স্বার্থপর
দীপান্বিতা রায় পাল
দিনটা ছিল পয়লা অঘ্রান।দেখতে দেখতে বিয়ের এক বছর পার করল মেহুল ও সুজয়।মেহুল সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা আর সুজয় কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।বেঙ্গলি ম্যাট্রিমনির মারফত ওদের পরিচয়,কাজের ফাঁকে কয়েক মাসের আলাপচারিতা,এরপর ভালো লাগা, তারপর বিয়ে।সিদ্ধান্তে পৌছাতে মাস ছয়েকের বেশি সময় নেয় নি ওরা দুজনে।দুই পরিবারের সম্মতিতে গতবছর আজকের দিনে চার হাত এক হয়েছিল ওদের।তাই প্রথম বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের জন্য সেদিন সন্ধ্যায় ওদের কমপ্লেক্সের বিশাল কমিউনিটি হলে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সুজয়।মেহুল এর বাবা মা,দিদি,জামাইবাবু,ওদের মেয়ে কলি,সুজয়ের কাছে পিঠের বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন,পরিবার নিয়ে অতিথির সংখ্যা প্রায় শ'খানেক।শ্যামবাজারে সুজয়দের পৈতৃক বাড়িতে বিয়ের আগে এক দুবার আসলেও বিয়ের পর গত এক বছরে ছোট মেয়েজামাইয়ের এই নতুন আস্তানায় কখনো আসা হয়নি বিশ্বাস দম্পতির।ওদিকে দিদি শিমুলের সাথেও বিয়ের পর এই প্রথম দেখা মেহুলের।বোনের বিয়েতে শিমুলের না থাকা নিয়ে বেশ গুঞ্জনও উঠেছিল আত্মীয় মহলে।যদিও বিকাশ,মেহুলের জামাইবাবু তার একমাত্র শালির বিয়ের সব ঝক্কি সামলে ছিল একার হাতে।এতদিন পর কাছের মানুষদের সাথে দেখা হবে,বিশেষ করে ছ'দিনের কলিকে শেষ দেখার পর আজ প্রথম দেখবে সেই আনন্দ ও উত্তেজনায় মেহুল বড়োই অস্থির হয়ে উঠল।বিকেলে সাজের পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রূপের ঝলকে নিজেই মুখ ফেরাতে পারল না। তার উপর সুজয়ের দেওয়া বুটিক এর নীল রঙা সিল্কের শাড়ি, হীরের হালকা গয়না আর মাথায় খোপার পাশে বেগুনি অর্কিড এর গোছাটা ওকে মোহময়ী করে তুলেছিল আরও দশগুণ।সুজয়ের সৌম্যকান্তি চেহারা আর মেহুলের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য অতিথিদের বিয়ের দিনের মত আবারও মুগ্ধ করছিল সেদিন।অপেক্ষারত মেহুলের উৎকন্ঠা আর সুজয়ের অতিথি আপ্যায়নের সাথে অনুষ্ঠান তার নিজস্ব ছন্দে এগিয়ে চলছিল।কিছু সময় পর মেহুলের পরিজনরা উপস্থিত হল অনুষ্ঠানের মেজাজকে বিঘ্নিত না করে।পাছে মেকআপ নষ্ট হয় তাই ভেজা চোখের কোণে লেপটে যাওয়া কাজল মুছে ঠিক করে নিল মেহুল।বাঁধভাঙা হাসি দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করল মন থেকে,নিমেষে ভার হয়ে থাকা মনটা হালকা পালকের মত উড়তে লাগল।মুহূর্তের আনন্দে মেতে ওঠা মেহুল হঠাৎ থমকে গেল দিদির পাশে ছোট্ট কলিকে দেখে।পঁচিশ বছর আগে পুরীতে পরিবারের সাথে তোলা একটা ফটোর কথা মনে পড়ে গেল ওর।অবিকল একইরকম দেখতে ফটোর সেই ছোট্ট মেহুল যেন গোলাপি ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের পাশে।মুহর্তের মধ্যে মেহুলের বুকের ভেতরটা টন্ টন্ করে উঠল।কি অসহ্য ব্যথা ! নিজেকে চরম স্বার্থপর মনে হল তখন।ওই নিষ্পাপ শিশুর চোখে চোখ রাখার মত সাহস হল না ওর।কারণ ছোট্ট কলি তো ওরই গর্ভের অযাচিত সন্তান যা বিয়ের আগের একটা ভুলে ধারণ করে ছিল মেহুল। শুধু মাত্র বাবা মায়ের সম্মানহানির ভয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে জন্মানো ছ'দিনের বাচ্চাটাকে দিয়ে এসেছিল নিঃসন্তান দিদির কাছে। সেদিন কি শুধুই সে পরিবারের কথাই ভেবে ছিল? নাকি সিদ্ধান্তটা নিজের ঘেঁটে যাওয়া জীবনের সহজ সমাধান ছিল? নাকি একটা নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ জীবন কাটানোর লোভ তার অকাঙ্খিত মাতৃত্বকে হারিয়ে জিতে গিয়েছিল? সব নিয়ে গুছিয়ে সংসার করা মেয়েটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল এক নিমেষে।চারবছরের কলিকে দেখা মাত্র ওর মধ্যে জোর করে চেপে রাখা মাতৃত্ববোধ জেগে উঠল সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত।এই ভয়ই শিমুল করে এসেছিল প্রথম থেকে।কলিকে দেখা মাত্র যদি বোন বিয়ের সিদ্ধান্তে পিছিয়ে যায়!যদি বোন কলির মাতৃত্ব দাবি করে!যদি কলিকে চিরতরে তাকে হারাতে হয়!তাই সমাজের কুকথা অগ্রাহ্য করে বাবা মা বোনের সাথে সামাজিক দূরত্ব রেখেছিল কলি আসার পর থেকে।এমনকি একমাত্র বোনের বিয়েতে অনুপস্থিতও ছিল মেয়ের মিথ্যা অসুস্থতার অজুহাতে।জন্ম না দিলেও সমাজের নজরে কলির মা এখন শিমুল।বুকের পাথর ক্রমশ ভারী হতে থাকল মেহুল এর।সুজয়কে বিয়ের আগে পূর্বের সম্পর্কের কথা সব জানালেও সন্তান ধারনের বিষয়টি বলার মত সাহস তখন মেহুলের ছিল না।জীবনের এত বড়ো ঘটনা সুজয়ের কাছে গোপন করায় নিজের প্রতি কেমন একটা ঘৃণা হতে লাগল ওর।তবে এর জন্য কি মেহুলই একা দায়ী?ওর বাবা মা,দিদি কি ওকে বাধ্য করেনি বিয়ের আগে সুজয়কে কলির কথা কিছু না জানাতে?যার জন্য মেহুল ওদের ক্ষমা করতে পারে নি আজও।মাঝে মাঝে প্রচন্ড গা গুলিয়ে উঠছিল মেহুলের। কেমন যেন চারদিক আবছা হয়ে আসছিল বার বার।অনুষ্ঠানে অবিরত বেজে যাওয়া সানাই এর আওয়াজকে ছাপিয়ে চিৎকার করে পৃথিবীকে বলতে ইচ্ছা করছিল, "হ্যাঁ, কলি আমার সন্তান, আমি ওর জন্মদাত্রী মা"।কিন্তু হায়রে বিধাতা! পরিস্থিতির কাছে মেহুল যে বড়ই অসহায়। নিজের মনের বাসনাকে আবারও খুন করে মনের গভীরে পুঁতে রাখল সে।ছোট্ট কলির কাছে মনে মনে ক্ষমা চাইল তার এই অপারগতার জন্য।সিদ্ধান্ত নিল সুজয়কে সে তার না বলা সব কথা বলবে,তাতে যদি ওর সুখের ঘরে ভাঙন ধরে তার দায় একান্ত ওর নিজের।সকলের আড়ালে নিজের সাথে দীর্ঘক্ষন যুদ্ধ করতে করতে মেহুল অসুস্থ হয়ে পড়ল।হঠাৎ জ্ঞান হারাল।
চোখ খুলে নিজেকে নার্সিংহোমের ঠান্ডা ঘরে পেল মেহুল। সুজয় দাঁড়িয়ে ছিল মেহুলের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়।মেহুলের কাছে এসে বলল,"বিবাহবার্ষিকীতে এইভাবে এতভালো উপহার পাবো, ভাবিনি ম্যাডাম,ধন্যবাদ।"কথাটা বলে হাসিমুখে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল ঝড়ের গতিতে। মেহুল কিছু বোঝার আগেই ডিউটিতে থাকা নার্স জানালো,সে সন্তানসম্ভবা।শব্দটা মেহুলকে যেন দ্বিতীয়বার নাড়িয়ে দিল। কি করবে এখন সে? আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকবে নাকি আবারও স্বার্থপর হবে?নাকি ভালোবাসার মানুষের কাছে হার মানবে?এক মিশ্র অনুভূতিতে মেহুল চোখ বুজল।বাচ্চার গায়ের গন্ধ,শরীরের আলতো ছোঁয়া,নিষ্পাপ হাসি স্বপ্নের মধ্যে অনুভব করল।দুদিন বাদে নার্সিং হোম থেকে মেহুল ফিরল সুজয়ের হাত ধরে।হবু মায়ের প্রাথমিক লক্ষণ স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথে মেহুল একটু একটু করে কলির স্মৃতি ভুলতে শুরু করল।তিনমাস হল স্কুলে নিয়মিত যাতায়াতের জন্য প্রথমদিন থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সুজয়।এই সময় সকালের দিকে মেহুলের খুব শরীর খারাপ লাগে।সবসময় ইচ্ছে করে শুয়ে থাকতে।এখন নিয়মিত স্কুলে যেতে মেহুলের মন চায় না।দুবছরের কর্মজীবনে এই প্রথম মেহুলের স্কুলের প্রতি অনিহা তৈরী হল। তবে আজ যে মেহুলকে একটা সি.এল নিতেই হবে। সকাল থেকে বমির প্রকোপ বেড়েছে আর সেই সঙ্গে তলপেটের কাছে চিন চিনে ব্যথা।ঘরের কাজ করতে করতে শিউলি এসে বলল, "ও বৌদি, দাদাকে ফোন করে বলো না বাড়ি ফিরে আসতে। তোমার অবস্থা দেখে আমার ভালো লাগছে না।" "আজ দাদার কলেজে পরীক্ষা আছে রে। আর একটু দেখি।ব্যথা না কমলে ফোন করব ক্ষন।" কথা গুলো বলে ধীর পায়ে মেহুল বাথরুমের দিকে গেল।খানিক সময় পর হঠাৎ মেহুল তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল,না! এ হতে পারে না,আমি মানতে পারছি না,এ কোন পাপের শাস্তি আমায় দিলে ঈশ্বর।"মেহুলের চিৎকার শুনে যখন শিউলি রান্না ঘর থেকে ছুটে এল ততক্ষণে সব শেষ।বাথরুমের দরজার কাছে মেহুল দাঁড়িয়ে,ওর দু পা বেয়ে রক্তের ধারা মেঝেতে জলের সাথে মিশে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদীর মত।খবরটা সুজয় পেল কলেজে থাকাকালীন।শিউলির ফোন আসার পর ছুটে এসেছিল মেহুলের কাছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল মেহুলকে। আর মেহুল ওর ভালোবাসার মানুষের বুকে আছড়ে পড়ে কেঁদেছিল সেদিন সারা রাত। মিসক্যারেজের জন্য স্কুল থেকে পঁয়তাল্লিশ দিনের ছুটি পেয়েছিল মেহুল। সুজয়ের বাড়ি থেকে ফোনে কয়েকটি সান্ত্বনা বাক্য আর উপদেশ ছাড়া আর কোনো প্রকার সাড়া মেলেনি সেই সময়।প্রায় একমাস বারাসাতে মা বাবার কাছে থেকে ছিল শরীর ও মনের কষ্ট লাঘব করতে মেহুল। দিদিও ছিল কলিকে নিয়ে কিছু দিন বারাসাতে।নাহ্! কলিকে দেখে মেহুলের এখন আর কোনো পাপ বোধ হয় না।কলির সারাদিনের এলোমেলো কথার উত্তর দিতে দিতে মেহুল ক্লান্ত হয় না।সারাদিন আদরের মনির সাথে খেললেও ঘুমানোর সময় কলির শিমুলকেই চাই।মায়ের গা ঘেঁষে না শুলে কলিরানির ঘুম আসে না।কলির সাথে শিমুলের এই একাত্ম বন্ধন ভাঙার সাধ্য মেহুলের নেই। এই ক'দিনে মেহুল অনুভব করেছিল,শুধুমাত্র সন্তান ধারন করে জন্ম দিলেই সম্পূর্ণ মা হওয়া যায় না।সন্তানের সব দায়িত্ব পালন করে সন্তানের স্বার্থে আত্মত্যাগের মাধ্যমেই একজন নারী প্রকৃত মা হওয়ার যোগ্যতা রাখে।তাই কলির মা এখন সম্পূর্ণরূপে শিমুলই।কলির প্রতি মায়ের এই অধিকারবোধকে মেহুল আর প্রশ্রয় দিল না আগের মত।ছোট্ট কলির কথা ভেবে সারাজীবনের মত মনের ভেতরের সুপ্ত মাতৃত্বের দাবিকে কবর দিল। 'স্বার্থপর' শব্দটা এখন আর কষ্ট দেয় না মেহুলকে।কলকাতায় ফিরে মেহুল সুজয়কে কলির অজানা সব কথা জানিয়েছিল সাহস করে। শুনে সুজয় স্বাভাবিক ছন্দে বলে ছিল, "ইতিহাস পড়তে আর পড়াতে আমি ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু আমি তো অতীত নিয়ে বাঁচি না মেহুল। অতীতের একটা অসতর্ক মুহূর্তের ভুল আমার মেহুলকে কখনো আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। " মেহুল আবারও কান্নায় সুজয়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেদিনের মত। এবার মেহুলের চোখে কোনো পাপবোধ নেই, নেই কোনো অপরাধবোধের ছায়া,আছে শুধু একরাশ অফুরান ভালোবাসা আর বিশ্বাস যা দিয়ে মেহুল সুজয়ের জীবন ক্যানভাসে ভবিষ্যতের রঙীন ছবি আঁকবে নতুন আঙ্গিকে।
=======================
Dipanwita Roy Paul
19/3 Birpara Lane. Kolkata 30