নবকুমারের দুগ্গা দর্শন
মিঠুন মুখার্জী
নদীয়ার শান্তিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে নবকুমার কোনদিন কলকাতা দেখেনি। কৃষক বাবার ছেলে হওয়ায় অভাবের মধ্যে কোনো মতে এইট পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছিল সে। 'কলকাতায় নাকি বিরাট দুর্গাপূজা হয়'--- এমনই শুনেছে সে তার বাবার কাছ থেকে। কিন্তু কোনদিন দুচোখ দিয়ে সে দেখেনি। সেবার সমগ্ৰ বঙ্গে বন্যা হয়েছিল। সালটা ২০০০ ছিল। নবকুমারদের চাষের জমি, বাড়ি সবই জলের তলায় চলে গিয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে বাবা- মার সঙ্গে কলকাতার শিয়ালদহে এক দূর সম্পর্কের পিসির বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল তারা। নবকুমারকে খুবই ভালবাসতেন তারা। ভাবে ভোলা সহজ সরল মন, তার বয়সি মহানগরের কোনো ছেলের মধ্যে নেই। তাছাড়া তাদের কোন সন্তানও ছিল না। সেদিন হাজার হাজার মানুষ বন্যার কারণে গৃহ ছাড়া হয়েছিল। চারিপাশের নদী-নালা সব ছাপিয়ে গ্রামে ও শহরের মধ্যে জল চলে এসেছিল। সেদিন নবকুমারদের মতো কত মানুষ যে বিপদের মধ্যে ছিল তা যথাযথ বলা যায় না। মানুষ মারাও গিয়েছিল অনেক। সে বছর কলকাতায় দুর্গাপুজো তেমন একটা হয়নি। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল কলকাতার পুজো কমিটির মানুষগুলো।
নবকুমার তার পিসিমাকে বলেছিল---"পিসি, আমি কোনদিন কলকাতায় পুজো দেখিনি। আমাকে পুজোর দিনগুলিতে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাবে।" পিসি তাকে বলেছিলেন---"এবার তো বন্যার জন্য কোলকাতায় তেমনভাবে পুজোও হচ্ছে না। তবে একদিন তোকে নিয়ে যাব আশেপাশে হওয়া কিছু পুজোর মন্ডপে।" সপ্তমীর দিন বিকেল বিকেল নবকুমারকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলেন তিনি। নবকুমারের বাবা- মা পিসার সঙ্গে বাড়িতেই ছিল। যে কয়টি পুজো সে বছর হয়েছিল তা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। তিন ঘন্টা ঘুরে নবকুমারকে তার পিসি দশটি মন্ডপ ও ঠাকুর দেখিয়েছিলেন। এক একটি মন্ডপ নবকুমারের কাছে খুবই আশ্চর্যের লেগেছিল। তাদের গ্রামেও পুজো হয়, তবে এরকম মন্ডপ ও ঠাকুর কোনদিন সে দেখেনি। কি অসাধারণ মূর্তি, কি অসাধারণ সৌন্দর্য। এক একটা মণ্ডপ দেখে নবকুমার চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিল না। কোন মন্ডপ কাঁচ দিয়ে তৈরি, আবার কোনোটা পয়সা দিয়ে, কোনোটা চামচি দিয়ে তো কোনোটা দেশলাইয়ের কাঠি ও বাক্স দিয়ে তৈরি। কোথাও সপ্তম আশ্চর্যের তাজমহল তৈরি করা হয়েছিল, কোথাও আইফেল টাওয়ার। শিল্পীদের কাজ দেখে প্রশংসা করতেই হয়। নব কুমারের মত একটি ছোট্ট ছেলের পক্ষেও শিল্পীর দক্ষতা অনুভব করা সম্ভব হয়েছিল।
শুধু মন্ডপই নয়, মাতৃ প্রতিমা ও লাইটিং মনোমুগ্ধকর ছিল। নবকুমার অবাক হয়ে ভেবেছিল--- "কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রতিবছর কলকাতায় পুজো হয়। অথচ আমাদের মত মানুষেরা একদিন কাজ না করলে দু- বেলা ঠিক মতো আহার জোটাতে পারে না। আমাদের কথা কেউই ভাবে না। এই মহানগরের মানুষ পুজোর এই ক'দিন দুহাতে টাকা উড়ায়। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেনা এই টাকাগুলো যদি তারা অসহায় দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিত, তাদের দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খাবার ব্যবস্থা করে দিত-- তবে মা দুর্গা আরো বেশি খুশি হতেন।" বড় বড় মানুষের মনে যে সকল চিন্তা আসে না, সেই সকল বিষয় নবকুমারের মনে উঁকি মারে। কারো কাছে আনন্দটাই শেষ কথা, আবার কারো কাছে ক্ষুন্নিবৃত্তি দূর করার মত অর্থ নেই। নগর সভ্যতার মানুষের মুখে সারা বছর যারা আহার জোটায় অসময়ে তাদেরকেই এরা চেনে না। হঠাৎ করে এইসব চিন্তা তার মাথায় ভিড় করে আসায় তার ঠাকুর দেখার আনন্দটাই মাটি হয়ে যেতে বসে। সে বুঝতে পেরে এই চিন্তা ত্যাগ করে। পুনরায় মাতৃ প্রতিমা ও লাইটিং মন দিয়ে প্রত্যক্ষ করতে থাকে। নবকুমারের মাসি বুঝতে পারে এরকম মণ্ডপ, লাইটিং ও মাতৃ প্রতিমা নবকুমার হয়তো প্রথম দেখছে। তাই তার প্রতিটি কণাকে আস্বাদন করার চেষ্টা করছে সে। মাসি নবকুমারের সকল আবদার রেখেছিলেন। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে কেনাকাটায় কখনো না করেন নি। তারপর এই প্রথম তারা কলকাতায় এসেছিল। তিনি চান নি নবকুমাররা মনে কোনো কষ্ট নিয়ে গ্ৰামে ফিরে যাক।
তারপর একদিন জল শুকিয়ে যায়। মাস দুয়েক নবকুমাররা কলকাতায় ছিল। তারা বুঝতেই পারে নি বাড়িতে, না বাড়ি থেকে দূরে অন্য কারো বাড়ি আছে। বাড়ি ফেরার পথে মাসির দুচোখে জল দেখা যায়। মাসি বলে--- " এবার সেভাবে ঠাকুর দেখতে পারিস নি। তাই আগামী বছর পুজোর সময় বাবা-মার সঙ্গে কলকাতায় আসিস। প্রচুর আনন্দ হবে।সবাই মিলে প্রতিদিন ঠাকুর দেখতে যাব।" দেখতে দেখতে একবছর কেটে যায়। বন্যার কথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভুলেও যায়। আবার সকলে পুজোর আনন্দে মেতে ওঠে। পুজোর দুই মাস আগে থেকে কলকাতায় পুজোর মণ্ডপ তৈরির কাজ শুরু হয়। গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি পুজোর আয়োজন হয়। কলকাতায় দ্বিতীয়-তৃতীয়া থেকেই মন্ডপে মন্ডপে পুজোর ভিড় জমতে থাকে। কলকাতার পুজোর যে প্রানবন্ত রূপ এবছর নবকুমার প্রত্যক্ষ করে, তা গতবছর ছিল না। নবকুমার বুঝতে পারে এবছর কলকাতায় পুজো দেখতে না আসলে গতবছর আর এবছরের প্রভেদ বুঝতে পারত না সে। সে বুঝতে পারে এমন দুর্গা পুজো ভারতের আর অন্য কোথাও হয় না। প্রতিদিন সকলে মিলে ঠাকুর দেখা , আড্ডা মারা, খাওয়া-দাওয়া করা সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল নবকুমারের। সে বুঝতে পেরেছিলো কলকাতার দুর্গা পুজো সম্পর্কে বাবার বলার তাৎপর্য। লোকের ভিড়ে নবকুমারের হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় দুচোখ দিয়ে একের পর এক অসাধারণ মন্ডপ, প্রতিমা ও লাইটিং দেখে যাই রাত জেগে। কোনো বাঁধাই যেন তাকে বাঁধা দিতে না পারে। গ্ৰামে ফেরার কথা পুজোর আনন্দে সে ভুলেই যায়। বার বার নবকুমারের মনে একটা কথাই উচ্চারিত হয় -- "সাধ মিটিবে না। প্রতিবছর কলকাতায় ঠাকুর দেখতে আসতেই হবে।"
======================
মিঠুন মুখার্জী
C/o -- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম -- নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগনা
পিন -- ৭৪৩২৫২