চশমা পরে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া সাহানার কাছে রীতিমত বিরক্তিকর। গরম চায়ের বাষ্পে চশমার গ্লাস ঘোলাটে হয়ে যায়, সেজন্য বেশিরভাগ সময় চশমা খুলেই চা খেতে হয় ওকে। যদিও ব্যাকরণ অনুসারে চা পান করা হওয়া উচিত। কিন্তু খাওয়া শব্দের ব্যবহারের আধিক্যে ভুলটা আজ সঠিক হিসেবে প্রচলিত হয়েছে। যেমন সময়ের সাথে সাথে জীবনের অনেক ভুল সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে হয়।
আগের বার যখন শ্যুটিং স্পট দেখার জন্য গদখালিতে এসেছিলো তখন চৌমাথার এই বট গাছের নিচে কোনো চায়ের দোকান ছিলো না। তবুও নিজেকে যাচাই করার জন্য চা বিক্রেতা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করে সে, আচ্ছা আপনার এই চায়ের দোকানটি কত দিনের?
চায়ের দোকানের মালিক, ঠিক মালিক বলা চলে না, একচ্ছত্র অধিপত্নী রাশেদা জানাই, জি আপা, এই মাস তিনেক। আফা, আপনাকে আর একখান বিস্কুট দেবো?
বিস্কুট লাগবে না বলে জানাই সাহানা। প্রখর স্মৃতিশক্তি সাহানার, এটা নিয়ে নিজের মধ্যে যে একটা তৃপ্তিবোধ কাজ করে না তেমন নয়। তবে প্রচণ্ড রকমের বিনয়ীও বটে।
চায়ের দোকানের বিপরীতে রাস্তার পাশে খালের মতো একটা সরু জলাশয়। জলাশয় হলেও জলটা তেমন দেখা যাচ্ছে না, কচুরিপানা আর কলমিলতায় ঢাকা পড়েছে। সবুজ পাতার মাঝে বেগুনি রঙের কলমি ফুলগুলো রোদে জ্বলজ্বল করছে। মোবাইল দিয়ে ক্যামেরা বন্দি করতে ভুল করে না সে। গতকাল রাতে ক্যামেরায় চার্জ না দেওয়ার দরুন আজ ক্যামেরাটা আনা হয়নি। ইউনিভার্সিটি থেকেই ছবি তোলাটাও সাহানার আরেকটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যতত্ত্বে গ্রাজুয়েশন শেষ করে এখন ডিরেকশনে মন দিয়েছে। তবে বাইরে থেকে ফিল্মের উপর আরেকটু পড়াশোনা করার ইচ্ছা আছে। তার আগে কিছু শর্ট ফিল্মের কাজ করতে চায় সে।
বাঁশের ত্রিভুজাকারের ফ্রেমে ছেঁড়া মশারির কিছু অংশ আটকিয়ে ছিটকি বানিয়ে খালের কলমিলতার নিচ থেকে মাছ ধরতে ছিলো বছর আটের একজন ছেলে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সে দৃশ্যও চোখ এড়ায়নি তার। চায়ের দোকান থেকে খানিকটা দূরেই মাছ ধরছিলো ছেলেটা। হঠাৎ উৎফুল্লতার সাথে চিৎকার দিয়ে জানান দেয়, এ মা বড় একখান শোল মাছ পাইছি, দেখে যা।
আচ্ছা মাকে তুই বলে এই যে সম্ভোধন তাকে কি ইতর সুলভ আচরণ বলা চলে? নাকি আবেগের গভীরতায় সেটা সঠিক, ভাবতে থাকে সাহানা। রাশেদা দোকান থেকে ছেলেটির কথার উত্তর দেয়, আমার আসার সুমায় নেই রাতুল, মেলা কাজ বাকি। আর মাছ ধরা লাগবে না, ইস্কুলে যা, এগারোডা বাজতি গেছে।
বাক্যবিনিময়ে সাহানার বুঝতে বাকি থাকলো না রাতুল রাশেদারই ছেলে। সাহানাকে এখনও বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। গাড়ির টায়ার চেঞ্জ করা শেষ হয়নি। এখানে বসে থাকতে অবশ্য ওর মন্দ লাগছে না। বাতাসে খালের কলমিলতাগুলো দোল খাচ্ছে, রাস্তার পাশের ঝরা কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো যেন লাল গালিচা বিছিয়েছে। গ্রাম বাংলার এই অপরূপ সৌন্দর্য সাহানাকে চিরদিনই মুগ্ধ করে। তাই তো ওর সিনেমায় এই মাটি আর মাটির মানুষের জীবনকে ফুঁটিয়ে তোলার ইচ্ছা। এর মধ্যে রাতুল যে কখন খাল থেকে উঠে দোকানে এসেছে সাহানা খেয়াল করেনি। রাতুল কোমরে বাঁধা মাছের প্যাকেটটি দোকানের দেওয়ালে ঝুলিয়ে বলে, মাছডা রাখলাম এখানে, আমি ইস্কুলে যাচ্ছি। তুই শোল মাছটা ভুনা করে রাখিস। টিফিনে এসে খেয়ে যাবানে।
খিলিপানের জন্য সাইজ করে কাটা পানগুলো ধুতে ধুতে রাশেদা বলে, পেঁয়াজের যে দাম তাতে আর ভুনা খেতে হবে না। সরষে দিয়ে রান্না করে রাখাবানে, খেয়ে যাস। যেন আবার ডাকতি যাওয়া না লাগে। মাছখানা বাড়িত নিয়ে যা, আমি যদি ভুলে যাই? আর যেন নিচে রাখিসনে, রান্নাঘরের শিকেয় তুলে রাখিস।
ড্রাইভার এসে জানায় গাড়ির টায়ার চেঞ্জ করা হয়ে গিয়েছে। এবার সাহানাকে উঠতে হবে, বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে তার। চা-বিস্কুটের বিল দিতে গিয়ে এতক্ষণে এই প্রথমবার রাশেদার মুখটা দেখা হলো সাহানার। দেখে রীতিমত চমকে উঠেছে সে। আসলে যখন এসে চায়ের দোকানে বসেছিলো তখন দোকানের তাক থেকে কি যেন একটা নামাচ্ছিলো রাশেদা। আবার যখন চা দিয়ে সাহানাকে নিতে বলেছে তখন সাহানা দোকানের দিকে পেছন ফিরে কলমিফুলের ছবি তুলছিলো। তারপর থেকে তো ওইদিকে তাকিয়ে বসে আছে চা খেয়ে। সেজন্য এই আধাঘণ্টায় একবারের জন্যও রাশেদার মুখটা দেখা হয়নি তার। কি অদ্ভুতভাবে মুখের ডানপাশটা পুড়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন জোর করে পুড়িয়ে দিয়েছে। খুব কৌতূহল হচ্ছে জানার জন্য, আবার বুঝতে পারছে না জিজ্ঞাসা করাটা ঠিক হবে কিনা।
নিজের কৌতূহলকে দমন করতে পারছিল না সাহানা। তাই তো গাড়িতে উঠতে গিয়েও আবার ফিরে এসেছে রাশেদার দোকানের সামনে। সাহানাকে দেখে রাশেদা জিজ্ঞাসা করলো, আফা, কিছু লাগবে আপনার?
সাহানা বুঝতে পারছে না কীভাবে জিজ্ঞাসা করবে। জিজ্ঞাসা করলে পোড়াদাগগুলো যদি আবার ওকে নতুন করে পোড়ায়। সাহানা না-সূচক ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে বললো, না, কিছু লাগবে না। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
রাশেদা দুপুরে রান্নার জন্য বাড়ি যাবে সেজন্য জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলো। গোছাতে গোছাতে বললো, মনে করবো ক্যান, আপনি বলেন কী জানতে চান?
সাহানা বলে, না, মানে আপনার মুখের এই পোড়া দাগটি কীসের? দেখে তো ঠিক এক্সিডেন্ট বলে মনে হচ্ছে না।
রাশেদা হাসতে হাসতে বলে, এই কথা? আরে ধূর মনে করবো ক্যান। সবাই জিজ্ঞাসা করে, এইডে নতুন কিছু না আমার জন্যি। ভাগ্যের দাগ আফা, ভাগ্যের দাগ।
বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রাশেদা।
সাহানার বোধগম্য হয়ে ওঠে না, মানুষ কষ্টের কথা কীভাবে এমন হাসতে হাসতে বলে! তবে রাশেদা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার পর অনেকটা মেঘের গর্জনের পরে নিঃস্তব্ধ প্রকৃতির মতো শান্ত হয়ে গেলো। সাহানা এবার জিজ্ঞাসা করেই বসলো, কিন্তু কীভাবে?
রাশেদার কণ্ঠটা নেমে এসেছে। কেমন কাঁপাকাঁপা গলায় বললো, স্বামী ভালোবেসে পুড়িয়েছে আফা।
- তোমার নিজের স্বামী! এইভাবে!
- হুম আফা, বেশি ভালোবাসতো তো, সেইজন্য।
এই কয়েকটা কথা সাহানার কৌতূহলের পারদকে আবার কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলো। সে রাশেদাকে বললো, আর এক কাপ চা হবে?
রাশেদা যদিও বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, কিন্তু কেন জানি না বলতে পারলো না। উনুনের কয়লার আঁচেই জলটা গরম করে সাহানাকে আর এককাপ চা বানিয়ে দিলো। সাহানা চায়ে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা, যদিও তোমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার তবুও জিজ্ঞাসা করছি, কী এমন হয়েছিলো যার জন্য এভাবে মুখটা পুড়িয়ে দিলো?
- এখন আর ব্যক্তিগত ব্যাপার নেই আফা, ওর সাথে ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে শীতের শেষে। যদিও মানুষ কয়েছিলো মিলমিশ করে নিতে। কিন্তু আজ মনে হয় যেডা করেছি ভালোই করেছি।
মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। রীতিমত অনেকগুলো কঠিন কাজের মধ্যেই একটা হয়তো। এমন পরিস্থিতিতে 'ও' কিংবা 'হুম' শব্দের সাথে তাল মেলানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। সাহানাকেও তাই করতে হলো।
- হ আফা, আসলে মর্দ্দা মানুষের দেহের ক্ষিদে!
- দেহের ক্ষিদে!
- হ, ওই দেহের ক্ষিদেই তো কাল হলো আমার জন্যি। আমাদের বিয়ে হয়েছে ১০ বছর, ছেলেটাকেও তো দেখলেন কত বড়ো হয়েছে।
- মাশাল্লাহ, বেশ বড়ো হয়েছে। আর ওর নামের মতো দেখতেও মিষ্টি।
- দোয়া করেন ওর জন্যি। আসলে আমার মাসিকের সময় অনেক পেটে ব্যথা হয়। যন্ত্রণায় আমার নাওয়া-খাওয়া থাকে না। তাছাড়া ভোরবেলা থেকে সারাশীত চাতালে ধান সিদ্ধের কাজ করতাম। দুটো বাড়তি পয়সার আশায়। ওর বাপ রাতে বিছানায় এসব কিছুই বুঝতে চাইতো না। সব সময়ডা কি আর শরীর-মন ভালো থাকে কন?
-তুমি কিছু বলতে না?
- বলেই তো ঝামেলাডা বেঁধেছে। আফা, আমি জানি স্বামী হিসেবে হক আছে তার। কিন্তু আমার সমস্যাও তো বুঝতি হবে ওর। কিন্তু বুঝতো না। শুধু শুধু সন্দেহ করতো আর বলতো ধানের চাতালে গিয়ে মাগী হয়েছে। ভাতারকে তো আর ভালো লাগবে না। নতুন ভাতার জুটাইছিস তো!
সাহানার কৌতূহলের পারদে যেন ধাক্কা লাগলো। নিজের অজান্তে বলে বসলো, মানুষ এমনও হয়!
- হয়, আফা, হয়। তবে এরা মানুষ না, মানুষের মধ্যে অমানুষের আত্মা।
- সেটাই হবে হয়তো, কিন্তু পুড়লো কীভাবে?
- পুড়িনি আপা, জানোয়ারডা পুড়ায় দিছে। যেদিন পুড়ায় দিলো তার আগের দিন রাতেও আমার সাথে ঝগড়া হয়েছিলো ওর। আমি চাতাল থেকে এসে রান্নার জন্য মাছ ভাজতে ছিলাম। ছেলেডার কেমন জ্বরজ্বর লাগতেছিলো। তার জন্য আর ইস্কুলে পাঠায়নি। ও বাইরে থেকে এসে দেখে ছেলে হাতনেই বসে নিজের মতো লুডু খেলছে। ছেলে ইস্কুলে যায়নি ক্যান জিজ্ঞাসা করলি আমি বললাম, ওর জ্বর এসেছে তাই আর পাঠায়নি।
তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় গিয়ে ওর কপালে হাত দিয়ে বলে, জ্বর তো নেই গায়। নিজে তো নষ্ট হয়েছিস সাথে সাথে আমার ছেলেটাকেও নষ্ট করার ধান্ধা?
এ কথায় ও কথায় অশান্তি বেড়ে গেলো।ঝগড়ার এক পর্যায় এসে অমানুষটা আমার মুখে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা বসিয়ে দেয়। কী যে যন্ত্রণা হয়েছিলো আফা, কাটা কইতরের মতো সারাবাড়ি দাপাদাপি করেছিলাম।
নিজের অজান্তে রাশেদার চোখে জল এসে গিয়েছে। আর বিড়বিড় করে বলছে, আমার তো কোনো দোষ ছিল না আফা, উপরওয়ালা এই শাস্তি দিলো ক্যান আমারে?
শাস্তি পেতে সব সময় অপরাধী হতে হয় না, প্রয়োজন শুধু মন্দভাগ্যের। সবটা শুনে নিঃস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সাহানা। ওর চেনা গণ্ডির বাইরেও যে এতটা অচেনা জগৎ থাকতে পারে সেটা হয়তো ও আগে বোঝেনি। মনের মধ্যে কতশত প্রশ্নেরা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। সাহানা ভাবে রাশেদার স্বামী অশিক্ষিত, তার পারিবারিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কিন্তু যাদের আছে সেসব মানুষেরা কি এটার উর্ধ্বে? ফিজিক্যাল এবং মেন্টাল হেলথের জন্য সুস্থ যৌনসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা মানুষ কবে বুঝবে? আদৌ কি কোনোদিন বুঝবে? এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে কথা বলাটা যে এখনও একরকম ট্যাবু হয়েই রয়েছে বিষয়টা ভাবতেই কেমন জানি অস্বস্তি লাগে সাহানার। কামনা যখন প্রেমের উর্ধ্বে চলে যায় তখন সেটা পাশবিক, অমানবীয়। তাই হয়তো সুবর্ণলতা আক্ষেপ করে বলেছিলো, পুরুষের এই পাশবিক প্রবৃত্তির কাছে হার মেনে যায় সবকিছু। আমরা কেন বুঝতে চাই না আমাদের লাইফ পার্টনার আমাদের আস্থার জায়গা, ভালোবাসার অবলম্বন, পথ চলার সঙ্গী। হোক সেটা নারী কিংবা পুরুষ, উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এর মাঝে রাশেদার ঝাঁপি নামানো শেষ। তালা দিতে দিতে বললো, আফা, আমার বাড়িতে চলেন। দুপুরে শোল মাছ দিয়ে মেহমানদারি করবানি।
রাশেদার কথায় অন্যমনস্কতা কেঁটে যায় সাহানার। বলে আজ থাকুক, আগামী দিন এসে নিশ্চয় আপনার হাতের তরকারি দিয়ে পেট ভরে ভাত খাবো।
সাহানাকে মনে হয় আবার আসতে হবে। রাশেদার বড্ড দেরি হয়ে গেলো। রাতুল আসার আগে রান্না শেষ করতে না পারলে না খেয়েই থাকতে হবে ছেলেটাকে। রোদের তীব্রতা বেশ বেড়েছে একটু আগের হাস্যোজ্জ্বল কলমিলতার ফুলগুলো কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে নুয়ে পড়ছে।আচ্ছা, ওরা কি রাশেদার প্রতিচ্ছবি? কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে উঠার সাথে সাথে কেমন বিবর্ণ হয়েছে।
আজ আর শ্যুটিং স্পট দেখতে যাবে না সাহানা। জীবন যেখানে গল্প হয়ে ধরা দেয়, সেখানে কল্পনায় হারানোর কী প্রয়োজন!
==========================
শার্শা, যশোর, বাংলাদেশ থেকে