প্রসঙ্গ : রম্যরচনা
রণেশ রায়
বিদ্রুপ টিকা টিপ্পনী রঙ্গ তামাশা নিয়ে সৃষ্ট রম্যরচনা সাহিত্যের একটা অঙ্গ। আমি কয়েকটা রম্যগল্প তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করব যে হালকা চালে ওপরের বিশেষণে বিশেষিত হয়ে সেজে ওঠে কোন রম্য রচনা সে কবিতা ছড়া গল্প বা নাটক হতে পারে।
কোন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্মকে রমনীয়তা, খেয়ালি কল্পনা আর কৌতুক পূর্ণ হাস্যরসের দ্বারা সমৃদ্ধ করে তোলেন তাঁর রম্যরচনায়। তা গল্প কবিতা বা ছড়ার মাধ্যমে হতে পারে। এটা কোন বিষয় সম্পর্কে সাহিত্যিকের মননের এক বিশেষ ধরনের পরিবেশন, শিল্প নৈপূণ্যে সৃষ্টি যা হাস্যরসে রসসিক্ত। রম্য কথাটি ধরে তার মানে ধরে স্থূল অর্থে বলা হয় সাহিত্যে কোন রচনা সামগ্রিক বিচারে রমণীয়ভাবে পরিবেশন করলে তাকে রম্যরচনা বলা যেতে পারে। কোন বিষয়কে সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত মননের সাহায্যে হাস্যরসে সমৃদ্ধ করে পরিবেশন করা হয় রম্য রচনার মাধ্যমে। সেই দিক থেকে একে সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত রচনা বলে অনেকে মনে করেন । যে রচনা সর্বাত্মক বিচারে রমণীয় বা মনোরম তাকে ব্যাপক অর্থে রম্যরচনা নামে অভিহিত করা হয়।তবে রম্য সাহিত্যকে নেহাত বাস্তব বর্জিত কল্পিত রচনা ভাবলে ভুল হয়।রম্য রচনায় বস্তুজগতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখক তার মননের রঙে রাঙিয়ে তাকে হাস্যরস কৌতুক রসে সিক্ত করে গল্প কবিতা ছড়া বা প্রবন্ধের মাধ্যমে উপস্থিত করেন শিল্প গুণের সমাবেশ ঘটিয়ে ।
সাহিত্যে রম্যরচনার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের রচনা যেমন কৌতুকপূর্ণ হয় তেমনি একই সঙ্গে এ ধরনের রচনায় সাহিত্যিকের গভীর জীবন বোধ সূক্ষ শৈল্পিক নৈপুণ্যে পরিবেশিত হতে পারে। রম্য রচনা সাহিত্যের ভান্ডারকে বাড়িয়ে তোলে, সাহিত্য শিল্পকে এক অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। সাহিত্যিক আর পাঠকের মধ্যে এক অভাবনীয় মেলবন্ধন সৃষ্টি করে।
মজলিসের মেজাজে সাহিত্যিক ও পাঠকের মধ্যে খোলামেলা নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে আপাত লঘু সরস উপস্থাপনের মাধ্যমে সাহিত্যের আঙিনায় কিছু রচিত হলে তাকে রম্য রচনা বলা হয়। অনেকে মনে করেন গভীর ভাবনা বর্জিত অনানুষ্ঠানিক ঘরোয়া মেজাজে লঘু হাস্যরসাত্মক বন্ধনমুক্ত পরিবেশনই রম্যরচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের রচনায় কোন গভীর তত্ত্ব কথা প্রকাশের প্রয়াস থাকে না বলে অনেকে মনে করেন। পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের তাগিদ দেখা যায় না বলে মনে করা হয়।
মনে রাখা উচিত আপাতভাবে রম্য রচনা হালকা মজাদার ভারমুক্ত তত্ত্ব নিরপেক্ষ বলা হলেও খুব শৈল্পিক নৈপুণ্যে হালকা মজার আড়ালে গভীর কথা বলা হয় অনেক রম্য রচনায়। রম্য রচনায় আপাত হাসি তামাশার আড়ালে কান্নার রোল এক গভীর বিরহ বেদনা শোষনের মর্মর ধ্বনি ধ্বনিত হতে পারে। তাই তাকে নেহাত ভাবনা মুক্ত কৌতুক হাস্যরসে সিক্ত ভাবার কারণ নেই।অনেক গভীর ভাবনা তত্ত্বকথা পরিবেশিত হতে পারে আপাত লঘু কৌতুক ছলে। পশ্চিমী শিল্প জগতে চার্লি চ্যাপলিন তাঁর অভিনয়ে রম্য রচনা জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর প্রতিটি অভিনীত চরিত্রে রম্য রচনাকে তুলে ধরা হয়েছে হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে। আর সত্যজিৎ রায় স্বমহিমায় বাংলা ছড়ায় শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র জগতে রম্যরচনা রূপকার। সমাজের গভীর সমস্যা উঠে এসেছে তাঁর চলচ্চিত্র শৈলীতে। সাধারণত গল্পের প্রসাধনে রম্যরচনা সজ্জিত বলে মনে করা হলেও কবিতা ছড়া প্রবন্ধের মাধ্যমে খুব সুক্ষভাবে রম্যরচনা পরিবেশিত হতে পারে। তাছাড়া নাটক চলচ্চিত্র রম্য রচনা পরিবেশনের উচ্চ মার্গের মঞ্চ। সৈয়দ মুজতবা আলী, শিবরাম চক্রবর্ত্তী, সঞ্জীব চ্যাটার্জী, এমনকি রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক লেখার মধ্যে আমরা এই ধরনের রম্যরচনা পেয়ে থাকি।
===================