প্রতিদিনের মতো এসে কাজ শুরু করে দিয়েছে সোমা। একটানা কথা বলাটা ওর স্বভাব।
এই সময়টা আমিও ওর কাছে এসে বসি। সারাদিন একা একা থাকি -- চুপচাপ। তাই সোমার নানাধরণের কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগে আমার।
সোমা সেদিন ঘর মুছছিল। আর যথারীতি মুখ চলছিল তার। হঠাৎ আমার চোখ গেলো ওর খোলা পিঠের কাটা দাগটার উপর। সোমা এতদিন কাজ করছে, কই কখনও তো খেয়াল করে দেখিনি এটা। ঠিক মেরুদন্ডের পাশে একটা গর্ত মতোন কাটা দাগ। আমি তা দেখে আঁতকে উঠে বললাম, " এ কি গো , তোমার পিঠের ওখানটা ওরকম গর্ত মতোন কাটা দাগ কেন গো?"
শুরু হলো কাহিনী --
"আর বোলো না কাকীমা। ছোটবেলায় আমি খুবই দুষ্টু ছিলাম গো। আমাদের একটা দল ছিল। এ বাড়ি ও বাড়ি সে বাড়ির বাগান থেকে ফল চুরি করে বনপুকুরের কাছে সব রেখে আসতাম। সময় সুযোগ বুঝে ভাগাভাগি করে সবাই খেতাম।"
" বনপুকুর কি গো ?"
"একটা বিশাল পুকুরের পাশেই নানাধরণের গাছপালা ঘেরা বন। ওটার নামই ছিল বনপুকুর। ওখানে আমরা মাঝে মাঝেই রান্না করেও সবাই মিলে চড়ুইভাতি করে খেতাম, ওহ্ সে কী আনন্দের দিন ছিল গো।''
" আর পড়াশোনা করতে না?"
"পাঠশালা যেতাম , বাড়ির এতো কাজ যে পাঠশালায় পড়াশোনা আর বেশিদূর হলো না গো --"
ওর কথায় কথায় জানা গেল, ওর বাবা বেশিরভাগ বাড়িতে থাকতেন না। তাই সংসারের দায়িত্ব ওর উপর এসে পড়েছিল। খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
যে বয়সে বই খাতা নিয়ে থাকার কথা,সে বয়সেই শুরু হয়ে গিয়েছিল সোমার জীবনসংগ্রাম।
"আসল কথাটাই যে শোনা হল না সোমা" --
সেকথা বলতেই, আবার শুরু করল --
"আমরা দুপুরে ঘুমাতাম না। তখনই সবার বাড়িতে চড়াও হয়ে, যে যা পেতাম তাই নিয়েই দে ছুট,একবারে চম্পট বনপুকুরে। আমি এত জোরে দৌঁড়োতাম যে কেউ নাগাল পেত না। একবার খবর পেলাম জ্যেঠিমাদের বাগানে প্রচুর তরমুজ হয়েছে। জ্যেঠিমার মেয়ে পলাদি বলল আমি পাহাড়া দেব, সেই সুযোগে তোরা যত পারিস তুলে নিবি তরমুজ। আমরা দলবেঁধে যেই না বাগানে ঢুকেছি ওমনি আমাকেই দেখতে পেয়েছে জেঠিমা। উনি যে আড়াল থেকে লক্ষ্য করছিলেন বুঝতেই পারিনি। আমি তো মন খারাপ করে, গরু ছাগল সব নিয়ে আজ আর মাঠে চড়াতে যাব না ভেবে বাড়ি চলে এলাম।"
মা বলল, "কেন মাঠে গরু ছাগলগুলিকে চড়াতে নিয়ে যাসনি?" এই বলেই, হঠাৎই মা খুব মারতে শুরু করল। আমি তখনও জানি না যে জেঠিমা ঐসব কথা মায়ের কানে তুলে দিয়ে গেছে। জেঠিমা এসে কখন মায়ের কানে ঢেলে গেছে সে খবর জানা ছিল না আমার।
মায়ের মার খেয়ে, আমার খুব কষ্ট হল।
বললাম, " তোমাদের কাজও করব, আবার মারও খাব? বেশ আমি আর বাড়ি আসবই না। তারপর আমার সাদা ছাগলটাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম। ওকে বললাম, আমি চলে যাচ্ছিরে ধলি। আর দেখা হবে না তোর সাথে। ও কী বুঝল কে জানে, মাথা নাড়তে লাগল। আমি আর আসবো না রে, এই বলে আমি গরু,ছাগলগুলোকে চড়াতে দিয়ে বনপুকুরের জঙ্গলে গিয়ে বসে রইলাম।
সন্ধ্যে হতেই গরু,ছাগলের বাঁধন খুলে দিলাম ওরা বাড়ির পথে ছুটে চলে গেল।
অন্যদিন ওদের সঙ্গেই বাড়ি ফিরে আসি। আজ যে আমার খুব রাগ-দুঃখ-অভিমান হয়েছে। আমি আর ঘরে ফিরব না।"
এদিকে সোমাকে বাড়ি ফিরতে না দেখে, একরাশ চিন্তা নিয়ে তাকে খুঁজতে বেড়িয়েছে মা।
দেখা পাচ্ছে না। ভাবছে কী করবে?
পাবে কি করে? বনপুকুরের জঙ্গলে লুকিয়ে রয়েছে যে সোমা। মা অনেকবার ডাকার পর সোমা যেই না বেড়িয়ে এলো, অমনি ওর মা হাতে থাকা খুন্তিটা ছুঁড়ে দিতেই গেঁথে গেল ঠিক পিঠের মাঝখানটায়। আর গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল। সোমার ঠাকুমা তো ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। গ্রামের লোকেরা ধরাধরি করে সোমাকে নিয়ে গ্রামের ডাক্তারের কাছে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে এলো।
রাতে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল সোমা।
পরদিন যথারীতি সকালে উঠে মাছ ধরার জন্য নদীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
নয়-দশ বছর বয়স থেকেই সংসারের ভার তার কাঁধে এসে পড়লেও দুপুরটাকে সে নিজের মতো করে কাটাত। আমার খুব অবাক লাগল, আগের দিন এতো কষ্ট সহ্য করে আবার সকালে উঠে মাছ ধরার জন্য নদীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল শুনে।
বললাম , "হ্যাঁ গো সোমা একদিনেই ব্যথা কমে গেলো !"
"কি করবো কাকীমা এতগুলো পেট সংসারে। আমাকেই তো খাবারের যোগার করতে হবে,আমার কি আর শুয়ে বসে থাকলে চলবে?"
মনেমনে ভাবলাম কত কষ্ট মেয়েটার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে।
জানতে চাইলাম ,"বন্ধুরা মিলে বনপুকুরে কি কি করতে?"
সোমা বলল , " কারও গাছের নারকেল,আম ,কুল ,কয়েদ বেল , এমন কি পুকুর থেকে মাছও চুরি করতাম।
একবার আমার পুতুলের বিয়ে দিলাম। আমার মেয়ে বন্ধুরা বলল, 'এই সোমা তোর মেয়ের বিয়ে দিবি বরযাত্রীদের খাওয়াবি না?' কি করব? সেদিন আকাশে খুব মেঘ করেছিল। আর মেঘ করলে গলদা চিংড়ি পুকুরের পাড়ে এসে উপুর হয়ে থাকে। কাকাদের পুকুর, দেখলে আর রক্ষা রাখবে না,ধরাও বেশ ঝামেলার। দু'দিকটা ধরে তুলতে হয়, নয়তো লেজ দিয়ে খুব জোর ঝাপটা মারে। তাতে আঙুল কেটে যায়।খুব সাবধানে কাকাদের পুকুর থেকেই প্রচুর চিংড়ি ধরে বনপুকুরের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হল। আগেই সবার বাড়ি থেকে একটু একটু করে চাল এনে পুরোনো কাপড়ে বেঁধে মাটিতে গর্ত করে, তার ভেতরে রাখা হয়েছিল। কেউ যাতে না বুঝতে পারে সেজন্য ওপরে মাটি চাপা দিয়ে গোবর দিয়ে লেপে দিতাম। " আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, চাল পচে যেতো না?"
সোমা বললো , " না না।
কেউ তেল কেউ নুন কেউ হলুদ কেউ আরার মার জিরে বাটা থেকে লুকিয়ে তা একটু নিয়ে আসত।
পাড়ার এক কাকীমা হাড়ি কড়া দিতো।"
"তোরা রান্না করতে পারতিস ?"
একগাল হেসে বলল, " দারুণ হোতো গো ,সবাই খুব মজা করে খেতাম, ওরা বলতো",'দারুণ রান্না হয়েছে।' বলেই সোমা হাসল একগাল।
সোমার গল্পে জোয়ার এসেছে। সে বলেই চলেছে।
আমিও সুযোগ বুঝে জানতে চাইলাম, "আর কি কি করতে ?"
ও যেন উত্তর দেবার জন্য তৈরিই ছিল।
বলল , " জানো আমরা খই ভেজেও খেতাম। "
"এতটুকু টুকু মেয়ে ,খই ভাজতে ?"
" হ্যাঁ গো "
বলেই আবার একগাল হাসল।
আমি বললাম , "ধান কোথায় পেতে?"
বলল , "কারো না কারো খেত থেকে চুরি - করে"।
সারাটাদিন সংসারের জন্য খেটে,নি।
সোমাদের মতো কিশোরী মেয়েদের যে সময় স্কুল, লেখা-পড়া করার কথা, সে সময়টা তার কেটেছে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে। খুব কষ্ট হচ্ছিল মনেমনে ওর কথা শুনে, ওর কথা ভেবে। কিন্ত কি আর করা ! আমাদের সমাজে কিছু কিছু মানুষ এভাবেই পরিস্থিতির শিকার হয়। ভেবে পাই না এর প্রতিকার কী। আমি যতটা পারি সোমার জন্য করি। কিন্তু সমাজের আর সোমারা? তাদের দায়িত্ব ভার কে নেবে, কবে নেবে? এই প্রশ্নের উত্তর আজও আমার কাছে অধরা।
====================
Arati Mitra.
267/3. Nayabad,Garia.
Kol. 700094