জেলেরহাট-নেপোর মোড়-পিয়ালির পথে
অরবিন্দ পুরকাইত
প্রায় যে-কোনো বেরোনোই কি তবে— যাকে বলে— ভ্রমণ হয়ে উঠতে
পারে! হয়তো পারে। যাদের দেখার চোখ এবং ধৈর্য আছে, অনুভবের গভীরতা এবং
আন্তরিকতা আছে, তাদের কাছে হয়ে উঠতেই পারে। তার সঙ্গে পরিবেশনের প্রসাদগুণ
এবং সেই পরিবেশনের সময়-সুযোগ থাকলে, তা স্পর্শ করতে পারে অন্যদেরও। পাঠক,
এটি তার যোগ্য নমুনা অবশ্যই নয়, এটি অনেকবার-যাওয়া সচরাচর-পরিচিত এক
গ্রামীণ এলাকার প্রসঙ্গ একটু, দৃশ্য দু-একটি আর জেনে-নেওয়া কিছু তথ্যের
লিপিবদ্ধকরণ। জায়গাটিও— জেলেরহাট— যাকে বলা হয় 'ট্যুরিস্ট স্পট', তাও
নয়। তাই সে-আশা নিয়ে না পড়াই ভাল। আর ছবিও দিলাম না, কেউ কেউ কেবল ছবি
দেখেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন এই ভয়ে!
চিংড়ি
নেবে? পাকা সড়কে উঠতে-না-উঠতেই, সামনের দিক থেকে চলন্ত সাইকেলে একেবারে
সামনাসামনি এক বালক। বাঁদিকের হ্যান্ডেলে এক পলিব্যাগে ঝোলানো সামান্য
চিংড়ি। কতটা হবে? বড়জোর পাঁচ-সাতশো গ্রাম। সুরটা লেগে গেল! আমাকে
খরিদ্দার ঠাউরেছে। মুহূর্তে তার ধন্দ নিরসন করলাম মাথা নেড়ে। আর এক সুবিধা
হল, পথচারী আর একজন একই সময়ে সে-বিষয়ে কৌতূহলী হলেন। হয়তো ঘোলা বাজারের
উদ্দেশেই বেরিয়েছে, পথে বিক্রি হয়ে গেলে আর যেতে হয় না। আমিও কি
কখনো-সখনো ভাদ্রে কুড়োনো আমাদের তালেবর তালগাছের সুস্বাদু বাড়তি তাল
বয়ে নিয়ে গিয়ে গোকর্ণী বাজারে বাবার সবজি-ঝোড়ার পাশটিতে রেখে
দাঁড়াইনি, দু-চার পয়সা আসার আশায়! বিপরীতমুখে সাইকেলে এক প্রৌঢ় —
'ভুলের বালুচরে যে বাসর বাঁধা হল জানি তার নেই কোনো দাম...।' সুর আরও জমে
উঠল। এই সকালেই, ভুলের বালুচরে...! আমার এত প্রিয় গানের চরণ! সকালের এই
অপূর্ব সার্থকতার মধ্যে অনায়াসেই জাগা সম্ভব অসার্থকতা, অনিত্যতার বোধ।
সর্বোপরি তো আছেই, হায়, জীবন এত ছোট কেনে এ ভুবনে!
পায়ে পায়ে গুটিগুটি এগোই নেপোর মোড়ের দিকে। জেলেরহাট প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে। সংস্কারকৃত পাকা সড়ক এখন মসৃণ। প্রথম-ভাদ্রের আকাশ
মনোরম। দূরে দূরে গ্রাম 'দুই-চারিখানি'। মাঝে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘরও।
যেদিকে তাকাও বর্ষাস্নাত স্নিগ্ধ শ্যামল সৌন্দর্য। আম-জাম-জামরুল, বট-অশথ,
তাল-নারকেল-খেজুর, বেল-বাবলা ইত্যাদি বর্ষার আশ্বাসে প্রাণবন্ত গাছ।
এখনও-অপরিমিত এ বর্ষায় মাঝেমধ্যের খানিক খানিক বৃষ্টিকে পাথেয় করে মাঠের
রোয়া শেষ, ধানগাছে লাগছে ঘোর। তবে গোড়ায় আরও জলের আশায় আছে তারা।
ডানদিকে অদূরে উচ্ছল কিশোরীর হাতে একটি খালি থালা, মাঝেমধ্যে সেটি একটু
বাজিয়েও নিচ্ছে সে। সড়ক-অভিমুখী সে কিশোরীর পিছনে হাঁসের বিচিত্রবর্ণী
ছোট ছোট বাচ্চা। তাকে খানিক অনুসরণ করার পর থমকে গিয়ে, খেলায় মাতল তারা
পরস্পরে। বড় হাঁসেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেউ ঠোঁট দিয়ে বিলি কাটছে আপন
অঙ্গে, কেউ মাথা হেলিয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছে গভীর মনোযোগে। কেউ বা
কোনো কিছু করাকেই বাহুল্য বিবেচনা করছে!
যতবার
জেলেরহাটে মাসির বাড়ি আসি, পায়ে পায়ে একবার নেপোর মোড়ের দিকে না গিয়ে
পারি না। গ্রামে যত আত্মীয়ের বাড়ি, একটুও সময় থাকার সুবিধা হলে, যতটুকু
সম্ভব আশেপাশে ঘুরেফিরে না এলে আশ মেটে না। যতই মিল থাক না কেন, তবু
প্রতিটি গ্রামই আমার কাছে স্বতন্ত্র। 'দেখে দেখে এই চোখ আপনহারা!...' আসলে
আমার কাছেপিঠের প্রকৃতি-পরিবেশও কম পরিতৃপ্তির নয়, আকাশও তো নয় কম
আশ্চর্যময়। ঋতুতে ঋতুতে কত যে তার রূপবৈচিত্র্য! এই বাংলারই অজস্র গ্রামের
ক'টা দেখেছি! কতটুকুই বা তাদের চিনি-জানি! পরিচিত কত
গাছপালা-পশুপাখি-কীটপতঙ্গেরই নাম-ধাম-কাম ভাল করে জানা নেই, তো অপরিচিতর!
এসেছি অফিস-ফেরতা রাতে, ক্যানিং লোকালে বেতবেড়িয়া-ঘোলা স্টেশনে নেমে;
সকালে আবার অফিস ধরব সে স্টেশন থেকেই। গত বছর একটা বাইক কেনায় অনেক
সুবিধা হয়েছে মাসিদের, মাসতুতো ভাই স্টেশন থেকে মোটরবাইকে করে নিয়ে এসেছে
আবার স্টেশনে পৌঁছেও দেবে বলেছে। প্রাতকৃত্যাদির পরেই স্নান সেরে নিয়ে
দেখলাম ঘণ্টাখানেক সময় অনায়াসেই ঘোরাফেরা করা যায়। কালক্ষয় না করে
কয়াল পাড়ার পাশেই পাকা সড়কে পা রেখেছি।
পিয়ালিতে এ বছর চিংড়ি হয়েছে প্রচুর। বলছিলেন ইশা আলি সরদার। এক-এক জন
চার-পাঁচ কেজি করে ধরছে। জানালেন যে যেতে পারলে হত ছোটবেলার মতো— কেমন
ইচ্ছে করে না আর! তাছাড়া দোকানও রয়েছে। পিয়ালির কাছাকাছি অংশটা মজেই
ছিল। সম্প্রতি সংস্কার হয়েছে। আগে নদীর বুকের উপরে বর্ষাকালেও হাঁটা
অসম্ভব ছিল না, এখন তুলনায় গভীরতা বেড়েছে।
পিয়ালির সঙ্গে দেখা হয়েছে কখনও কখনও। গভীর দুকুলভরা রূপে নিশ্চয়ই নয়;
কখনও তার মজে-যাওয়া ম্লানিমার সঙ্গে, কখনও তার অংশত-জেগে-থাকা সত্তার
সঙ্গে। ঢোসাহাটের উপর দিয়ে ফেরার সময়, ঢোসাহাট থেকে দাঁড়িয়া হয়ে
জেলেরহাট যাওয়ার সময়। বিদ্যাধরী থেকে বেরিয়ে মাতলায় মেশার আগে এটিও
পিয়ালির গমনপথের অন্তর্গত। তার সুবাদেই পিয়ালি টাউন, পিয়ালি স্টেশন।
বিভূতিভূষণ বড় যথার্থ বলেছিলেন যে অচেনার আনন্দকে পেতে হলে সমস্ত
পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অপু যেমন সবকিছু 'গিলিতে
গিলিতে' চলত, যেখানেই বেড়াতে যাই না কেন, যতক্ষণ জেগে থাকি আজও আমারও
ইচ্ছে করে তেমনই। কিন্তু অনেকের সঙ্গে হলে সেটা তো আর তেমন সম্ভব হয় না
সবসময়। নানান গল্পগাছা এড়ানো যায় না। তাছাড়া, বিশেষ করে রাত্রিকালীন
যাত্রা হলে পথের দুপাশে বহু কিছু অদেখা রেখে গন্তব্যের উদ্দেশে চলে যেতে
হয়। সে তো একরকম লোকসানই। যেখানে ভ্রমণে বেরিয়েছি একেবারে সেখানে পৌঁছে
যা দেখার দেখব সেটাই কি সব! যতদূর দেখা যায় যাত্রাপথটাও অপাঙ্ক্তেয় নয়
নিশ্চয়ই। কতবার যে কোনও কোনও স্টেশনে একটু নেমেই আবার উঠে পড়েছি
স্টেশনটাকে শুধু একটু ছুঁইব বলে!
পৃথিবীর বহু
দেশ ভ্রমণকারী রবীন্দ্রনাথ বড় সুন্দর করে বললেন, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু
জানি! বলেছেন যে, দেশে দেশে কত নগর রাজধানী, মানুষের কত কীর্তি, কত গিরি
সিন্ধু মরু, কত অজানা জীব, কত অপরিচিত তরু তাঁর রয়ে গেছে অগোচরে। আমাদের
পথচলার সামর্থ্য একসময় ফুরিয়ে আসে, তখনও সমস্ত বিস্ময় নিয়ে তেমনই রয়ে
যায় অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড; আর সব ফেলে রেখে আমরা একদিন বিদায় নিই। নতুন নতুন
চোখ তখনও সবিস্ময় দেখতে থাকে, অনুভব করতে থাকে সৌন্দর্য আর রহস্যের অপার
লীলাভূমি সে অন্তহীন মহাবিশ্বকে, কতকালের আরও কত কত চোখের নতুন দৃষ্টির
মতো!
শিশু সত্যজিতের ডায়েরিতে রবিঠাকুর লিখে
রেখে গেছেন সেই অমোঘ বাণী যা বলছে যে, বহু পথ ঘুরে, বহু খরচ করে পাহাড়
সমুদ্র দেখতে গিয়েছেন, কেবল ঘর থেকে দু-পা ফেলে চোখ মেলে দেখা হয়নি 'একটি
ধানের শীষের উপর একটি শিশিরবিন্দু।' হিমালয়ের পথে পথে দীর্ঘ পদচারণকারী
প্রবোধকুমার সান্যাল পায়ে-হাঁটা ভ্রমণকেই প্রকৃত ভ্রমণ বলে মনে করতেন।
নেপোর মোড় বারইপুর থানায়। নেপো এক ব্যক্তি, তাঁর আসল নাম নবীর আলি
মোল্লা। তিনি ছিলেন কৃষক। তাঁর জ্ঞাতি নাতিই আমাদের এই ইশা, নেপোর মোড়ে
তাঁর সার-খোল-বিষের দোকান। এঁদের বাড়ি মোড়ের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ পাড়ায়।
পিয়ালি নদীর কাছেই এই মোড়, মোড়ে একটি বট ও অন্য দু-একটি গাছ, একটি গভীর
নলকূপ; কয়েকটি দোকান দু-পাশে। পূর্ব দিকে দাঁড়িয়া অভিমুখে এ পথে আরেকটু
এগিয়ে গেলে আছে বুড়ির মোড়। এক বৃদ্ধা চপ-মুড়ি নিয়ে বসতেন সেখানে, তাঁর
স্মৃতি রয়ে গেছে সে নামে। এখান থেকে দক্ষিণে ঢোসাহাটের দিক একটু এগিয়ে
গেলে পিয়ারের মোড়। পিয়ারের মোড় কেন? কেন-না সেখানে পিয়ার বলে একজন
মানুষ টুকটাক চায়ের জিনিসপত্র নিয়ে বসতেন। এমন কত জায়গার সঙ্গে যে জেগে
রয়েছে কত মানুষের স্মৃতি! আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে। তখন বলতে গেলে বিজন
পথ, আজকের তুলনায়। পথটাই তো ছিল না অনেক আগে, ছিল মাঠ। মাঠের উপর দিয়ে
প্রথমে সরু রাস্তা, পরে ক্রমশ চওড়া সড়ক। মাসির বিবাহসূত্রে তিন-চার দশকে
আমারও নেহাত কম বার আসা হয়নি এখানে। প্রথম-প্রথম আসতাম বারুইপুর-ক্যানিং
সড়কে রামধারি মোড়ে নেমে ভ্যানে করে, ঘোলা বাজারের উপর দিয়ে, পঞ্চায়েত
অফিস ডানদিকে রেখে। শিয়ালদহ-ক্যানিং রেলপথে বেতবেড়িয়া-ঘোলা স্টেশনের গা
থেকে এসেছে এই সড়ক বারুইপুর-ক্যানিং সড়কের বেলেগাছি মোড়ের উপর দিয়ে। এও
এসেছে ঘোলা বাজারের উপর দিয়ে। রামধারি থেকে আসা রাস্তার সঙ্গে ঘোলা
বাজারেই এ রাস্তার মিলন। আগে রাস্তা ছিল খোয়া-ওঠা, এবড়ো-খেবড়ো, যাত্রা
ছিল কষ্টকর। বেলেগাছি মোড়ের সঙ্গে বেতবেড়িয়া-ঘোলা স্টেশন যুক্ত হওয়ায়
পথটি এখন ব্যস্ত, দোকান ও বসতবাড়ি বেড়েছে ভালই।
নেপোর মোড় থেকে দক্ষিণে ঢোসাহাটের পথে একটু এগোলেই ছবির মতো একটি খাল।
পায়ে পায়ে এগিয়ে একবার বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলাম সেখানে, তুলেছিলাম
ছবি। এ পথ দিয়ে বাড়ি ফিরেছিও একাধিকবার, মামাতো ভাইয়ের বাইকে। তো অনেকেই
মাছ ধরে সেই খালে। এদিকে খেজুর বা তাল-আশ্রয়ী বট-অশথের দেখা মেলে বেশ।
একসময় কয়েকটি ছবি তুলেছিলাম এমন গাছের।
অধুনা-নেপোর মোড়ের পাশেই একদা ছিল জেলেরহাট। সে হাট দীর্ঘদিন আর নেই।
একটা হিসাবের আন্দাজে দেখা যাচ্ছে মোটামুটি সাত-আট দশক আগে অস্তিত্ব ছিল সে
হাটের। অদূরে পিয়ালির ঘাটে এসে ভিড়ত নৌকা, মাথায় করে সেখান থেকে
মালপত্র নিয়ে আসত লোকে হাটে। নদীর পাশে জেলেদের হাট থেকে বা জেলেদের
আধিক্য থেকে হয়তো জেলেরহাট।
নবীর আলি অর্থাৎ
নেপোর বাড়ি ছিল এই মোড়েরই দখিন পাশের পাড়ায়। সবাইকে নিয়ে আনন্দ করে
চলতে ভালবাসতেন তিনি। তখন এখানে মাল হত, কাছি টানাটানি হত। অল্পবয়সি
ছেলেদের তিনি গোটাপাঁচেক বা এক প্যাকেট নেড়ো পুরস্কার হিসাবে ঘোষণা করে
মাল করতে লাগিয়ে দিতেন। বড় নেড়ো তখন দু-পয়সা করে। ছোট ছোট ছেলেরা
অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে লেগে যেত মাল করতে। বড় মেলোদের (মল্লযোদ্ধা) দিতেন
ট্রফি আর টাকা। কিঞ্চিদধিক অর্ধ শতক পূর্বে— তা দশ টাকা বলে জানা গেছে।
মেদিনীপুর থেকে দল আসত, যাত্রা হত আট-দশ দিন করে। ফড় বসত। নবীর ওরফে
নেপো অনেক সময় ঠিক করে দিতেন কবে কার বাড়ি খাবে যাত্রাদল। তাঁর সামর্থ্য
যে আহামরি ছিল তা নয়, কিন্তু তাঁর ব্যবস্থাপনা করতে পারতেন। আশপাশের
হিন্দু-মুসলমান সবাই তাঁকে ভালবাসত, সবাইকে নিয়ে চলতেন। লোকের
সুবিধা-অসুবিধার সুরাহা করার চেষ্টা করতেন। থানার সঙ্গেও তাঁর বেশ একটু
যোগাযোগ ছিল। কংগ্রেসি রাজনীতি করতেন।
নেপো হাতে
সবসময় ঘড়ি পরে থাকতেন। মজার ব্যাপার হল, সে ঘড়িতে কাঁটা থাকত না! কেউ
সময় জানতে চাইলে আকাশের দিকে একটু তাকিয়ে প্রায় নিখুঁত সময় বলে দিতেন!
মারা গেছেন ছেচল্লিশ বছর আগে, জানালেন তাঁর জ্ঞাতি নাতি ইশা। ইশা তাঁর
মায়ের কাছে শুনেছেন, তাঁর দেড় বছর বয়সে মারা যান নবীর আলি। নাতিকে কাঁধে
নিয়ে নাকি ঘুরতেন নবীর। বাড়িতে ডাকাতির সময় তিনি ও তাঁর পুত্র
গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পৌত্রকে (নিজের) পাওয়া যায়নি বলে প্রাণে
বেঁচেছিলেন তিনি। প্রয়াণের পরে, তাঁর পাড়া সংলগ্ন এই মোড়টিকে তাঁর নামে
নামকরণের মাধ্যমে তাঁর স্মৃতিকে ধরে রেখেছে আশপাশের গ্রামের হিন্দু-মুসলমান
মানুষজন।
পিয়ালির কথায় পঞ্চানন দাসের 'পিয়ালী বোন আমার, একলাটি' কবিতার কয়েক চরণ উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে যায় :
"বিস্তীর্ণ দুপাশে দুধারে শুরু থেকে শেষ
সীমাহীন নক্ষত্তপুঞ্জের মতো পাশাপাশি
সোনা-ধান, অগুনতি দুধসর বিন্নি মরিশাল
মায়াবী ফসলেরও হাট, ঢোসা বদুকুলা চন্দনেশ্বরে
তিলপি ছাড়িয়ে শ্যামনগরে আমতলা ধর্মতলায়
আলটাখালি গোবিন্দপুর কোয়াবাটি কাঁকসায়
পিছাখালি ডোঙাজোড়া অম্বিকানগরে
নিজ হাতে পরিপাটি করে পলি দিয়ে
সার জল আদুরে সোহাগী ছোঁয়ায়
চোখে চোখে নির্ভুল রেখেছে সাজিয়ে।
এ পিয়ালী অন্য অপর কেউ নয় আর,
বোন আমার
আমার জন্মভূমি জননীর গর্ভের সন্তান
তাইতো কষ্ট পাই, ছুটে ছুটে যাই, দেখি
দেখি তার মনকেমনের ক্ষতচিহ্নগুলো,
কী জানি কেন, কে বা কারা কোন চটুল খেয়ালে
জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সহজ সরল এক
সাদামাটা প্রাণখোলা বাদাবুনী মেয়েটাকে
বেঁধেবুঁধে রেখেছে এভাবে নিভৃত নিরালায়।" — ('বেলা শেষের কবিতা', ১৪ নভেম্বর ২০২২)
রবীন্দ্র পরবর্তী সুবিখ্যাত কবি— 'রূপসী বাংলা'র কবি— জানিয়েছিলেন,
বাংলার মুখ তিনি দেখেছেন তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজতে যান না আর। আর নিজের
কীর্তিকে বিশ্বাস-না-করা বেলাশেষের রবীন্দ্রনাথ কী বললেন? "আমি জানি যাব
যবে/সংসারের রঙ্গভূমি ছাড়ি'/সাক্ষ্য দেবে পুষ্পবন ঋতুতে ঋতুতে/এ বিশ্বেরে
ভালোবাসিয়াছি। এ ভালোবাসাই সত্য, এ জন্মের দান।/বিদায় নেবার কালে/এ সত্য
অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।" আমাদেরও তো তাই-ই, এই এক জনমেই
যতটুকু দেখা যায়, জানা-বোঝা যায়, ভালবাসা যায়— 'এ জন্মের দেখাশোনা'। মন
বলে একাধারে ভয়াল ও অপরূপ এই পৃথিবীতে বারবার ফিরে ফিরে আসি, জীবনানন্দ
যেমন ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায় আবার ফিরে আসবেন বলেছিলেন; যেটুকু মেধা
আছে সে বলে, 'বারে বারে আর আসা হবে না'— কখনোই ফেরা হবে না আর। তাতে কী!
'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে রায়।' ব্যক্তি-মানুষ না থাকলেও থেকে
যাবে মানবধারা। আর মানবধারাটাই যদি শেষ হয়ে যায়! তাহলে তো লেঠা চুকেই
গেল! কে তখন ভালবাসবে এই অপরূপাকে! এ পৃথিবী হারাবে তখন একইসঙ্গে তার আপন
সন্তান ও প্রেমিক/প্রেমিকাকে (পৃথিবীর কেবল নারীসত্তা, পুরুষসত্তা নেই— মনে
হয় না), তার ভালোবাসার 'মানুষ'কে। হয়তো এখনও পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ
প্রেমিককে। তাই লালন উচ্চারণ করলেন, 'এমন মানবজনম আর কি হবে/মন যা কর
ত্বরায় কর এই ভবে।' একটিই জন্ম— অমূল্য জন্ম; যে জন্মটি পেয়েছি, ভাল-মন্দ
তার মধ্যেই যা-কিছু।
আপাতত বিদায়,
জেলেরহাট। আবার হয়তো কোনওদিন— ভিন্ন কোনও ঋতুতে হয়তো বা— পায়ে পায়ে
ফিরব তোমার পথে। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে। উদ্দেশ্যহীন ঘুরব তোমার নেপোর মোড়ের
এদিক-ওদিক। যাব পিয়ালির পাশটিতে। তোমরা তো থাকবে, আমি যদি থাকি।
======================
তথ্যঋণ :
জেলেরহাট কয়াল পাড়ার পাঁচুগোপাল কয়াল ও নদীয়া কয়াল এবং নেপোর মোড়ের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ পাড়ার ইশা আলি সরদার।
---------------------------------------
অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক — গোকর্ণী,
থানা — মগরাহাট,
জেলা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।