ফেবুর নাভিশ্বাস
প্রদীপ কুমার দে
ঘুম! বড় শান্তির! মৃত্যুর মতই! নিজেকে হারানো। এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে গেল। ঘুমিয়ে এত আনন্দ বোঝা যায় তাহলে মৃত্যুর পরও কি সব এমনই হবে?
বেশ ফুরফুরে হাওয়ায় হাঁটছি বিকালে পার্কের পাশ দিয়ে। চোখ এমনই একনজরে দেখে নিলাম রেলিংয়ের ধার ধরে এক তন্বী বাঙালি অল্পবয়সী সুন্দরী শাড়ি পরিহিতা, মাঠের মধ্যে ঘুরছে। বাঙালি মনে হল যে কেন তা জানি না, কিন্তু মনে হল। সেই কাউকে ভাল লাগলে আমরা যেমন কায়দা করে বলে দিই না, কোথায় যেন দেখেছি?
চোখ ঘুরিয়ে নিলাম কারণ ও দেখছিল। মেয়েটা সরে গেল।
আমি কিন্তু মাঠের বাইরে। হঠাৎ দেখি মেয়েটি সহসা মেন গেট দিয়ে বেরিয়ে আমার সামনে চলে এল।
টানা কাজল চেরা চোখ মেলে আমাকে একঝলক দেখে কৌতুহলের সঙ্গে আমার নামটা উচ্চারণ করেই পরম আগ্রহে জানতে চাইল,
-- কি ঠিক বলেছি?
আমি অবাক। ধপাস করে আকাশ থেকে একেবারে পাতালে, একি সম্ভব?
-- ভুল বলেননি, কিন্ত কি ভাবে?
-- ফেসবুক বন্ধু। আপনার লেখা পড়ি।
-- কিন্তু আমিতো আপনাকে পাইনি?
-- আমি লাইক কোমেন্ট কিছু করি না। পোস্টও করি না।
দ্যাখো কান্ড?
ফেসবুকের কি কেরামতি! পাঁচ হাজার বন্ধু। অথচ কেউ কাউকেই চিনি না। যত কমাই তত উইপোকার মত বাড়ে।
মেয়েটি কি ভাবল। আমাকে বললে ,
-- হ্যাঁ। বুঝেছি। আপনি এই বিষয়ে একবার একটা পোস্ট দিয়েছিলেন মনে আছে আমার। খুব ভাল লিখেছিলেন। আমি লাইক দিইনি ঠিকই কিন্তু কপি করে সেভ করে রেখেছিলাম।
-- সে কি? এযে মারাত্মক অন্যায়।
-- ধ্যুৎ! আমি ত বলেই দিলাম। দেখবেন তো বলুন। পড়ে শোনাই।
হায়রে কি অবস্থা। এক্ষণে এই সুন্দরীকে কি বলে অবজ্ঞা করি? তাও আবার আমার লেখা ওর সেভে? ভাবা যায়? অগ্যতা রাজী হলাম।
-- দেখি পড়ুন।
-- অনেকদিন কলকাতা ছাড়া। ভাল লাগছিল না। আপনাকে পেয়ে ভাল হল। আসুন মাঠে বসে পড়ে দিচ্ছি।
ও মোবাইল ঘেঁটে পড়তে শুরু করল,
পরিণতিঃ
এক কষ্টের, এক ব্যথার কথা লিখছি।
না লিখে পারলাম না।
সবাই না পড়ুক, যারা আমার খুব কাছের প্রানের, মনের বন্ধু তারা তো পড়বেই।
ফেসবুকে ৫০০০ বন্ধু, অর্থহীন। কমালেও রোজই বাড়ে। প্রতিদিন শো দুয়েক রিকোয়েস্ট আসে ফেরাতেও পারিনা। অনেকে আবার এসেই ম্যাসেঞ্জারে ' হাই' শব্দে ঘুম ভাঙ্গায়। আমার যতোটা মনে পড়ে চার -পাঁচবার আমি ৫০০০ কমিয়ে নামিয়ে দিয়েছিলাম। তাতেও কিছু সুবিধা হয়নি। অনেকে আসে ' লাইক' করতে নয়, পেতে।
আবার অভিযোগ ও জানায়, ভয় দেখায় ছেঁটে দেওয়ার, একবারো ভাবেনা যে তারা যেচে এসেছিল। যাক, এটা আমার নিজেকে বড়াই করার কথা নয় আমার দেখা জলজ্যান্ত একটা ছবি। কেউ কষ্ট পাবেন না, কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয় , নিজের কষ্টের কথা মাত্র শেয়ার করলাম।
আসলে আমি যেটা বলতে চাইছি তুমি আমার অতিথি, যখন আথিত্য গ্রহন করেইছো তখন আমার সবকিছু দেখো। প্রোফাইলে লিখেই রেখেছি আমি লেখালিখি করি সেখানে তোমার আগেই বোঝা উচিত তুমি কেন আসছো? হয় লেখা পড়তে, নয় লিখতে। আমার লেখা পড়ো আমি ভালোবেসে তোমার লেখা পড়বো। ছোট বড় কোন কথা নয়। অহংকারের কথা নয়, বারবার বলছি। কিন্তু' হাই'- 'হুই' করার জন্য অথবা প্রথমেই ম্যাসেঞ্জারে এসেই ' আমি বিপদে পড়েছি একটু সাহায্য করবেন - কিছু টাকা দেবেন? ' এটা কি ধরনের বন্ধুত্ব?
ফেসবুক থেকে আমি অনেক হীরে মানিক খুঁজে পেয়েছি তারা আমার প্রানের বন্ধু, হয়তো অনেককে আমি দেখিয়ওনি, কিন্তু তাতে কি ?
পৃথিবী গোল, ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলে হতেও পারে।
আমি খুশি , তাদের বড় ভালোবাসি, অনেকের সঙ্গে প্রায়শই ফোনে গল্প করি, এমনকি অনেকের পরিবারের একজন হয়ে পড়েছি।
তাইতো রোজই রিকোয়েস্ট এলে সুযোগ দিই, বন্ধু হওয়ার। প্রথমে আশা রাখি। যখন দেখি ফাজলামি করছে তখন ত্যাগ করি ,বিপদ আসার আগেই।
আমি ভীষণ বন্ধুপ্রিয়। বন্ধুদের ভালোবাসি। ব্যবহারিক জীবনে ছোটবেলা থেকে আমার অনেক বন্ধু, এখনো সকলেই প্রায় আমার সঙ্গে আছে এবং থাকবে। তাই আমি বড় খুশি। এখানে আছে প্রকৃত ভালোবাসা।
ফেসবুক বন্ধুদের কাছ থেকে অতোটা আশা করি না, তবুও ফেসবুকের মর্যাদা রাখার আহবান করি, না হলে সবটাই " ফেক " হয়ে যাবে যে।
আমি ঘোর বিষ্ময়ে তাকিয়ে ওই সুন্দরীর দিকে। ও হেসে ঝিলিক দিল,
-- আপনার নামটাতো বলেই দিলাম, আমার নামটা জানতে চাইবেন না?
আমি লজ্জিত। হাত জড়ো করে দিলাম। ঘাড় নারলাম, জানতে চাই তো ...
-- আমি রুদ্রাক্ষী দাশগুপ্ত।
মেয়েটার দাঁতগুলি মুক্তোর মত ঝিলমিল করে উঠল। চোখের চাউনি যেন নীল আকাশে দুখন্ড সাদা মেঘের ভেলা, হাসি মনমোহিনী। যেচে আলাপ করে এত আনন্দ দান এইপ্রথম আমি কোন নারীর কাছ থেকে পেলাম। আবার যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলার লোক কম।
আমি বললাম,
-- আপনার এলেম আছে বটে।
-- কলকাতায় থাকতাম এখন এখানে, চাকরি করি তাই।
-- এখানে কোথায় থাকেন?
আবার মিচকে হাসি।
-- ওই তো রাস্তার ওপারে ফ্ল্যাটে।
-- ওহঃ
-- চলুন না আমাদের বাড়ি?
-- সে কি?
-- হ্যাঁ। ওখানে আমার বাবা মা থাকে। গেলে আলাপ গল্প হবে। চলুনই না ....
বলেই রুদ্রাক্ষী ওর নরম তুলতুলে আঙুলগুলো দিয়ে আমার আঙুল ধরে নিল। আমার সর্বাঙ্গ শরীরে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হল।
একমিনিটের মধ্যে রোমান্স শেষ হয়ে গিয়ে ভয়ে ভীতু হয়ে গেলাম।
উরিঃ বাপরে এ কি কোন মায়াবী নারী? শক্তিময়ী না কি ছলনাময়ী? আমি কি তবে পেত্নীর কবলে?
এবার মনে হয়ে বড় নারীঘটিত কেস খেয়ে থানার লকআপ ঘুরে, হয় একেবারে ফাঁসি, নয়তো সেই যাব্বজীবন ঘানি টানার পাকারাস্তায়?
মেয়েটা সরি, রুদ্রাক্ষী খিলখিলিয়ে হেসে আমার হাতটা ধরে এক টান মারল,
-- ভয় পেয়ে গেলেন নাকি? আরে চলুন, কোন ভয় নেই আমি রক্তমাংসের এক অবলা নারী মাত্র।
আমি ওড় কব্জায়, ও আমায় টানছে ....
রুদ্রাক্ষী আমায় টানতে টানতে রাস্তা পার করিয়ে ওদের ফ্ল্যাটের লিফটে তুলে নিল। দরজায় গিয়ে বেল বাজাতেই এক বৃদ্ধ , দাঁড়ি গোঁফের মালিক, দরজাটা খুলে দিল,
-- এ কেডা রে? কারে ধরে আনছোস?
রুদ্রাক্ষী চোখের ইশারা করলো,
-- আগে ত ঢুকতে দিবা, পরে কইতেছি।
বৃদ্ধ সরে দাঁড়ালেন বটে, কিন্তু সন্দেহের চোখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাপতে লাগলেন, যেন বন থেকে সদ্য ধরে আনা কোন জন্তুরে দেখছেন।
রুদ্রাক্ষী হেসে ব্যাপারটা লঘু করতে চাইল,
-- আমার বাবা।
আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধাকে দেখিয়ে জানালো,
-- আমার মা।
আমি হাত তুলেও নামিয়ে নিলাম ভয়ে। দেখি উনিও অবাক বিষ্ময়ে,
-- কোথা হইতে জুটালি এই আপদেরে?
আমি ত থতমত।
ওই ওদের জানালো,
-- হইল গিয়া আমার বন্ধু।
ওর বাবা চেঁচিয়ে উঠল,
-- উল্টাসিধা জনেরে ঘরে লইয়া আনছিস ক্যান ?
মা খেদিয়ে উঠল,
-- হ্যারে, তোর কডা বন্ধু আছে রে? রোজ দু তিন খানে লইয়া আনতেছিস?
কথাগুলো শুনে গা জ্বলছিল। শেষ কথাটায় একেবারেই মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। নিজেকে মনে হল আমি ওর শিকার।
রুদ্রাক্ষীর মুখোমুখি হলাম। অত সুন্দর মুখটা ক্রমশই যেন পাল্টে যেতে থাকল। তাৎক্ষণিক এক পেত্নীর মুখ মনে হল।
ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর আরো কি ঘটবে, এই ভেবে। আর সময় নষ্ট না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এটা মনে হল সুন্দরীর তৈরী করা কোন ফাঁদ!
দরজা খোলাই ছিল। ভাবলাম এই সুযোগ। দৌড়ে বেরিয়ে একেবারে সিঁড়িতে নামলাম। আকস্মিকতায় সবাই হকচকিয়ে গেল আর আমি ততোধিক লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে নামতে থাকলাম।
রুদ্রাক্ষী হতচকিতের ঘোর কাটিয়েই উপর থেকে চেঁচাতে লাগল,
-- পালাচ্ছেন কেন? ও দাদা, ভয় নেই।
সিঁড়ি যেন আর শেষ হচ্ছেনা। ভয়ে আমার প্রান ওষ্ঠাগত, মুখ দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছি, দমবন্ধ করা অবস্থা, রাস্তায় পড়তে চাইছি, খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না, কেন?
মুখ দিয়ে ঘোঁ ঘোঁ আওয়াজে দরদর করে ঘামছি, কি করব বুঝতেই পারছি না।
স্ত্রী গজরাচ্ছে,
-- কি হয়েছে? কি হয়েছে?
কানে আসছে। উঠে বসার চেষ্টা করছি। চারদিকে চেয়ে আছি ফ্যাল ফ্যাল করে কিছু খুঁজছি, কিছু মনে করার চেষ্টায় আছি।
মেয়ে চেঁচাচ্ছে,
-- কি স্বপ্ন দেখছিলে নাকি? মা একটু জল দাওতো।
জল সিঞ্চন হল। মুখেও ধরলো। জল খেয়ে কষ্ট অনেকটা কমল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্তি হল। প্রান ফিরে পেলাম যেন।
দুপুরের অকাল ঘুম। পেটে ভাল লাঞ্চ সঙ্গে আফ্রিকান গ্রাফসের জুস আর শীতকালীন চড়া গরমের যোগেই যে আমার এই এত বড় প্রাপ্তি, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্বার্থক এই ঘুম, শুভালভ, স্বপ্ন আর সুন্দর একটা প্লট।
স্বপ্ন বটেই .....
যাচাই করে তবেই না।
============================
প্রদীপ কুমার দে
বিরাটী আবাসন
এল আই জি -৯
এম বি রোড
নিমতা
কোলকাতা -৭০০০৪৯