ছবিঋন- ইন্টারনেট
রবীন্দ্র - নজরুল ভাবনা
দেবযানী পাল
রবীন্দ্রনাথ - নজরুল - দুই ভিন্ন আঙ্গিকের সাহিত্যধর্মী মানব - তাদের ধর্ম,জীবনযাত্রা,সামাজিক, মানসিক স্তরভেদে হলেও সাহিত্যের ইতিহাসে দুজনেই সমান আদরনীয় দেশপ্রেমে বরণীয়।
রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন সম্ভ্রান্তশালী পরিবারে ,জন্ম সূত্রে পেয়েছিলেন সম্পদ শিক্ষা সংস্কৃতি, পরিশীলন - সেই পরিবার, দেশ, সমাজকে এনে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ সম্মান সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল।
অন্যদিকে নজরুল বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের এক অখ্যাত দরিদ্র মুসলমান পরিবারের সন্তান, জীবনের অনিশ্চিত তাড়নাতে সদা উদ্ভ্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রাঁচিতে সৈনিকের জীবন আবার কলকাতায় ফিরে এসে অদূর ভবিষ্যতে সঁপে দেওয়া এক উদ্দাম উচ্ছসিত,দেশভক্তিতে নিমজ্জিত মানুষ।
তবে দুজনের মিল - প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অসম্পূর্ণতা, অসম্ভব সৃষ্টি প্রতিভা যা প্রতিষ্ঠানগত শিক্ষাকে লজ্জায় ফেলে বুঝিয়ে দেয় প্রতিভার কাছে তা কত তুচ্ছ। দুজনের জীবন বৃত্ত আলাদা হলেও প্রতিভার নিপুণতায় একে অন্যের পরিপূরক। নজরুল বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সংগীতের রচয়িতা, গায়ক, গীতিকার, কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন।
রবি ঠাকুর - নজরুল দুজনের সাহিত্যে র ভিন্নতাই রসদ ছিল সাহিত্য রসনায়।নজরুল ইসলাম ৩৮ বছরের ছোট ছিলেন রবি ঠাকুরের থেকে মাত্র ২১-২২ বছর বয়সেই তিনি পৃথিবীতে বাংলা কবিতার বিস্ফোরণ ঘটান।
নজরুলের দেশপ্রেম ছিল চর্চিত যেখানে রবীন্দ্রনাথও তাকে নিয়ে রীতিমতো উৎসাহী ছিলেন।নজরুলই প্রথম যিনি জাতির উর্ধ্বে গিয়ে লিখেছিলেন- হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন /কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।' আমার কৈফিয়ৎ' কবিতায়ক নজরে দুটি ছত্র - প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় ৩৩ কোটি মুখের গ্রাস /যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ। এভাবেই তিনি গোটা পৃথিবীতে পীড়িত মানুষের কবি হয়ে ওঠেন।
রবি ঠাকুরের সাথে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ ১৯২০ সালে পূজার ছুটিতে শান্তি নিকেতনে। ওই সাক্ষাতে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে' আগমনী ' কবিতাটি শুনিয়েছিলেন, তখনো তিনি বিদ্রোহী কবিতাটি লেখেন নি।
১৯২২ সালের ১১ আগস্ট যখন নজরুল ধুমকেত পত্রিকা প্রকাশ করার সময় রবি ঠাকুরের আশীর্বাদ চাইলেন,রবি তাকে ' তুই ' সম্বোধন করে লিখেছিলেন --- আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নি সেতু
দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন।
অলক্ষনের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।
নজরুলের জীবনে পরম প্রাপ্তি রবি ঠাকুরের থেকে তারই লেখা 'বসন্ত 'নাটিকাটি নজরুলকে উৎসর্গ । নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা ও রাজনৈতিক প্রবন্ধের সংকলন যুগবাণী যখন ইংরেজ শাসক দ্বারা বাজেয়াপ্ত হয় নজরুল আত্মগোপন করতে চাইলেও কুমিল্লায় ধরা পড়েন এবং কলকাতায় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইন হো এই রাজদ্রোহী কবিকে 1923 সালের ১৬ই জানুয়ারি ১ বছরের জন্য কারাদণ্ডে দন্ডিত করলে একদিনের জন্য প্রেসিডেন্সি জেলে রেখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। এই পুরো ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য রাখছিলেন, পরে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় কে ডেকে তার হাতে নজরুলকে উৎসর্গীকৃত নিজ লেখা বসন্ত গীতিনাট্য বইটি দিয়ে বলেছিলেন,আমি নিজ হাতে দিতে পারিনি বলে দুঃখ যেন না করে, অকুণ্ঠ আশীর্বাদ দিয়ে বলেছিলেন যেন সে লেখা না বন্ধ করে, সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগানোর কবিও চাই।
ব্রিটিশ আশীর্বাদপুষ্ট রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, আমার সোনার বাংলা /আমি তোমায় ভালোবাসি অথবা ও আমার দেশের মাটি /তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
নিপীড়িত মানুষের কবি নজরুল লিখেছিলেন, বন্ধু আমার!থেকে থেকে কোন সুদূরের বিজন পুরে/ডাক দিয়ে যাও ব্যথার সুরে
অথবা বন্ধু, তোমার বুক ভরা লোভ ,দুচোখে স্বার্থ ঠুলি /নতুবা দেখিতে,তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।
রবীন্দ্রনাথ নিপীড়িত মানুষের কবি হয়ে উঠতে পারেননি, উচ্চকণ্ঠে সমাজের ও শাস্ত্রের রীতিনীতি লঙ্ঘনের কথা উচ্চারণ করেছেন ঠিকই কিন্তু প্রয়োজনীয় সময় ইংরেজ সরকারের অন্যায়ের ক্ষীন কণ্ঠে প্রতিবাদী হয়েছেন মাত্র।
অন্যদিকে নতুন সমাজ গঠন ও অস্তিত্বের মূল্যায়নে বিদ্রোহের রণাঙ্গনে কাজী নজরুল বারবার নিজেকে জন কবি হিসেবে তুলে ধরেছেন ৪২ বছরের সমগ্র মানসিক সত্তার মৃত্যু ঘটার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।
==================
নিউ ব্যারাকপুর।