কাতর চোখের দৃষ্টি , তাকিয়ে আছেন বিপিন বাবু, কাছে ডাকছেন, ঠিক আগের মতই ব্যাস্ত সমস্ত ভঙ্গী ! " বিমলা, আর কতদিন একা একা থাকব ? আমি আর কত অপেক্ষা করব বলো তো ? নিজের সব কাজ এখানে নিজেই করতে হয়, এই করে আমার এখানে কুড়ি বছর কেটে গেল। হাতে পায়ে আমার আর জোর নেই। তুমি আজকাল আমাকে যেন চিনতেও পারোনা ! সেই আগের মত তোমার সেবা পাব, সেই আশাতেই তো এতদিন বসে রইলাম। এবার সময় হয়েছে। এই যে আই, সি ইউ তে দশ দিন কাটিয়ে ছেলেদের এত টাকা খরচা করালে, তোমার কঠোর মনে কি একটুও দয়া নেই ? তুমি চিরকাল যে স্বার্থপর ছিলে তাই রয়ে গেলে। আমার বেঁচে থাকার শেষ একবছর তুমি আমাকে দিয়ে আমার ছাড়া জামা কাপড় কাচাতে, মনে আছে ? আমার পাজামায় পেচ্ছাপ হয়ে যেত তাই তুমি কত ঘেন্না পেতে !" বলতে বলতে বিপিন বাবুর চোখের চাউনি কঠোর হয়ে উঠল !
এই মানুষটা তার শরীর ভোগ করেছে শুধু , তাকে ব্যবহার করেছে, নিজের কাজে লাগিয়েছে, ভালবাসার ভাণ করে গেছে কিন্ত সত্যিই কি ভালবেসেছে ? তার সতেরো থেকে সাতাশ বছর বয়স অবধি তাকে পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য করেছে। ওনার মৃত্যুর পরেই একমাত্র জীবনে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পেরেছেন বিমলা। এসব কথা তো কাউকে কখনও বলতে পারেননি। চিরকাল সতী স্বাধী স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন। বড় করে সিঁদুরের টিপ পরতেন, সিঁথি জোড়া চওড়া সিঁদুর দিতেন, যতদিন উনি বেঁচে ছিলেন, সুখী গৃহিনীর ভূমিকায় সফল অভিনয় করে গেছেন। তবে বলতে নেই স্বামী তাঁর আঁচল ধরাই ছিল ! কিন্ত ঐ যে, ওনার নানা চাহিদা মেটাতে মেটাতে জীবন একেবারে জেরবার হয়ে গেছিল। এত খেতে ভালবাসতেন, বাজার থেকে রোজ কাঁড়ি কাঁড়ি শাক সবজি, নানারকম মাছ আনার শেষ ছিল না। কোনও রান্নার লোক রাখার আর্থিক ক্ষমতা ছিল না, এতবড় সংসারের গুঁতো তাকেই সামলাতে হয়েছে। সরকারী চাকরী ছিল না, প্রাইভেট কোম্পানির মাঝারি চাকরী করে এতবড় সংসার টেনেছেন বিপিনবাবু। রিটায়ারড হয়ে ছেলেদের কাছে হাত পাততে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত । তবে বিমলা চিরকাল ছেলেদের কানে " বাবা মা ই হচ্ছে আসল ভগবান " এ হেন আপ্তবাক্য বর্ষণ করে গেছেন ছোট থেকেই, তাতে তারা বড় হয়েও বাবা মা কে সম্মান করতে ভোলেনি।
বউ রা এসে যাতে সেই সুশিক্ষায় জল না ঢালতে পারে সেদিকেও সজাগ ছিলেন। তাকে নিয়ে বউদের হাসাহাসি চলে, এক জায়গায় হলে, এটা টের পান ! তবে আমল দেননা, যতদিন ছেলেরা হাতের মুঠোয় আছে ততদিন তিনি কারো পরোয়া করেননা।
বিমলা র ঘুম ভেঙে গেল, কঁকিয়ে গোঙানি শোনা গেল, " যাবনা, আমি যাবোনা আর তোমার কাছে। " রাতের
আয়া সুতপা, ঘুম চোখে মিচকে হেসে ডাকে, " ও মাসীমা, কোথায় যাবেন না? কার কাছে যাবেন না?" ঘুমের ঘোর লাগা চোখে আঙুল তুলে দেওয়ালে বিপিন বাবুর ছবির দিকে দেখান। সুতপা কাজে লাগার পরে প্রায় দিনই এ হেন ঘটনা ঘটছে।
আয়া স্বান্তনার সুরে বলে, " আচ্ছা আচ্ছা, আপনাকে যেতে হবে না, ঘুমান আরও, সবে ভোর চারটে বাজে। "এরপর সুতপা তো ঘুমিয়ে পড়ে কিন্ত বিমলার মনে স্বপ্নের রেশ থেকে যায়। চিরকাল তিনিই সবাইকে চাপে রেখেছেন, এখন অন্যরা তাকে চাপ দিচ্ছে। দুঃসহ অবস্হা চলছে !
তাকে অসুস্থ দেখে এই ভোর বেলার পাতলা ঘুমের মধ্যে সবাই আসে। বিপিন বাবু মানে তার পরলোকগত স্বামী প্রায় দিনই, এমনকি দিনের বেলায়ও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্হায় এসে তাকে জাগিয়ে দিচ্ছেন।
কী জ্বালাতনে পড়েছেন বিমলা। মাত্রই তো তার এখন অষ্টাশী বছর বয়স হল, এই কী তার যাবার সময়? এখনও কত দিন তার বাঁচার সাধ। বিপিন চন্দ্র তালুকদার আশি বছরে ক্যানসারে চলে গেছেন বলে কী তাকেও যেতে হবে? এ কী আবদার ! এতদিন ইনি তার ধারে পাশে ঘেঁসতে পারেন নি। কারণ তিনি দিব্য সুস্থ ছিলেন। এখন একটু ঠান্ডা লেগে ভাইরাল জ্বর আর তার থেকে নিউমোনিয়া যেই না হয়ে গেল এরা এখন তার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।
হাসপাতাল থেকে বাড়ী চলে এলেন জেদ করে, ডাক্তারদের কথা না শুনে। হাতের স্যালাইন টিউবের নল ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিলেন বলে ওয়ার্ডের নার্সরাও ভয় পেয়ে যাচ্ছিল, ছেলেদের ভয় হচ্ছিল মা বোধহয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। ঈষৎ পাগলামির নাটক না করলে বোধহয় আরও দুদিন হাসপাতালেই আটকে রাখত।
মাঝে মাঝে দুদিন তিনদিন দাদা আর ভাই এসেও ঘুরে গেছে। " ওরে বিমলা, তোর সময় হয়ে গেছে, আর কত মাটি কামড়ে পরে থাকবি, চলে আয় এইবেলা, দিদি তো কতকাল আগে থেকে এসে বসে আছে। আমরা ভাইবোনরা আবার তাহলে এক জায়গায় হয়ে একটু সুখ দুঃখের গল্প করতে পারব। " দাদা ঠিক সেই আগের মত মৃদু মৃদু হেসে বলে। ভাই আবার আরও সরেস, সে একদিন গভীর ঘুমের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছিল তাকে। বলে, " দিদি, তোমার বিষয় আসক্তি এবার ত্যাগ করো, অনেক হয়েছে। হরিনাম জপতে জপতে চলে এস, এমন শান্তির জায়গা ছেড়ে তুমি ওখানে কেন পড়ে থাকতে চাও?"
এদের কে বোঝাবে, তার সাধ এখনও মেটেনি। এই তো হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফেরার সময় রাস্তায় দেখে এলেন এক জায়গায় ইলিশ উৎসব হচ্ছে! আহা ইলিশ মাছের স্বাদ কী স্বর্গে পাবেন? কচু দিয়ে ইলিশ মাছ, ভাপা ইলিশ, কালোজিরে কাঁচালঙ্কার ইলিশ, এইসব সুখাদ্যের মধ্যেই তো স্বর্গ লুকিয়ে আছে। এসব বোকা গুলোকে সেকথা কে বোঝাবে?
এরা তো ঠিক আছে, এককালে তার আপনজন ছিল, কিন্ত বিপদ আরও বেড়েছে, তিন ছেলের বউদের বাবা মায়েরা এসেও খুব জ্বালাচ্ছে ! সবাই তো এখন ওপারে !
বড় বৌমা র বাবা তার ছেলেবেলাতেই ইহলোক ত্যাগ করেছিল বলে তার সঙ্গে দেখা হয়নি। ছোট বয়সের সেই পিতৃহারা মেয়েটি এবং তার আরও দুই ছোট ভাই বোন কে বড় হতে হয়েছিল কাকা জ্যাঠাদের আশ্রয়ে। তাদের মা ও পরিস্থিতির চাপে পড়ে আর কিছুটা স্বভাব গত ভাবেও বড়ই নিরীহ টাইপ ! অপুষ্টিতে ভোগা খুব ছোট খাটো, শীর্ণ দীর্ণ এক মহিলা। মেয়ে কে তেরো বছরের বড় এই ছেলে র সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তিনি দায়মুক্ত হতে চেয়েছিলেন। কানে কম শুনতেন বলে বিমলা তাকে কম খোঁটা দেননি। কারণে অকারণে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার করে তুলেছিলেন। সেই নিরীহ মানুষটাও এখন কিনা এসে তাকে চোখ পাকাচ্ছে !
কানের কাছে বসে ঘ্যান ঘ্যান করে কত কথা বলে যাচ্ছে।
" দিদি, আপনি তো কোনও দিন আমার মেয়েকে শান্তি দেননি, বিয়ের পর থেকে তাকে আপনার জুলুমবাজী সহ্য করতে হয়েছে। আমাদের পণ দেবার ক্ষমতা ছিল না, তাই নিয়ে আপনার কত হেনস্থা আমার মেয়ে মুখ বুজে শুনে গেছে। এবার একটু রেহাই দিন মেয়েটাকে। মেয়ের আমার দুঃখের কপাল। তিন বছর বয়সে ওর বাবা মারা গেল, কত লাথি ঝাঁটা খেয়ে আমার শ্বশুর বাড়ীতে কাটিয়েছি। তাই তো ওর কাকা জ্যাঠাদের আনা এই সন্বন্ধতেই হ্যাঁ করেছিলাম, বয়স নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। জামাই আমার বলতে নেই , মানুষ ভাল ! কিন্ত তখন তো বুঝিনি মেয়ে এক আগুন থেকে আর এক অগ্নিকুন্ডে এসে পড়ল। আপনি আর দাদা দুজনে মিলেই তাকে কথা শুনিয়ে গেছেন। 'হাতে মাথা কাটা ' যাকে বলে ! অসুস্থ হবার আগে পর্যন্ত হোম ডেলিভারির খাবার খেলেন। বছর দশেক আগে একবার মেয়ের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে, হোম ডেলিভারি খাওয়া ধরলেন, তাতে করে মেয়েটা একটু আরাম পেয়েছিল। নিজের সংসারের পয়সা বাঁচাতে সে বেচারা উদয়াস্ত খাটে। কাজের লোক রাখেনা, চারজন লোকের রান্নার ঝামেলা পোয়ায় ! সংসারের বাকী সব কাজ একা হাতে করে যাচ্ছে। ওর ছেলেটা বড়, তাকে ছোট বেলায় এত অতিরিক্ত আদর দিলেন, ওর বাবা মাকে ঠিক করে মানুষ করতে দিলেন না। ওকে নিজের কুক্ষিগত করে রাখার কূটবুদ্ধি তখন কাজে লাগিয়ে ছিলেন। ফলে নাতি টা আমার ঠিক মত মানুষ ই হলনা। কীরকম দরকচা মেরে গেল সবকিছুই।
এখন আবার হাসপাতাল থেকে ফিরে বায়না ধরলেন, আর হোম ডেলিভারির খাবার খাবেন না। সে ঠিক আছে, কিন্ত মেয়েটা আমার খেটে মরে যাচ্ছে দেখে কোন মা শান্তিতে থাকতে পারে বলুন ?
মেয়েকে সারাজীবন তো কম কথা শোনাননি! আপনার যা চোখা মুখ ছিল, আমি তো আপনাকে রীতিমত ভয় পেতাম।
কাজের লোকদের সঙ্গে আপনার ঝগড়ার চোটে বাড়ীতে কাক চিল বসতনা। বয়সের ভারে আপনার চোপা একটু কমেছে ঠিকই ! তবে কী জানেন, স্বভাব আপনার একটুও বদলায়নি, ওটা চিতায় উঠলেই যাবে। তা, এই তো একটা সুযোগ ছিল এপারে আসার, সেটাও এমন জেদ ধরলেন, যমদেব ও হাঁপিয়ে উঠল ! তবে এবার একদিন এমন কষে ধরবেন তিনি , আপনি পার পাবেন না।" বলে ঠা ঠা করে হেসে উঠে বড় বৌ এর মা কোথায় দৌড়ে পালালো ! তবে এসব শুনে কি স্থির থাকা যায়, বুকের মধ্যে কাঁপুনি ধরে !
এ তো তাও একরকম, মেজো বউমার বাবা মা আবার ডিভোর্সী। মা উচ্চ শিক্ষিত, স্কুল টিচার, অমায়িক মানুষ ! তার স্বামী বিপিন বাবু আবার সব সময় অন্য মহিলাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন। মেজো বউমার মায়ের মার্জিত কথাবার্তা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। একসময়ের কম্যুনিস্ট পার্টি করা মহিলার সঙ্গে বসে বসে রাজনীতির আলোচনা করতেন। বিমলার বিদ্যা ক্লাস সেভেন অবধি। এইসব মহিলাদের উপর ঈর্ষার জ্বালাকে আড়াল করার জন্য এদের ওপর সবসময় এক হাত নিতেন ! ঠেস মেরে কথা বলে সুখ পেতেন।
ভগবান তাকে মুখ তো দিয়েছেন, চেহারাও তার মন্দ নয়। তিনি এসব শিক্ষিতদের থোড়াই ভয় পেতেন?
মেজ ছেলে টাই সব কটার মধ্যে সেরা ছিল। সে খড়্গপুর আই আইটি র পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার, করে বসল লাভ ম্যারেজ !
মেয়েটি তাদের আগের পাড়ার, সুন্দরী, শিক্ষিতা। বিয়েতে বাধা দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পারেন নি। ছেলে তাহলে হাতছাড়া হয়ে যেত। কিন্ত এমন ছেলের বিনিময়ে কত পণ ঘরে আনতে পারতেন ভেবে তাদের স্বামী স্ত্রীর অনুতাপের শেষ ছিল না। তবে বিপিন বাবুর আবার হবু ছেলের বউ কে দেখে ভীষণ ভাল লেগে গেল ! ঐ যে সুন্দর মুখ দেখলেই গলে যাওয়ার স্বভাব। মেজো ছেলের বিয়ের পর এই বউমা হয়ে উঠল খুব প্রিয়।
সেই মেজ বউমার মা ও ধীর স্থির ভাবে মাঝে মধ্যেই কাছে আসছেন। এসে তার মধুর স্বরে অনেক কথা বলে, অনেক অনুযোগ জানিয়ে যাচ্ছেন। " মনে আছে, আমার শান্ত মুখচোরা মেয়েকে যখন একা পেতেন, আপনি কত খারাপ কথা বলেছেন ? আমার মেয়ে বা আমি কেউই সেসব কথা ভুলিনি, আপনি চীৎকার করে বলেছিলেন, তোমার মা যা, যা গয়না দিয়েছে সব খারাপ, মাকে বলবে সব আবার নতুন করে বানিয়ে দিতে। আমার অমন হীরের টুকরো ছেলেকে একটা হীরের আঙটি যাও বা দিলেন সেও আবার আঙুলে ছোট হয় কী করে ?"
"মেয়ে তো জানত তার মা কত কষ্ট করে তাকে গয়না দিয়েছে, তাই এসব কথায় তার দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল পড়ত তখন ! প্রথম দিকে আপনার বাক্য বাণ শুনে এসে তাও আমার কাছে বলত, শেষের দিকে বলত না আর, পাছে আমি কষ্ট পাই তবে আমি বুঝতাম মেয়ে আমার চাপা স্বভাবের, তাই বলছে না কিছু , কিন্ত কলকাতায় যখনই আসত তার অশান্তি টের পেতাম। । কী ভাগ্যিস জামাই চিরকাল কলকাতার বাইরে চাকরী করেছে। আপনার এখানে থাকলে বোধহয় সেও আমার মতই বাধ্য হত ঘর ছাড়তে। " "মেয়ের ভদ্র স্বভাবকে আপনি দূর্বলতা বলে ভুল করেছিলেন। যদিও আপনার বিষবাক্য সে চুপ করে শুনেই গেছে, উল্টে জবাব দেয়নি কোনও দিন। আমার শিক্ষায় সে বড় হয়েছে তো ! তাকে নিয়ে এটুকু গর্ব আমার আছে। হবে নাই বা কেন বলুন ? আমরা ছিলাম জমিদারের ফ্যামিলি, বাবা ছিলেন কলেজের প্রফেসর, স্বাধীনতা সংগ্রামী। আমার স্বামীর পারিবারিক আভিজাত্য আর শিক্ষা দীক্ষাও আপনার কল্পনার বাইরে ।
নেহাত আপনাদের কপাল গুণেই এমন পরিবারের মেয়েকে বিবাহ সূত্রে পেয়েছেন। "
" আপনার এই মেজ ছেলে এমনি ভালই , তবে শত হলেও আপনার ই তো ছেলে, ছোট র থেকে দেখেছে মানুষের সঙ্গে বিশ্রী ভাবে মা কথা বলে। তার কিছুটা তো অবশ্যই থাকবে ছেলেদের মধ্যে। তাই না ? "
কাঁহাতক অন্য মহিলার মুখে এইসব জ্ঞানের কথা সহ্য করা যায় ! বিমলা ঘুমের মধ্যে কান চাপা দেন আর মুখ থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হয়।
সকালের আয়া লক্ষী এসে তাকে জাগায়। " মাসিমা যে কত স্বপ্ন দেখেন ঘুমের মধ্যে তার ঠিক নেই !" " একটু উঠে বসুন দেখি, বিছানা তো আবার ভাসিয়েছেন, পরিস্কার করে দিই। " বিমলা র ঘুম চটকে গেল! হাতী দয়ে পড়লে একটা পিঁপড়েও তাকে লাথি মারে, ওনার হয়েছে এখন সেই অবস্হা। এই কোথাকার মেয়ে, দুদিন একটু আয়াগিরি করে, এসেছে ওনার সঙ্গে কর্তালি করতে। বেশ করে দিলেন মুখ ঝামটা ! " অ্যাই চোপ, একদম মিথ্যে কথা বলবে না। ভোর রাতে আমি বলে বাথরুম গিয়ে সব সেরে আবার এসে শুলাম। সুতপা আমাকে ধরে ধরে নিয়ে গেল আমার পরিস্কার মনে আছে।" "কোথায় বিছানা ভেজা , কোথায়?"
লক্ষী হেসে বলে, " ও মাসীমা মিথ্যা বলে আমার লাভ কী ? আপনি যদি বলেন, আমি পরিস্কার করবনা, কিন্ত তাতে আপনারই ক্ষতি হবে। আমার বরং কাজ কমে যায় ! "
বিমলা বুঝলেও গজগজ করতে লাগলেন, " দাও আমার শাড়ী টা, শাড়ী পরব আমি, এসব ম্যাক্সি ফ্যাক্সি আমি পড়বনা, আমাকে বুড়ী সাজাতে চায় বড় বৌমা। দরকার নেই তাও হাসপাতাল থেকে আসার আগেই তিন খানা ম্যাক্সি কিনে আনল ! ভাব দেখাচ্ছে যেন কত দরদ ! সব জানা আছে আমার !" লক্ষী এসব কথায় কান দেয়না, নিজের কাজ করে। বাবুদের বাড়ী বাড়ী আয়া র কাজ করে দেখেছে, এদের সংসারের মধ্যে কত জটিলতা আর কূট কচালি !
মাসীমার সকালের সব প্রাতঃকৃত্য , প্রাতঃরাশ করিয়ে তাকে বিছানায় আধশোয়া করে বসিয়ে ঘর দোর পরিস্কার করতে আর কাপড় কাচতে গেল! ওমা, কিছুক্ষণের মধ্যে এসে দেখল মাসীমা আবার ঘুমে ঢলে পড়েছেন। এইসব কড়া কড়া ওষুধ খাইয়ে অসুখ সারিয়ে দেয় ডাক্তাররা কিন্ত শরীরকে একদম কমজোরি বানিয়ে দেয়।
বিমলা হঠাৎ দেখলেন, পাশে একজন রাশভারী দাড়িওয়ালা বুড়ো মত লোক বসে আছেন। আ, মরণ দশা ! এ লোকটা আবার কোত্থেকে এল? চোখ কচলে ভাল করে ঠাওর করে দেখে বুঝলেন এ হচ্ছে মেজো বউমার বাবা।
বাবা মা র ছাড়াছাড়ি হলে কি হবে, মেয়ের সঙ্গে বাবার খুব পীড়িত ছিল। তাদের এককালের পুরনো পাড়ায় এনাকে সবাই খুব সমীহ করত ! খুবই ভদ্র, বিনয়ী, রাজনীতির জগতের মানুষ ছিলেন। স্বামী স্ত্রীর কী জন্য বনিবনা হয়নি তা জানা নেই , বিপিন বাবুর এক সময়ের পরিচিত জন ছিলেন ! তা ইনি আবার কী বলতে এলেন?
গম্ভীর স্বরে আরম্ভ করলেন, " আমার মেয়েকে অনেক দুঃখ দিয়েছেন, মেয়ে কোনদিন নালিশ করেনি বটে তবে এখন তো আমি সবার সব মনের কথা জানতে পারি, আপনি যা যা বলে তার মনোকষ্টের কারণ হয়েছিলেন তাও জেনেছি।
আগে আমি সব সাংসারিক ব্যাপারেই খুব উদাসীন ছিলাম কিন্ত এখন আমার অন্তরদৃষ্টি খুলে গিয়ে বোধদয় হয়েছে।
আপনি কেমন মানুষ বলুনতো ! আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার কথা ! যখন আমি শেষের দিকে একটু অসুস্থ ছিলাম ! মেয়ে বলেছিল , ' বাবা মোটামুটী আছেন' আপনি তখন বললেন, ' এবার উনি গেলেই ভাল হয়।' একথা কেউ বলে ? বাবা র মৃত্যু কামনা করছেন তারই মেয়ের সামনে। আজকে আপনার যা অবস্হা, এই সময় যদি আপনার সম্পর্কে একথা কেউ আপনার ছেলে মেয়েদের বলে, কেমন লাগবে শুনতে? " প্রবল ভর্ৎসনা র দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে গেলেন বিমলা। লক্ষী এসে ডাকতে লাগল, " ও মাসীমা, এমন কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে আছেন কেন?" উঠলেন আস্তে আস্তে। এসে বসলেন বাইরের ঘরের সোফায়। " আমি ঘুমুচ্ছি নাকি তুমি ঘুমোচ্ছো ? " এদের সব সময় চোখ রাঙিয়ে রাখতে হয় ! ওনার মাথায় চড়ে বসবে এমন লোক পৃথিবীতে হয়নি আর হবেও না।
'এরা সবাই আমাকে বাজে কথা বলছে, বোকা বানাতে চাইছে, আমি কি কিছু বুঝিনা? আমার কোনও অসুখ ও করেনি, মরার কথা তো ওঠেইনা। বললেই হবে, আমার এখনও অনেক দিন আয়ু ! ' বিড়বিড় করে বলেন বিমলা। কথা বলতে গেলে জিভ টা কাঁপে, ফলস্ দাঁতে ভর করে মাংস খান, কানে কম শোনেন, হাঁটতে গেলে পা ঘষে চলতে হয় ! তো কি হয়েছে ? এখনও দুবেলা মাটন খেয়ে হজম করেন, একটু আধটু পাতলা দাস্ত সবার হয়, ওসব উনি কেয়ার করেননা । বিকেলের দিকে মন্দিরে যাবার নাম করে বেরিয়ে চপ সিঙারা খেয়ে ফেরেন। জীবনকে উপভোগ করছেন রীতিমত। মরলেই হল ! এইসব অনামুখোরা আগে চলে গেছে তাই আমাকে দেখে হিংসায় জ্বলে।
দিন দুই কেটে যায় , ঘুমটা একটু ভাল হচ্ছে এখন। কুড়িটা ওষুধ খেতে হয় সারাদিনে। ডাক্তার কে আর কদিন পরেই দেখাতে যেতে হবে। বড় ছেলে আর আয়া নিয়ে যাবে। খুব সেজে যাবেন। লক্ষীকে বলবেন, আলমারির থেকে একটা ভাল দামী শাড়ী বের করে পরিয়ে দিতে। আমাকে অসুস্থ দেখেছে ডাক্তার, রুগী বানিয়ে রাখতে চায় তাই। সবার বদমাইশি বোঝেন তিনি। এবার দেখবে কত ধানে কত চাল ! গতকাল ঘরের ঝুল ঝেড়েছেন নিজের হাতে, ডাক্তার টাকে শোনাতে হবে এসব কথা। লক্ষী তো, "মাসীমা করবেন না করবেন না," করে বাধা দিতে এসেছিল, বলেছেন, " একদম ন্যাকামী করবে না, সুস্থ মানুষ আমি, রুগী সাজিয়ে রাখলে তোমার খুব মজা হয় না ? বসে বসে ডেইলি চারশো টাকা করে নিচ্ছ ! " লক্ষী চুপ করে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল।
কাল রাতে আবার স্বপ্ন দেখেছিলেন এক দম্পতির, তার ছোট বউমার বাবা মা। এদের আপাত দৃষ্টিতে বেশ সদ্ভাব দেখেছিলেন। মহিলা ছিল খুব জাঁদরেল, ইনিও চাকরী করতেন। বয়সে তার থেকে অনেক ছোট হলেও সব পটাপট মরে গেল। মহিলাকে তিনিও সমঝে চলতেন। ভদ্রলোক নিরীহ ধরনের, তবে কালকে দুজনেই হাত ধরা ধরি করে এসে যেন কত কী বলে যেতে লাগল। তার সম্পর্কে খারাপ খারাপ কথাই বলছে ওরা, এইটুকুই বুঝতে পারলেন। তিনিও দুহাত দিয়ে ওদের ঘাড়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে লাগলেন। কিন্ত কিছুতেই যাবেনা !
রাতের আয়া সুতপা হঠাৎ চীৎকার করে বলে উঠল, "ও মাসীমা আপনি ঘুমের ঘোরে কোথায় সরে এসেছেন, পড়ে যাবেন তো এবার আমার ঘাড়ে। "
স্বামীর মৃত্যুর পরে গোটা মাঝারি খাটটা জুড়ে একাই আরাম করে শুতেন, এখন সুতপা ঠিক তার বিছানার নীচে শুচ্ছে। মাঝরাতে ধড়মড় করে উঠে পড়তে হল ! ওঃ এই দুঃস্বপ্ন গুলো কবে যে পিছু ছাড়বে আমার ! মনে মনে ভাবেন ! ঘুমের ওষুধ খেয়েও আজকাল আর তেমন ঘুম আসতে চাইছে না। বাকী রাত টা বোধহয় জেগেই কাটাতে হবে।
কবে যে আসবে তার সুদিন ফিরে! একঠায় বসে বসে যত রাজ্যের ছাইপাঁশ বাংলা সিরিয়াল দেখা। শাশুড়ীদের কিভাবে বৌমাদের সঙ্গে কড়া হতে হয়, মানুষ হল শক্তের ভক্ত, কিভাবে সেই শক্তি প্রদর্শন করতে হয়, ইত্যাদির কলা কৌশল মন দিয়ে শিখতেন। বড় মেয়ে মাকে তার পুরনো স্মার্ট ফোন দান করেছিল বছর দুয়েক আগে। সেখানের হাল হকিকত বুঝতেও তার খুব বেশী সময় লাগেনি। ছেলে মেয়েদের আর বিশেষ করে বৌমাদের সঙ্গে কম্পিটিশন করে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করছিলেন।
কে বলবে তার বয়স হয়েছিল ! ইয়ংদের হার মানিয়ে দিব্যি ছুটছিল তার জীবনের গাড়ী ! এবারের বেহাল অবস্হা কাটবে কবে ? পূজো আচ্চায় তেমন আস্হা নেই, তবে লোক দেখানো ভরং নিত্যই করে যান। এতদিন ধরে যে জল, প্রসাদ, ধূপ ধূনো করলেন, ভগবানের কী সেকথা মনে পড়ছেনা? বুঝতে কেন পারছেনা, বিমলা আরও বাঁচতে চায়!
==================
কাকলী দেব , কলকাতা ।