ছোটগল্প ।। মায়ার খেলা ।। উত্তম চক্রবর্তী
অনিক যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত প্রায় একটা । আজ ওর প্রানের বন্ধু শ্যামলকে কাশি মিত্তির ঘাটে নিজ হাতে দাহ করে আসতে হবে অনিক স্বপ্নেও তা ভাবতে পারেনি কোনদিন। ও তো আর আজকের বন্ধু ছিল না, সেই কলেজ লাইফ থেকে অনিক, শ্যামল, প্যাভেল আর দিনু এই চারজন ছিল একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। দিনু ছিল খুব বড় লোকের ছেলে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ওরা বি এস সি পাশ করার পর দিনুকে ওর বাবা বিলাতে পাঠিয়ে দিল উচ্চ শিক্ষার্থে। অনিক আর প্যাভেল এই কলকাতাতেই আলাদা আলাদা ভাল দুটো কম্পানির চাকরিতে দুজনে জয়েন করে। আর শ্যামল চলে যায় দিল্লিতে একটা বড় প্রাইভেট ফার্মে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেলস ম্যানেজারের চাকরি নিয়ে।
শ্যামল ছিল অত্যন্ত ভাল স্টুডেন্ট । দিল্লিতে গিয়ে চাকরির সাথে সাথে ও এম বি এ টা করে নেয় আর ধিরে ধিরে চাকরিতে উন্নতি করতে থাকে। শ্যামলের বাড়ি শোভা বাজারে । বাড়িতে শুধু রিটায়ার্ড বাবা আর এক অবিবাহিতা দিদি ছাড়া কেউ নেই। ওদের বাড়িটা আসলে ভাড়া বাড়ি। শ্যামলের বাবা একটা প্রেসে প্রুফ রিডারের কাজ করতেন আর অতি সামান্য রোজগারে শ্যামলদের মানুষ করেছেন। ওর দিদির স্কুলের পর আর পড়া হয়নি। দিদির চেহারাটাও ভাল নয় আর একটু তোৎলামির সমস্যা থাকায় বিয়ে হয়নি।
শ্যামল দিল্লি থেকে মাঝে মাঝেই কলকাতা আসত। আর তখন প্রতিবারই যতদিন ও কলকাতায় থাকত রোজ অফিস ফেরত কফি হাউসে ওদের আড্ডাটা আগেকার মতই চলতো জমিয়ে। এমনই এক সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে আসার পর অনিক আর প্যাভেলকে প্রথম দিনই পূজার কথা জানালো শ্যামল। পূজা , মানে পূজা ব্যানারজির সাথে ওর গতবার কলকাতা থেকে ফেরার সময় ফ্লাইটে আলাপ। ওরা পাশাপাশি একসাথে জার্নি করে ও ওদের মধ্যে আলাপ পরিচয় হয়।
পূজা কলকাতার একটা অ্যাডভারতাইসিং কোম্পানিতে চাকরি করে আর দিল্লিতে করোলবাগে ওর পিসির বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিল সেদিন। পূজাদের নিজেদের বাড়ি বেহালাতে, ওর বাবা রাইটার্সে চাকরি করেন। ওর ছোট ভাই যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ওর মা হোম মেকার। সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবার।
শ্যামল আরও জানালো যে ফ্লাইটে ওরা পাশাপাশি বসে অনেক গল্প করেছে। এমনকি দিল্লিতে কনট প্লেসে ওরা দুজন বেশ কয়েকবার দেখাটেখাও করেছে এবং দুজনের মধ্যে ইতিমধ্যে বেশ ভাব ভালোবাসাও হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় খবর ওরা এমাসেই বিয়ে করছে আর কয়েকদিন পর। এত ঘটনা কিছুই ও বন্ধুদের শেয়ার করেনি একদম কলকাতায় এসে সামনা সামনি সব বলবে বলে। অনিকরা খুব খুশি হল এসব শুনে।
একটা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ, কিছু বন্ধু বান্ধব আর আত্মিয়দের নিয়ে ছোট খাট একটা পার্টি, কিছু ফোটো তোলা আর ভিডিও , এই ছিল শ্যামলের বিয়ের মনে রাখার মতো ঘটনা। বিয়ের পর পূজা শ্যামলের সাথে ওর দিল্লির ফ্ল্যাটে চলে যায়।কলকাতায় শ্যামলের বাবা আর দিদি থেকে যায় ওদের শোভাবাজারের বাড়িতে।
অনিক পূজাকে যতটা দেখেছে তাতে ওর মনে হয়েছে যে মেয়েটাকে ভগবান শুধু তাকিয়ে থাকবার মতো রূপই দেয়নি সাথে দিয়েছে অসম্ভব স্মার্টনেস। শ্যমল বলেছে যে পূজা ভীষণ আধুনিক জীবন জাপন পছন্দ করে। স্কটিশ চার্চ কলেজে থাকা কালিন ওরা বন্ধুরা মিলে ক্লাব, ডিসকো, লং ড্রাইভিং, সিনেমা দেখা এসব নিয়েই বেশি সময় কাটাত আর জীবনটাকে উপভোগ করত।
বিয়ের দুই বছরের মাথায় শ্যামল আর পূজার একটা ফুট ফুটে মেয়ে সন্তান হয়। অনিকের মনে আছে ঐ মেয়ের মুখে ভাত হয়েছিল পূজাদের বেহালার বাড়িতে। অনিক ও ওদের সব বন্ধুরাই গিয়েছিল ঐ অনুষ্ঠানে। মেয়ের নাম শ্যামলের বাবার পছন্দ অনুযায়ী রাখা হয়েছিল নেহা।
শ্যামল কলকাতায় যখনই আসত পূজা বেশির ভাগ সময় বাপের বাড়ি কাটাতেই ভালবাসত। নেহা থাকত শ্যামল আর ওর দিদির জিম্মায়, নেহাকে ওর মামা বাড়িতে বেশি নিয়ে যেত না পূজা। অনিক পরে শুনেছে যে পূজা ওর শ্বশুরকে মেনে নিলেও শ্যমলের দিদিকে খুব একটা সহ্য করতে পারতো না। ননদের সাথে প্রায়ই খুঁটি নাটি বিষয়ে ওদের ঝগড়া ঝাটি লেগেই থাকত।
বেহালার বাড়িতে নেহা ছাড়া থাকতে কোন দুঃখ ছিলনা পূজার। নেহাও দাদু ও পিসির কাছে খুব ভালই থাকত। ওদিকে পূজা ওর বন্ধুদের সাথে দেখা করা, সিনেমা যাওয়া, ক্লাবে যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো এসবেই বেশি সময় কাটাত। ওর মেয়েকে নিয়ে ঘরের মধ্যে বন্দি থাকার চেয়ে এই স্বাধিন জীবনটাই বেশি পছন্দ ছিল।
প্রায় মাস চারেক আগে দুর্গাপূজার পর পরই শ্যামল ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় চলে এলো। ওদের শোভাবাজারের বাড়িতে ওর একটা আলাদা ঘর ছিল আর তাই ওদের কোন অসুবিধা হলনা। শ্যমলের বাবা আর দিদি খুব খুশি হয়েছিলেন। আর মনে মনে আরও বেশি খুশি হয়েছিল পূজা। এবার ওর আর বাপের বাড়িতে যাবার সময়ের কোন বাধা রইলনা। নেহাকে ননদের ওপর ছেড়ে দিয়ে ও প্রায়ই চলে যেত বেহালাতে। এখন সপ্তাহে চার পাঁচ দিন বাপের বাড়িতেই পরে থাকত পূজা। যে কয়দিন শ্বশুর বাড়ি থাকত সেকয়দিন পূজা বেশির ভাগ সময়ই হয় হোয়াটস এপ অথবা সেল ফোনে বন্ধুদের সাথে ব্যাস্ত থাকত।
কফি হাউসে ওদের আড্ডায় শ্যামলকে প্রায়ই খুব উদাস মনে হত অনিক আর প্যাভেলের। ওদের কিছু কিছু ঘটনার কথা শেয়ার করেছিল শ্যামল । কিন্তু ওরা ওকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি। পূজার সাথে ওর সম্পর্ক যে দিনে দিনে খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে বুঝতে বাকি রইলনা।
কিন্তু ঘটনাটা যে এমন পর্যায় পৌছবে অনিক বা প্যাভেল কেউই তা আন্দাজ করতে পারেনি। এই শনিবার কফি হাউসের আড্ডাতে এসে শ্যামল ওদের খুলে বলল সব। প্রথম থেকেই ওকে খুব অশান্ত আর গম্ভীর দেখাচ্ছিল। প্যাভেল চেপে ধরাতে শ্যামল ওদের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। আর সব শুনে দুই বন্ধু যেন আকাশ থেকে পড়লো । ওরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো শ্যমলের দিকে, কি বলবে বুঝতে পারলনা।
পূজা যেই ক্লাবে বন্ধুদের সাথে প্রায়ই যাতায়াত করত ওখানকার এক ডি জে, সাবির নামের একটা ছেলের সাথে নাকি অনেকদিন যাবতই মেলা মেশা চলছে। ওরা প্রায়ই কলকাতার এখানে ওখানে মিট করে এমন কি একবার দুজনে গাড়ি নিয়ে দিঘাতেও বেড়াতে যায়। আর গত বুধবার পূজা নেহাকে রেখে শ্যামলকে ছেড়ে বরাবরের মতো চলে গেছে। শনি বার দুপুরে ফোন করে শ্যামলকে জানিয়েছে যে ও এখন থেকে সাবিরের সাথেই থাকবে, শ্যামল যেন আর ওর সাথে কোন সম্পর্ক না রাখে, যোগাযোগ না করে।
শ্যামলের সাথে পূজার প্রেম ভালবাসা প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই ফিকে হয়ে আসছিল। নেহার মতো একটা কোলের শিশুকে এভাবে দিনের পর দিন ছেড়ে থাকতে পারে, এ কেমন তরো মা। দাদু আর পিসির কাছে থাকতে থাকতে নেহাও এখন আর মার কোলে খুব একটা যেতে চায়না। ওকে স্নান করান, জামা কাপর পড়ানো, খাওয়ানো সব কাজই ওর দিদি হাসিমুখে করে চলেছে। মহিলার বিয়ে সাদি হয়নি। এই কচি শিশুটার মধ্যে ও পায় অপার আনন্দের সন্ধান।
শ্যামল খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল। যাকে ও ভালবেসে বিয়ে করেছিল একদিন সে যে এভাবে ওকে ছেড়ে দিয়ে একটা অন্য ধর্মের ছেলের সাথে থাকতে চলে যাবে সেটা ও ভাবতেও পারেনি। তার থেকে বড় কথা নেহা, নেহাকে ও কিভাবে নিজের থেকে আলাদা করে দিল। দিদিকেই নেহা এখন আস্তে আস্তে মায়ের জায়গায় বসাচ্ছে। হয়ত এমন একদিন আসবে যেদিন ঐ শিশুটা ওর মার মুখটাই ভূলে যাবে।
একজন বিবাহিতা মহিলা যখন তার স্বামীকে ছেড়ে চলে যায়, তখন তার স্বামী হিসাবে একজন পুরুষ মানুষের কাছে সেটা কত বড় লজ্জা বা অপমানের ব্যাপার সেটা যে কোন বুদ্ধিমান লোকই বুঝতে পারে। কয়েক দিন বাদেই পাড়ার লোকেরা বা আত্মীয় স্বজনেরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে। শ্যামল এতবড় সত্যটাকে কি ভাবে ধামা চাপা দেবে, ওর মাথায় কিছু আসছে না।
শ্যামলের বাবা ওকে ডিভোর্সের পরামর্শ দিয়েছেন। অনিক আর প্যাভেল দুজনেই শ্যামলকে একই পরামর্শ দিল। কিন্তু শ্যামল সহজে পূজাকে ডিভোর্স দেবেনা ঠিক করল। ও ঠিক করল সাবিরের সাথে গিয়ে দেখা করবে আর ওকে নেহার কথা বলে বোঝাবার চেষ্টা করবে আর পূজাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
পূজাদের ক্লাবে গিয়ে ওখানকার ম্যানেজারকে অণুরোধ করতেই উনি সাবিরের ঠিকানাটা দিয়ে দিলেন শ্যামলকে । পূজার সাথে শ্যামলও একবার এই ক্লাবে গিয়েছিল অনেক দিন আগে বিয়ের পর। অনিক আর প্যাভেল দুজনেই ঐদিন শ্যামলকে বার বার বুঝিয়েছিল এভাবে সাবিরদের বাড়িতে না যেতে। কিন্তু শ্যামল ওদের কারো কথাই শোনেনি, পরদিনই গেল ওখানে, আর সেই যাওয়াটাই হল কাল।
রবিবার সকালে দশটা নাগাদ শ্যামল সাবিরদের মৌলালীর মোড়ের কাছেই একটা গলির ভিতর পুড়ানো এই বাড়িটাতে গিয়ে পৌছালো। সাবীরের বাবা, দাদা , মা সবাই তখন বাড়িতেই ছিল। শ্যামল যখন নিজের পরিচয় দিয়ে ভিতরে গিয়ে ওদের বৈঠকখানায় বসে কথা বলছিল তখন ভিতরে পূজার গলাও পেল, পূজা ওদের চা দেবে কিনা জিজ্ঞাসা করছিল।
সাবীর শ্যামলকে জানিয়েছিল যে পূজার সাথে ওর সম্পর্ক ওদের বিয়ের অনেক আগে থেকে। তখন সাবীর ছিল বিবাহিত। কিন্তু গত বছর ঈদের দিন ওর স্ত্রী একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সাবীর বিবাহিত ছিল বলেই পূজা ওকে বিয়ে করতে পারেনি। যদিও ওদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল আগের মতই। আর সেইসময় শ্যামলকে ওর ভালো লেগেছিল তাই ওকে বিয়ে করেছিল।
শ্যামল সব কিছু শুনে খুবই অবাক হয়ে গেছিল, কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রেখে এবার নেহার কথা বলে সাবীরকে অণুরোধ করতে লাগল পূজাকে ওর সাথে ছেড়ে দেবার জন্য। তখনই ওর মা আর বাবা দুজনেই ঘরে ঢুকে শ্যামলকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করতে শুরু করেন। সাবীরের প্রথম স্ত্রী মরে গেছে আর এখন ওর ভালবাসাকে কেন সাবীর শ্যামলের হাতে তূলে দেবে, যে কিনা নিজের বৌকে ধরে রাখতে জানেনা। শ্যামল লজ্জায় অপমানে মেজাজ হারিয়ে ফেলে। ওদের মধ্যে তর্কা তর্কী শুরু হয়।
শ্যামল সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খায় যখন পূজা এসে সোজাসুজি ওর মুখের উপর ওকে অপমান করে চেঁচিয়ে বলে "কেন এসেছ এখানে। তোমাকেতো আগেই বলেছিলাম আমার সাথে যোগাযোগ না করতে। আমি তোমার মুখ দেখতেও চাইনা আর ভালও বাসিনা, বেরিয়ে যাও, এখান থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।"
বাড়ি ফিরে সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘড়েই বসেছিল শ্যামল। খাওয়া দাওয়াও করেনি আর কারও সাথে কথাও বলেনি আর। শুধু সন্ধ্যায় একবার কিছুক্ষনের জন্য বের হয়ে নেহাকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করেছে আর অঝোরে কেবল কেদেছে ছেলেটা।
সকাল সাতটার সময় প্যাভেল ফোন করে জানালো শ্যামল আর নেই। গতকাল রাতেই ফ্যানের সাথে ঝুলে গলায় দড়ি দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে ও। যাবার আগে শুধু দিদিকে লিখে গেছে আগের দিনের সব ঘটনা আর ওকে অনুরোধ করেছে যাতে ও মেয়েটাকে দেখাশুনা করে মানুষ করে তোলে। পুলিশ এসে ডেড বডি মর্গে নিয়ে গেছে। অনিক যেন সোজা হাসপাতালে চলে আসে।
---------শেষ----------