দু'চারজন একসঙ্গে কোথাও যাওয়া যাবে না । সিনিয়রদের সামনে দিয়েও যাওয়া যাবে না । ওরা জানে না বলেই যেদিন বাসস্ট্যান্ড থেকে বিশ্ব বিদ্যালয়ের বাসে করে হস্টেলে আনিয়ে ছিল, সেই দিনই সিনিয়রদের আবাসিক কমিটি চারতলার সভাগৃহে হস্টেলের বিধি নিষেধগুলি শুনিয়ে দিয়েছে। ফোন থাকলেও ব্যবহার করা যাবে সিনিয়র কমিটির সেক্রেটারির সামনে। অন্যথায় নয়। ফলে ঋষভসহ আরও যারা নবীন কেউই ভুলেও ওই কাজটি করে না । ঋষভ ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হ'বার পর দু'দিন না যেতেই মা ফোন করেছে, কিরে ভালো আছিস? হস্টেলের দাদারা ভালো তো? পড়াশোনা চালিয়ে যা, পয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না । তোর বাবা আমি দু'জনে কঠোর পরিশ্রম করে যাবো। ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। মুখ উজ্জ্বল করবি বাবা। তোর জন্যই তোর দিদির পড়াশুনা বন্ধ করে দিলাম। বিয়ে থা দিতে হবে তো । লাউড স্পীকারের আওয়াজ পাশে সেক্রেটারি প্রলয় শুনছে। যেভাবে সবার কথা শোনে । ব্যস! মা-বাবা যা বলে সবাই শোনে । অভিযোগ জানানোর মত কিছু থাকে না। কেবল-" হ্যাঁ ভালো আছি" এটাই বলতে হয় । সর্বক্ষণ শুধু" ভালো আছি" বলে চুপ থাকতে হয় । দোকানে প্রয়োজনে কিছু কিনতে যাওয়া যাবেনা। যদিও যায় সিনিয়র সাথে অবশ্যই থাকবে । যখন তখন নয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির পর । মানে পাঁচ টার পর বিকালে । খেলাধুলা ? নৈব চ। মাঠ দখল করে সিনিয়ররা ।
ঋষভ বসেছিল খাটে। প্রলয় এসে বলল, আজ রাতে খাবার পর চোদ্দ নম্বর রুমের তোমরা তৈরি থেকো--সিনিয়র দাদারা আসবে পরিচয় করে আপন করে নিতে হবে তো। কথাটা শুনে ঋষভেরা খুশি হলেও একটা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার মধ্যে। প্রতিটি হোস্টেল বিল্ডিং-এর প্রথম গেটে দ্বাররক্ষী অর্থাৎ নিরাপত্তারক্ষী অষ্টপ্রহর প্রহরায় আছে। সিনিয়রদের নিষেধ থাকে জুনিয়রদের রুমে আসা যাবেনা। এ কথা তো সরেজমিনে ঋষভের বাবা-মা শুনে এসেছে। তাহলে আসল কেন ? আবার রাতেও আসবে । কেন আসবে? ওরা চার তলায় থাকে। গেটে লক্ষ্য পড়ে । সিকিউরিটি বলল , সবকা সাথ বাত হুয়া থা কেয়া ? জলদি বাৎ কর লো ।
----- জী রাত মে কিসকা ডিউটি হোগা ? মিস্টার সিং হানিয়া সাব ? প্রলয় বলল ।
রাত দশটার পর ওরা খেয়ে কেউ কেউ পড়তে বসবে অথবা শয্যাপাতি ঝাড়পুঁছ করছে ঘুমোবে বলে । টয়লেটে যাবার ছিলায় ঋসভ বেরিয়েছে । প্রলয়সহ তার সাথে কৌশিক- ইন্দ্র -মলয়কে দেখল আসতে । কৌশিক একটা খবর কাগজে মুড়ে সাড়ে সাতশ' হাতে ধরিয়ে দিল সিকিউরিটির হাতে। তারপর সিকিউরিটি দু'হাতে খৈনি ডলছে । বেশি পরিমাণ ডলে ইন্দ্র আর কৌশিককে দিতে হবে । তেরছা আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । পাশে পান্থপাদপের উদ্দাত্ত শরীরের গায়ে হেলান দিয়ে সিংহনিয়া।
---- সুইচ অফ করনা পড়ে গা? সিংহানিয়া বলল।
---- সিসিটিভি আওর ইলেকট্রিক বোর্ড দু'নো অব কর দো ।
----- ওয়ান থাপ্পড় দি জি এ।
ইন্দ্র পকেট থেকে একটা পাঁচশ' টাকার নোট পকেটে গুঁজে দিল ।
দু চারবার হাতের তালুতে শুকনো চুন উড়িয়ে চিমটি কেটে ওদের হাতে দিতে চাইল । কেউ নিল কেউ নিল না । প্রলয় ওদের "আয় "বলে চোদ্দ নম্বর রুমে গেল। ততক্ষণে ঋষভ এসে শুয়ে পড়েছে। ওরা ঘরে ঢুকেই দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। আলো নেই অন্ধকার পুরী।
---- খানকির ছেলের কারেন্টও গেল । প্রলয় বলল।
----- অ্যায় মোমবাতি বা এমার্জেন্সি থাকলে জ্বালা। কৌস্তভ খাট থেকে উঠেই নিজের বই ডেস্ক থেকে মোমবাতি নিয়ে জ্বালালো ।
----- অ্যায় এটা জ্বালিয়ে দে তো ।
কৌস্তভ দেখে অবাক । গাঁজার কলকে !
----- এটা কি ?
----- ধরিয়ে টান, তারপর বলছি । গাঁজার পুরিয়া দিয়ে কাতাই দড়ির গুল্টি পাকিয়ে হাতে ধরিয়ে দিতে সে জ্বালাতে কিন্তু বোধ করল ।
----- তোর ঠাকুরদা তামাক খেত?
----- জানিনা দেখিনি । তবে বাবার মুখে গল্প শুনেছি ।
----- বাবা বিবেক তুমি তাহলে টান দাওনি ? জানিনা ধরিয়ে দিয়ে একটা খাটে এসে সবাই বস ।
সে কিছুতেই ধরাতে পারছে না ।
----অ্যায় ঋষভ ধরিয়ে দে তো।
সে বাধ্য হলো জোরে টান দিয়ে ধরিয়ে দিতে। যেই না কল্কে নিয়ে হাতে দিতে আসল-- ইন্দ্র বলল, তোদের কল্কে তোরা টান দে । কিন্তু বোধ করলেই প্রলয় হুমকি দিয়ে ওদের গাঁজার কল্কে টান দিতে বাধ্য করল ।
----- দেখছি । তোদের সাহস তো কম না !! তাজ্যব বুনে যাচ্ছি ! সিনিয়র দাদাদের সামনে গাঁজা টানবি ? এ কী অধঃপতন ? বলে সবাইকে সাজা দিতে উলঙ্গ করে কান ধরে ওঠবোস করিয়ে বলল, ধরিয়ে দিতে বলেছি, তা বলে টান মারবি ?
---- এই বোতলটা কিসের দ্যাখ্ তো ? নে---
ঋসভ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল , এটা বাংলা মদ ।
----.ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট, প্রাইস বলবি তো না কি? এই নে প্লাস্টিক গ্লাস নে সবাই গ্লাসে গড়িয়ে পেগ বানা। তারপর বায়োডাটা ধরব ।
---- মাথা কেমন করছে আর মদ খেতে পারব না। ----- ভালোবেসে দিচ্ছি । যাঁচা অন্ন ছাড়তে নেই । সবাই " চিয়ার্ডস " বলে খেলেও ঋষভ খায়নি। প্রত্যেকে পান করে প্রলয় ঋষভকে বলল, হাউ মেনি স্টুডেন্টস ইন ইওর ক্লাস ?
----- সেভেনটি আপ তো হয়েছে ।
----- কোনটা চোখে লেগেছে ?
----- জানিনা ।
----- এই প্রপোজ লেটারগুলো নে। তোরা ছ'জনে ছয়জনকে দিবি । কালকে ওয়ার্কিং আওয়ারে। একেবারেই টপ হলে শুধু নয় চাকরি করে খাওয়াতে পারবে । তার আগে বলবি, তোরা নয় আমরা এই চারজন পরখ করে দেখব । মানে চেটেপুটে চাখবো। তারপর হ্যান্ড ওভার যদি মনে হয় করব না হলে মাল আমার থাকবে। ওদের হাতে চিঠি ধরিয়ে দিয়ে শুরু হল, হাউ মেনি সুইটি ইন ইওর ক্লাস ? হাউ মেনি লাভারস ইন দেম ? হু আর ইউজড্ ? স্পীডি স্পীক টু মি ।
ওরা সবাই বসে কেউ বলতে পারছে না।
---- দাদা প্যান্ট কি পরে নেব ?
----- হোয়াই ? শাস্তি কি মুকুব করে দিয়েছি ? না বলেছি ? শান্তনুকে সিগারেট আনতে বলেছিলাম এনেছিস ?
সে বলল, হ্যাঁ, এইতো ।
---- নিয়ে আয় ।
সাহেবী কায়দায় হাতে সিগারেট নিয়ে সিনিয়ররা মুখে আগুন ধরিয়ে বলল , প্রত্যেকদিন এক প্যাকেট করে সিগারেট আমাদের প্রত্যেককে দিয়ে আসবি। বুঝলি ? ধোঁয়ার কুন্ডলী ছেড়ে বলল , জানিস আমার আবার বিড়িতে উৎকট গন্ধ লেগে থাকে । যে না পারবি দু'হাজার টাকা মাসে দিয়ে আসবি ।
---- টাকা কেন ?
----- সেই মুখে মুখে তর্ক ? কৈফিয়ৎ দিয়ে কি টাকা দিবি ? সব জানলে আমরা আছি কি করতে ? তোরা সবাই আমাদের সামনে এসে দাঁড়া । যাদু দেখাই অন্ধকার কাছাকাছি আয়।
অনুগত ভৃত্যের মতো ছয় জনে এসে দাঁড়াল ওদের সম্মুখে। ঈষৎ আলোয় আবছা মুখ দেখা যাচ্ছে । ----- প্রত্যেকের দুহাত পিছনে মুঠি করে দাঁড়া । সিগারেটে জ্বলন্ত মুখে টান দিয়ে ওরা পুরুষাঙ্গে ছ্যাঁকা দিল। সংগে সংগে যন্ত্রণায় চেঁচাতে লাগল।
----- হাত পিছন থেকে আনলি কেন ? আ-য় কাছে আ-য় । এবারে হাত উপরে তুলে দাঁড়া।
ওরা কাঁদছে চোখে জল । আকুতিভরা কন্ঠ্যে, দাদা আর না -- ।
----- আমরাও সয়েছি রে প্রাণের ভাই লক্ষণ । সইতে তো হবে নবীন বরণ হচ্ছে না যতক্ষণ ।
---- নে -ওয়ান -টু -রেডি -থ্রি । বলে আবার একসঙ্গে ছ্যাঁকা । ওরা ছটফট করছে ।
----- ব্যস । অ্যায় -- আমরা এখনো খাইনি । কিচেন থেকে এই অবস্থায় ভাত এনে দে আমরা এখানেই বসে খাব । ওরা বাধ্য হল যেতে । গিয়ে দেখে অন্যান্য ঘরের অনেক জুনিয়র তথা নবীনরা খাবার থালা নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় যাচ্ছে । ঋষভরা ফিরে আসলে খেতে খেতে বলল , প্রত্যেকদিন আমাদের ঘরে তোরা থালায় ভরে ভাত তরকারি দিয়ে আসবি, বুঝলি ? চোখে চোখে ইশারা করে একসঙ্গে থালায় থুতু ফেলে বলল, খাবার যেন না নষ্ট হয়, নে তোরা খেয়ে নে । খা---
ধমক দিতেই ওরা থালা হাতে নিয়ে খেতে লাগল। ---- প্রত্যেকদিন আমাদের টয়লেট বাথরুম পরিষ্কার করে দিয়ে আসবি। সকালে উঠে রুম পরিষ্কার করবি, প্রত্যেকদিন একজন যাবি, ছয় দিনে ছয় জন। আমরা রবিবার দিন পরিষ্কার করব। ঠিক আছে ? অন্যথা যেন না হয় । সোজায় না হলে আঙ্গুল বাঁকাতে হবে। টাকা দিয়ে আসবি, এখানে থাকতে হলে ইউনিয়নে মাসিক চাঁদা দিতে হবে । ওখানে খাতা আছে লিখে দিয়ে আসবি। বুঝলি ? চল্ । অ্যায় তোরা সঙ্গে চল ।
---- কোথায়? আমরা কেন যাব ? শান্তনু বলল ।
---- মশারি ধরে টাঙিয়ে দিবি চল ।
ওরা সকলেই সেই অবস্থায় সিনিয়রদের রুমে গিয়ে মশারি ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। ওরা ঘুমোতে শুয়ে পড়ল । ওরা কেউ কেউ ঠায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করে ফেলল ।
কত অভিশপ্ত রাত এভাবে কাটাতে হয় সবাই জেনেও চুপ করে থাকে।
পরের দিন ঢুল ঢুল চোখে ওরা যখন ক্লাসে যাবে ব্যস্ত নবারুণ বলে গেল , তোদের মধ্যে একজন মাসোহরা থেকে কান্টুর দোকান থেকে বাংলা তিনটে আর সাড়ে সাতশ' দু'টো আমাদের রুমে দিয়ে আসবি।
মেন হস্টেল থেকে সামান্য দূরে ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় - রবীন্দ্রনাথ - সুভাষচন্দ্র - আম্বেদকরের প্রস্তর মূর্তি। পান্থপাদপ, পাতাবাহার গাছের বেষ্টনীর পাশে ওরা রাত বারোটার পরে মদ্যপান করতে ঘিরে বসেছে । ওদের মাঝখানে বোতলগুলি যেন আলোয় চিক চিক করছে না হাসছে বোঝা গেল না কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়ের প্রতিকৃতিতে রজনীগন্ধার মালা , উনি কিন্তু সদাহাস্য মুখ নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে হাসছেন।
==========================
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা
পিন কোড :743347
মুঠো ফোন : 7479274263(হোয়াটস )
9734591074
ই মেইল : sudam1964krishna @
gmail.com