তাকে সে ভীষণ পছন্দ করে কারণ তার ভেতর হাজারটা গুণ না থাকলেও এমন কিছু গুণ আছে যা তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু মানুষজন মানতে পারেন না তাদের ভেতর এত মিল হয় কি করে! কেউ না কেউ তোমাকে পছন্দ করবেই কারণ কিছু গুণ তোমার ভেতরও আছে যা অন্যের চোখে পড়বে না, তোমার চোখেই পড়বে। প্রথম প্রথম বিভা এড়িয়ে চলতো, কিন্তু যখন সে বুঝতে পারলো মানুষটার হৃদয় অনেক বড়ো, তখন সে কাছে এসেছে, অনেক কাছে। কাউকে পেতে হলে, একান্ত করে কাছে পেতে হলে তাকে আগে বুঝতে হয়। এজন্য কেউ দ্রুত সন্নিকটে না এলে মন খারাপ করতে নেই, তাকে বুঝতে সময় দিতে হয়, তাকে বুঝতে নিজেরও সময় নিতে হয়।
অফিস থেকেই ফোন করে মৃদুল জানালো, চুলে বেণি করো, দুটি বেণি।
বিভা মৃদুলের কথাতে হ্যাঁ সম্মতি জানালো। অথচ আজ দুপুরে স্নানের সময় সে চুলে স্যাম্পু করেছে। খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ে উড়ে তাকে বিশেষ বিরক্ত করছে তখনও৷ স্বামীর খুশির জন্য সে এলোকেশে বেণি করতে বসে গেলো। নিজের পছন্দকে বিসর্জন দিলো স্বামীর খুশির জন্য। মানুষটি তাকে বিরক্ত করে, কিন্তু কখনো বিরক্ত হয় না। এই কারণে নিজের ভেতর বিরক্তিবোধ জাগলেও প্রকাশ করে না। সারাটা জীবন ভেবে ভেবে বড়ো হয়েছে, বিরক্ত করবো, কিন্তু বিরক্ত হবে না এমন একজন মানুষ জীবনে চাই।
তেমন মানুষটি সে পেয়েছেও। একটু পরে ফোন করে জানালো, আসার সময় বাদাম আনবে।
মৃদুল বাসার কাছে চলে এলেও বুঝতে দিলো না, সে আবার স্থানীয় বাজারে গেলো। বাদাম কিনলো। বাদাম পেলেই যে সন্তুষ্ট হয় তাকে অসন্তুষ্ট করার জন্য ন্যূনতম অজুহাতও ব্যক্ত করা ঠিক না।
দিনশেষে মৃদুল বাড়ি এলে নিষ্পলকে চেয়ে থাকে বিভা। মৃদুল বলে, বিভার আভায় হারাবো আমি। নিকষে বিভা কী খোঁজে?
উত্তরে বিভা বলে, চরিত্রের সাথে সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। সৌন্দর্য কখনো চরিত্রের চেয়ে দামি হতে পারে না। আর সৌন্দর্য আচরণে, ব্যবহারে; অঙ্গে না।
ঠোঁটে একটু হেসে মৃদুল বলে, কিন্তু নিষ্পলকে চেয়ে আছো কেন? মনে হয় প্রথম দেখছো! প্রথম দেখার মতো কি আশ্চর্য লাগছে আমাকে? আর আমাকে দেখে কি আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে?
বিভা বলে, চোখ থাকলেই হয় না, দৃষ্টিশক্তি থাকতে হয়। সুদৃষ্টিশক্তি। সোনা চেনা সহজ কাজ নয়। চোখ থাকার পরও চোখে দৃষ্টিশক্তির অভাবে মানুষ সোনাকে কাচ ভেবে ফেলে দেন। মানুষটা তুমি খাঁটি। অপেক্ষা করা সুন্দর হয় যখন যার জন্য অপেক্ষা করা হয় সে খাঁটি হয়। একজন খাঁটি মানুষ জীবনে আছে। খাঁটি মানুষের জন্য আশ্চর্যতা ফুরায় না।
মৃদুল বলে, চোখের দিকে অনন্তকাল তাকালেও কি মানুষ চেনা যায়?
বিভা বলে, মনের কথা বুঝতে মন লাগে। না বলা কথাগুলো অনুভব দিয়ে বুঝে নিতে জানলে আপন মানুষ চেনা যায়। কারণে-অকারণে যে খোঁজ নেয়, আমি জানি সে আমাকেই চায়।
মৃদুল হাসে। প্রাপ্তির হাসি, মিষ্টি হাসি। হেসে নিয়ে বলে, সুযোগ দাও, ফ্রেশ হই। ঘামের গন্ধে আমি নিজেই থাকতে পারছি না।
বিভা নিষ্পলকে চেয়ে বলে, তোমার ঘামগন্ধ আমার মুখস্ত। আমি তোমার ঘামগন্ধে কোনো দুর্গন্ধ পাই না। আমাদের জন্য তোমার ঘাম ঝরে, তোমার ঘামের দাম আমার কাছে অনেক। অমূল্য স্বর্ণ দিয়ে আমি কী করবো? আমার কাছে অমূল্য তুমি।
মৃদুল এবার বিভার চোখ বরাবর নিষ্পলকে না চেয়ে থেকে পারলো না। হৃদয়ের ভেতর থেকে একটি কথা বের হয়ে এলো, এত ভালোবাসো কেন?
উত্তরে বিভা বলে, শত ব্যস্ততার মাঝে থেকেও যে মানুষটা আমাকে আগলে রাখে তাকে ভালো না বেসে থাকা যায়!
মৃদুল বলে, আমি যে মাঝে-মধ্যে তোমার উপর রেগে যাই!
বিভা বলে, অতিরিক্ত রাগি মানুষের ভালোবাসাটাও অতিরিক্ত হয়। যে অল্পে রাগে সে অল্পে হাসেও। যে অল্পে রাগে সে অল্পে ব্যথা-বেদনাও ভুলে যায়।
মৃদুল অবাক হয়ে বলে, যখন রেগে যাই তখন দুঃখ লাগে না?
বিভা না-বোধক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার সময়ে দুঃখকে প্রশ্রয়ই দিই না।
মৃদুল বলে, তবে কেন চোখে জল আসে?
বিভা বলে, হৃদয় দিয়ে ভালোবাসলে চোখ দিয়ে জল ঝরবেই।
মৃদুল বিস্ময় ভরা চোখে বিভাকে দেখে আর বলে, আমি কালো, তোমার কোনো আক্ষেপ নেই?
বিভা দৃঢ়চিত্তে বলে, চেহারা কদিনই থাকে! মনের লাবণ্যই স্থায়ী। যার কাছে আমার মূল্য অনেক সেই তো আমার কাছে অমূল্য। যে আমাকে গুরুত্ব দেয়, আমি তার কাছে সুখ পাবোই। তুমি কালো সবার চোখে, কিন্তু আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ।
একটু হেসে মৃদুল বিভার বাধা ডিঙালো। তারপর ফ্রেশ হতে স্নানাগারে গেলো। টেবিলে খাদ্য-খাবার তরে তরে সাজালো বিভা। খেতে বসে মৃদুল বললো, ইলিশ মাছ তোমার পছন্দ বলে গতকাল ইলিশ মাছ নিয়ে আসতে বললে। অথচ ইলিশ মাছ রান্না করোনি কেন?
বিভা বললো, ইলিশ মাছে তোমার এলার্জি আছে আমাকে তো বলোনি, মা বলেছেন। তুমি খাবে না সেই খাবার আমি খাবো কী করে!
মৃদুল আশ্চর্য হয়ে বলে, বলো কী! আমার কারণে একটা প্রিয় খাবার ত্যাগ করবে?
বিভা বলে, প্রিয় মানুষের জন্য অনেক প্রিয় বিষয় ত্যাগ করতে হয়। তোমার পথের পথিক আমি। তোমার শখের ভেতরই আমার শখ নিহিত।
মৃদুল দ্রুত উঠে গেলো খাওয়ার টেবিল থেকে। ফ্রিজ থেকে মাছ নিয়ে নিজেই ভাজতে গেলো। বিভা পেছন পেছন এলো আর বললো, এভাবে আমার পছন্দ যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সে কেন আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হবে না? পুরো পৃথিবী লাগে না, সাথে এমন সঙ্গী থাকলে গণ্ডিও যথেষ্ট।
মৃদুল মাছ ভাজতে ভাজতে বলে, বাইরে আগে অনেক কিছু খেতাম, এখন কিছু খেতে গেলেই তোমার কথা মনে পড়ে। তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। তোমাকে নিয়ে তাই অনেক ভাবনাজাল আঁকি।
বিভা বলে, আমাকে যে ভাবনা জুড়ে এতটা রাখতে পারে, সে কেন আমার ভাবনা জুড়ে থাকবে না? সেই তো আমার সকল সুখের কারণ। তুমিই তো আমার সকল সুখের কারণ। তাই তোমাকে খুশি করার কারণ খুঁজি। নিজেকে খুশি রাখার কারণ খুঁজি না। তোমার খুশিতে আমার মনে খুশির জোয়ার সৃষ্টি হয়।
এই বলে বিভা মৃদুলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মৃদুল বলে, এত আদরকাড়া কেন তুমি? এত আদর জানা কেন তুমি? আমি তো আদর দিতে জানি না!
বিভা বলে, এতটা যে যত্নে রাখে আলাদা করে তাকে আর আদর করা জানতে শিখতে হয় না। আমার প্রতি যার এতটা টান একদিন সে আদর দেওয়ার শিক্ষক হয়ে যাবে। প্রকৃত জীবনসঙ্গী প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে পৃথিবীর সব সুখ খোঁজে।
মাছ ভাজা শেষ হলে ওরা আবার খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলো। তারপর মৃদুল নিজেও এক টুকরো ইলিশ মাছ নিলো। তা দেখে বিভা বললো, ইলিশ খাবে? দেখো এই খাদ্যই ওষুধ, এই খাদ্যই বিষ।
মৃদুল বলে, পছন্দের মানুষের পছন্দ অপছন্দের হলেও পছন্দের করে নিতে জানতে হয়। শুধু নিজের পছন্দের কথা প্রকাশ করতে থাকলে পছন্দের মানুষের কাছে অপছন্দ হয়ে যেতে হয়।
বিভা বাধা দিয়ে বলে, যা খেলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে তা না খাওয়ায় শ্রেয়। তুমি তোমার তাই তুমি তোমাকেই আগে ভালোবাসবে। সম্পর্কে মধুরতা আনতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ডেকে নেওয়া ঠিক না। আমার খুশির কারণ হতে গিয়ে তুমি তো তোমার দুখের কারণ ডাকতে পারো না।
মৃদুল বলে, যার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত তার জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি খুবই সামান্য। আর অসুস্থ হলে শুশ্রূষা দেওয়ার মানুষ তো আছে আমার। তোমার সেবায় হবো আমি বলীয়ান।
বিভা দ্বিমত পোষণ করে বলে, সেবা দেওয়ার মানুষ থাকলেই রোগ ডেকে আনতে হবে? কোনো রোগকেই আমন্ত্রণ জানানো ঠিক না।
মৃদুল খেতে খেতে বলে, মন ভালো থাকলে রোগ হয় না। পৃথিবীর সব মানুষ কল্পনাতেই বেশি সুখী। আমি বাস্তবে সুখী।
বিভা গদগদকণ্ঠে বললো, তোমার মন ভালো রাখার সেই শক্তি কি আমার আছে? আমি শুধু তোমার ভালো চাই, কিন্তু নিজের ভালো তো নিজেকেই রাখতে হয়। সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে মুখে যে হাসি তুমি রাখো তা মূলত মিথ্যা হাসি।
খাওয়া বন্ধ করে মৃদুল বললো, ভালোবাসার প্রত্যেকটি মানুষই জীবনের জন্য জরুরি। সবার ভালো থাকার উপর নিজের ভালো থাকা নির্ভর করে। হাজার কষ্টে থেকেও কাছের মানুষের সুখে রাখার চেষ্টাটাই আসল ভালোবাসা। একা ভালো থাকা যায় না, একা ভালো থাকার চেষ্টা করলে একাই হয়ে পড়তে হয়। অনেকের অনেক ত্রুটিই চোখে পড়ে, সব দেখেও না দেখার ভান করা হয় শুধু সম্পর্ক রক্ষার জন্য। কারণ সম্পর্কটা জীবনের জন্য জরুরি। অনাদরে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
বিভা বললো, আমার ভেতর ত্রুটি পেলে জানাবে, নিজের ভুল নিজে ধরা যায় না। আমার আচরণ তোমার মনের বিরুদ্ধে গেলে জানাবে। আমি ভুল করেই যাবো, তুমি ক্ষমা করেই যাবে এটা ঠিক না। তোমার আমার সম্পর্কে কেন অসুস্থতা থাকবে?
মৃদুল বলে, তোমার নিজস্বতা আছে। আমার প্রভাবে কেন তুমি তোমাকে পরিবর্তন করবে? কোনো একটি বিষয়ে তোমার ধারণা আমার সাথে নাও মিলতে পারে, আমার অযাচিত চাওয়া থাকবেই বা কেন? আর আমার অযাচিত চাওয়ার কাছে কেন নিজেকে ভাঙবে?
বিভা জানায়, আমার জীবনে তুমি বিশ্বস্ত মানুষ। তুমি আমার খারাপ কখনোই চাইবে না। তাই তোমার উপর আমার এত বেশি নির্ভরতা। জানি আমি তোমার প্রয়োজন ও প্রিয়জন।
পরেরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে একটি শাড়ি কিনে এনেছে মৃদুল। অন্যান্য নারীরা শাড়ি দেখলে যেমন পুলকিত হয় বিভা তেমনটি পুলকিত হলো না। বললো, বলেছি তো আমাকে শাড়ি দিলে তুমি শার্ট নেবে। তুমি শার্ট না নিলে আমি শাড়ি নেবো না। আমি সাজবো তুমি দেখবে আমি তা বুঝি না।
শুনে মৃদুল বলে, তোমাদের জন্যই আমি পরিশ্রম করি। তোমায় ভালো রাখা, ভালো থাকতে সহয়তা করা আমার দায়িত্ব। তোমার চোখের কাজল কেনার দায়িত্বও আমার, তোমার চোখে জল যেন না আসে সে দায়িত্বও আমার।
বিভা না-সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, তোমার ঘাড়ে ভারবোঝা হয়ে থাকা কি আমার দায়িত্ব? দুটি মানুষ পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটলে অনেক পথ যেতে পারে। আমায় কাঁধে নিয়ে বেশি দূর যেতে পারবে? আমি তো তোমার কাঁধের বোঝা নই, আমি তোমার সহযাত্রিনী। আমাকে মূল্যবান উপহার দিতে হবে না, কেবল সময়টুকু দিও। তোমার দেওয়া প্রত্যেকটি ক্ষণ আমার জন্য মহামূল্যবান।
অন্যমনস্ক হয়ে মৃদুল বললো, শাড়িটা তবে ফেরত দিয়ে আসবো? খুব পছন্দ হয়েছিলো বলেই এনেছিলাম। তুমি কত খুশি হবে ভাবতে ভাবতে এসেছি, হলে অখুশি।
শাড়িটা বিভা বুকে চেপে নিলো আর বললো, না ফেরত দিতে হবে না। তবে নতুন শার্ট না কিনলে এ শাড়ি আমি পরবো না। ক্রমাগত ত্যাগ করে যাবে তুমি আর আমি ক্রমাগত সুবিধা নিয়ে যাবো ভালোবাসার দলিলে তা লেখা নেই।
এমন সময় মৃদুলের মা মৃদুলকে ডেকে নিলেন। পারিবারিক ব্যাপারে কথা চললে বিভা সেখানে যুক্ত হয়ে নিজের মত পেশ করে না। আজ বিভাকে জোর করে ডেকে নিলো মৃদুল। কিন্তু বিভা চুপ থাকলো। কোনো কথা কেউ জিজ্ঞাসা না করলে সে নিশ্চুপই থাকে। নিজের ঘরে ফিরে মৃদুল বললো, পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তুমি কথা বলো না। তুমি কি পরিবারের সদস্য না?
উত্তরে বিভা বলে, তোমাদের কত ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে এই সংসার দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ এই বাড়ি এসে আমার কথা বলা আমার কাছে অনধিকার চর্চার মতো মনে হয়।
মৃদুল বলে, লক্ষ্মীর মতো কথা বলো। লক্ষ্মীরাই লক্ষ্মী থাকে। রগচটা, বদমেজাজিরা কখনো লক্ষ্মী হয়ে উঠতে পারে না। শুধু ভাগ্যের কারণেই তোমাকে জীবনে পেয়েছি।
বিভা মৃদুলের চোখ বরাবর চেয়ে বলে, হৃদয় মাঝে ডুব দিতে জানো, ডুব দিতে জানো বলেই ঝিনুক পাও, ঝিনুক না পেলে কি কেউ মুক্তো পায়?
মৃদুল বলে, চারিদিকে মুক্তোর ছড়াছড়ি থেকে একটি মুক্তো কি করে বাছাই করবো ভাবতাম। কিন্তু মুক্তো বাছাই করতে হয় না, মুক্তো জীবনে চলে আসে। হৃদয় থেকে যারা চায় তারা মুক্তোই পায়। মন থেকে চাইলে মন মনের মতো মানুষ পাবেই পাবে।
বিভা মৃদৃলের বুকে মুখ লুকায়। বড়ো নির্ভরতার আশ্রয় এই বুকের সন্ধিস্থল। বলে, তোমাকে কত যে ভালো লাগে তুমি জানো না, আমি জানাতেও পারবো না। কেন এত ভালো লাগে জানি না। ভালো লাগার কারণ থাকে না। এখন একা থাকলে ভয় করে, একা বাইরে গেলে ভয় লাগে। একটু সময় কথা না বললেই খারাপ লাগে। অন্যদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। কেবলই তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে। কাজের মধ্যেও মনের চোখে শুধু তোমার চোখ ভাসে। যে যাকে ভাবে তার মনশ্চক্ষে সে সব সময় থাকে। তুমি আমার তৃষ্ণা জুড়ে।
মৃদুল বলে, এভাবে মায়া জাগানো কথা আর বলো না। এত মায়া দিলে বাইরে যেতে পারবো না, বাইরে গেলেও থাকতে পারবো না। এত মায়া জাগাতে জানো তুমি ভাবতেই পারি না। যে মানুষটা এভাবে মায়া জাগাতে পারে সে মানুষটা খুব ভালো মনের হয়।
বিভা ঠোঁটে হেসে বলে, তুমি কত ভালো মানুষ তুমি জানো না। তোমাকে আমি চিনে নিয়েছি, তুমি মিষ্টি হৃদয়ের একজন মানুষ। তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে কাতর হয়ে থাকি। তুমি এখন আমার প্রয়োজন না, তুমি আমার ভালোবাসা; প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়, ভালোবাসা শেষ হয় না। তুমি আমার নিজের মানুষ। একান্তই নিজের মানুষ। নিজের মানুষ সেই যার কারণে নিশ্চিন্তে শান্তির ঘুম হয়।
মৃদুল বলে, কাচ খুঁজতে খুঁজতে মানুষ হিরা পেলে মানুষ আর কাচ খোঁজে না। তুমি আমার হিরা, অমূল্যের চেয়ে অমূল্য। কাচ না পেয়ে পেয়েছি হিরা, আমার ভাগ্য বড়ো সৌভাগ্যের। কতক্ষণ এভাবে বুকটা দখল করে রাখবে? একটু তো চাও আমার দিকে?
বিভা বলে, তোমার বুকে যে প্রশান্তি পাই কোথায় গেলে পাবো আমি? তোমার বুকের মধ্যখানে থাকলে আমি স্বর্গসুখ পাই।
মৃদুল বলে, আমার ঘরে আসার আগে কখনো কি মনে হয়নি মানুষটা ভালো হবে তো? কখনো কি মনে হয়নি যার ঘরে যাচ্ছি তার মন মানসিকতা কেমন হবে?
বিভা উত্তরে বলে, না তেমন মনে হয়নি। আমি ভেবেছি যে মানুষটা আমাকে গ্রহণ করছে আমাকে জেনে-বুঝেই গ্রহণ করছে। কেউ অসুখী হওয়ার জন্য সংসার গড়তে যায় না। মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আমার মানুষটা আমাকে অনেক ভালোবাসবে। তাছাড়া স্বামী কখনো স্ত্রীকে ঠকায়? কখনো কেউ কাউকে ঠকিয়ে নিজে জিততে পারে না। তুমি আমার হাত ধরেছো শুধুমাত্র তো মুহূর্তটুকু উপভোগ করার জন্য না। কোনো পুরুষই তার সঙ্গিনীকে কষ্টে রাখে না, এটাই সত্য।
মৃদুল বিভার কথা শোনে আর আশ্চর্য হয়। মনের অনুভূতিগুলো কত সুন্দর করে প্রকাশ করতে জানে সে। অথচ সে নিজে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না বলে গুমড়ে মরে। বিভাকে বললো, এত ভালোবাসো কেন? মানুষকে অতিরিক্ত ভালোবাসতে নেই। অতিরিক্ত যত্ন করতে নেই। বেশি বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। ভালোবাসা বেশি প্রকাশও করতে নেই। মানুষ অতিরিক্ত পেয়ে গেলে বদলে যায়। মানুষ বদলে গেলে মানুষ ভুলে যেতে চায়। বদলে গেলে দীর্ঘদিনের সম্পর্কও ঠুনকো হয়ে যায়। মানুষ অতিরিক্ত পেয়ে গেলে গুরুত্ব দিতে ভুলে যায়। বেশি ভালোবাসা পেলে ভালোবাসার মর্যাদা রাখে না।
শুনে বিভা বলে, যে সত্যিকারে ভালোবাসে সে বদলে যায় না। যে সত্যিকার ভালোবাসে সে গুরুত্ব দিতে কার্পণ্য করে না। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ কখনো ছেড়ে যায় না। ভুলে থাকে না। ভুল বোঝে না।হাজারও কষ্টের মাঝে আগলে রাখে। জীবনে যাকে পেয়েছি আমি জানি আমিই তার কাছে পুরো পৃথিবী। হাজারও ব্যস্ততার মাঝে আমি তাই তোমাকেই স্মরণে রাখি, রাখি মনের কোঠরে।
মৃদুল বলে, কত ভালো তুমি। এমন একজন জীবনসঙ্গীই আমি মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম যে আমাকে পাওয়ার পর আমার ভেতরেই পৃথিবীর সব সুখ খুঁজে পাবে। সৌন্দর্যের মাঝে ভালোবাসা না খুঁজে তুমি ভালোবাসার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজেছো, আর তাই আমার মতো একজন কালো ছেলেকেও কত অনায়াসে গ্রহণ করেছো। কালে বলে সারাটাক্ষণ ভাবতাম হয়তো আমার একজন ভালোবাসার মানুষ জুটবে না। রূপের সৌন্দর্যের অহংকারের কাছে গুণের সৌন্দর্যের পতন।
বিভা বলে, মনের মানুষটা মনের মতো হতে হয়। সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসা ভুল সিদ্ধান্ত। ভালোবাসার মধ্যেই সৌন্দর্য খুঁজলে জীবনটা রঙিন হয়। পরস্পর পরস্পরের বিশ্বাসে থাকলে আর কিছু লাগে না। প্রত্যেকই জীবনে একজন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি চায়। ব্যক্তিত্ব আর ব্যক্তি মানুষটা ভালো হলে আর কিছু লাগে না। আর আমি কখনো আমার রূপ নিয়ে ভাবিনি। পুরুষ মানুষকে রূপ দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য আটকানো যায়। এজন্য গুণ দিয়ে আটকাতে হয়, মায়া দিয়ে জড়াতে হয়।
দুইদিন পরে বিভার বাবা বিভাকে নিয়ে বাড়ি গেলেন। বাসায় পৌঁছেই মৃদুলকে ফোন করে কান্না করলো বিভা। মৃদুল বললো, এক পাক্ষিক সময়কালের সংসার জীবন আমাদের মাত্র অতিক্রান্ত হলো। এত মায়া আমার জন্য? এত কান্না আমার জন্য।
বিভা বললো, তোমার জন্য মনের মধ্যে খুব মায়া জন্মেছেগো। এক পাক্ষিক অনেক সময়, একদিন হলেও বন্ধন যদি বন্ধনের মতোই হয় তবুও মায়া জন্মে। এ মায়া ঈশ্বর প্রদত্ত।
মুদুল বলে, হয়তো আমার চাওয়াটা পবিত্র ছিলো, তাই তোমাকে পাওয়া। চাওয়াটা পবিত্র হলে পাওয়াটা অনিবার্য। জীবনে সব কিছু ভুলে থাকা গেলেও তোমার মায়া ভরা মুখের কথা ভুলে থাকা যাবে না। থেকো তুমি আমার সাথে ছায়ার মতো লেগে লেগে।
একটু পরেই পাশের বাসা থেকে জেঠিমা এলেন। এসেই বিভার সামনে বিভার মাকে বললেন, জগতে কি আর ছেলে ছিলো না? ওমন একজন কালো ছেলের সাথে তোমার এমন লক্ষ্মীর মতো সুন্দর মেয়েটাকে কেন বিয়ে দিলে? জুড়ে দিলেই জোড়া লাগে?
জেঠিমাকে সমর্থন করে পাশের বাড়ির শ্যামলের বৌ বললো, পয়সার লোভ করেছে বিভার বাবা-মা। ছেলে চাকরি করে, আর কোনো কিছু না ভেবে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে। পয়সা তো মেথররেও আছে।
বিভার মা বললেন, নায়কোচিত চেহারার কত ছেলে আছে রিক্সা চালাচ্ছে। মেয়েকে সুন্দর চেহারার রিক্সা চালকের কাছে বিয়ে দেবো? ছেলেটির কর্মগুণ আছে বলেই তার কাছে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। শ্যামলের বৌ বাড়ি যাও, রাত-দিন শ্যামলের সাথে ঝঞ্জাট করো, তুমি এসেছো জ্ঞান দিতে। জগৎ চলে মেধায়, রূপে না। মানুষ কর্মের কারণে মহামানুষও হয়, অমানুষও হয়। সফল মানুষরাই সত্য আর সুন্দর। তোমরা চেহারা দেখো বলে ঠকো, চরিত্র দেখলে জিততে। চেহারা দেখো, আচরণ দেখো না।
শ্যামলের বৌ চলে গেলেও জেঠিমা গেলেন না। বললেন, বুঝলাম ছেলেটির রোজগার ভালো। কিন্তু ওদের কি মানাচ্ছে? কালো, কিন্তু কত কালো! ফরসা আর কালোই কি কখনো মানিক-জোড় হয়? মানিক-জোড় শব্দযুগল কিন্তু অকারণে আসেনি! জুড়ি বা জুটি মানানোর ব্যাপারও আছে। তাছাড়া পরবর্তী প্রজন্মও যদি ওমন কালো হয় কেমন হবে? আগাম না ভেবে কেউ সিদ্ধান্ত নেয়?
বিভার মা জবাবে বললেন, মৃদুল শিক্ষিত, তার সন্তান শিক্ষিত হবেই। আপনার কোন সন্তানটা শিক্ষিত হয়েছে? কালো সন্তানও ভালো, মূর্খ আর বখাটে সন্তানের চেয়ে।
জবাব শুনে মনোক্ষুণ্ণ হয়ে জেঠিমা চলে গেলেন। বিভার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মন এমনই, চারিপাশ দ্বারা প্রভাবিত হয়, আর ভারাক্রান্ত হয়। যার কাছে যাকে ভালো লাগে তার কাছে সেই সুন্দর, নিজেকে শান্ত করে ঘরে গেলো সে।
বিভা এসেছে জেনে বিভার তিনটি বান্ধবী চলে এলো। রজনী উৎসাহের সাথে বললো, এই দেখ্ তোদের বিয়ের ছবি। তোর বরকে চেনায় যাচ্ছে না, রাতের আঁধারের সাথে যেন মিশে গিয়েছে। আর তোর ছবি দেখ্, মনে হচ্ছে আঁধারের মাঝে পূর্ণিমার আলোর বিচ্ছুরণ। এই মানুষটার সাথে থাকলে তোর আত্মসম্মান থাকবে? আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কারো সাথে থাকার চেয়ে একা থাকাও সম্মানের।
রজনীর কথার সাথে কথা মিলিয়ে দিনা বললো, ঈশ্বর তার সাথে তারই মিলিয়ে দেন যার সাথে যার মিলবে, কথাটি তোর ক্ষেত্রে মিললো না। দাদাবাবুর সাথে থাকতে থাকতে হয়তো ভালো লেগে যাবে, কারণ প্রতিটি হৃদয়েই ভালোবাসা প্রগাঢ় থাকে। কিন্তু তিনি এই যে এত কালো ব্যাপারটা মানা যায় না। ভালোতে ভালোত্ব নাও থাকতে পারে, কিন্তু কালোতে কালোত্ব কমই থাকে। তবুও তোদের জুটিটা মানানসই হলো না।
স্মারণি বললো, তুই সুন্দর ও লম্বা। তোকে অপছন্দ
করবে এমন পাগল সমাজে নেই। কোথা থেকে এক কৃষ্ণকালো এলো চিল হয়ে, আর তোকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো, মানা যায় না। তোর কপালটা খারাপ। আসলে সুন্দরীদের কপাল সুপ্রসন্ন হয় না। সৌদামিনীর বিয়েও হলো এক কালো ছেলের সাথে। কালো ছেলেগুলোর সুন্দরী মেয়েদের প্রতি এত লোভ কেন?
বান্ধবীরা চলে গেলে বিভা মন খারাপ করে বসে থাকলো। মৃদুল ফোন দিলে বিভা রাগতস্বরে বললো, মন ভালো নেই পরে কথা বলবো।
মৃদুল বললো, আমার সাথে কথা বলে যদি মন ভালো না হয় আর কারো সাথে কথা বলে কভু তোমার মন ভালো হবে না।
বিভা কর্কশকণ্ঠে উত্তর দিলো, তুমি কি মন ভালো করার মেশিন? তুমি আর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করবে না।
হঠাৎ এমন কথা শুনে মৃদুল হতবাক হয়। সর্পিণীদের খোলস আছে, তাই বদলায়। বিভাকে তাই মনে হচ্ছে। তাই সে বলে, তোমার কথার ভেতর আমার জন্য কেমন যেন বিতৃষ্ণা। একদিন চোখের আড়ালে না যেতেই ভুলে গেলে সব ভালোবাসা? একদিন না যেতেই বদলে ফেললে নিজেকে? পাল্টে ফেললে বোল? হালকা হাওয়াতেও বদলে ফেলো নিজেকে? ভুলে যাও সব কথা দেওয়া?
বিভা বললো, তুমি তো একজন যোগ্য মানুষ। আমাকে নিজের সাথে জড়াতে কেন এসেছিলে? চেহারা কি যোগ্যতার মাপকাঠি? তুমি নিজেকে কেন একজন যোগ্য নারী থেকে বঞ্চিত করেছো? রূপ ছাড়া তো আমার মাঝে কিছু নেই, অথচ মানুষ তোমাকে ছোটো করছেন। আমার ভাগ্যকে মানুষ দুর্ভাগ্য বলছেন। তুমি নাকি আমার উপযুক্ত নও।
শেষের কথাগুলো শুনে মৃদুল চমকে গেলো। একটু আগেও চেনা মানুষটার আচরণ অচেনা লাগছিলো, কিন্তু এখন চেনা মানুষটার আচরণ চেনার চেয়ে আরও চেনা লাগছে। সে বললো, আমি কখনোই কারো কাছে স্পেশাল ছিলাম না। একমাত্র তুমিই তোমার জীবনে আমাকে স্পেশাল করে নিয়েছো। তোমার কাছে আমি বিশেষ কিছু না হলে তুমি আমার কাছে থাকতে না। তুমি কষ্ট দিলে সহ্য করতে পারবো না।
বিভা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, ওরা সব রূপ দেখে; তোমার গুণ দেখে না, মন বোঝে না। ওরা তোমার বাইরটা দেখে, তোমার ভেতরটা জানে না। আবরণে সুন্দর মানুষ দিয়ে আমি কি করবো যদি মানুষটার ভেতরটা সুন্দর না হয়? নায়কোচিত চেহারা দিয়ে আমি কি করবো, যদি সে নায়কই না হয়! তুমি তো আমার জীবনের নায়ক।
মৃদুল বললো, এজন্য তোমাকে চোখের আড়াল করতে চাই না। নানা মানুষ কুমন্ত্রণা দেন কানে। কবে না জানি এই কুমন্ত্রণায় তুমি ভুলে যাও। সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা আসেন যত্ন করে মন ভেঙে দিতে। অন্যের সুখ যখন সহ্যের বাইরে চলে যায় তখনই এমন করেন তাঁরা। একজনের সুখ অন্যজনের অসুখ, সহ্যাতীত। অন্যের সুখ দেখলেই আসল অসুখ জাগে।
এভাবে একটি দিন আসে সে দিনটাও চলে যায়। প্রতিবেশিনীরা আসেন আর মন ভাঙা কথা বলেন। মন্দ কথা বলতে কেউ কৃপণতা করেন না। ভালো নেই যারা তাঁরাই এমন মন্দ কথা বলতে জানেন। ভালো থাকবেন না তারা যারা এমন অন্যের সম্পর্কে বিষ ঢালেন।
তিন দিনের মাথায় মৃদুল বিভাকে নিতে এলো। প্রতিশিনীরা জাদুঘরের আশ্চর্য জীব দেখার মতো উৎসুকের সাথে বিভাদের বাড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে আসছেন মৃদুলকে দেখতে। যেমন করে নতুন বৌকে দেখতে আসেন গ্রাম্য গৃহিণীরা। মৃদুলকে দেখেন আর মিটিমিটি হাসেন আর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে একে অন্যের কানে কানে কী কী বলেন! বোঝায় যায় কালো ব্যাপারটি নিয়ে সবাই গুঞ্জণরত।
কেশবের মা যুগলের মায়ের উপর রেগে গিয়ে বললেন, পৃথিবীতে কালো রং আছে বলেই সাদা রং এত শোভা পায়। কালো তাতে কী! মনে কালি না থাকলেই হলো। পুরুষের রূপ কি সম্পদ! পুরুষের গুণ হচ্ছে সম্পদ। শরীরের রং দিয়ে কখনো সৌন্দর্য বর্ণনা করা ঠিক না। চেহারা যেমনই হোক মন যেন সুন্দর হয়।
যুগলের মা বললেন, কালো বলেই তো দেরি করেনি, দেখতে এসেই বিয়ে করেছে। কোনো প্রকার মত পরিবর্তনের সুযোগ দেয়নি। বিভার বরের বুদ্ধি আছে। যাহোক, যেটা হয়ে গিয়েছে এখন সেটা মানতে হবে৷ বাবা-মায়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সন্তানকে মনোদুর্ভোগ নিয়ে বাঁচতে হবে।
মানুষের এমন সমালোচনা, কানাঘুষা মৃদুল দেখে। ব্যাপারটা দিনভর এবং প্রতিদিন হচ্ছে। তার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। যে কালোত্বের কারণে তার প্রতি পরীক্ষার লেখাতে পর্যাপ্ত নম্বর উঠলেও ভাইভায় নম্বর কম উঠেছে, যে কালোত্বের কারণে জব না হতে হতেও একটা জব হয়েছে, যে কালোত্বের কারণে কর্মক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইনের কাজে যুক্ত হতে পারে না, যে কালোত্বের কারণে অনেক মেয়েপক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে একটা বিয়ে করতে পেরেছে, সেই কালোত্বের কারণেই সে শ্বশুরবাড়ি অপমানের পর অপমান হচ্ছে। সে আর সহ্য করতে পারলো না। কাউকে কিছু না বলে সন্ধ্যাবেলাতেই শ্বশুরালয় থেকে বের হয়ে পড়লো।
মৃদুলকে না দেখতে পেয়ে বিভা ফোন করলো। ফোন বন্ধ। বাড়ির সবাই জেনে গেলেন মৃদুল কোথাও চলে গিয়েছে। বিভার মা রেগে গেলেন, বিভাকে বললেন, মানুষ দেখতে সুন্দর হলেই সুন্দর আর ভালো হয় না, মানুষের বড়ো পরিচয় তার কর্মে, আচরণে। কারো কথা শুনে মৃদুলকে যদি আঘাত করে থাকিস ভুল করেছিস। পৃথিবীতে আমাদের পর যদি কেউ তোর ভালো চায়, তবে সে মৃদুল। তোর কষ্টে আমাদের পর যদি কেউ কষ্ট পায়, তবে সে মৃদুল। আমাদের পর যদি কেউ তোকে নিরাপত্তা দেয়, তবে সে মৃদুল। মৃদুল ভালো ছেলে। সংসার করতে একজন ভালো মানুষের খুব প্রয়োজন।
বড়দি এসে বললো, মৃদুলের চেহারা নিয়ে কখনো আক্ষেপ করবি না। যার মন যত সুন্দর সে তত বেশি সুন্দর। মৃদুলকে আমরা চিনেছি। সুন্দর মনের মানুষ চিনতে আঁতশ কাচ লাগে না।
বড়দা বললো, ফরসা চেহারার চেয়ে সুন্দর মন অনেক দামি। মনের সৌন্দর্য সুপ্ত থাকে না, স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়। মৃদুল নম্র আর ভদ্র। তার কথাবার্তা পরিচ্ছন্ন। যার যত সুন্দর ভাবনা সে তত সুন্দর মানুষ, চেহারা তো আবরণ মাত্র। মানুষের সৌন্দর্য চেহারায় থাকে না, থাকে মনে। চেহারার ফোয়ারার চেয়ে ব্যক্তিত্বের মায়া দামি।
বড়দি আবার বললো, মানুষের বড়ো সৌন্দর্য হলো তার চরিত্র। চেহারার অহংকারে মাটিতে পা না পড়লে এক সময় পায়ের নিচে মাটি থাকে না। চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, ব্যাক্তিত্ব থেকে যায়; মৃদুল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। ব্যক্তিত্ব দেখে ভালোবাসতে হয়।
যাকে তাকে ভালোবাসার কথা বলা যায় না। বিভা মাকে, দাদা-বৌদিকে বোঝাতেই পারলো না মৃদুলকে সে কত ভালোবাসে। মৃদুলের হৃদয়টা কত বেশি পরিষ্কার আর সুন্দর সে ছাড়া তো আর কেউ বেশি জানে না। কাউকে ভালোবাসলে রূপ দেখে ভালোবাসতে হয় না, মন বুঝে ভালোবাসতে হয়, সে জানে। যারা সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসে তারা মূলত সৌন্দর্যের পাগল হয়, মানুষটার মনকে বোঝে না। রূপ, টাকা আর ক্ষমতার বাহারকে গুরুত্ব না দিয়ে ভালো মনের জীবনসঙ্গীকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। চেহারা যেমনই হোক, ভালোবাসাটায় আসল। মানুষ মন মানসিকতায় উন্নত আর আচরণে সুন্দর এমন খোঁজে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মনে মনে চেহারায় সুন্দরকেই লালন করে। মনের বা গুণের সৌন্দর্যের খোঁজ কেউ রাখতে চায় না। বেশিরভাগ মানুষ বোকা তাই বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই খোঁজে। কিন্তু বিভা তেমন নয়, সে জানে সৌন্দর্য মুখের আবরণে না, মনে। সুন্দর ব্যবহারই আভরণ। আর তাই পারিপার্শ্বিকতার কারণে যে দিনের আলোতেই বাইরে যেত না, সে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতেই বের হয়ে পড়লো মৃদুলের উদ্দেশ্যে। বিভার অন্তরের টান দেখে বোঝা যায়, পুরুষ মানুষের সৌন্দর্যে নারী আটকে যায় না, আটকে যায় পুরুষের দায়িত্বে।
বাড়ি এসে দেখে শুকনো মুখে বসে আছে মৃদুল। বিভাকে দেখতেই দৌঁড়ে এসে বুকে চেপে ধরে বললো, এত রাতে বের হয়েছিলে কেন বাসা থেকে?
বিভা বললো, তুমি যেখানে সম্মান পাও না, সেখানে আমি থাকি কী করে? আর সেখানে যাবো না আমি।
মৃদুল প্রতিউত্তরে বলতে থাকে, বিভা, সবাই আমাকে কালো বলে এতে আমার কষ্ট নেই। সত্যকে মেনে নিতে শিখেছি অনেক আগেই। তুমি সুন্দর বলে তোমাকে বিয়ে করেছি, এটা সত্য। আমি চাইনি আমার সন্তানও কালো হোক, আর সারাটা জীবন আমার মতো নির্যাতিত হোক পরিবেশ দ্বারা। তোমাকে হঠাৎ এবং দ্রুত সিদ্ধান্তে সময়ক্ষেপণ না করে বিয়ে করেছি, এটাও সত্য। যাতে নানা মতের প্রভাবে তোমাদের মত পরিবর্তন না হয়। কী করবো বলো? আমার আচরণ সবার কাছে ভালো লাগে, আবার সবাই-ই বলে কালো হলে কী হবে কথাবার্তা ভালো। আমার দ্বারা আমার মহল্লার অনেকেই উপকৃত হয়, সেই তারাই আবার বলে, কালো হলে কী হবে উপকার করার ইচ্ছা আছে। আমার রেজাল্ট ভালো, সেই দিকে কারো নজর নেই, আমি কালো সেই দিকে সবার ভ্রূক্ষেপ। ভালো চাকরি করি, ভালো রোজগার করি তবুও সেদিকে মানুষের নজর নেই, বলে ইনকাম ভালো তাতে কী কালো তো। ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বড়ো হয়েছি বলেই তোমাকে বিয়ে করেছি আমি। সন্তান মানুষ না হলেও আক্ষেপ করবো না, তবুও আমার সন্তান যেন পরিষ্কার হয়। অবিবেচক সমাজে যোগ্যতার চেয়ে রূপের মূল্য অনেক। রূপদম্ভের কাছে কর্মগুণের পতন এই সমাজ বাস্তবতায়। আমার খুব খারাপ লাগে যেখানে আমি আমার অধস্তনদের আত্মবিশ্বাস জোগাবো, সেখানে আমার নিজেরই আত্মবিশ্বাস শূন্যের কোঠায়, শুধু কালো বলে। মানুষ সৌন্দর্য দেখে, চরিত্র দেখে না। সুন্দর মানসিকতা কেউ দেখে না, সবাই সৌন্দর্যের পাগল। মানুষের মন সদা ছুটে চলে ফরসাপানে। ব্যক্তিত্বের মাধুর্য দিয়েও যে মানুষকে কাছে টানা যায় অধিকাংশই তা বুঝতে চান না। শুধু চেহারায় ভালো বলে তার হাতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বাবা-মা, তবুও আমার কাছে বিয়ে দেননি। কালো টাকা রোজগার করে তার হাতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, তবুও আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দেননি। কালো যেন রং না, কালো যেন অভিশাপ। কালো বাজারিকে মানুষ পছন্দ করেন, কিন্তু নির্ভেজাল কালো মানুষকে মানুষ অবজ্ঞা করেন।
বিভা কোনো কথা না বলে মৃদুলের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। সে মৃদুলকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পায় না। মৃদুলও এখন কোনো সান্ত্বনায় ভোলে না। প্রকৃতপক্ষে একজন কালো মানুষ জানে পৃথিবীর নিয়ম আর বাস্তবতা কত কঠিন।
======================
নাভারণ, ঝিকরগাছা, যশোর থেকে।