ছোটরানীর প্রতিশোধ
মিঠুন মুখার্জী
আজ থেকে একশো বছর আগের ঘটনা। হাড় হিমকরা কাহিনী। অমিত, রঞ্জন ও সুজিত তিন বন্ধু বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে ঘুরতে গিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক স্থান বিষ্ণুপুর। তারা তিনজনেই যেহেতু ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, সেহেতু সকলের মধ্যেই বিষ্ণুপুর নিয়ে নানান কৌতূহল ছিল। বি.এ তৃতীয় বর্ষে তখন সবাই পড়তেন। বাঁকুড়ায় এই প্রথম তাদের ভ্রমণে যাওয়া। রাজবাড়ী থেকে শুরু করে রাস মঞ্চ, আরো অনেক ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরে খুব ভালো লেগেছিল তাদের। তারা তিন দিন বিষ্ণুপুরে থাকার পরিকল্পনা করেছিলেন। এক পুরনো রাজবাড়িতে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা। ওই বাড়ির দেখাশোনার জন্য দুজন লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। বাইরে থেকে কোনো অতিথি এলে তাদের বসবাসের যোগ্য দুটি ঘর ছিল। মূল প্রাসাদে তালা দেওয়া। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কথিত আছে এই রাজবাড়ীর অন্দরমহলের এক গুম ঘরে রাজা অন্যায় ভাবে তার ছোট রানী সুরশ্রীকে হত্যা করেছিলেন। রাজা বিষ্ণু বর্মা খুব অত্যচারী রাজা ছিলেন। তার শাসনে প্রজারা সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকত। তিনি গান পছন্দ করতেন না। তাঁর তিন রানী যথাক্রমে সুরঞ্জনা, সুদর্শনা ও সুরশ্রী। তারাও রাজাকে যমের মতো ভয় করতেন। রাজা অপছন্দ করবেন এমন কোন কাজ করার সাহস করতেন না। কেবল সুরশ্রী একটু ব্যতিক্রম। তিনি ক্ষত্রিয় বংশের রাজকন্যা। পিতার গৃহে থাকাকালীন তিনি গান খুব ভালবাসতেন। গান না করে একদিনও থাকতে পারতেন না। খাওয়া না হলেও তার সমস্যা হতো না, কিন্তু গান না করলে তার ঘুম আসত না। অত্যাচারী ও শক্তিশালী রাজা রাজকন্যা সুরশ্রীকে দেখে বিবাহ করবার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বাবা রাজি না হলে যুদ্ধের ভয় দেখান বিষ্ণু বর্মা। প্রজাদের কথা চিন্তা করে রাজকন্যা সুরশ্রীর পিতা বিষ্ণু বর্মার সঙ্গে একমাত্র কন্যা সুরশ্রীকে বিবাহ দিতে রাজি হন। দুই রানী থাকা সত্ত্বেও বিষ্ণু বর্মা তৃতীয় রানী হিসেবে রাজকন্যা সুরশ্রীকে বিবাহ করেন।
বিষ্ণুপুরের রাজবাড়িতে একদিন নিজের ঘরে রানী সুরশ্রী গলা ছেড়ে গান করছিলেন। রাজা বিষ্ণু বর্মা তা শুনে ফেলেন। তিনি সত্বর ছোট রানীর ঘরে গিয়ে গান বন্ধ করতে বলেন। সম্রাজ্ঞী সুরশ্রী চুপ করে যান। রাজা রানীকে বলেন--- "আমার প্রাসাদে তুমি আর কোনদিন গান গাইবে না। আমি গান পছন্দ করি না। আমার রাজ্যে কাক- পক্ষী পর্যন্ত আমার ভয়ে চুপ করে থাকে। আর তুমি গলা ছেড়ে গান গাইছো।" ছোটোরানী সুরশ্রী মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার দুচোখে জল দেখা যায়। তিনি মনে মনে চিন্তা করেন,--- "এর থেকে আমাকে মেরে ফেললেও আমি বেঁচে যেতাম। গান আমি বন্ধ করতে পারবো না।" রাজা বিষ্ণু বর্মা তাকে এও বলেছিলেন--- "আর কখনো তোমায় গান করতে শুনলে তোমার যথাযথ শাস্তি বিধান করা হবে। সাবধান, খুব সাবধান।"
এরপর অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। রাজপ্রাসাদে টু-শব্দটি শোনা যায় না। বড় রানী সুরঞ্জনা ও মেজরানী সুদর্শনা আলাদা আলাদা ঘরে থাকতেন। তারাও সব সময় রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারতেন না। রাজা তাঁর ইচ্ছামতো রানীদের কাছে যেতেন। রানীদের কারো জীবনের স্বপ্নপূরণ হয় নি। রাজা নপুংসক ছিলেন। সন্তান জন্ম দেওয়ার কোনো ক্ষমতা তার ছিল না। রানীরা তাঁর ভয়ে তাঁকে তাদের শরীরটাকে দান করেছিলেন, কিন্তু মন দান করেননি। ছোটোরানী সুরশ্রীর আগে রাজা বিষ্ণু বর্মার যে দুজন রানী, তাদেরও তিনি ভয় দেখিয়ে লাভ করেছিলেন। ক্ষমতার কাছে সকলে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন ।
বছর খানিক পরে রাজা এক দাসীর কাছ থেকে জানতে পারেন, ছোটরানী সুরশ্রী প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে এই প্রাসাদে গান করেন। কখন করেন সেটিও রাজাকে জানায় সে। রাজা ছোটো রানীর প্রতি প্রচন্ড রেগে যান। পরদিন যখন ছোট রানী সুরশ্রী তার ঘরে দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে গান করছিলেন, তখন রাজা দুজন প্রহরীকে নিয়ে ছোটো রানীর ঘরে প্রবেশ করেন। ছোট রানী তাকে দেখে ভয়ে কেঁদে দেন। তিনি বলেন-- "গান আমার প্রাণ। গান না করলে আমি বাঁচবো না। আমার কাছ থেকে গান কেড়ে নেবেন না। আপনার কাছে আমি একান্ত অনুরোধ করছি।" রানীর কোনো অনুরোধ কাজে আসেনি। রাজা বিষ্ণু বর্মা তাকে বলেন--- " তুমি আমার কথার অমান্য করে বড় ভুল করেছো। তুমি আমার ক্রোধ জানোনা? এই অন্যায়ের জন্য তোমাকে শান্তি পেতেই হবে।" প্রহরীকে বলেন--- "প্রহরী, ছোট রানী সুরশ্রীকে আমাদের অন্ধকার গুম ঘরে হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেলে দিয়ে এসো। দশ দিন কোনরকম খাবার দেবে না। শুধু দিনে দুবার করে জল দেবে। দশ দিন পর যদি বেঁচে থাকে তাহলে ওর বাপের কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমি আর ওর মুখ দেখতে চাই না।" প্রহরীরা রাজার কথা মতো রানী সুরশ্রীর হাত-পা ও মুখ বেঁধে গুম ঘরে ফেলে দেয়। দিনে দুবার জল দিতে যেত রাজার বিশ্বস্ত দাসী দময়ন্তী। অষ্টম দিন জল খাওয়াতে গিয়ে দাসি দময়ন্তী দেখে, রানীর দেহে প্রাণ নেই। রাজাকে এসে বলায় রাজা গোপনে লাশটা জ্বালিয়ে দিতে বলেন। রাজার কথা মতো রানী সুরশ্রীর মৃতদেহটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
রানীর মৃতদেহ পুড়িয়ে দিলেও রানীর অতৃপ্ত আত্মা রাজবাড়ীর ও গুম ঘরের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতো। মাঝে মাঝে অনেকেই তাকে দেখেছিলেন। রাজা বিষ্ণু বর্মার প্রতি প্রতিশোধ সে নিয়েছিল। তাঁর পিতাকে একদিন দেখা দিয়ে তাঁর উপর হওয়া অত্যাচারের কথা তিনি বলেছিলেন। এরপর পিতা কন্যার শোকে মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তিনি সুরশ্রীকে বলেন--- "তোকে যে অন্যায় ভাবে হত্যা করেছে, তাকে তুই ছাড়বি না মা। উপযুক্ত শাস্তি তাকে দিবি তুই।"
ছোটরানী সুরশ্রীর আত্মা একদিন বড়রানী সুরঞ্জনার মধ্যে প্রবেশ করে। সেই দিন রাজা বিষ্ণু বর্মা বড় রানীর কাছে রাতে এসেছিলেন। বড় রানীর সঙ্গে যখন তিনি সম্ভোগে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় বড় রানীর মধ্যে থেকে ছোটরানী সুরশ্রীর আত্মা কথা বলতে থাকে। "এই পাষণ্ড রাজা, আমায় চিনতে পারছিস? মেয়েদের তুই খেলার যন্ত্র মনে করিস, না? তোর খুব ক্ষমতা। দেখি আজ আমার হাত থেকে তোকে কে বাঁচায়।" ঘর থেকে রাজা পালাতে যান। এমন সময় বড়রানী সুরঞ্জনার শরীর থেকে সুরশ্রীর আত্মা বেরিয়ে আসে। বড়রানী জ্ঞান হারান। রাজার মাথা ধরে উঁচুতে তুলে নেন ছোট রানী। তারপর বলেন--- " তুই কেন গান পছন্দ করিস না? তুই তো মানুষ নস!! পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ আছেন যে গান পছন্দ করে না? তোর মতো পশুর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তোকে আজই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দেবো।" এরপর হাত জোড় করে রাজা বিষ্ণু বর্মা রানী সুরশ্রীর আত্মার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন ও তাকে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তাকে ছেড়ে দেননি। মট করে তাঁর ঘাড়টা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজা বিষ্ণু বর্মা মারা যান। বিষ্ণু বর্মা মারা গেলে বড় রানী সুরঞ্জনা সিংহাসনে বসেন। কয়েকবার তাদেরকে ছোট রানী দেখা দিয়ে তার মৃত্যুর ঘটনা তাদের শোনান এবং বলেন--- "দিদি এভাবে আপনাদের জীবন যাবে না। আপনারা দুজন দুটি দত্তক পুত্র নেন। তারাই হবে বিষ্ণু বর্মার পরবর্তী বংশধর।" ছোট রানীর কথামতো দুটি দত্তক সন্তান নিয়েছিলেন সুরঞ্জনা ও সুদর্শনা। বড়রানী তাঁর ছেলের নাম দেন অর্জুন বর্মা ও মেজো রানী তার ছেলের নাম দেন বাসুদেব বর্মা।
সুরঞ্জনা ও সুদর্শনা নারী হওয়ায় এবং রাজকুমাররা ছোট হওয়ায় পার্শ্ববর্তী রাজা অভয় গুপ্ত রাজ্যের উপর আক্রমণ করার চিন্তা করেন। আক্রমণ করার আগে একদিন অভয় গুপ্ত তাঁর ঘরে রাতে শুয়েছিলেন। হঠাৎ দেখেন তাঁর খাট নড়ছে, ঘরের আলো মাঝে মাঝেই বন্ধ হচ্ছে, আবার জ্বলছে। খুব সাহসী ছিলেন তিনি। প্রথমে ভয় না পেয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন। হঠাৎ দেখেন তাঁর ঘরের মধ্যেই একটা চেয়ারে কে যেন চুল ছেড়ে বসে আছেন। তিনি 'প্রহরীদের' ডাক দেন। কিন্তু কোনো প্রহরী ছুটে আসে না। অচেনা ওই মহিলাটাকে দেখার জন্য আরো সামনে এগিয়ে আসেন তিনি। এবার যত কাছে আসতে লাগলেন তিনি, তাঁর বুকের মধ্যে ততই ধুকপুক করতে লাগলো। চেয়ারে যিনি বসেছিলেন তিনি আসলে রানী সুরশ্রীর আত্মা। তাঁর কাছে গিয়ে রাজা অভয় গুপ্ত 'কে তুমি' বলে কাঁধে হাত দিতেই দেখেন, মাথাটা তার দিকে ঘুরে গেলো।চোখ দুটো লাল টকটকে। সারা মুখে রক্ত মাখা। চোখ দুটি বিস্ফোরিত। রাজা অভয় গুপ্ত ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলেন। ছোটোরানীর আত্মাকে জিজ্ঞাসা করলেন--- "কে তুমি? কি চাও? আমার অন্দরমহলে কেন?" তখন রানী বিকট হাসি হেসে দেন। তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে মহাশূন্যে ঘুরতে থাকেন। আবার দেওয়াল বেয়ে উপরের দিকে উঠে যান। রানী সুরশ্রীর এই দৃশ্য দেখে সাহসী অভয় গুপ্ত ভয় পেয়ে যান। রানী বলেন--- "আমি জানি, তুই রাজা বিষ্ণু বর্মার রাজ্যে কয়েক দিনের মধ্যে আক্রমণ করতে যাচ্ছিস। আমি চাইনা তুই ওই রাজ্যে আক্রমণ করিস। ওইদিকে কোনদিন চোখ তুলেও চাইবি না। তাহলে তোকে আমি শেষ করে দেব। নারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাস কাপুরুষ!! নারীদের দুর্বল মনে করিস? বিষ্ণু বর্মার অবর্তমানে সুযোগ নিয়ে তুই ওদের উপর আক্রমণ করবি? কান খুলে শুনে রাখ, ওদের সাথে আমি আছি। ওদের কিংবা রাজ্যের কোনো ক্ষতি করার চিন্তা করলে তোকে ও তোর সৈন্যদের কাউকে আমি ছাড়বো না। তুই ভাবছিস আমি কে? আমি রাজা বিষ্ণু বর্মার ছোট রানী সুরশ্রী। রাজার অত্যাচারে আমি মারা গিয়েছি। আমার আত্মা রাজার অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছে। আমি চাইনা রাজার মতো তুইও ভুল করিস। তার পরিণতি খুবই খারাপ হবে।" এই সাবধান বাণী শুনিয়ে ঘরের থেকে নিমেষের মধ্যে একটা দমকা হাওয়া হয়ে বেরিয়ে যান তিনি। চলে গেলে আবার স্বাভাবিক আলো জ্বলে ওঠে। এতক্ষণ আলো- আঁধারী ঘরের মধ্যে তারা কথা বলছিলেন। রানী চলে যাওয়ার পর রাজা অভয় গুপ্ত একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। এতক্ষণ তাঁর দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
রানী সুরশ্রীর কথা মতো রাজা অভয় গুপ্ত তাঁর মাথা থেকে বিষ্ণু বর্মার রাজ্যে আক্রমণের চিন্তা একেবারে ঝেরে ফেলেন। বিষ্ণুপুরে দীর্ঘদিন শান্তি বিরাজ করতে থাকে। বারো বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। রাজপুত্রেরা বড় হয়ে যান। দুই যুবরাজের সিংহাসনে অভিষেক ঘটে। এক যুগ কেটে গেলেও রানী সুরশ্রী তখনও সমহিমায় রাজ্যে ঘুরে বেড়ান। তিনি কথা দিয়েছেন দুই রানীকে, এই রাজ্যকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার। তিনি থাকবেন। তাছাড়া তাঁর শ্রাদ্ধ-শান্তি ঠিকঠাক না হওয়ায় তাঁর আত্মার সদগতি হয়নি।
রাজকুমাররা মায়েদের কথামতো পুরুলিয়া রাজের দুই কন্যাকে বিবাহ করেন। তাদের একজন সুমিত্রা ও অন্যজন শকুন্তলা। এদিকে অভয় গুপ্ত মারা গেলে তাঁর পুত্র সরোষ গুপ্ত সিংহাসনে বসেন। তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে বিষ্ণুপুর রাজ্যে আক্রমণ করেন।রানী অনেক চেষ্টা করেও কাউকে বাঁচাতে পারেননি। চতুর সরোষ গুপ্ত তার শয়তানি বুদ্ধিতে জয়লাভ করেন। পূর্বেই তান্ত্রিক দিয়ে রানী সুরশ্রীকে বন্দী বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। ফলে রানী তেমন সাহায্য করতে পারেননি। প্রিয়জনদের হারিয়ে রানী সুরশ্রী প্রচন্ড কষ্ট পান।
একদিন রাতে তিনি গান শুরু করেন। রাজা সরোষ গুপ্ত হঠাৎ গানের আওয়াজ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে যান। তারপর বিছানা থেকে নেমে গানকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে দেখেন যে, মন্ত্রপুত করে যে ঘরে রানী সুরশ্রীকে শিকল দিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেই ঘর থেকে এই গানটি আসছে। অনেকদিন পর গান করার ইচ্ছে জেগেছিল ছোটো রানীর। গানটির সুরটা এত সুন্দর ছিল যে কেবল সরোষ গুপ্তই নন, যে কারোরই মনকে আকৃষ্ট করবে। ছোট রানীর অসাধারণ গানে তিনি এতই মত্ত হয়েছিলেন যে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। যে বাক্সের মধ্যে মন্ত্রপুত করে রানীর আত্মাকে ধরে রাখা হয়েছিল সেই বাক্সের তালা ও শিকল খুলে দেন তিনি। নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনেন।এরপর বাক্সের থেকে ছোট রানী সুরশ্রী বেরিয়ে আসেন। তাকে সম্মোহন করে ঘন জঙ্গলে নিয়ে যান। বট গাছের ঝুরির সঙ্গে পেঁচিয়ে তাকে মেরে ফেলেন। তারপর থেকে আশেপাশের রাজ্যে ও বিষ্ণুপুরে প্রায়ই অমাবস্যার রাতে রানী সুরশ্রীর আত্মাকে গান করতে শোনা যেত। একটাই আশার কথা, যে মানুষের খারাপ চায় তার জন্য রানী সুরশ্রী যমের দূত ছিলেন, কিন্তু ভালো মানুষকে কখনো তিনি বিপদে ফেলেন নি। তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। তবে অনেকেই বলেন রানীর আত্মার সদগতি এখনো হয়নি। অমাবস্যার রাতে এখনো রাজবাড়ীর অন্দরমহলে থেকে গান শোনা যায়, পায়ের নূপুরের আওয়াজ কানে আসে। প্রায় একশো বছর অন্দরমহলে কেউ প্রবেশ করেননি। অমিত, রঞ্জন ও সুজিত এই কাহিনী শুনে যেমন ভয় পেয়েছিলেন, তেমনি রানীর আত্মার সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছাও জেগেছিল। কারণ তারা চেয়েছিলেন রানীর শ্রাদ্ধ-শান্তি করে তাঁর আত্মার সদগতি করতে। তাদের সঙ্গে রানীর হয়তো কোন সম্পর্ক ছিল না। তবুও তাদের মানবিকতার পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন তারা।
পরের দিন রাতে অতিথিশালায় তিনজন ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ অন্ধকার ঘরের মধ্যে অমিত অনুভব করেন, তাদের দরজাটা খুলে গেল। একটা চিকন গলার গান বাইরে থেকে ভেসে আসছে। রাতটা ছিল অমাবস্যার। সে রঞ্জন ও সুজিতকে ডেকে তোলেন। তারাও ঘুম থেকে উঠে গানটি শুনতে পান। হঠাৎ গানের সাথে সাথে নূপুরের শব্দ তাদের কানে আসে। গানটা ছিল এমন---"আমি জানি, এ জগতে কেউ কারো নয়। সবই মায়া, সবই মায়া।" তিনজন তাদের সঙ্গে থাকা টর্চ নিয়ে অতিথিশালা থেকে বেরিয়ে পড়েন। নূপুরের আওয়াজ লক্ষ্য করে ওই গানটি শুনতে শুনতে প্রাসাদের জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেন তাঁরা। কিছুদূর যাওয়ার পর অমিত রঞ্জন ও সুজিতকে বলেন--- "আর যাওয়া কি ঠিক হবে? অমাবস্যার রাত। যদি কোন বিপদ হয়।" রঞ্জন বলেন--- "দেখি না কি হয়। চলো, আজ রানী সুরশ্রীকে দেখেই ছাড়বো।" ছোট জঙ্গল পেরিয়ে তারা রাস মঞ্চের কাছে এসে উপস্থিত হন। হঠাৎ সুজিত দেখেন রাস মঞ্চের উপর একজন নারী সাদা কাপড় পড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। টর্চ মারতেই উধাও হয়ে যায়। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পরে হঠাৎ অমিত অনুভব করেন--- কে যেন তার কাঁধের উপর হাত রেখেছেন। ভয়ে ভয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন রানী সুরশ্রীর আত্মা। খুব ভয় পেয়ে যান তিনি। সুজিত ও রঞ্জন পালিয়ে যান। ছোটরানী অমিতকে বলেন--- "ভয় পাস না। আমি তোদের কিছু করব না। তোরা আমার আত্মার সদগতি করতে চাস। সেটা আমার পক্ষে খুব ভালো কথা।আমার মৃত্যুর কাহিনী তোরা জানিস নিশ্চয়। আমি অসৎ- খারাপ মানুষের যম, ভালোদের ভালো। তোরা আমার শ্রাদ্ধ-শান্তি করতে চেয়েছিস। আমি খুব খুশি। আমার আপন বলতে কেউ নেই-- যারা আমার পিন্ড গয়ায় দান করবে। পিন্ড দান না করলে আমি উদ্ধার হবো না। তোরা আমায় মুক্তি দে। আমি তোদের কথা দিলাম, 'পরজন্মে তোদের সাথে আমার আবার দেখা হবে। এই জন্মের ঋণ আমি তোদের পরজন্মে শোধ করে দেবো।' এই বলে হঠাৎ রানী অদৃশ্য হয়ে যান। অমিত ঘুম থেকে লাফ দিয়ে ওঠেন। সারা শরীর ঘেমে যায়। রঞ্জন ও সুজিতকে ডেকে পুরো ঘটনাটি শোনান।
পরদিন তারা তিনজন নিজেদের সাধ্যমত জিনিসপত্র কিনে এনে পুরোহিত ডেকে রানী সুরশ্রীর শ্রাদ্ধ-শান্তি করেন। রাজবাড়ীতে ছোটরানী সুরশ্রীর একটা ছবি ছিল। ছবিটা এনে গলায় মালা দিয়ে এক স্থানে রাখেন। কিছু ব্রাহ্মণকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। পরদিন বিষ্ণুপুর থেকে তারা বাড়ি ফিরে আসেন। এক মাস পর তিন বন্ধু মিলে গয়ায় যান ছোটরানীর পিন্ড দান করতে। পিন্ডদান করার পর হঠাৎ মহাকাশে ছোটরানী সুরশ্রীকে অমিত অনুভব করেছিলেন। তিনি হাত তুলে তাদের সবাইকে আশীর্বাদ করছেন। পরজন্মে রানীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছিল কিনা জানিনা, তবে তারা যে একটা মানবিক কাজ করেছিলেন তা বলাই যায়।
=======================
মিঠুন মুখার্জী
C/o -- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম -- নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগনা
পিন -- ৭৪৩২৫২
ফোন -- ৯৬১৪৫৫৫৯৮৯
হোয়াটসঅ্যাপ -- ৯৫৩১৫৩৮৭১০