন্দননগর থেকে মাসি,মেসোমশাই এসেছেন।সঙ্গে মাসতুতো বোনটিও।তার আব্দার মেটাতেই দেরি হয়ে গেল।ছাড় ও সব।পরে হবে কথা।আগে মাঠে চল দেখি।দল গঠন হয়ে গেল মনে হচ্ছে।
দেরি করে না বিল্টু।বুবাইকে নিয়ে প্রায় দৌড়ে মাঠে ঢুকে পড়ে।সাধাসাধি করে জায়গা করে নেয় দুজন।তবে দুটো পৃথক দলে।আজ বুবাই বিল্টুর প্রতিদ্বন্দ্বী।তা হোক।এ তো কোনো প্রতিযোগিতা নয়।প্রাক্টিস ম্যাচ।আলাদা দলে হলে অসুবিধে কোথায়?
খেলা জমে উঠেছে।হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে দু'দলে।প্রায় ঘন্টা পার হতে চলল।কোনো দলই গোল করতে পারছে না।বিল্টু একটা দলের ফরোয়ার্ডে খেলছে।অন্য দলের স্টপার বুবাই।প্রতিদ্বন্দ্বী দলের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বার বার দেখা হচ্ছে বিল্টু আর বুবাইয়ের।দুজনেই মুচকি হেসে নজর দিচ্ছে বলের দিকে।স্টপারে ভালোই খেলে বুবাই।ফোলা পা নিয়েও যে ভাবে একটার পর একটা সেভ করছে তাতে বিল্টুরা আজ আর গোল করতে পারবে না বলে মনে হচ্ছে।কম যায় না বুবাইদের দল।এ পর্যন্ত আধ ডজন বার তাদের খেলোয়াড়রা বিল্টুদের রক্ষণ ভেদ করে পৌঁছে গেছিলো গোলের কাছেই। গোল করতে পারে নি নিজেদের কিকের দোষেই।একবার তো তাদের গোলকিপার একটা জোরালো কিক সেব করে দিল বারের উপর দিয়ে ঠেলে।
সূর্য্য ডুবতে চলেছে।আলো কমে আসছে।আর বেশি সময় খেলা চলবে বলে মনে হয় না বিল্টুর।গোল শূন্যই থাকবে আজ খেলা।বিপক্ষ দল মরিয়া হয়ে উঠেছে।আক্রমণ প্রতিআক্রমণে খেলার গতি বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত লয়ে।এমনই একটা সময়ে মাঝমাঠে বুবাইদের হাফব্যাকের পা থেকে বল কেড়ে নেয় বিল্টুর দলের এক খেলোয়াড়।বিল্টু তখন দাঁড়িয়ে মাঠের দক্ষিণ দিকে।মাঠের সেন্টার থেকে বুবাইদের দিকে একটু চেপে।বল বিল্টুর দিকে ঠেলে দেয় তার দলের ছেলেটি।বল ধরে বিল্টু তাকায় মাঠের বিপক্ষ অংশে।মাত্র তিনজন খেলোয়াড় সেখানে।একজন উত্তর অংশ থেকে দৌড়ে আসছে বিল্টুর দিকে।অন্য একজন পেনাল্টি বক্সের বাইরে ছিল।সে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে গোলের কাছে।আর আছে বুবাই।ঠিক তার সামনে।কয়েক হাত দূরে।বিল্টু বেশ বুঝতে পারে বুবাইকে কাটাতে পারলেই সামনে কেবল গোলকিপার।বল নিয়ে সে একটু এগিয়ে যায় দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে।নজর তার বলের দিকেই।বুবাইদের গোলকিপার ক্রমাগত এগিয়ে আসছে গোলমুখ ছেড়ে।বুবাই ছাড়া বাকি দুজন খেলোয়াড় বল থেকে দূরেই।বুবাই আছে কাছে।কিন্তু---না তো!বুবাই তো এগিয়ে এলো না বল লক্ষ্য করে?তবে কি সে গোল করার সুযোগ করে দিচ্ছে বিল্টুকে?তা কি করে হয়?খেলায় তো সে বেশ আন্তরিক।এগোনো এক ঝলক থামিয়ে বিল্টু তাকায় বুবাইয়ের অবস্থানের দিকে।সেখানে তো নেই বুবাই!কি ব্যাপার?গেল কোথায়?তার কি প্রবল টয়লেট পেল এ সময়ে?না--কি----!বলে কিক করা ভুলে বিল্টু তাকাতে থাকে মাঠের চারিদিকে।বুবাইদের গোলকিপার ততক্ষণে বিল্টুর কাছে পৌঁছে গেছে।পা দিয়ে সে বল ঠেলে পিঠিয়ে দেয় মাঝমাঠে।বিল্টুর চোখ তখন পশ্চিম দিকের গোলপোষ্টের পিছনে।বড় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো গাড়িটার দিকে।গাড়িটার একটা দরজা আধখোলা।বুবাই পৌঁছে গেছে দরজার কাছে।অবাক বিস্ময়ে খেলা ফেলে সেদিকে দৌড়োয় বিল্টু।সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠছে।বুবাই হঠাৎ ওখানে গেল কেন?কখন মাঠ ছাড়ল সে?
গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল বুবাই।বন্ধ হল গাড়ির দরজা।গাড়িটা গড়াতে লাগল দক্ষিণ-মুখো।রাস্তায় উঠে ক্রমশঃ দূরে চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে হতভম্বের মতোই তাকিয়ে থাকে বিল্টু।গাড়িটা কার?কোথা থেকে এসেছিল?যাচ্ছে বা কোথায়?খেলার পোশাকে বুবাই বা উঠল কেন তাতে?বাবা মাকে কিছু না জানিয়ে এই ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যেয় কোথায় যাচ্ছে বুবাই?এমন কি জরুরি----!সব তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে বিল্টুর ভাবনায়।এটা কি কোনো খারাপ লক্ষণ?বুবাইদের বাড়িতে তো মনে হচ্ছে এখুনিই যাওয়া দরকার।বিল্টু দৌড়োয় বুবাইদের বাড়ির দিকে।
চেনা বাড়িটার সদর দরজার পাশে দেয়ালে আটকানো কলিং বেলের সুইচ।ঘন ঘন সুইচে চাপ দিতে থাকে বিল্টু।উপর থেকে ভেসে আসে---বুবাই ফিরলি নাকি?যাচ্ছি বাবা। একটু সবুর কর।ওভাবে বেল বাজালে নষ্ট হয়ে যাবে তো বেলটা।
কেটে যায় কয়েক মুহূর্ত।সদর দরজা খুলে বিল্টুকে দেখতে পান বুবাইয়ের মা।চমকে উঠে জিজ্ঞেস করেন---বল্টু---তু---ই---?বুবাই কোথায়?
---সেটাই তো জানাতে এলাম কাকিমা।বুবাই---!
---কি---ই---ই!কি হয়েছে বুবাইয়ের?হাঁফাচ্ছিস কেন তুই?তবে কি----?
---তোমাদের গাড়ির মতো একটা গাড়ি------!
---কি যা--তা--বকছিস!বুবাই কোথায় বল শিগগির।বুবাইয়ের মায়ের বুকের ভেতরটা টনটনিয়ে ওঠে।গলায় দলাপাকিয়ে ওঠে কান্না। চোখে চলে আসে জল।
---তোমাদের গাড়ির মতোই একটা গাড়িতে গিয়ে উঠেছে বুবাই।খেলতে খেলতে কখন যে-----!
---তার মানে?কার গাড়ি?কোথায় সে গাড়ি?
---বুবাই উঠতেই গাড়িটা ছুট দিলো দক্ষিণ দিকে।
---কি বলছিস এসব!কেউ কি ডেকেছিল ওকে?
---শুনতে পাইনি কাকিমা।খেলায় ব্যস্ত ছিলাম----।আচ্ছা---কাকিমা---;তোমাদের বাড়িতে অজ কোনো আত্মীয় এসেছেন?
---কই--নাতো।কিন্তু এসবের সঙ্গে বুবাইয়ের সম্পর্ক কি?তুই কিছু লুকোচ্ছিস মনে হচ্ছে।সত্যি করে বল।মজা করার সময় এটা নয় বিল্টু।আমার মন-----!
---সত্যি বলছি কাকিমা।বুবাই মাঠে যেতে দেরি করেছিল।কারণ জিজ্ঞেস করতে বলেছিল---মাসি, মেসোমশাই এসেছেন।সঙ্গে বোনও।তাই----।
পুরো বিষয়টা তালগোল পাকিয়ে যায় বুবাইয়ের মায়ের মাথায়।কি করা উচিত বুঝতে পারেন না।বুবাইয়ের বাবাকে ফোন করবেন ভাবেন।পা বাড়ান সিঁড়ির দিকে।বিল্টু ঠায় দাঁড়িয়ে বাইরে।হঠাৎ বুবাইয়ের মায়ের মুঠোয় ধরা ফোনটা বেজে ওঠে।চমকে যায় বিল্টু।অজানা আতঙ্কে সে সেঁধিয়ে যায় ঘরের মধ্যে।দাঁড়িয়ে যান বুবাইয়ের মা।ফোনটা মেলে ধরেন চোখের সামনে।অচেনা নম্বর থেকে ফোন।ধরবেন কি না বুঝতে পারেন না।কেটে যায় ফোন।বিল্টু জিজ্ঞেস করে---কে ফোন করল এখন কাকিমা?কাকু নাকি?উত্তর আসার আগেই আবার বাজে ফোন।বিল্টু কাঁপা গলায় বলে---ফোনটা রিসিভ করুন কাকিমা।হয়তো-----!
কিডন্যাপড হয়েছে বুবাই।কিডন্যাপাররা জানালো বুবাই তাদের কাছে আছে।নিরাপদেই আছে।মুক্তিপন হিসাবে তাদের পঞ্চাশ লক্ষ টাকা চাই।টাকা পেলে তবেই তারা নিরাপদে বুবাইকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।কবে, কোথায়,কোন সময়ে,কি ভাবে টাকা পৌঁছে দিতে হবে সেটা তারা রাতের দিকে জানাবে।আপাতত তারা টাকা যোগাড় করুক।
টলতে থাকেন বুবাইয়ের মা।বোবা দৃষ্টিতে তাকান বিল্টুর দিকে।তাঁর বুকের ধুকপুকুনির শব্দ কানে আসে বিল্টুর।তারও শরীর কাঁপছে প্রবল আতঙ্কে।ফোনের কথাগুলো অস্পষ্ট হলেও শুনতে পেয়েছে সে।তার মাথায় ঘুরে চলেছে বুবাইয়ের মিথ্যে বলাটা।এই প্রথম সে মিথ্যে বলেছে বিল্টুকে।কিন্তু কেন?---ভাবতে থাকে বিল্টু।হঠাৎ তার চোখ পড়ে বুবাইয়ের মায়ের দিকে।জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি।পড়ে যাবেন যে মেঝেতে!ত্রস্ত হাতে তাঁকে জাপটে ধরে বিল্টু।মুখ থেকে তার বেরিয়ে আসে জোরালো চিৎকার---কা---কি---মা---আ---আ---!চেষ্টা করতে থাকে সে তার কাকিমাকে টেনে সামনের সোফাটার কাছে নিয়ে যেতে।
বিল্টুর চিৎকারে দোতলার ভাড়াটিয়াদের অনেকেই নেমে আসেন নিচে।সব জেনে তাদেরই একজন ফোন করেন বুবাইয়ের বাবাকে।দ্রুত বাড়িতে আসতে বলেন।জানান--তাঁর স্ত্রী অসুস্থ।দুজন মহিলার সাহায্য নিয়ে বিল্টু ততক্ষণে সোফায় আধশোয়া করে দিতে পেরেছে তার কাকিমাকে।সোফায় হাত পা ছড়িয়ে গোঁয়াতে থাকেন তিনি।তাঁর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয় বিল্টু।কল লিষ্ট ঘেঁটে সদ্য আসা ফোনের নম্বরটা বের করে সে।মেঝের টি-টেবিলের নিচে পড়ে থাকা পুরোনো খবরের কাগজ থেকে ছিঁড়ে নেয় একটু ফাঁকা টুকরো।টেবিলের উপর পড়ে থাকা সস্তা বলপেনটা দিয়ে অনেক কসরতে লিখে নেয় বের করা ফোন নম্বরটা।উপস্থিত ভাড়াটিয়াদের দু-একজন থানায় জানাতে বলেন বিল্টুকে।কোনো কথা বলে না বিল্টু।অপেক্ষা করতে থাকে বুবাইয়ের বাবার আসা পর্যন্ত।
বুবাইয়ের বাবা বাড়িতে ফিরে বিস্তারিত জেনে নেন ঘটনা সম্পর্কে বিল্টুর কাছে।তাঁর মনেও একটা খটকা লাগে।কাউকে কিছু না বলে এভাবে গাড়িটাতে কেন গিয়ে উঠল বুবাই?বিল্টুকেই বা মিথ্যে বলল কেন?বুবাই তো মিথ্যে বলে না তেমন!কি কারণ থাকতে পারে এর পিছনে--ভেবে পান না তিনি।বুবাইয়ের মায়ের মাথার পাশে গিয়ে বসে পড়েন তিনি কোনো মতে।বুবাইয়ের বাবার গলার স্বরে সম্বিৎ ফেরে বুবাইয়ের মায়ের।কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট স্বরে কেটে কেটে বলেন তিনি ফোনে শোনা কথা গুলো।হতাশ গলায় বুবাইয়ের বাবা বলেন---কি আর করা যাবে।একমাত্র সন্তান বুবাই।টাকাপয়সা তো ওর ভবিষ্যত ভেবেই রাখা।ওকে বিপদমুক্ত করতে যদি এতটা টাকা দিতেই হয় যোগাড় তো করতেই হবে।এর বাইরে আমাদের তো করার আর কিছুই নেই।এখন ধৈর্য্য ধরে আগামী ফোন-কলের অপেক্ষা।বুবাইয়ের মায়ের মাথায় হাত রেখে নাড়াতে থাকেন মাথাটা।গলায় জোর এনে বলেন---এত ভেঙে পড়লে চলবে না এখন।যে ভাবেই হোক টাকা জোগাড় করব আমি।প্রয়োজনে সব সঞ্চয় উজাড় করে দেব।তবু বুবাইয়ের কিছু হতে দেব না।মন শক্ত কর একটু।ওঠো,উপরে চল।কোথায়,কখন টাকা দিতে হবে জানাক আগে।তার পর ব্যবস্থা।তার আগে কয়েক জায়গায় ফোন করতে হবে।বন্ধুদের কাছেও সব জানিয়ে কিছু ধার পাই কি না দেখি।
বিল্টু বলে---ওসব তো করবেনই কাকু।কিন্তু থানাতে একটু জানানো দরকার মনে হচ্ছে।এক বার----?
---কিছু লাভ হবে কি?থানা-পুলিশ করতে গেলে তাদের কথা মতোই চলতে হবে।তাতে অকারণ বিলম্ব ঘটে যেতে পারে।বুবাইয়ের কোনো ক্ষতি-----!
---আমার মনে হয় না তেমন কিছু হবে।কিডন্যাপাররা এখনো হয়তো তাদের গোপন যায়গায় পৌঁছোতে পারেনি।থানাকে জানানোর বিষয় এত তাড়াতাড়ি তারা ভাববে বলে মনে হয় না।তা ছাড়া তাদের দাবি মতো টাকা দেওয়ায় সম্মতি দিতে আমি আপনাকে নিষেধ করছি না কাকু।আপনার ভাবনা মতোই সব চলুক।কেবল থানাকে একটু----।
কয়েক দণ্ড কি যেন ভাবেন বুবাইয়ের বাবা।বলেন---তাই হোক।থানাতে একটা F I R নাহয় করেই রাখি।তবে তার আগে এদিকটা গুছিয়ে নিতে হবে।কাকিমাকে এক দিকে ধর দেখি।উপরে নিয়ে যাই।একটু জলটল খাক।পাখার হাওয়ায় একটু সুস্থ বোধ করলে তার পর নাহয়----।
উপরে গিয়ে বিল্টু একটু সাদা কাগজ আর কলম চেয়ে নেয়।তাতে আগের লেখা ফোন নম্বরটা পরিষ্কার করে লেখে।কলম আর কাগজের টুকরোটা হাতের মুঠোয় রেখে বলে--- কাকু আমি একটু বাড়িতে যাচ্ছি।আধাঘন্টার মধ্যেই ফিরব।এ সব খুলে জামা প্যান্ট পরে নেব।বাবা মাকে বলে সঙ্গে নিয়ে আসব।কাকিমাকে একটু দেখবেন।আমিও আপনার সঙ্গে থানায় যাব।
সব দিক সামলে নাছোড় বিল্টুকে স্কুটির পিছনে বসিয়ে থানায় গিয়ে পৌঁছান বুবাইয়ের বাবা।সন্ধ্যে তখন আটটা ছুঁইছুঁই।বাড়িতে রেখে এসেছেন বিল্টুর বাবা মাকে।বলেছেন---রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা সেখানেই হবে।তাঁরা যেন অস্থির না হন।থানা থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশের কোনো একটা রেস্টুরেন্ট থেকে সবার জন্যেই কিনে নেবেন কিছু।বিল্টুর মুঠোয় ধরা ছোটো এক টুকরো কাগজ।তাতে কিডন্যাপারদের ফোন নম্বর আর গাড়ির নম্বর লেখা।বাড়িতে যাওয়ার পথে গাড়ির নম্বরটা লিখে নিয়েছিল বিল্টু।এমনিতেই মনে ছিল নম্বরটা।তবু একবার ড্রেন-স্লাবে লেখাটা রাস্তার আলোয় দেখে মিলিয়ে নিয়েছে সে।
ও,সি-র ঘরে ঢোকেন বুবাইয়ের বাবা।পিছনে বিল্টু।ও,সি-কে নিজের পরিচয় দিয়ে আজকের পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে জানান তিনি।ও, সি তাঁকেবসতে চেয়ার দেখিয়ে বলেন---চাক্ষুস দেখেছে কি কেউ?
বুবাইয়ের বাবা বিল্টুর দিকে ইঙ্গিত করেন।ও, সি জানতে চান ছেলেটির পরিচয়।পরিচয় পেয়ে বিল্টুর কাছ থেকে পূর্বাপর পুরো ঘটনা জেনে নেন।বিল্টু সুযোগ বুঝে হাতের কাগজের টুকরোটা ও,সি-র দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে---ওদের ফোন নম্বর আর গাড়ির নম্বর।
উৎফুল্ল ও, সি বলেন--বাঃ,---তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান ছেলে হে!ভালো---ভালো।আমাদের কাজের সুবিধা হবে।বুবাইয়ের বাবার উদ্দেশে বলেন---খুব ভালো করেছেন দ্রুত থানায় এসে।ব্যাটারা এখনো সব দিক গুছিয়ে উঠতে পারে নি মনে হয়।দুটো ভালো ক্লু হাতে পেয়েছি।দেখি কি করতে পারি।বেশ কিছুদিন ধরে গোটা উত্তর 24পরগণার ছোটো শহর,শহরতলি দাপাচ্ছে এই কিডন্যাপাররা।অবস্থাপন্নদের ঘাড় ভেঙে আদায় করছে মোটা টাকা।শত চেষ্টাতেও ধরা যাচ্ছে না ব্যাটাদের।আসলে কোনো জোরালো ক্লু মেলে না সেভাবে।তার উপর ভুক্তভোগীরা থানাকে জানান বেশ দেরি করে।এটা দেখছি একদম টাটকা।দক্ষিণ দিকে গেলে অনেক গুলো সম্ভাব্য ঠেক।ডায়মণ্ড হারবার, বজবজ,জয়নগর বা কোনো প্রত্যন্ত গ্রাম হতে পারে।যাই হোক,চেষ্টা তো একবার করে দেখি।
কাগজের টুকরোটা ডিউটি অফিসারকে দিয়ে ফোন লাগাতে বলেন ও, সি।বুবাইয়ের বাবাকে বলেন--কল রিসিভ করলে আপনিই নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলবেন।থানায় বসে আছেন--এটা ভুলেও বলবেন না।কেবল বলবেন বুবাইয়ের মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।আপনি উদ্বিগ্ন।তাই ফোন পাওয়ার অপেক্ষা না করে ফোন করেছেন।আর--হ্যাঁ,---মুক্তিপন দিতে আপনি যে রাজি তা জানাবেন অনুনয়ের ভঙ্গিতে।জানতে চাইবেন--কোথায়,কখন টাকা দিতে হবে।বাকিটা আমরা দেখব।
ফোনে সংযোগ হয়।ফোন চলে আসে বুবাইয়ের বাবার হাতে।ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি একান্ত অনুরোধের ঢঙে জানতে চান বুবাইয়ের অবস্থান।তার শারীরিক অবস্থা।ওপাশ থেকে পরিচয় জানতে চাওয়া হয়।জানানোর পর প্রথমেই সতর্ক করা হয় পুলিশকে যেন কোনোকিছু না জানানো হয়।জানালে বুবাইয়ের ক্ষতি হতে পারে।জীবন্ত ফিরে পাওয়া নাও যেতে পারে।বুবাই সুস্থ আছে জানিয়ে বলা হয় তাদের দাবি মাত্র পঞ্চাশ লক্ষ টাকা।টাকাটা যত দ্রুত তারা পাবে তত তাড়াতাড়ি বুবাইকে পৌঁছে দেওয়া হবে বাড়ির কাছে।তবে বাকি বিষয় একটু রাতের দিকেই জানানো হবে।
ফোন কেটে যায়।কথা চলা কালিন ট্র্যাক করে টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যায় বজবজের কাছে।ও, সি বলেন---রাতের দিকে ফোন করবে ব্যাটারা।তার মানে---হয় এখনো খোঁয়াড়ে ঢুকতে পারেনি।নয়তো সবটা গুছিয়ে উঠতে পারেনি।আমরা এখুনিই রওনা হব।রাস্তায় যদি ফোন আসে গাড়ি বন্ধ করে রিসিভ করতে হবে।কথা বলতে হবে।তাতে সুবিধা হবে।কিন্তু কোনো অবস্থায় জন্তুগুলো যেন বুঝতে না পারে আমরা ধাওয়া করছি।
একটা ক্রিম রঙের গাড়ি বের হল থানা থেকে।রাত তখন প্রায় দশটা।বুবাইয়ের বাবার জন্যেই একটু দেরি হল।তিনি একবার বাড়িতে গেছিলেন কিছু খাবারদাবার দিয়ে আসার জন্যে।পুলিশ সঙ্গে নিয়ে তাঁরা যে বের হচ্ছেন অপরাধীদের খোঁজে--সেটা জানিয়ে আসেন বুবাইয়ের মাকে।সান্ত্বনা দেন--সব মিটে যাবে ভালোয় ভালোয় আশা করা যায়।তা ছাড়া রওনা হওয়ার আগে সবাই খেয়ে নেন হাল্কা কিছু।রাতে খাবার জোটার সম্ভবনা খুবই কম।
গাড়িটির সামনে ড্রাইভারের পাশে একজন অফিসার।মাঝে ডানদিকে বুবাইয়ের বাবা।মাঝে থানার ও, সি। আর বামদিকে আরও একজন অফিসার। পিছনের জোড়া সিটে একা বিল্টু।গাড়ির ড্রাইভার সহ সব অফিসারের পরনে সাধারন মধ্যবিত্তের পোশাক।তিনটি বুলেট ভরা আগ্নেয়াস্ত্র একটা ছোটো ব্যাগে ভরে নেওয়া হয়।রাখা হয় সামনে বসা অফিসারের পায়ের কাছে।আর নেওয়া হয় কয়টি হাতকড়া।যদি প্রয়োজন হয়।গাড়ি ছুটতে থাকে বজবজ মুখো।গাড়ির সব কাঁচ পুরোপুরি তোলা।বেরুবার সময় ডিউটি অফিসারকে সতর্ক করে যান---রাস্তায় ফোন-কল আসলে ইন্টার কানেকশন করে দেওয়া হবে থানার ফোনের সঙ্গে।দ্রুত টাওয়ার ট্র্যাক করে ও,সি-কে জানাতে হবে অপহরনকারীদের অবস্থান।ও, সি গাড়িতে বসেই যোগাযোগ করেন বজবজ থানার সঙ্গে।নিজের পরিচয় ও ঘটে যাওয়া ঘটনা সংক্ষেপে জানিয়ে বজবজ থানার ও, সি-কে অনুরোধ করেন প্রস্তুত থাকতে। ডাক পেলে দ্রুত যেন ঘটানা স্থলে পৌঁছান তিনি প্রয়োজনীয় ফোর্স নিয়ে।তাঁদের সাহায্য ছাড়া অপরাধীদের ধরা সম্ভব না ও হতে পারে।বজবজ থানা প্রয়োজনীয় সাহায্যের আশ্বাস দেন।গাড়ির সবাইকে ও, সি সতর্ক করেন---রাস্তায় যদি কোথাও পেট্রল পুলিশ বা অন্য কেউ গাড়ি আটকায়,কেউ যেন কোনো কথা না বলেন।যা বলার তিনিই বলবেন।
গাড়ি বজবজ টাউন সীমানায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে যায়।হঠাৎ বেজে ওঠে বুবাইয়ের বাবার ফোন।ফোন ইন্টার কানেকসন করে দিয়ে কল রিসিভ করে কথা বলতে ইসারা করেন ও, সি।অপহরনকারীদের কল।বুবাইয়ের বাবা বলছেন কি না জেনে নিয়ে ও প্রান্ত থেকে বলা হয় মুক্তিপনের কথা।বলা হয় পরদিন একটা ব্রিফকেসে টাকা ভরে তাঁকে সন্ধ্যে ছটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে ডায়মণ্ড হারবার।দাঁড়াতে হবে পারাপারের বাঁধানো ঘাটটার কাছে।তার পরের করনীয় তিনি পৌঁছালে জানানো হবে।থানা থেকে ও, সি-কে জানানো হয় ফোন কলের টাওয়ার লোকেশন।ও,সি বুঝতে পারেন সঠিক পথেই এসেছেন তাঁরা।
গাড়ি ঢুকে পড়ে বজবজ টাউনের মধ্যে।গাড়ির গতি অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।রাস্তার দু'পাশে সবাই তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেছেন।যদি সন্দেহ জনক কিছু চোখে পড়ে।নজর রাখছে বিল্টুও।ঘুমিয়ে থাকা শহর।রাস্তার দু'পাশের বাড়িগুলো অন্ধকার।কেবল রাস্তার বাতিস্তম্ভ গুলো থেকে অপর্যাপ্ত আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।আরোহীদের মুখে কথা নেই।কেটে যায় কয়েক মিনিট।গাড়ি পাশ কাটিয়ে যায় একটা প্রায় সমাপ্ত বহুতল।এটি অন্য বাড়িগুলোর মতো অন্ধকার নয়।বাড়িটির দু'পাশের সংলগ্ন গলিদুটিতে জ্বলছে অল্প পাওয়ারের এল,ই,ডি।তিন তলার একটা ঘর থেকে বের হচ্ছে হাল্কা আলো।হঠাৎ বিল্টু চাপা স্বরে বলে---ও,সি কাকু---গাড়িটা দেখতে পেয়েছি আমি।
---কখন?---কোথায়?
---একটু আগে ডানহাতে ফেলে আসা অসম্পূর্ণ ফ্ল্যাটবাড়িটার পশ্চিম গলির মধ্যে।
---ঠিক দেখেছিস তুই?তুই নিশ্চিত কি এটা সেই গাড়ি?
---না---তা ঠিক নয়।তবে সে রকমই মনে হল যেন।
একটু এগিয়ে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার পাশে।ও,সি ফোন করে বজবজ থানাকে বলেন দশ/বারো জন সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের অবস্থানে পৌঁছোতে।মিনিট কুড়ির মধ্যেই বজবজ থানার ও,সি সহ ফোর্স পৌঁছে যায়।তাঁদেরকে বলা হয় বাড়িটির চারপাশ ঘিরে ফেলতে।বুবাইয়ের বাবা আর বিল্টুকে বলা হয় গাড়ির মধ্যে থেকে যেতে।না ডাকা পর্যন্ত তারা যেন বাইরে বের না হয়।গাড়ির দরজাও খুলতে বারন করা হয়।বজবজ থানার ও,সি-র ইসারা পাওয়ার পর গাড়ি থেকে নামেন তিন জন।হাতে লোডেড পিস্তল।চরম সতর্কতায় নিঃশব্দে তিনজন এগিয়ে যান বাড়িটির দিকে।দু'পাশের গলি দুটি দেখে নেন ভালো করে। দেখেন গিড়িটিও।বিল্টুর দেওয়া টুকরো কাগজে লেখা নম্বরটা ও মেলান।ও,সি-র মুখে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি।আসন্ন সাফল্যের সম্ভবনায় হয়তো।রাস্তায় ফিরে উপর দিকে তাকিয়ে দেখতে পান তিন তলার একটা ঘরের হাল্কা আলো।তার পর সিঁড়ি খুঁজে বের করে ফোনের আলোয় চরম সতর্কতায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকেন উপরে।তিন তলার উদ্দিষ্ট ঘরটার কাছে পৌঁছে দেখেন দরজার পাল্লা লাগানো হয়নি তখনো।দরজামুখে পৌঁছে উঁকি দেন ভিতরে।চারজন লোক ত্রিপল পেতে আধশোয়া অবস্থায়।ঘুমে আচ্ছন্ন তারা।ঘরে জ্বলছে অলপ ওয়াটের এল, ই, ডি।দরজা পাশে অস্ত্র উঁচিয়ে পজিশন নেন ও, সি।অফিসার দু'জন ঢুকে পড়েন ঘরের ভিতর।তাঃদেরও দৃঢ় মুষ্ঠিতে অস্ত্র।আঙুল ট্রিগারে।ঘুমন্ত চারজনের কাছে গিয়ে একজন অফিসার টানটান দাঁড়িয়ে পড়েন তাদের সামনে।অন্যজন বাম হাতে খোঁচা দেন এক ঘুমন্তকে।খোঁচা খেয়ে লোকটা পাশ ফিরে শোয়।এবার একটা জোরালো ধাক্কা।ধড়মড়িয়ে উঠে বসে লোকটা।তার পরনে সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক।চোখ কচলাতে কচলাতে একরাশ বিরক্তি নিয়ে চাপা গলায় সে বলে---হল কি রে নন্টে?পাশে তাকিয়ে দেখে নন্টে তখনো ফোঁসফোঁস করে ঘুমোচ্ছে।একটু বিরক্ত হয়ে সামনে তাকাতেই তার মুখ হাঁ হয়ে যায়।গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে--আঁ---আঁ---আঁ--শব্দ।সেই শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বাকি তিন জনের।ধড়মড়িয়ে উঠে বসে তারা।সামনে দু'জন শক্তপোক্ত লোককে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের ঘোর কেটে যায়।ইতিমধ্যে একজন মাথার কাছে রাখা দেশি পিস্তলটা হাতে তুলে নিতে চেষ্টা করে।ঝটিতে একজন অফিসার পিস্তলের বাঁট দিয়ে তার হাতে সজোরে আঘাত করেন।ককিয়ে ওঠে লোকটা।অস্ত্রটা বামহাতে তুলে নেন অফিসার।পাশের একজন আচমকা দুই হাতে দুই অফিসারকে জোরে ধাক্কা দেয়।দৌড়ে দরজার দিকে যায় সে।সেখানে দাঁড়ানো ও, সি-র হুঙ্কার গমগমিয়ে দেয় ঘর।খান খান করে দেয় রাতের নীরবতা।তাঁর হাতের উদ্ধত পিস্তল দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে লোকটা দু'হাত দূরে।ততক্ষণে ধাক্কা সামলে দুই অফিসার চিৎকার করেন সমস্বরে---হাত উপরে তোলো সবাই।চালাকি করলেই লাশ হয়ে যাবে মুহূর্তে।দরজার পাশ থেকে ও, সি একটা ব্লাঙ্ক ফায়ার করেন জানালা লক্ষ্য করে।চারজনই বুঝে যায় পালাবার পথ বন্ধ।একে একে শক্ত করে হাত বেঁধে ফেলা হয় চারজনের।ঘরের মধ্যে পড়ে থাকা বাঁশ বাঁধার নারিকেল দড়ি দিয়ে।জানতে চাওয়া হয় বুবাইয়ের অবস্থান।তাদের কথা মতো পাশের অন্ধকার একটা ঘর থেকে অচৈতন্য বুবাইকে উদ্ধার করা হয়।একজন অফিসার বুবাইকে তুলে নেন পাঁজাকোলা করে।বজবজ থানার ও, সি-কে চিৎকার করে সার্চলাইট জ্বালাতে অনুরোধ করা হয়।
সার্চলাইটের আলোয় নিচে নামেন অফিসাররা।সঙ্গে চার অপরাধী।বিল্টুরা যে গাড়িতে বসে ছিল সেখানে যান বুবাইকে কোলে রাখা অফিসার।গাড়ির মাঝের সিটে শুইয়ে দেওয়া হয় অচৈতন্য বুবাইকে।বুবাইয়ের বাবার অস্থির অবস্থা দেখে অফিসার বলেন--জ্ঞান নেই।তবে বেঁচে আছে।এখন সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।কাছেপিঠের যে কোনো একটা হসপিটালে ভর্তি করতে হবে একে এখুনিই।আশা করা যায় সুস্থ হয়ে উঠবে অবিলম্বে।খারাপ কিছু যদি ঘটে যায় তো কপাল----!হঠাৎ বুবাইয়ের বাবার চোখ পড়ে একেবারে পিছনে দাঁড়ানো হাত বাঁধা লোকটার উপর।স্বল্প আলোতেও চিনতে অসুবিধে হয়নি তাঁর একমাত্র শালাবাবুকে।চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করেন তিনি।কোনো কথা বের হয় না তাঁর গলা থেকে।কেবল হাঁ হয়ে যায় তাঁর মুখটা বেঢপ ভাবে।
ও, সি পিঠ চাপড়ে দেন বিল্টুর।মুখে বলেন---ওয়েল ডান বয়--ওয়েল ডান! আরও অনেক কথাই বলা হয়ে যায় এই পিঠ চাপড়ানোতে।বজবজ থানার পিজন ভ্যানে তোলা হয় চার আসামিকে।করমর্দন করেন দুই ও, সি।প্রিজন ভ্যান ছুটে যায় বজবজ থানামুখো।গাড়িতে পিছনে সামনে ঠাসাঠাসি করে বিল্টু সহ চারজন বসে পড়েন।বুবাইয়ের বাবা কেবল মাঝে বুবাইয়ের মাথার পাশে।অত্যন্ত উদ্বিগ্ন স্থির চোখে তাকিয়ে তিনি বুবাইয়ের দিকে।সে চাহনি থেকে ঝরে পড়তে চায় একরাশ প্রশ্ন।গাড়ি ছুটে চলে বজবজ সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের দিকে।
==================
উত্তর 24 পরগণা।