গল্প।। অস্তরাগ ।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক
অস্তরাগ
বিশ্বনাথ প্রামাণিক
১
মাত্র ১৯ মিনিট
৩৭ সেকেন্ড।
এই সময়টুকু আমার জীবনে কালো মেঘের বুক চিরে হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে যাওয়া আকাশের মতো উদ্ভাসিত।
কত দ্রুত অথচ কত স্পষ্ট এক ঝলকে আমার সবকিছু মুহূর্ত দেখে নিয়ে আবার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে চলে গেল।
বিরক্তিতে কুঁচকে ওঠে মনটা।
আলো চেয়েছিলাম বিদ্যুৎ তো নয়।
- হ্যালো, রঞ্জন...... হ্যালো...
অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন দুপুরে যখন ওর ফোনকল পেলাম তখন সত্যিই চমকে উঠেছিলাম। অচেনা নম্বর কতই তো আসে! কৌতূহল থাকে, থাকে ভয়ও। কে আবার এই অসময়ে স্মরণ করলো কে জানে! তবু ফোনের ওই একটানা ডাককে উপেক্ষা করতে পারলাম না। প্রথমে একটু সময় দিয়ে দেখে নেওয়া, মিসড কল নাকি সত্যি আমাকে চায়! তারপর রিসিভ করা। আশ্চর্যজনকভাবে খুব চেনা গলার আওয়াজ। মনে হয় যেন আমার বুকের গভীর থেকে উঠে আসা কোন বিস্মৃত ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি – হ্যালো, রঞ্জন...... হ্যালো...
আমি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বুঝে নিতে চাইছিলাম আগন্তুক আওয়াজটাকে। হয়তো মেপে নিতেও। খুব সন্তর্পণে খুব আস্তে আস্তে বললাম – বলছি। আপনি…...
- আমাকে চিনতে পারলি না! আমি...
বুকের মধ্যে যেন শত হাতুরির ঘা-এর কম্পন হচ্ছিল। গলাটা কি একটু কেঁপে গেল? যতদূর সম্ভব আবেগ সামলে নিতে চেষ্টা করলাম।
- আর বলতে হবে না। বুঝেছি, কিন্তু হঠাৎ এতদিন পর?
- খুব অবাক হচ্ছিস না? ভাবছিস নম্বর জোগাড় করলাম কীভাবে?
এড়িয়ে গিয়ে বললাম - এমনভাবে! এত বছর পরে...তা একটু অবাক হচ্ছি বটে... যাক সে কথা, আপাতত তোর উদ্দেশ্যটা, মানে যেজন্য এত কষ্ট করে...
- বুঝেছি এখনো তোর রাগ যায়নি। সেদিন অমিতাভর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল জানিস? ওর কাছ থেকে তোর ফোন...
চট জলদি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম - ও। ওরা ভালো আছে?
- দেখলাম তো বেশ। কেন! তোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই?
- ছিল। তবে ইদানিং...
- নেই। তাই তো? একা একা তোর কষ্ট হয় না?
ওদিকে অভিমান ঝরে পড়ল স্পষ্ট! তবু সহসা কিছু বলে উঠতে পারলাম না। চুপ করে কান পেতে আছি আরো কি বলে শোনার জন্য।
ফোনের মিনিট এলাম পিক পিক করে সাড়া দিয়ে গেল। ওদিকেরও কোন সাড়া নেই। বুঝলাম সময় নিচ্ছে।
এবার আমাকে চমকে দিয়ে জানালো - আমি কোন এক্সকিউজ দিচ্ছি না রঞ্জন। কেন সেদিন তোর সঙ্গে যেতে পারলাম না, তা নিয়েও কোন অজুহাত খাড়া করতে চাই না। আর এতদিন পরে বোধহয় তার দরকারও নেই তোর কাছে। আবার চুপ। কিছু কষ্ট চাপতে সময় নিল বোধহয়!
আমার থেকে খানিক সহানুভূতি আশা করেছিল। হয়তো আশা করেছিল, যা চোখে বুকে গেছে তা নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কী জাতের কিছু একটা। কিন্তু আশ্চর্য! আমি অতখানি মহৎ হতে পারিনি। আমার স্পষ্টতঃ রাগ হচ্ছিল। হতাশা ঝরে পড়া গলায় আবার আওয়াজ এলো - রঞ্জন, প্লিজ ভুল বুঝিস না। তোকে আমায় অনেক কথা বলার আছে। একদিন সময় দিতে পারিস?
- সময়! মনে মনে হাসি পেল খুব। কত সময় যে পার হয়ে যায় যদি তুই জানতিস! দ্রুত সামলে নিয়ে বললাম - ব্যাচেলার মানুষের আবার সময়! (ইচ্ছা করেই নিজের একাকী থাকার কথাটা বোধ হয় না বললেই ভাল হত) তবু কিসের জন্য লোভ হল- বলেই ফেললাম।
- তুই বিয়ে করিস নি?
- হয়ে ওঠেনি আরকি! না না। তার মানে আবার আমাকে দেবদাস ভেবে বসিস না।
- তবে কি অমল! ব্যঙ্গের সুর ওর গলায়।
- তাও নয়। আমি আমিই, মানে রঞ্জন। যাক, সময়ের কথা কি বলছিলিস যেন?
- দেখা করা যায় না একদিন! না মানে...
- এত সংকোচ করছিস কেন? তাছাড়া কারণটা জানতে পারি কি?
- সেটা ফোনে?
- কেন? তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? হ্যালো... হ্যালো...
- মহাভারত অশুদ্ধ হবে কিনা জানিনা। তবে দেখা হওয়াটা বড় জরুরি।
মনে মনে বললাম সেদিনও খুব জরুরী ছিল। কিন্তু সে কথা বলতে পারলাম না। আমার ভদ্রতায় বাঁধলো কিনা কে জানে! বললাম, বেশ তো একদিন চলে আয়।
- কোথায়?
- ১০৫ সুকান্ত সরনি, নিউ গড়িয়া। কলকাতা ১৫৫।
- এটাই তোর ঠিকানা বুঝি?
- ভাড়া বাড়ির।
অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছিল। বোধহয় ও কাউকে লুকিয়ে ফোন করছিল। ওর গলায় ব্যস্ততার সুর ফুটে উঠছিল। দ্রুত জানালো, প্রস্তুত থাকিস, সময় মত আমি ফোন করে নেব। এখন রাখি...
- হ্যালো ... হ্যালো...
- যাঃ!
ফোনটা কেটে দিল!
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব আমি আবার আমার একলা থাকার নৈঃশব্দে ডুবে গেলাম। মনে
পড়ে গেল সেই শিয়ালদা স্টেশন থেকে মাথা নিচু করে একা ফিরে আসার করুণ কাহিনি। কি হলে
কি হতে পারত ভাবার বয়স তখন হয়নি। কিন্তু সদ্য ইয়ুনিভারসিটি কমপ্লিট করা যে
ছেলেটা, স্বপ্নের ডানায় ভেসে উড়ে চলেছে, তাকে এক মুহূর্তে বাস্তবের মাটিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল যে,
সে এই অঞ্জনা।
দশ বছর ধরে অভিমানের পাহাড় জমে ছিল আমার
মনে। তা এই মাত্র ১৯ মিনিট
৩৭ সেকেন্ডে যে যাওয়ার নয় তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। অতিলোভের
বশবর্তী হয়ে ফোনটা নিয়ে আবার নেড়ে-চেড়ে দেখছিলাম।
যেন দেখছিলাম আমার অঞ্জনাকে - যাকে কুড়ি বছর ধরে চিনি, জানি, হয়তো বা আজও ভালোবাসি।
ইচ্ছা করছিল অনন্ত সময় ধরে কথা বলে চলি। কথা বলে আমার ভালো লাগছিল। ভীষণ ভালো। ওর গলার আওয়াজে মনে
হচ্ছিল যেন হঠাৎ স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন হুর।
আবারো চেষ্টা চালিয়ে যাবার বাসনায় নম্বর বের করে ডায়াল করি। না কিছুতেই পাচ্ছি না। যতবারই চেষ্টা করি নট রিচেবল! আশ্চর্য! আবার হারিয়ে গেল? আমার মর্জি মতো কিছু হয় না। সব হয় ওর মর্জি মতো। বিরক্ত হয়ে প্রায় ছুঁড়ে ফেলার ভঙ্গিতে ফোনটা টেবিলের উপর রেখেদিলাম।
২
আবার সারা ঘর পায়চারি করতে লাগলাম আপন মনে।
বোতল খুলে জল খেলাম ঢক ঢক করে।
বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এক অধ্যায়, স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া রুগ্ন জীর্ণ পুঁথির মরচে ধরা হলুদ পাতা থেকে আজ চোখের সামনে ফুটে উঠছে ডাগর দুটি চোখ, মলিন এক মুখ- তার বিষন্নতার দৃষ্টি মিলে চেয়ে আছে নিরবে। স্পষ্ট হয়ে উঠছে সব- যা বলতে চাইছিলাম একান্ত মনে প্রাণে!
জানি সবকিছু সবসময় হিসেব মিলে হয় না। তবু হিসাব মত না হওয়ায় আমার এত অভিমান কেন! কেন আজও ওকে ক্ষমা করতে পারিনি সে যন্ত্রণা আমার কাছে আজও বিভীষিকার মতো।
মাঝের সময়গুলোতে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। সংসারের টিকে থাকার পরীক্ষার পাস করে আমি সভ্য ভদ্রভাবে জীবন কাটানোর পথ বাতলেছি। আমি সুখী! নাকি সুখের সন্ধান করতে চাওয়ার মানসিকতা আমার নেই- আজও হিসাব মেলাই। স্মৃতির রোমান্সের ১০ বছর যে কীভাবে কেটে গেল জানিনা। কিন্তু ওই বা এতদিন পরে দেখা করতে চায় কেন? ক্ষমা চাওয়া? অন্তত অঞ্জনাকে যতদূর চিনি ও সে রাস্তায় যাবে বলে মনে হয় না। তবে কি ও সুখি হয়নি?
সারাদিন এক ভাবনায় মনটা আচ্ছন্ন। কী বলতে চায় ও! আবার একবার চেষ্টা করে দেখব নাকি! আমার কৌতূহল আমাকে পাগল করে তুলছিল। ঘড়িতে দেখলাম চারটে ৫৭, এবার একবার চেষ্টা করলে কেমন হয়!
ফোনটা নিয়ে আবার ঘাঁটতে লাগলাম। বার বার নম্বরখানা থেকে কি যেন খুঁজতে চাইছিলাম! কেন জানিনা মনে হল নম্বরগুলো আমার বড় আপন। এই নম্বরের ও প্রান্তে বসে আছে আমার এত দিনকার প্রতীক্ষার মানুষ। নিজের অজান্তেই সবুজ বোতামে হাত চলে গেল নাকি! এই তো ফোনের স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে অপরিচিত একটি নম্বর। ও বলেছিল সময় মত ফোন করে নেবে। আমার আর তর সইছিল না। কি জানি কি ভাববে! এত যে রাগ দেখালাম এখন কি বা বলবো! ইতস্তত করতে করতেই ওদিক থেকে ফোন রিসিভ করার স্পষ্ট সংকেত পেলাম।
বুকের ধুক পুকুনিটা আবার শুরু হয়েছে। একটা অপরাধ বোধ (যা এতক্ষণ খেয়ালিই ছিল না) ছিঁড়ে ফেলছে আমাকে। এটা ওর শ্বশুরবাড়ি। আমার আরও সংযত হওয়া উচিত ছিল। ভাবতে ভাবতেই পুরুষালি কণ্ঠের গম্ভীর আওয়াজ – হ্যালো। আমি তথৈবচঃ।
আরো একবার আওয়াজ এল – হ্যালো... হ্যা...
অস্পষ্ট গোঙানির সুরে উত্তর দিলাম- আ..মি…
স্পষ্ট ধমকের সুরে উত্তর এল - কে আমি?
সম্বিত ফিরে পেয়ে চটজলদি নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত উত্তর দিলাম - মাফ করবেন, রং নম্বর হয়ে গেছে, রাখছি।
দ্রুত লাল বোতাম টিপে ফোনটা কেটে দিলাম।
যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের খাঁচা থেকে।
ভদ্রলোক কী ভাবলো কি জানি! যা খুশি ভাবুক। তবু নিজের পরিচয় দিতে পারলাম না।
এখন অনেক বেশি ফ্রি লাগছে।
কি ছেলেমানুষই না করে ফেলেছিলাম! কিন্তু
সত্যিই কি ফ্রি হতে পেরেছি? নিজের বোকামি বুঝতে বেশি দেরি হলো না।
দ্রুত রিসিভ কল খুলে ফেললাম।
এই তো দুপুর ১টা ৩৩ মিনিটে ফোন এসেছিল।
এই তো তারিখ ১লা আগস্ট ২০১২।
নীচে টাইম লেখা ১৯ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড।
আমার মাথা ঘুরতে লাগলো।
ভদ্রলোক নিশ্চয় খুশি হতে পারেনি।
ওকে আবার না কথা শোনায়! ধরা পড়ে যাবে, নিশ্চিত ধরা পড়ে যাবে।
আর জানি উনি এটা ভালোভাবে নিতে পারবেন না।
তবে আজ আমি কি আরো একবার ওকে হারালাম? ১০ বছরের পুরানো মরচে পড়া ক্ষত থেকে হঠাৎই রক্তক্ষরণে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো।
চোখ ধোঁয়া হয়ে আসছিল।
দ্রুত সামলে নিয়ে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লাম।
ভাদ্রের আকাশ অন্ধকার করে মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল। পড়ন্ত বিকালের আলো মেঘের অন্ধকারে ঢেকে গেল। সারাদিন আজ সূর্য দেখিনি আর এখন মনে হচ্ছে আমার আকাশ হতে সেও চির বিদায় নিল।
৩
পুনশ্চ
আজ পহেলা সেপ্টেম্বর ২০২০। আজও তার জন্য প্রস্তুত হয়ে জানালার ওপারে চেয়ে বসে থাকি। “সময় মত ফোন করে নেব, প্রস্তুত থাকিস”- কথাটা আমারই অজান্তে আমার মন লক্ষ বার আওড়ায়। ফোনের নম্বর খানা সচল রাখতে ক্রমাগত রিচার্জ করি। একে ওকে ফোন করে ব্যালেন্স নষ্ট করি। আর থেকে থেকে রিসিভ কলটা খুলে চেয়ে থাকি। ডায়াল নম্বরটা শয়তানের মত বড় বড় চোখ বার করে আমাকে ব্যঙ্গ করে। তবু ওই দুটিকে আজও ডিলিট করতে পারিনি। কিন্তু সত্যি বলছি যার জন্য এত কৃচ্ছসাধন তার কোন সংবাদ আজও আসেনি। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। আর তার মধ্যে শূণ্য দৃষ্টি মিলে দেখি কালো কালো থোকা থোকা মেঘেদের গহবরে গোলাপি আভাযুক্ত এক ডুবন্ত সূর্য তার অস্তরাগের মায়াজালে কেমন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে!
---------------