সীমার সংসার
আরতি মিত্র
ছোট বোন সীমার আচার আচরণে অনেক দিন ধরেই সুব্রত ভীষণভাবে বিব্রত হচ্ছিল আর সহ্য করতে না পেরে বাবাকে বললো , "বাবা সীমাকে বিয়ে দিয়ে দাও ।"
বাবা অবাক হয়ে বললেন , "কি বলছিস রে ! বাড়ির সবার ছোট সীমা। তোর দিদিকে এখনও বিয়ে দিতে পারলাম না। তাছাড়া সীমা সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। আগে পড়াশোনা শেষ করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক তারপর না হয় ভাবা যাবে ওর বিয়ের ব্যাপারে।"
" না না তুমি এখনই ভাবো। "
" কি হয়েছে বল তো, এতো জোর করছিস কেন?"
" তুমি কিছু জানো না ?"
" কি জানবো?"
"ও পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে সীমা ঘুরে বেড়ায়, আমার বন্ধুরা দেখেছে। সেকথা বলেছে আমাকে, তাছাড়া সবাই নানাধরণের কথা বলতে শুরু করেছে, আমার একদম ভালো লাগছে না এসব কথা শুনতে। তাই তো তোমাকে ওর বিয়ের কথা বলেছি।"
সীমারা তিন ভাই বোন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। টিনের চালের পাকা বাড়ি। অনেক কষ্ট করে বাবা ওদের জন্য একটা বড়ো ঘর , বারান্দা সহ একটা ছোট ঘর গড়ে তুলেছেন।
সন্তানদের বাবা প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসেেন ।স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে সর্বদাই ঘিরে রেখেছেন তাদের।
কিছুদিন হলো তিনি চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন। মা সংসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
বড় মেয়ে রীতা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোচিংয়ে পড়ানো এবং বাড়ি বাড়ি গিয়েও পড়ায় সে। পরিবারের সবার প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করে। ভাই পড়া শেষ করে চাকরির জন্য তৈরী হচ্ছে।
এমত অবস্থায় বাবা যখন ছোট মেয়ের ঘটনা শুনলেন, তখন সমাজের বিরূপ মন্তব্য এড়ানোর জন্য তাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
পাত্র সরকারী চাকুরে। কাছাকাছি বাড়ি। তাদের বাড়ির সঙ্গে কথা বলে নেওয়া হলো, বিয়ের পর যেন তাদের মেয়েকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
অবশেষে অনেক আলোচনার পর বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলো। উভয়পক্ষ আশীর্বাদ সম্পন্ন করলেন সুষ্ঠুভাবে। সঠিক দিনে নিয়ম অনুযায়ী, সীমার দিদি রীতা,বাবা-মা এবং আত্মীয়দের সাহায্যে বিয়ের অনুষ্ঠান মোটামুটি ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো।
সীমা খুবই সুন্দরী, মায়াময় মুখশ্রী, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, তাছাড়া বয়স কম বলে যেন লাবণ্য ঝরে পড়ছে।
বুকে পাথর চাপা দিয়ে বাবা মা ছোট মেয়ে সীমাকে অশ্রুসজল নয়নে বিদায়ের কাজও শেষ করলেন।
বৌভাতের দিন মা ছাড়া সকলেই আনন্দ করে নিমন্ত্রণ রক্ষা, মেয়ের হাসিমুখ দেখে বাড়ি ফিরে এলো। রাত ভোর হতে না হতেই ভয়ংকর সংবাদে ছুটলো সবাই। সীমাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কি এমন ঘটলো রাতে?
সে তো নিজের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করেছে, তবে এমন অঘটন ঘটলো কেন?
শ্বশুরবাড়ির সবাই কারণটা আন্দাজ করলো,কারণ তারা আগে থেকেই ঘটনাটা জানতো।
কিন্ত সীমার বাবা মা তো বিপদের আশঙ্কায় অস্থির হয়ে পড়লেন। সবাই যে যার মতো ছুটলো খবর আনতে।
বৌভাতের দিন রাতেই সীমা জানতে পারলো পরিতোষকে চাকরী থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। শুনে, সীমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো,এ সে কাকে বিয়ে করেছে?
বাড়ির লোকজনের বক্তব্য " তুমি গিয়ে বড় সাহেবের পায়ে ধরে বলবে ও সব ঠিক হয়ে যাবে। "
বলে কী পরিতোষ?
" ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা ! আমি পায়ে ধরবো? কেন কি অপরাধ করেছে সে"
তখন জানতে পারলো যে কিছুদিন ধরেই অফিস যাবার নাম করো পরিতোষ স্টেশনে গিয়ে বসে থাকতো। ওর অফিস সাঁতরাগাছিতে, রেলের সহকারী স্টেশন মাস্টার। মনে মনে বললো, " এখন আমি কি করবো?
বাড়িতে বলতে পারবো না এসব কথা।
অনেক কষ্ট করে সবাই এই অনুষ্ঠান করেছে এখন জানতে পারলে দুঃখে সবার বুক ফেটে যাবে।
আর পারছি না সহ্য করতে" এই বলে অঝোর নয়নে কাঁদতে লাগলো সে।
পরিতোষ বললো , " তুমি গিয়ে বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে, সুন্দর মুখের সর্বত্র জয় "
" এ কি শুনছি আমি?
বৌকে কেউ এভাবে বলতে পারে? ওঃ আমি আর ভাবতে পারছি না। নিজেকে শেষ করে ফেলবো আমি।
না হলে এই লজ্জার হাত থেকে আমার রেহাই নেই। "
এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে সীমা রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। নিজের মনে মনেই ভাবতে লাগলো, " স্টেশনে তো এলাম, ওরা আবার এখানে আসবে না তো?
আসার সম্ভাবনাই বেশি।
তবে এখন কি করি?
লাইনের পাশে অনেক ঝোপঝাড় রয়েছে,
ওর আড়ালে যাই। "
হঠাৎই সীমার বাবার স্নেহভরা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
সে এই পথ বেছে নিলে লজ্জার হাত থেকে হয়তো পার পেয়ে যাবে কিন্ত বাবা যে বড্ড কষ্ট পাবেন।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে পাড়ার এক মাসীর বাড়ি গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। মাসী তার সব কথা শুনে, নানাভাবে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। বোঝালো তাকে , " এইভাবে কি জীবন থেকে পালিয়ে কি বাঁচা যায় রে মা?
যতদিন বাঁচবি লড়াই করেই বাঁচতে হবে তোকে।
এ তো নিজের কাছে হেরে যাওয়া।
তুই তো হারতে শিখিস নি সীমা। তোকে সেই ছোট্ট থেকে দেখেছি"
" ঠিকই বলেছো মাসী
এবারই সত্যিকারের জীবন সংগ্রাম শুরু হবে আমার।
বাপের বাড়ির কাউকেই জানানো চলবে না
তবে এটাই যা দুঃখ।
এতোদিন মিশেও মানুষটাকে চিনতে পারলাম না গো।"
" সংসার করার পর আরও কতকিছু দেখতে হবে রে মা। শুরুতেই যার এই রূপ। সে বহুরূপী না হয়ে যায় না রে।
তোকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে, মনে রাখবি তোদের জীবন-তরীর নাবিক এখন তুই "
" বাড়িতে সচ্ছলতা না থাকলেও অনেক আদরে মানুষ হয়েছি মাসী। অবশ্য সবই তুমি জানো
তাছাড়া ছোট বলে কোন কষ্টের আঁচ লাগতে দেয় নি বাবা মা কেউ, অথচ আজ আমার কি অবস্থা?"
"এতো ভেঙে পড়িস না সীমা, ধৈর্য্য ধর 'যে সয় সে রয়। '
চল এবার তোকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি, আমি যা বলার বলবো, তুই কোন কথা বলবি না।"
বাড়িতে ঢুকে, সীমা লক্ষ্য করলো থমথমে পরিবেশ। সে কারো সঙ্গে কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেলো।
সকলে সীমাকে খুঁজতে গেলেও, সীমার বাবাতো যেতে পারেননি।
তিনি নিরুপায় হয়ে সীমার শ্বশুরবাড়িতে এসে মেয়ের অপেক্ষায় বসে ছিলেন।
সীমা দেখলো বাবা তার ঘরে বসে আছেন।
সীমা এবার চোখের জল আর আটকে রাখতে পারল না। বাবার পায়ের উপর কেঁদে লুটিয়ে পড়লো।
বাবা ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে, ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "মেয়ে হয়েছো
অনেক সহ্য করতে হবে মা।"
বাবার স্নেহের পরশে সীমা নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।
বাবা সান্ত্বনা দিয়েই উঠে পড়লেন।
আসলে ছেলে মেয়েরা তাঁর বুকের পাঁজর। এদের কষ্ট তাঁর কাছে অসহনীয়।
ইতিমধ্যে শাশুড়ি মা এসে বললেন,
" চোখের জল মোছো বৌমা,
তোমাকে শক্ত হতে হবে
তোমার শ্বশুর সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়েছেন
দুজনের একই চরিত্রের
তোমাকেও অনেক কষ্ট যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে,
মনে জোর আনো।
নিজেকে শেষ করাটা কোনোমতেই ঠিক নয়।
চলো সকাল থেকে তো কিছুই খাও নি
কিছু মুখে দেবে চলো।"
সীমার শাশুডী যেন দুর্গাপ্রতিমা। যেমন গায়ের রঙ, তেমন সুন্দর মুখশ্রী। কাঁচাপাকা চুলে লাল টকটকে সিঁদুরে রাঙানো সিঁথি। কপালে জ্বলজ্বল করছে বড়ো সিঁদুরের টিপ। স্নেহের প্রতিমূর্তি , দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
সীমার মনে হলো, এই মায়ের এই ছেলে,
এই রকম হলো কি করে?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে শাশুড়ি মাকে অনুসরণ করলো। সারাটাদিন নিরাসক্তভাবেই সে দৈনন্দিন কাজকর্ম সারলো। রাত নামলো। খাওয়া দাওয়ার শেষে নিজের ঘরে তো যেতেই হবে।
কিন্ত সীমার একদম ইচ্ছে করছিল না সেখানে যেতে। মানুষটার মুখ দেখতে।
নিরুপায় হয়েই ঘরে গিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সীমা শুয়ে পড়লো।
তারপর মনে মনে ভাবলো, এভাবে কতদিন চলবে?
সব ভালোবাসা যেন শুষ্ক মরুতে পরিণত হয়েছে।
কত স্বপ্ন দেখেছিল, আজ সব ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল।
এখন কি করবে সে?
নিজের ঘরে ফেরার সব পথ বন্ধ তার।
মানিয়ে নিতে হবে সংসারে।
সেই চিরন্তন উক্তি,"মেয়ে হয়েছো,সব সহ্য করো "
সত্যিই তাই, মেয়েরা কতো অসহায়।
অন্যায় করছে জেনেও মুখ বুজে সব মেনে নিতে হয় তাদের।
সীমারও তেমনই হাত পা বাঁধা, অন্য মেয়েদের মতো।
বাবাকে কোনোমতেই কষ্ট দিতে পারবে না সে।
পড়া তো আর হলো না, সবই জলাঞ্জলী গেল।
এতো কম বয়সে মাথায় বিশাল বোঝা চাপলো , কপালে কোন সুখ লেখা নেই ।
এরপর গিয়ে পরিতোষের অফিসারদের হাতে পায়ে ধরে চাকরী বাঁচাতে হবে তার।
সাসপেন্ড মানে অর্ধেক মাইনে, কোয়ার্টারও নেই।
থাকবে কোথায়? কি করে চলবে তাদের?
সে তো একদম রান্না করতেও জানে না।
বাড়ির ছোট বলে সবার খুবই আদরে বড়ো হয়েছে। মা তাকে কখনও রান্না করার জন্য , রান্নাঘরে ঢুকতেই দেননি।
যাক যা হবার তো হয়েই গেছে। এবার নতুন জীবন শুরু করতে হবে।
কতো আশা করেছিল, সব শেষ হয়ে গেল।
এই মানুষটাকে সে ভালোবাসেছিল?
নিজের উপর নিজের খুব রাগ হলো খুব।
চিনতে এতো ভুল হলো তার?
মূল্যবোধহীন একটা মানুষ, সত্যিই কি সে মানুষ নামের যোগ্য?
এক আদর্শে মানুষ সে, আর এ তো চূড়ান্ত আদর্শহীনতার উদাহরণ।
হাওড়া থেকে ট্রেন।
হঠাৎ পরিতোষের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো
" কি এতো ভাবছো বলতো ?
অফিসারদের কাছাকাছি গিয়ে দুঃখ দুঃখ মুখ করে যা বলার বলবে এই আর কি"
কি সহজেই কথাটা বললো পরিতোষ। কোন গ্লানি নেই। নিজের অপরাধের বোঝা অন্যের ঘাড়ে নির্দ্বিধায় চাপিয়ে দিল। কী নির্লজ্জ সে।
অবশেষে চাকুরীস্থলে এসে পৌঁছলো।
অফিসারদের হাতে পায়ে ধরে চাকরীটা বজায় রইলো। একজন স্টাফের কোয়ার্টার ভাগাভাগি করে শুরু হলো নতুন জীবন।
এখন তো মাইনের প্রশ্নই নেই।
বিয়েতে যা পেয়েছিল সীমা তা থেকেই খরচ করতে লাগলো।
বাবার বাড়িতে কোনদিন খাওয়ার কষ্ট পায় নি।
আর এখন এই পরিস্থিতি তার?
আরও কত কষ্ট সহ্য করতে হবে কে জানে?
প্রতিদিনের এক নিয়ম, যখনই রান্নার যোগার করবে ঠিক তখনই কারেন্ট অফ হয়ে যায়।
জ্বালানির অন্য কোন ব্যবস্থা নেই। তাই হিটারে রান্না হয়।
টিফিন টাইমে কোয়ার্টারের মালিক এসে
জানতে চায়
" বৌদি আজও রান্না হয়নি তো ,
দিন দিন একসঙ্গে রান্না করেনি"
দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে তাদের।
সীমা ভাবে, এই কী জীবন !
পরিতোষের গুণের আরও কত কিছু যে তার অজানা ছিল।
অফিসে যাবার পর দরজায় নক করছে কেউ।
এখনও সীমার অবাক হবার পালা অনেক বাকি।
দরজা খুলেই দেখলো একটি ছেলে
" বৌদি , তোমার সঙ্গে একটু গল্প করতে এলাম
ঘরে ঢুকতে দেবে তো নাকি"
" আপনার দাদা যখন থাকবে তখন আসবেন"
এই বলে সীমা দরজা বন্ধ করে দিল।
ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে পরিতোষের প্রতি ঘেন্নার পাহাড় জমছিল।
অফিস থেকে ফিরেই পরিতোষের কি হম্বিতম্বি।
কেন তার বন্ধুকে বসতে দেওয়া হয়নি ঘরে?
ছিঃ ছিঃ ছিঃ !
তাহলে কি ভালোবাসা বলে কিছু ছিল না পরিতোষের মনে?
পরপুরুষকে উপঢৌকন দিতে চায় সীমাকে?
কোন কথাও সে বললো না এ ব্যাপারে।
মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে সে পালিয়ে যায় এখান থেকে। কিন্ত কোথায় যাবে?
এতো মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে বাঁচা যায়?
একটু শীতল প্রলেপ পেল সে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে।
প্রকৃতি দু হাত ভরে সাজিয়ে দিয়েছে চতুর্দিক।
যে দিকেই তাকায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। দেখে যেন, কষ্টের কিছুটা অবসান হয়।
জীবনের বসন্ত তো উধাও হয়ে গেছে কবে?
বাঁচার রসদ এবার তাকে সংগ্রহ করতে হবে
এখানকার পরিবেশ থেকে। নিরিবিলি নিশ্চুপ পরিবেশ। শুধু নানা ধরণের পাখির কলকাকলী ভরা সবুজের পরিবেশ।
কোকিলের মধুর গান, ভ্রমরের গুঞ্জন, নানা রঙিন ফুলের সুরভি।
সব মিলিয়ে মন ভালো হয়ে যায়। এখন আর
কিছু করার নেই, এদের আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে হবে তাকে।
যে এতোদিন ভালোবাসার নামে অভিনয় করেছে, আজ সেটা জেনে, বুঝতে পেরেও ফেরার পথ পাচ্ছে না সীমা।
নিত্য নতুন মেয়ের সঙ্গ প্রয়োজন পরিতোষের। তারা আবার দিনমজুর, কাজের লোক, আদিবাসী মহিলা।
এই নোংরা চরিত্রের কথা কোয়ার্টারে কারও অজানা ছিল না। পরিতোষের কাজের জায়গার সঙ্গী সাথীরাও একই ধরণের মানুষ।
এই ভাবে চলতে চলতে একদিন নিজেদের কোয়ার্টার হলো। পুরোপুরি মাইনেও পেতে লাগলো।
কিন্ত বেশিরভাগটাই চলে যেতো তার মেয়েমানুষ পুষতে।
পরিতোষের বাইরের রূপটার ভেতরে যে এতটা কদর্য একটা নোংরা মন আছে, এতদিন সবটাই সীমার অজানা ছিল।
মেয়েমানুষ পাল্টানোর এই যে কদর্য স্বভাব, প্রথম প্রথম সীমা তা বুঝতে পারতো না।
মাঝে মধ্যেই যখন মেয়েদের কাছ থেকে অভিযোগ কানে আসতে শুরু করল, তখন ধীরে ধীরে সবই
বোধগম্য হলো সীমার।
তখন মনে হতো কারও হাত ধরে বেরিয়ে যায় সে। কিন্ত সেই চিরন্তন পিতৃস্নেহ ,ভালোবাসার বন্ধন সে টুটবে কিভাবে?
একাকীত্ব কাটাতে একটা সন্তানের জন্য পাগল হয়ে উঠলো সে। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সব পরীক্ষা নীরিক্ষার পর জানা গেল, পরিতোষের অক্ষমতার কথা।
সীমার মানসিক অবস্থা লক্ষ্য করে পরিতোষ মনে মনে একটা মতলব আঁটলো।
কিছুদিন পর পরিতোষ সীমাকে যখন একটা অচেনা জায়গায় নিয়ে এলো, তখন সীমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ,
" এ তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এলে ?"
" এ একটা আশ্রম,একজন সাধু এখানে ওষুধ দেয়, যা খেলে তুমি সন্তান লাভ করবে। শুধু একটা রাত তোমাকে এখানে থাকতে হবে।"
কথাটা শুনে ভাবলোে, বলে কী পরিতোষ?
তবু পরম বিশ্বাসে সেখানে প্রবেশ করলো সীমা, দেখলো সারি সারি মেয়েরা এক-কাপড়ে সারা অঙ্গ কোনরকম ঢেকে প্রাপ্তির আশায় হত্যে দিয়ে বসে আছে।
হঠাৎ চতুর্দিকে সাজো সাজো রব উঠলো।
সাধু আসছেন, সাধু আসছেন।
চোখের সম্মুখে সাধুকে দেখে সীমা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল।
এ কাকে দেখছে সে? পলাশ সাহা? পাড়ার সকলে যাকে রাঙা পলাশ বলে টিটকারী দিত।
রমা বৌদির সঙ্গে কু-কীর্তি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, শেষে পাড়া ছাড়া হয়েছিল। পালিয়ে বেঁচেছিল পুলিশের হাত থেকে।
সে তো ভেবেছিল শ্রদ্ধার প্রতিমূর্তি কাউকে প্রত্যক্ষ করবে এখানে। কিন্ত তার পরিবর্তে লোভ , লালসা, ভোগী চেহারার এক মানুষ।
এখানেও দৃষ্টি দিয়ে সে সব নারীর সর্বশরীর লেহন করছে। মানুষ না বলে বোধহয় পশু বলাই শ্রেয় ।
সীমা মনে মনে প্রস্তুত হতে লাগলো।
নিজেকে বাঁচাতে যে করেই হোক এখান থেকে পালাতেই হবে। কিন্ত মাথায় তো কোন রকম বুদ্ধিই আসছে না। নিশ্ছিদ্র পাহারা। কি করবে এখন সে? এমত অবস্থায় কিভাবে বা কোথা দিয়েই ঘরের বাইরে নিয়ে যাবে নিজেকে?
ছোটবেলার লুকোচুরি খেলার কথা মনে পড়ল তার। এখানে সেরকম কিছু কায়দা কাজে লাগাতে হবে।
এই এলাকাটি বন জঙ্গলের মধ্যে। সুতরাং জানালা টপকে যদি কোন গাছে ওঠা যায়, তবে কিছুক্ষণ পরেই পরিস্থিতি বুঝে গাছ থেকে নেমে, আদিবাসী পাড়ায় পৌঁছে গেলেই নিশ্চিন্ত। কারণ সীমাকে ওরা খুব ভালোবাসে। মনে মনে ভাবলো , " কতবার ওদেরকে পরিতোষের কুনজর থেকে বাঁচিয়েছি , ওরা এতো সৎ যে কোন কিছুর বিনিময়ে নিজের সতীত্ব বিসর্জন দিতে রাজি নয়।"
এসব কথা ভাবনার মধ্যেও, সীমা কিন্ত তক্কে তক্কে ছিল, ওরা একটু অন্যমনস্ক হতেই, সে নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে, একটা জানলা টপকে একটা বড়ো গাছে উঠে পড়লো।
এদিকে সাধুর সাঙ্গ পাঙ্গরা অনেক খুঁজে সীমাকে না পেয়ে আশ্রমের দিকে চললো। ওরা চোখের আড়াল হতেই যা ভাবা তাই কাজ। সীমা কাছাকাছি এক আদিবাসীদের বাড়ি গিয়ে উঠলো। ওকে দেখে আদিবাসী বৌটি তো প্রথমে হতবাক হয়ে গেলো। কী করবে ঠিক করতে পারলো না। মনের ভেতরটা আনন্দেে তোলপাড় করে উঠলো তার। সে এক গাল হেসে সীমাকে বললো , " তু ইখানে, কি হলো দিদি? তুর মরোদ কি তুকে তাড়াইন দিলে? উ তো ভালো লয় বটে"
" না রে ফুলমণি , সে অনেক কথা ,
আগে আমাকে একটু জল দে খেতে, গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে। "
" হঁ দিদি ,দিছি কেনে , কিন্তক কি হইনছে সেটা মুকে বলবিক লাই? "
" বলবো রে বলবো আগে জলটা খাই"।
এক চুমুকে সবটা জল শেষ করে, সীমা সব কথা ওকে খুলে বললো। বলতে বলতে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।
ফুলমণি তো সাঙ্ঘাতিক রেগে গেলো।
দিদিকে সে যেমন ভালোবাসে, পরিতোষকে তেমনি দু চক্ষে দেখতে পারে না।
রাগের মাথায় বলতে লাগলো ,
" হেই মধুর বাপ চল না কেনে, বাবুটোকে ধইরে লিয়ে আসি, বুঝাইন দিতে হবেক ইখানে দিদির লেগে হামরা আছি বটে, ইসব আমরা মাইনতে লাইরবো। "
"আচ্ছা বাবা আচ্ছা, এবার চুপ কর ফুলমণি
আমার তো কিছু হয় নি রে। "
" কি বইলছিস রে তু, হইতে তো পাইরতো। তখুন আমরা কি কইরতাম বল কেনে? তু তো আমাদের ভগবান আছিস। কত্তবার তু হামাকে বাঁচাইছিস , মনে লাই?"
ওদের ঘরে যা ছিল, তা দিয়ে রাতের মতো ভাতে ভাত খেলো সীমা। ওদের খাটিয়াতে শুয়ে পড়লো। রাতটা এভাবেই কেটে গেলো।
পরদিন সকালে উঠেই ফুলমণি ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলো। যদিও বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে সীমাকে ছেড়ে দিল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়েই পরিতোষের কাছে কিছু মিথ্যাচারণ করতে হলো।
পরদিন ঘরে ফিরে আসতেই পরিতোষ বললো, "সীমা, সাধুর ওষুধ খেয়েছো তো?"
- " হ্যাঁ, খাবার পর এমন ঘুম এলো , একঘুমে সকাল, ওরা বললো , এবার বাড়ি যাও, তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে।"
- " তাহলে সব ঠিকই আছে ।" বললো পরিতোষ।
নিজের অক্ষমতা আড়াল করতে মানুষ যে এমন ভয়ংকর পথ বেছে নিতে পারে সীমা কখনও ভাবতেই পারেনি।
সীমার বাবা মাঝেসাঝে মেয়েকে দেখতে আসতেন। কখনও কখনও সীমার দিদিও আসতো। তাদের অবশ্য সীমা নিজের কষ্টের কথা বলতো না। এতদিনে সীমা অনেক কাজই শিখে নিয়েছে। সে খুবই যত্ন করে তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতো। সে যে দুঃখ কষ্টে আছে কিছুই বুঝতে দিতো না তাদের কাউকে।
যথারীতি সীমা ঘর সংসারের সব কাজ সেরে আজও অপেক্ষায় রইলো পরিতোষের জন্য। সে মনস্থির করলো এবারে কলকাতায় গিয়ে একটা কোন ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের সন্তান যখন হবেই না, তখন দত্তক নিলে কেমন হয়? যদিও এ ব্যাপারে পরিতোষের একদমই মত নেই। কিন্ত সীমা যে তখন একটি সন্তানের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে।
এভাবেই কাটছে দিনগুলি এখন তার নিরানন্দ মনে, দুঃখের সাগরে ভেসে।
- "সীমা পেনশনটা তুলতে যাবে তো? ফেরার পথে তোমার যা দরকার কিনে এনো কিন্ত। "
- " কি ভালোবাসা এখন, যখন প্রয়োজন ছিল,
তখন তো এখানে ওখানে ছুকছুকানি করতে,
লজ্জাও করেনা তোমার?
কম তো ভোগাওনি, আজ কে পা ভেঙে দিল, কাল কে হাত মুচকে দিল, সব সেবাযত্ন তো আমাকেই করতে হয়েছে। জীবনের আসল সময় তো এভাবেই কেটে গেছে আমার। আর এখন দরদ দেখাতে এসেছে?"
সীমার মনে পড়ে গেল অতীতের যন্ত্রণার দিনগুলোর কথা। ওহ্ কি অসহনীয় অবস্থা ছিল।
ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেল সীমা
ফিরে গেল আলোহীন অতীতের আঁধারে।
বাবা ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে, ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "মেয়ে হয়েছো
অনেক সহ্য করতে হবে মা।"
বাবার স্নেহের পরশে সীমা নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।
বাবা সান্ত্বনা দিয়েই উঠে পড়লেন।
আসলে ছেলে মেয়েরা তাঁর বুকের পাঁজর। এদের কষ্ট তাঁর কাছে অসহনীয়।
ইতিমধ্যে শাশুড়ি মা এসে বললেন,
" চোখের জল মোছো বৌমা,
তোমাকে শক্ত হতে হবে
তোমার শ্বশুর সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়েছেন
দুজনের একই চরিত্রের
তোমাকেও অনেক কষ্ট যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে,
মনে জোর আনো।
নিজেকে শেষ করাটা কোনোমতেই ঠিক নয়।
চলো সকাল থেকে তো কিছুই খাও নি
কিছু মুখে দেবে চলো।"
সীমার শাশুডী যেন দুর্গাপ্রতিমা। যেমন গায়ের রঙ, তেমন সুন্দর মুখশ্রী। কাঁচাপাকা চুলে লাল টকটকে সিঁদুরে রাঙানো সিঁথি। কপালে জ্বলজ্বল করছে বড়ো সিঁদুরের টিপ। স্নেহের প্রতিমূর্তি , দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
সীমার মনে হলো, এই মায়ের এই ছেলে,
এই রকম হলো কি করে?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে শাশুড়ি মাকে অনুসরণ করলো। সারাটাদিন নিরাসক্তভাবেই সে দৈনন্দিন কাজকর্ম সারলো। রাত নামলো। খাওয়া দাওয়ার শেষে নিজের ঘরে তো যেতেই হবে।
কিন্ত সীমার একদম ইচ্ছে করছিল না সেখানে যেতে। মানুষটার মুখ দেখতে।
নিরুপায় হয়েই ঘরে গিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সীমা শুয়ে পড়লো।
তারপর মনে মনে ভাবলো, এভাবে কতদিন চলবে?
সব ভালোবাসা যেন শুষ্ক মরুতে পরিণত হয়েছে।
কত স্বপ্ন দেখেছিল, আজ সব ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল।
এখন কি করবে সে?
নিজের ঘরে ফেরার সব পথ বন্ধ তার।
মানিয়ে নিতে হবে সংসারে।
সেই চিরন্তন উক্তি,"মেয়ে হয়েছো,সব সহ্য করো "
সত্যিই তাই, মেয়েরা কতো অসহায়।
অন্যায় করছে জেনেও মুখ বুজে সব মেনে নিতে হয় তাদের।
সীমারও তেমনই হাত পা বাঁধা, অন্য মেয়েদের মতো।
বাবাকে কোনোমতেই কষ্ট দিতে পারবে না সে।
পড়া তো আর হলো না, সবই জলাঞ্জলী গেল।
এতো কম বয়সে মাথায় বিশাল বোঝা চাপলো , কপালে কোন সুখ লেখা নেই ।
এরপর গিয়ে পরিতোষের অফিসারদের হাতে পায়ে ধরে চাকরী বাঁচাতে হবে তার।
সাসপেন্ড মানে অর্ধেক মাইনে, কোয়ার্টারও নেই।
থাকবে কোথায়? কি করে চলবে তাদের?
সে তো একদম রান্না করতেও জানে না।
বাড়ির ছোট বলে সবার খুবই আদরে বড়ো হয়েছে। মা তাকে কখনও রান্না করার জন্য , রান্নাঘরে ঢুকতেই দেননি।
যাক যা হবার তো হয়েই গেছে। এবার নতুন জীবন শুরু করতে হবে।
কতো আশা করেছিল, সব শেষ হয়ে গেল।
এই মানুষটাকে সে ভালোবাসেছিল?
নিজের উপর নিজের খুব রাগ হলো খুব।
চিনতে এতো ভুল হলো তার?
মূল্যবোধহীন একটা মানুষ, সত্যিই কি সে মানুষ নামের যোগ্য?
এক আদর্শে মানুষ সে, আর এ তো চূড়ান্ত আদর্শহীনতার উদাহরণ।
হাওড়া থেকে ট্রেন।
হঠাৎ পরিতোষের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো
" কি এতো ভাবছো বলতো ?
অফিসারদের কাছাকাছি গিয়ে দুঃখ দুঃখ মুখ করে যা বলার বলবে এই আর কি"
কি সহজেই কথাটা বললো পরিতোষ। কোন গ্লানি নেই। নিজের অপরাধের বোঝা অন্যের ঘাড়ে নির্দ্বিধায় চাপিয়ে দিল। কী নির্লজ্জ সে।
অবশেষে চাকুরীস্থলে এসে পৌঁছলো।
অফিসারদের হাতে পায়ে ধরে চাকরীটা বজায় রইলো। একজন স্টাফের কোয়ার্টার ভাগাভাগি করে শুরু হলো নতুন জীবন।
এখন তো মাইনের প্রশ্নই নেই।
বিয়েতে যা পেয়েছিল সীমা তা থেকেই খরচ করতে লাগলো।
বাবার বাড়িতে কোনদিন খাওয়ার কষ্ট পায় নি।
আর এখন এই পরিস্থিতি তার?
আরও কত কষ্ট সহ্য করতে হবে কে জানে?
প্রতিদিনের এক নিয়ম, যখনই রান্নার যোগার করবে ঠিক তখনই কারেন্ট অফ হয়ে যায়।
জ্বালানির অন্য কোন ব্যবস্থা নেই। তাই হিটারে রান্না হয়।
টিফিন টাইমে কোয়ার্টারের মালিক এসে
জানতে চায়
" বৌদি আজও রান্না হয়নি তো ,
দিন দিন একসঙ্গে রান্না করেনি"
দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে তাদের।
সীমা ভাবে, এই কী জীবন !
পরিতোষের গুণের আরও কত কিছু যে তার অজানা ছিল।
অফিসে যাবার পর দরজায় নক করছে কেউ।
এখনও সীমার অবাক হবার পালা অনেক বাকি।
দরজা খুলেই দেখলো একটি ছেলে
" বৌদি , তোমার সঙ্গে একটু গল্প করতে এলাম
ঘরে ঢুকতে দেবে তো নাকি"
" আপনার দাদা যখন থাকবে তখন আসবেন"
এই বলে সীমা দরজা বন্ধ করে দিল।
ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে পরিতোষের প্রতি ঘেন্নার পাহাড় জমছিল।
অফিস থেকে ফিরেই পরিতোষের কি হম্বিতম্বি।
কেন তার বন্ধুকে বসতে দেওয়া হয়নি ঘরে?
ছিঃ ছিঃ ছিঃ !
তাহলে কি ভালোবাসা বলে কিছু ছিল না পরিতোষের মনে?
পরপুরুষকে উপঢৌকন দিতে চায় সীমাকে?
কোন কথাও সে বললো না এ ব্যাপারে।
মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে সে পালিয়ে যায় এখান থেকে। কিন্ত কোথায় যাবে?
এতো মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে বাঁচা যায়?
একটু শীতল প্রলেপ পেল সে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে।
প্রকৃতি দু হাত ভরে সাজিয়ে দিয়েছে চতুর্দিক।
যে দিকেই তাকায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। দেখে যেন, কষ্টের কিছুটা অবসান হয়।
জীবনের বসন্ত তো উধাও হয়ে গেছে কবে?
বাঁচার রসদ এবার তাকে সংগ্রহ করতে হবে
এখানকার পরিবেশ থেকে। নিরিবিলি নিশ্চুপ পরিবেশ। শুধু নানা ধরণের পাখির কলকাকলী ভরা সবুজের পরিবেশ।
কোকিলের মধুর গান, ভ্রমরের গুঞ্জন, নানা রঙিন ফুলের সুরভি।
সব মিলিয়ে মন ভালো হয়ে যায়। এখন আর
কিছু করার নেই, এদের আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে হবে তাকে।
যে এতোদিন ভালোবাসার নামে অভিনয় করেছে, আজ সেটা জেনে, বুঝতে পেরেও ফেরার পথ পাচ্ছে না সীমা।
নিত্য নতুন মেয়ের সঙ্গ প্রয়োজন পরিতোষের। তারা আবার দিনমজুর, কাজের লোক, আদিবাসী মহিলা।
এই নোংরা চরিত্রের কথা কোয়ার্টারে কারও অজানা ছিল না। পরিতোষের কাজের জায়গার সঙ্গী সাথীরাও একই ধরণের মানুষ।
এই ভাবে চলতে চলতে একদিন নিজেদের কোয়ার্টার হলো। পুরোপুরি মাইনেও পেতে লাগলো।
কিন্ত বেশিরভাগটাই চলে যেতো তার মেয়েমানুষ পুষতে।
পরিতোষের বাইরের রূপটার ভেতরে যে এতটা কদর্য একটা নোংরা মন আছে, এতদিন সবটাই সীমার অজানা ছিল।
মেয়েমানুষ পাল্টানোর এই যে কদর্য স্বভাব, প্রথম প্রথম সীমা তা বুঝতে পারতো না।
মাঝে মধ্যেই যখন মেয়েদের কাছ থেকে অভিযোগ কানে আসতে শুরু করল, তখন ধীরে ধীরে সবই
বোধগম্য হলো সীমার।
তখন মনে হতো কারও হাত ধরে বেরিয়ে যায় সে। কিন্ত সেই চিরন্তন পিতৃস্নেহ ,ভালোবাসার বন্ধন সে টুটবে কিভাবে?
একাকীত্ব কাটাতে একটা সন্তানের জন্য পাগল হয়ে উঠলো সে। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সব পরীক্ষা নীরিক্ষার পর জানা গেল, পরিতোষের অক্ষমতার কথা।
সীমার মানসিক অবস্থা লক্ষ্য করে পরিতোষ মনে মনে একটা মতলব আঁটলো।
কিছুদিন পর পরিতোষ সীমাকে যখন একটা অচেনা জায়গায় নিয়ে এলো, তখন সীমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ,
" এ তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এলে ?"
" এ একটা আশ্রম,একজন সাধু এখানে ওষুধ দেয়, যা খেলে তুমি সন্তান লাভ করবে। শুধু একটা রাত তোমাকে এখানে থাকতে হবে।"
কথাটা শুনে ভাবলোে, বলে কী পরিতোষ?
তবু পরম বিশ্বাসে সেখানে প্রবেশ করলো সীমা, দেখলো সারি সারি মেয়েরা এক-কাপড়ে সারা অঙ্গ কোনরকম ঢেকে প্রাপ্তির আশায় হত্যে দিয়ে বসে আছে।
হঠাৎ চতুর্দিকে সাজো সাজো রব উঠলো।
সাধু আসছেন, সাধু আসছেন।
চোখের সম্মুখে সাধুকে দেখে সীমা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল।
এ কাকে দেখছে সে? পলাশ সাহা? পাড়ার সকলে যাকে রাঙা পলাশ বলে টিটকারী দিত।
রমা বৌদির সঙ্গে কু-কীর্তি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, শেষে পাড়া ছাড়া হয়েছিল। পালিয়ে বেঁচেছিল পুলিশের হাত থেকে।
সে তো ভেবেছিল শ্রদ্ধার প্রতিমূর্তি কাউকে প্রত্যক্ষ করবে এখানে। কিন্ত তার পরিবর্তে লোভ , লালসা, ভোগী চেহারার এক মানুষ।
এখানেও দৃষ্টি দিয়ে সে সব নারীর সর্বশরীর লেহন করছে। মানুষ না বলে বোধহয় পশু বলাই শ্রেয় ।
সীমা মনে মনে প্রস্তুত হতে লাগলো।
নিজেকে বাঁচাতে যে করেই হোক এখান থেকে পালাতেই হবে। কিন্ত মাথায় তো কোন রকম বুদ্ধিই আসছে না। নিশ্ছিদ্র পাহারা। কি করবে এখন সে? এমত অবস্থায় কিভাবে বা কোথা দিয়েই ঘরের বাইরে নিয়ে যাবে নিজেকে?
ছোটবেলার লুকোচুরি খেলার কথা মনে পড়ল তার। এখানে সেরকম কিছু কায়দা কাজে লাগাতে হবে।
এই এলাকাটি বন জঙ্গলের মধ্যে। সুতরাং জানালা টপকে যদি কোন গাছে ওঠা যায়, তবে কিছুক্ষণ পরেই পরিস্থিতি বুঝে গাছ থেকে নেমে, আদিবাসী পাড়ায় পৌঁছে গেলেই নিশ্চিন্ত। কারণ সীমাকে ওরা খুব ভালোবাসে। মনে মনে ভাবলো , " কতবার ওদেরকে পরিতোষের কুনজর থেকে বাঁচিয়েছি , ওরা এতো সৎ যে কোন কিছুর বিনিময়ে নিজের সতীত্ব বিসর্জন দিতে রাজি নয়।"
এসব কথা ভাবনার মধ্যেও, সীমা কিন্ত তক্কে তক্কে ছিল, ওরা একটু অন্যমনস্ক হতেই, সে নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে, একটা জানলা টপকে একটা বড়ো গাছে উঠে পড়লো।
এদিকে সাধুর সাঙ্গ পাঙ্গরা অনেক খুঁজে সীমাকে না পেয়ে আশ্রমের দিকে চললো। ওরা চোখের আড়াল হতেই যা ভাবা তাই কাজ। সীমা কাছাকাছি এক আদিবাসীদের বাড়ি গিয়ে উঠলো। ওকে দেখে আদিবাসী বৌটি তো প্রথমে হতবাক হয়ে গেলো। কী করবে ঠিক করতে পারলো না। মনের ভেতরটা আনন্দেে তোলপাড় করে উঠলো তার। সে এক গাল হেসে সীমাকে বললো , " তু ইখানে, কি হলো দিদি? তুর মরোদ কি তুকে তাড়াইন দিলে? উ তো ভালো লয় বটে"
" না রে ফুলমণি , সে অনেক কথা ,
আগে আমাকে একটু জল দে খেতে, গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে। "
" হঁ দিদি ,দিছি কেনে , কিন্তক কি হইনছে সেটা মুকে বলবিক লাই? "
" বলবো রে বলবো আগে জলটা খাই"।
এক চুমুকে সবটা জল শেষ করে, সীমা সব কথা ওকে খুলে বললো। বলতে বলতে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।
ফুলমণি তো সাঙ্ঘাতিক রেগে গেলো।
দিদিকে সে যেমন ভালোবাসে, পরিতোষকে তেমনি দু চক্ষে দেখতে পারে না।
রাগের মাথায় বলতে লাগলো ,
" হেই মধুর বাপ চল না কেনে, বাবুটোকে ধইরে লিয়ে আসি, বুঝাইন দিতে হবেক ইখানে দিদির লেগে হামরা আছি বটে, ইসব আমরা মাইনতে লাইরবো। "
"আচ্ছা বাবা আচ্ছা, এবার চুপ কর ফুলমণি
আমার তো কিছু হয় নি রে। "
" কি বইলছিস রে তু, হইতে তো পাইরতো। তখুন আমরা কি কইরতাম বল কেনে? তু তো আমাদের ভগবান আছিস। কত্তবার তু হামাকে বাঁচাইছিস , মনে লাই?"
ওদের ঘরে যা ছিল, তা দিয়ে রাতের মতো ভাতে ভাত খেলো সীমা। ওদের খাটিয়াতে শুয়ে পড়লো। রাতটা এভাবেই কেটে গেলো।
পরদিন সকালে উঠেই ফুলমণি ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলো। যদিও বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে সীমাকে ছেড়ে দিল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়েই পরিতোষের কাছে কিছু মিথ্যাচারণ করতে হলো।
পরদিন ঘরে ফিরে আসতেই পরিতোষ বললো, "সীমা, সাধুর ওষুধ খেয়েছো তো?"
- " হ্যাঁ, খাবার পর এমন ঘুম এলো , একঘুমে সকাল, ওরা বললো , এবার বাড়ি যাও, তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে।"
- " তাহলে সব ঠিকই আছে ।" বললো পরিতোষ।
নিজের অক্ষমতা আড়াল করতে মানুষ যে এমন ভয়ংকর পথ বেছে নিতে পারে সীমা কখনও ভাবতেই পারেনি।
সীমার বাবা মাঝেসাঝে মেয়েকে দেখতে আসতেন। কখনও কখনও সীমার দিদিও আসতো। তাদের অবশ্য সীমা নিজের কষ্টের কথা বলতো না। এতদিনে সীমা অনেক কাজই শিখে নিয়েছে। সে খুবই যত্ন করে তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতো। সে যে দুঃখ কষ্টে আছে কিছুই বুঝতে দিতো না তাদের কাউকে।
যথারীতি সীমা ঘর সংসারের সব কাজ সেরে আজও অপেক্ষায় রইলো পরিতোষের জন্য। সে মনস্থির করলো এবারে কলকাতায় গিয়ে একটা কোন ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের সন্তান যখন হবেই না, তখন দত্তক নিলে কেমন হয়? যদিও এ ব্যাপারে পরিতোষের একদমই মত নেই। কিন্ত সীমা যে তখন একটি সন্তানের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে।
এভাবেই কাটছে দিনগুলি এখন তার নিরানন্দ মনে, দুঃখের সাগরে ভেসে।
- "সীমা পেনশনটা তুলতে যাবে তো? ফেরার পথে তোমার যা দরকার কিনে এনো কিন্ত। "
- " কি ভালোবাসা এখন, যখন প্রয়োজন ছিল, তখন তো এখানে ওখানে ছুকছুকানি করতে, লজ্জাও করেনা তোমার?
কম তো ভোগাওনি, আজ কে পা ভেঙে দিল, কাল কে হাত মুচকে দিল, সব সেবাযত্ন তো আমাকেই করতে হয়েছে। জীবনের আসল সময় তো এভাবেই কেটে গেছে আমার। আর এখন দরদ দেখাতে এসেছে?"
সীমার মনে পড়ে গেল অতীতের যন্ত্রণার দিনগুলোর কথা। ওহ্ কি অসহনীয় অবস্থা ছিল।
ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেল সীমা
ফিরে গেল আলোহীন অতীতের আঁধারে।
====================================
Arati Mitra.
267/3 Nayabad, Garia.
Kol. 700094