একদিন ঘটেছিল একটি ঘটনা।হাসিবুল আর নাসির যাচ্ছে ইট গড়ে তিনবিঘের মাঠে।যত এগোচ্ছে, দেখছে হেদো পুকুরের পূব পাড়ে বেশ ভিড়। কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল -কালাচাঁদকে, আনারুলকে।
কোনো উত্তর না দিয়ে।ওরাও তড়িঘড়ি ছুটে গেল। হেদোপুকুরের পাড়ে ভিড় জমাচ্ছে।
আবু বললেন, জানো না নাসির,আজ গ্ৰামের হালি নেতা মজনু । তার ছেলে ইমতিয়াজ ।এই বর্ষার জল ভরতি হেদোপুকুরে সোনার হার হারিয়েছেন ।
স্নান করতে এসে।জলের ভিতর পড়ে গেছে।চারদিক লোকজন যেন হাট বসেছে। মজনু এখানে দলবল নিয়ে আসবেন।মসজিদে মাইকে ঘোষণা করা হয়েছে।যে ব্যাক্তি খোঁজে দেবে।তাকে দশ হাজার টাকা দেবে আর দেবে একশো পিস রসগোল্লা ।
এই সোনার হার মাবুদ আলি। তার একমাত্র আদরের দৌহিতকে জন্মদিন পালনের উপহার হিসেবে দিয়েছিল।
স্মৃতি চিহ্ন ছিল ।তাই মজনুর চোখে জল ছলছল করছে ।
হাসিবুল আর নাসির শুনে দাঁড়িয়ে গেল ।
ইট গড়ে তিনবিঘের মাঠের দিকে আর গেল না।
একটু পরে আবার সব জলে নামবে। তেল মেখে দাঁড়িয়ে আছে। পটল,মানব,আমিরুল,টিপু ,রাকেশ, মিনু ।
দেড় তালগাছ সমান জলের গভীরতা । কেউ থই পাচ্ছে না।তবুও হাল ছাড়ে না। সকলে ডুবে ডুবে খোঁজে, কেউ আবার ঝুড়ি নিয়ে বালি তোলছে। কেউ মদের বোতল তুলছে।কেউ আবার কবেকাব ডুবে যাওয়া ভাতের হাঁড়ি তুলছে।কেউ দেখে হাততালি দিচ্ছে।
কেউ হো হো হো করে হাসছে।কেউ বসে বসে বিড়ির টান দিচ্ছে।এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
পটল বলল-আমার চোখ লাল হয়ে গেছে ।
আমি উঠে যাচ্ছি ।
এদিকে আসরের আজান হয়ে গেল। তবুও সোনার হার জলের ভিতর পাওয়া যাচ্ছে না। মজনুর ছেলে ইমতিয়াজ বলল- আজ এই পর্যন্ত থাক। কাল আবার ডুবুরী আনবো।
বেশ কিছুক্ষণ পর হাসিবুলের দূর সম্পর্কে মাসির ন ছেলে নাসির বলল ,আমি যদি একবার চেষ্টা করি। তাহলে কেমন হবে।
প্রথমে অনেক জন আপত্তি করল। না। না। আমরা নামতে দেবো না। যদি পেয়ে যায় ।তাহলে টাকাও পাবে।মিষ্টিও পাবে।
হানিফ বলল- যদি খোঁজে পাও। নাসির তোকে টাকা আর রসগোল্লা নিতে হবে না।আমাদের দিতে হবে।আমরা নিয়ে রাতে ফিষ্টি করবো।
আমরা এখানে প্রতিযোগিতা দেখতে এসেছি?
ইসলাম মাস্টার বললেন -দ্যাখো তোমরা যা ভাবছো ।
তা বড়ো কঠিন কাজ।একটা ছেলে জলে ডুবে খোঁজে হয়রান হবে। তার প্রাপ্য পুরস্কার তাকে দেওয়া উচিত।
হীরা ম্যাডাম বললেন-মিষ্টি আমার চাই।
আমার নাতি খাবে। গরম গরম লুচির সঙ্গে।
বর্ষার বাদল সন্ধ্যায় ।আর মিষ্টি কিনতে যাব না।
যাই হোক,নাসির জলে নামল- এক ডুব দিল।
ত্রিশ চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। এখনো উঠল না।
সবাই একেবারে নীরব হয়ে গেল।
নাসির নিশ্চয় জলের তলায় তলিয়ে গেছে।
এবার কী হবে? হাসিবুলের মুখে একটা বিষণ্ণতার ছবি।
এদিকে বৃষ্টি নেমেছে। সন্ধ্যা হয়ে এল।
তবুও কেউ বাড়ি ফিরে যায়নি। যারা এসেছিল।
তারা সকলেই শেষ পর্যন্ত দেখে যাবে ।
মাদুদের শিব মন্দিরে সাড়ে ছটার ঘন্টা বাজে।
মশাগ্রাম টু বাঁকুড়া শেষ লোকাল ট্রেন কালো ধোঁয়া ছেড়ে দূর স্টেশনের দিকে চলে গেল।
তখন নাসির জলের উপর ভেসে উঠল।
হাতে তার সোনার হার জলের ভিতর তুলে এনেছে। মজনুর মুখে তখন কি হাসি!কী আনন্দ?
বলে তা ঝোঝানো যাবে না।
এদিকে মনসুর বাইক নিয়ে দেশরা গেছে।
হরি ঘোষের মিষ্টির দোকান । মিষ্টি কিনে আনতে।
হারা আর মানিক দুজনে তুমুল মারামারি লেগে গেছে। কে আগে মিষ্টি খাবে?
সে কি রক্তাক্ত অবস্থা গা শিউরে উঠেছে
।হীরা বলছে মিষ্টি আমার চাই। নইলে আমি ... !
নাসির দেখল,এদের পরিস্থিতি একদম ভালো নয়।একটা টান টান উত্তেজনায় আছে।মনে মনে ভাবতে লাগল-তিন হাজার টাকার যদি মিষ্টি কিনতে দিই। তাহলে বড়ো ভালো হবে। তাই বেঞ্জিমাকে ডাকে। আপনি গুনে দেখুন। এখানে কত জন উপস্থিত আছেন?
নাসির বলল- হাসিবুলকে একবার ফোন করুন। মনসুরকে আরো তিনহাজার টাকা মিষ্টি কিনি আনতে। সবাইকে দেওয়া হবে। কেউ বাড়ি যাবেন না।
নাসির স্কুল তলার মাঠে শিউলি ফুলের গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ।একাকী মনে ভাবছে -বাকী সাত হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাব।বাবাকে একটা ধূতি পাঞ্জাবী কিনে দেব।মাকে একটা তাঁতের শাড়ি কিনে দেব। বোন আমিরাকে সালোয়ার কামিজ কিনে দেব।
বাবা খুশি হবে। মা খুশি হবে। আর বোন খুশি হবে।
রাত আট বাজছে। মনসুর এলো।দেশরা থেকে আটশো পিস রসগোল্লা নিয়ে।
ছেলে বুড়ো নারী সব নিয়ে মোট সাড়ে তিনশো জন দাঁড়িয়ে আছে ।
বেশ কিছুক্ষণ পর সকলের মধ্যে দেওয়া শুরু হলো। মজনু বললেন- নাসির তুমি সবার হাতে হাতে দাও। সকলে খুশি হবে।
নাসির বলল-না। আপনি দিন। আপনাকে গ্ৰামের মানুষ সম্মান করে। হাসিবুল দাঁড়িয়ে দেখল।একে একে দুটো করে রসগোল্লা নিয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। একশো পিস রসগোল্লা দিতে বাকি আছে।
হানিফ ,খোকন, দাউদ ,তোতা নিজের মতন মিষ্টি নিয়ে চলে গেলো। মিন্টু কিছু বলল না।এবার হাসিবুলের মিষ্টি নেবাব পালা ।দেখি একটা মিষ্টি পড়ে আছে। সব শেষ হয়ে গেছে। এদিকে মজনু নাসিরকে সাত হাজার টাকা দিয়ে বলল- বড়ো উপকার করেছো। এই দিনের কথা কখনো ভুলব না।এবার আমরা আসি। সাবধানে বাড়ি যাবেন ।
হাসিবুল সেই একটা মিষ্টি নিয়ে নাসিরকে টেনে নিল।মিষ্টি খাইয়ে দিল নাসিরের মুখে। এবার আমরা দুজন বাড়ি ফিরার পথে হাঁটতে শুরু করি।এটা ওটা গল্প করতে করতে পেরিয়ে আসি। কত পথ,কত মাঠ,কত ছোটো ছোটো গ্ৰাম।
ছাতিনাশোল সে তো চল্লিশ কিমি হবে। তারপর আমাদের ঘর। মহেশপুরের মাঠে খালের ধারে যখন আসি রাত্রি তখন সাড়ে দশটা। খিদে পেয়েছে ।কাছে কোনো দোকান নেই। খাবার কিনে খাব।
হাসিবুল বলল -ওই যে কারা আসছে,
কথা শুনে নাসির বলল- তাহলে ওরা ডাকাত সন্দেহ নেই। এখন উপায় কী? ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। চল আমরা শেওড়া গাছের ঝোপে লুকিয়ে যায়। ওরা দিকে এগিয়ে আসচে।কথা শেষ হতে না হতেই।দেড় হাতের মতো বাঁশের পাও। আট নটি আমাদের কাছে এসে পড়ল।
তারপরে ওরা আমাদের দুজনের উপর
হিংস্র বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়ল। দুটো স্মাটফোন আর সাত হাজার টাকা কেড়ে নেয়। -নাসিরের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে । এদিকে হাসিবুলের ডান পা মেরে ভেঙে দিয়েছে। তাই নিরুপায় হয়ে আছে। নাসির বারবার বলছে। পানিও জল দে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ।জলের ভিতর সোনার হার খোঁজার থেকেও। নাসির হাসিবুলের মুখের দিকে । রাতে চাঁদের আলোয় মায়াময় চোখে চেয়ে আছে।
**********************************
গোপালপুর
পোঃ খাড়রা
থানা ইন্দাস
জেলা বাঁকুড়া
বেশ ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন