দক্ষিণ বারাশত শিবদাস আচার্য্য উচ্চ বিদ্যালয় : যৎকিঞ্চিৎ স্মৃতিলেখ
অরবিন্দ পুরকাইত
জীবনকে নদী এবং নৌকা উভয়ের সঙ্গেই তুলনা করা হয়ে থাকে। জীবন-নদী, জীবন-তরণী। সেই জীবন-নদীর থাকে বিভিন্ন ঘাট, যেমন একটি সড়কের থাকে বিভিন্ন মোড়। বলা বাহুল্য যে এই মোড় নির্দিষ্ট থামার স্থান এবং বাঁক উভয়ার্থেই। তার বাইরেও আঘাটা বা দুই মোড়ের মাঝে কোথাও থামা যে থাকে না তাও নয়। অন্যভাবে বলা যায়, কাল-রূপ নদীতে জীবনই এক তরণী, কাল-নদীর ঘাটে ঘাটে বাঁকে বাঁকে যাবে চলে। বলা বাহুল্য, সে জীবন ব্যক্তিজীবন থেকে জীবনপ্রবাহ। তো হতে পারে সে ঘাট ভাঙাচোরা থেকে শান বাঁধানো, হতে পারে সে সড়কের মোড় সমৃদ্ধ থেকে নিতান্ত সাধারণ; কিন্তু সেগুলো নদীরই অঙ্গ, সড়কেরই অঙ্গ। কেবল সমৃদ্ধকে চাইব, নগণ্যকে গ্রহণ করব না তা তো হয় না। পাড়ি দিতে সব কিছুকেই ছুঁয়ে বা পেরিয়ে যেতে হয়, সে জলপথ হোক বা স্থলপথ। ঘাট বা মোড় আদতে মনুষ্যবসবাসের লক্ষণ— আশপাশে গ্রাম-নগরের উপস্থিতি।
কথাগুলো মনে হল দক্ষিণ বারাশত শিবদাস আচার্য্য উচ্চ বিদ্যালয় (উচ্চতর মাধ্যমিক) সম্বন্ধে হঠাৎ লেখার প্রস্তাব পেয়ে। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি সম্বন্ধে আমার স্মৃতি বলতে মাত্র বছর-দুইয়ের। ১৯৮৪—৮৬ সাল, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া ছিলাম এখানে। পরবর্তীকালের মতো বহু বিদ্যালয়ে তখন উচ্চমাধ্যমিক চালু থাকলে আমাদের হয়তো এই বিদ্যালয়ে আসাই হত না। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছিলাম মগরাহাট থানার বেণীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। মাধ্যমিক পাশ করার পর আর সেখানে পড়ার উপায় নেই! কাছাকাছি মাইতিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যাপারটাও একই। সুতরাং আমরা ভর্তি হলাম এই বিদ্যালয়ে। প্রথমত, বিদ্যালয়ের সুনাম, আমাদের চৌহদ্দির মধ্যে (আমার গ্রাম মগরাহাট থানার গোকর্ণী, এ বিদ্যালয় মাইল পাঁচেক দূরে) এ বিদ্যালয়কে সমীহ করত লোকে। দ্বিতীয়ত, মাধ্যমিক পাস করেই কলেজে ঢুকলে ছেলেমেয়েরা বখে যাবে, স্কুলে থাকলে তবু একটু শৃঙ্খলার মধ্যে থাকবে — এই-ই তো ছিল অনেক অভিভাবক-অভিভাবিকার ধারণা! পরবর্তীকালে, আমার যে জীবনসঙ্গিনী — বিদ্যালয়ের কাছাকাছি নুরুল্লাপুরের সরমা নস্করও দেখছি প্রায়-প্রতিবেশী শ্রী শ্রী সারদামণি বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকের পর এখানেই ভর্তি হয়েছিল (১৯৯০ সাল)! সারদামণি মেয়েদের স্কুল, এটি ছেলেদের। ছেলেদের, তবে সে ওই পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত— তার পরে উভয়ের। তো আমার আগের বিদ্যালয়ের সহপাঠীদের কেউ কেউ এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হল, অনেকেই কাছাকাছির ধ্রুবচাঁদ হালদার কলেজ বা অন্যত্র। এই বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক না থাকলে আমরাও হয়তো তরী ভেড়াতাম বহড়ু উচ্চ বিদ্যালয়ে (মেজদা বসন্ত এখানেই পড়েছে একাদশ-দ্বাদশ), দক্ষিণ বারাশতেরই ধ্রুবচাঁদ হালদার কলেজ, ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজ বা অন্য কোথাও (তখনও মগরাহাট কলেজ হয়নি)। অর্থাৎ বলার কথা এই— একটি সিদ্ধান্ত একটি স্বতন্ত্র স্মৃতি-ভাণ্ডারের জন্মদাতা। এই প্রতিষ্ঠানের বদলে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হলে নিশ্চয়ই হত স্বতন্ত্র সান্নিধ্য তথা স্মৃতির ভাণ্ডার। কিন্তু যা হয়নি সেখানে স্মৃতির ভাঁড়ার সচরাচর শূন্যেরই দিকে আর যা হয়েছে তার স্মৃতি সমৃদ্ধির দিকেই থাকে এগিয়ে। তা সে সান্নিধ্য তথা স্মৃতি যত স্বল্পকালীন বা দীর্ঘকালীন, নগণ্য বা সমৃদ্ধ — যেমনই হোক না কেন।
এই বিদ্যালয় মাত্র দু-বছরে আমাকে নিতান্ত কম তো দেয়নি! একটা দরজাই তো খুলে দিয়েছিল হাট করে। যে দরজা গড়ে দিয়েছে ভালবাসার আপন এক জগৎ। যে জগৎ দিয়েছে নিজস্ব ভালবাসার, যাপনের এক দীর্ঘ সুখ, কিংবা সুখ-দুঃখ। আসলে সব মিলিয়ে সে জগৎটিও তো জীবনেরই এক প্রতিরূপ যেন, স্বতন্ত্র নির্মাণে! তবে সে জগতের দুঃখ অন্তর ধুয়ে দিতেও সক্ষম, সক্ষম দিতে শুদ্ধতার পাঠ। হ্যাঁ স্মৃতির উজান ঠেলে প্রায় চার দশকের পারে এই যে লেখাটি লিখছি আমি (প্রস্তাবক অনুজ পঞ্চানন নস্করকে ধন্যবাদ), সেটাও হয়তো সম্ভব হত না সেই জগতে প্রবেশ না করলে। সমস্তকিছু ধরে রাখার বিষয়ে স্মৃতি অক্ষমতা জ্ঞাপন করলেও (তার উপরে, অতি যত্নে রাখা সবেধন নীলমণি এক 'দীপান্বিতা' কোথায় যে আত্মগোপন করে আছে, এখন লেখার সময় তার দেখা মিলল না! ইতোমধ্যে পূর্বের মাটির বাড়িও ধসে পড়েছে। কোথায় যে রয়েছে সে বা হারিয়ে গেছে চিরতরে! দীপান্বিতা এ বিদ্যালয়ের বার্ষিক সাহিত্যপত্র), কিছু তো সঙ্গী রয়েই যায় দীর্ঘযাত্রাতেও। স্মৃতির সম্পুট থেকে তেমনই উজ্জ্বল দু-একটি উদ্ধার করার দুর্নিবার আগ্রহ থেকেই এ লেখায় হাত দেওয়া, ব্যক্তিগতভাবে যা হয়তো রয়ে যাবে আমার আজীবনের সঙ্গী হয়ে।
'বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসে বিদ্যামঠতলে' যারা, তাদেরই মতো ঝাঁকের কই হয়ে ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি এ বিদ্যালয়ে ঢোকা আমাদের। একাদশ শ্রেণি, বাণিজ্য বিভাগ। ক্লাস হত বিদ্যালয়ে ঢুকে, ডানদিকে (অর্থাৎ পশ্চিমে) উঠে দোতলায় ডানদিকের শেষে কোণের ঘরে। দোতলায় উঠেই, ডানদিকের বিজ্ঞানের ক্লাস পেরিয়েই (উঠেই-বাঁদিকে ছিল শিক্ষকদের কক্ষ)। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। কত বড় ক্লাসঘর! ক্লাস প্রায় ভরা বাণিজ্য বিভাগে। বিচ্ছু ছাত্রদের অভাব ছিল না, তাই হট্টগোল লেগেই থাকত। ধুতি-পাঞ্জাবিশোভিত একটু খর্বকায় কোঁকড়ানো-কেশ ফর্সা রঞ্জিৎবাবু ক্লাস নিতে এলে ছাত্রদের যেন আরও পোয়াবারো! রঞ্জিৎবাবু মানে রঞ্জিৎ দত্ত— আরডি। আমাদের হিসাবশাস্ত্র, কারবার সংগঠন, অর্থনৈতিক ভূগোল পড়াতেন। পূর্বোক্ত সারদামণি বিদ্যালয়ের কাছেই ছিল তাঁর বাড়ি। তো তাঁর ক্লাসে হট্টগোলের মাত্রা বেশি হত। তিনি মাঝে মাঝে কৃত্রিম শাসন করতেন, ছাত্ররা তা থোড়াই কেয়ার করত! আসলে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী তো তাঁর কাছে টিউশন পড়ত! তিনি হেঁকে ওঠেন, কিন্তু হাস্যমিশ্রিত সে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের হাঁকিতে কে আর ভয় করবে! তবে এক-আধবার প্রকৃত রেগে না গিয়ে পারতেন না। সত্যিকার হেঁকে উঠতেন তখন। ছাত্রছাত্রীরা থতমত খেয়ে যেত। সেসব দিনে গম্ভীরভাবে বেশ কিছুক্ষণ ক্লাস নেওয়ার পর রঞ্জিৎবাবু আবার রঞ্জিৎবাবুতেই ফিরতেন। আবার সহজ করে নিতেন পরিস্থিতি। ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত স্তরে এত ভাল করে ক'জন আর চিনতেন! উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোল। তখন তো আর এখনকার মতো ঘরে বসে কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদিতে ফল জানার সুযোগ ছিল না, তা বিদ্যালয়ে গিয়েছি ফল জানতে। দোতলায় উঠছি, তিনি নামছেন। আমাকে দেখে বললেন, তুই ভালভাবে পাশ করেছিস। নম্বরটাও বলে দিলেন! আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তাঁর কাছে কোনোদিন টিউশন পড়িনি। ক্লাসেও বরাবর একদম পিছনের দিকের বেঞ্চে বসতাম, তাঁর সঙ্গে আমার খুব একটা কিছু পরিচয়ও ছিল না, কিন্তু তিনি দিব্যি বলে দিলেন! আমি তাঁকে প্রণাম করতে-না-করতে আমাদের আর এক সতীর্থ তাঁর কাছে এসে দাঁড়াতে, স্যার তার বুকে হাত রেখে— কী আশ্চর্য, স্যারের চোখ ভিজে উঠল! কী এক আন্তরিক কণ্ঠে তিনি বললেন, না রে, তোর হল না। সে দৃশ্য আমি কখনো ভুলতে পারব না।
রঞ্জিৎবাবুর ক্লাসে যদি হই-হট্টগোল হয় তো আর একজনের ক্লাসে পিন পড়লে বোধহয় শব্দ শুনতে পাওয়া যেত। তিনি সুপ্রভাতবাবু। সুপ্রভাত ঘোষ। ধুতিটি পরতেন লুঙ্গির মতো করে। সাদা পাঞ্জাবি। পঞ্চাশোর্ধ তখন সম্ভবত; সুঠাম চেহারা, উন্নতনাসা, ইন্দ্রলুপ্ত। তিনি ইংরেজি পড়াতেন একটাও বাংলা শব্দ ব্যবহার না করে। তিনি বলতেন, যতক্ষণ তোরা বুঝতে না পারবি আমি যতটা সহজ করে বলা সম্ভব বলব। দেখ, ইংরেজির মাধ্যমে ইংরেজি পড়লে ইংরেজিতে দখল দ্রুত ও ভাল হয়। আমাদের মুশকিল ছিল কি, সেই সহজতম ইংরেজিও বোঝার মতো স্তরে আমরা ছিলাম না। ইংরেজিতে আমাদের ভিত যে ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তাঁর অনেক চেষ্টার পরেও, একান্ত না বুঝতে পারলে কদাচিৎ বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন তিনি। আর তিনি পড়াতেন আমাদের 'কর্ণ কুন্তী সংবাদ', সে পড়ানো সারা জীবন মনে থাকবে। অসাধারণ! কী চমৎকার উচ্চারণ! রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী সৃষ্টি এই কাব্যনাট্যটির অসাধারণ সব মুহূর্তের অনবদ্য আনুভূতিক প্রকাশ! অতিনাটকীয়তাহীন সে উচ্চারণ বরাবরের জন্য হৃদয়ে গেঁথে গেছে। শিক্ষক হিসাবে সুপ্রভাতবাবুর মতো এমন নিঃশব্দ রেখাপাত করে উঠতে পারেননি আর তেমন কেউ। কত দিক দিয়ে যে তিনি প্রভাবিত করে গেছেন অজানা অপরিচিত আমাদের মতো সব ছাত্রদের! তিনি একটা কথা বলতেন। 'অপাঠ্য সব পাঠ্য কেতাব সামনে আছে খোলা/ কর্তৃজনের ভয়ে কাব্য কুলুঙ্গিতে তোলা।' ক্লাসের বইয়ের বাইরেও ভাল সাহিত্যপাঠে তিনি উৎসাহিত করতেন। নিজেও বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে ঢুকতেন নিয়মিত, বসে পড়তেন, বই তুলতেন। শিক্ষকদের কাছে টিউশন পড়া-না পড়ার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের অনুভূতি খুব-একটা সুখকর নয়, আমাদের আগের বিদ্যালয়ে সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোনও কোনও শিক্ষকের কাছে, টিউশন না-পড়া এক, পড়তে পড়তে ছেড়ে দেওয়া— আরও, ছেড়ে দিয়ে সেই শিক্ষকের পরিচিত অন্য কারও কাছে পড়া আর এক। সুপ্রভাতবাবু বলতেন, আমাকে যখন যেখানে পাবি, স্কুলের বারান্দায়, লাইব্রেরি, পথে-ঘাটে যেখানেই হোক— তোরা জেনে নিবি। কোনোরকম সংকোচ করবি না। শুনেছি তিনি কোনোদিন টিউশন করতেন না।
বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পরিচিতির প্রথম ক্লাসে প্রধান শিক্ষক শঙ্কর চৌধুরী কী বললেন! দূর-স্মৃতি থেকে জানাই, একটি উক্তি ছিল এইরকম : 'তোমরা যারা এই স্কুলে ভর্তি হয়েছ তারা কী পাবে জানি না, তবে তোমরা একজন শিক্ষক মহাশয়কে পাবে; তিনি সুপ্রভাত ঘোষ।...'
একদিন ক্লাসে কোনও কারণে পারিবারিক পারস্পরিক সম্বোধনের প্রসঙ্গ ওঠে। সুপ্রভাতবাবু বলেন, হ্যাঁ রে, নিজের বাবা-মাকে কেউ আপনি-আজ্ঞে করে! সবচেয়ে নিকট-সম্পর্ক, কেমন যেন দূরে দূরে ঠেলা মনে হয় না! আমার দিদিকে তো আমি 'তুই' বলি, কিন্তু কী মধুর সম্পর্ক আমাদের!
একবার বিদ্যালয়ের ফুটবল খেলার সময় একটা ব্যাপার চোখে পড়ে। সেই প্রথম। খেলার মাঠটি অদূরেই, সড়কের— আশি নম্বর বাস চলত যে পথে বিষ্ণুপুর থেকে কলকাতার ধর্মতলা পর্যন্ত— পূর্ব-গায়ে বিদ্যালয় আর পশ্চিম-গায়ে মাঠ, সামান্য উত্তর-পশ্চিমে। ক্ষীণ ব্যবধান রাস্তার ধার-ঘেঁষে উভয় দিকের সার-দেওয়া দোকানপত্রের। ফুটবল খেলা চলছে, হঠাৎ চোখে পড়ল মাঠের পাশে ঝাঁকড়া একটা গাছের নিচে সুপ্রভাত স্যার বিড়ি খাচ্ছেন খেলা দেখতে দেখতে! সেই-ই জানতে পারলাম তিনি ধূমপায়ী। আর কোনোদিন দেখিনি, জানি না অন্যদের এ বিষয়ে বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি না। শুনেছি তাঁর আদর্শবাদিতা ও সততার জন্য তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের স্মৃতিমন্দিরে চিরভাস্বর তিনি।
একহারা গড়নের সুবোধবাবু বাংলা পড়াতেন। সুবোধ প্রামাণিক। ধুতিপাঞ্জাবি পরিহিত, পাঞ্জাবি বেশির ভাগ সময় নীলচে। সুরসিক মানুষ। তাঁর বাংলা পড়ানো অত্যন্ত আকর্ষণীয়, সরস। এই সরস মানে কেবল মজাদার নয়, সাহিত্যের অন্যান্য রসেরও সহাবস্থান। পড়ানোর মাঝে কখনও কখনও বলতেন, কী, ধরতে পারছ তো? তারপর সহাস্য সংযোজন, আগে ধরতে জানতে হবে— ধত্তি না পাল্লি কত্তি পারবেনে। মনে আছে আমাদের পড়াতেন 'পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন', অক্ষয়কুমার দত্তের। পাঠ্যকে ছাত্রছাত্রীদের মন-মগজে চারিয়ে দেওয়ার জন্য এত আকর্ষণীয়ভাবে যে উপস্থাপন করা যায়, না শুনলে বিশ্বাস করা মুশকিল। গল্পচ্ছলে, নাটকীয়তা এনে, বিশ্লেষণে অনবদ্য সে পড়ানো। সুবোধবাবুর কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ছিল না। পড়ানোটা যে একটা শিল্প এবং তার জন্য সর্বোচ্চ ডিগ্রি না হলেও চলে তার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত সুবোধবাবু। রবীন্দ্রনাথ কর্মকার বাংলার অল্পবয়সী শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ছিল তাঁর— তিনিও সুবোধবাবু পড়ানোর প্রশংসায় কুণ্ঠাহীন। ছেলেমেয়েরা খুবই উপভোগ করত সুবোধবাবুর পড়ানো, মজা পেত যথেষ্ট। শুনেছি তিনি কাছাকাছি হরিনারায়ণপুর গ্রামের। বিদ্যালয়ের বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা 'দীপান্বিতা'য় স্মরজিৎ প্রামাণিক নামে একজন লিখল, শুনলাম তিনি সুবোধবাবুর সন্তান। পরবর্তীকালে দেখেছি স্মরজিৎ অন্যত্রও লিখতেন। তাই বলছিলাম, একদা-কাছে-থাকা এক এবং অদ্বিতীয় সেই দীপান্বিতা-কে যদি পেতাম আজ, খানিক সুবিধা হত। বিদ্যালয়ের সাহিত্যপত্রে কখনো লিখিনি, কোনোদিন যে লেখাজোখা করব সেই ভাবনাটাই তখনও চাগাড় দেয়নি।
মনে পড়ে সইফুর আনম স্যারের কথা। তিনি বাণিজ্য বিভাগেরই। আমাদের হিসাবশাস্ত্র, ব্যবসায় সংগঠন এইসব পড়াতেন। দীপান্বিতা-র সম্পাদকমণ্ডলীতেও ছিলেন তিনি। তিনি আক্ষেপ করতেন বাস্তব থেকে আমরা শিক্ষা নিই না বলে। দৃষ্টান্ত দিতেন। একটি ছাত্র গরুর রচনা লিখছে। মুখস্থ অনুযায়ী লিখছে গরুর চারটি পা, দুটি চক্ষু, দুটি কান ইত্যাদি অথচ মাঠে একটা গরু বাঁধা রয়েছে, সে সেটা দেখে লিখছে না। আমাদের নাগালে থাকা অনেককিছু আমরা সেভাবে পর্যবেক্ষণ করি না। চোখের সামনে থাকতেও আমরা বইয়ের পাতা হাতড়াই, মুখ গুঁজে বই মুখস্থ করি।
রবীনবাবু— রবীন্দ্রনাথ কর্মকার আমাদের বিদ্যালয়ে ঢোকার কাছেপিঠের সময়েই সম্ভবত বিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়ে এসেছেন। অল্পবয়সি-তাঁর সঙ্গে ছেলেমেয়েদের কারও কারও বেশ একটু বন্ধুত্বেরই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বাংলার শিক্ষক তিনি ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মে উৎসাহিত করতেন। মনে আছে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি একটি নাটক মঞ্চস্থ করালেন ছেলেমেয়েদের দিয়ে। নিজেরই লেখা নাটক, সম্ভবত পরিচালনাও নিজের। ছেলেমেয়েরা মহা উৎসাহে মঞ্চস্থ করল সে নাটক স্কুলবাড়ির নিচে দক্ষিণে মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত বিদ্যালয়ের নিজস্ব মঞ্চে। সামান্য একটু কাহিনিসূত্র মনে আছে। শহর থেকে বন্ধুরা গ্রামের এক বন্ধুর বাড়িতে আসছে। বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে স্থানীয় বাজারে মালপত্র-নিয়ে-বসা বিক্রেতাদের থেকে কিছু জিনিসপত্র কিনে বন্ধুর বাড়িতে এল তারা। পরে দেখা যাচ্ছে যাদের থেকে জিনিসপত্রগুলো কিনেছিল, তাদের মধ্যে ওই বন্ধুর বোনও (মা-ও সম্ভবত)। সে এক অস্বস্তি-বিড়ম্বনার মুখোমুখি উভয় পক্ষ! আমাদের ভাল লেগেছিল কেন-না আমরাও তো এরকমই পরিবারের। এই নাটকে আমাদেরই ক্লাসের শান্ত ধীর-স্থির দুই ছাত্রী অভিনয় করেছিল, তারা দক্ষিণ বারাশতের আগে (শিয়ালদহর দিকে) হোগলা স্টেশনের কাছাকাছি পালপাড়ার বাসিন্দা। একজনের নাম প্রণতি পাল। আমরা হোগলা স্টেশন থেকে কখনও কখনও ট্রেনে যেতাম স্কুলে, মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত তাদের সঙ্গে, যদিও কথাবার্তা হয়ইনি প্রায়।
সহপাঠী-প্রসঙ্গ এল যখন এই মুহূর্তে দু-একজনের নাম মনে করি। পিছনের দিকেই, আমাদের ঘনিষ্ঠ ছিল মাইতিরহাটের পুতুল (পুং কিন্তু), আতাসুরার শঙ্কর। ইয়ার্কিতে দুজনেই ওস্তাদ। মুখে লেগে থাকত গান-গল্প-সিনেমা। মীনাক্ষী, বন্দনা। ছিল তাপস (তার ভাই মানস বেণীপুরে আমাদের দশম শ্রেণিতে ছিল প্রথম। আমাদের এদিককার দুলালপুরে তাদের বাড়ি), সোমনাথ। শুনলাম মেঘলা দিনে পুব-দক্ষিণ কোণের কলা বিভাগের কতিপয় ললনার আহ্বানে দু-একদিন গান শুনিয়ে এসেছে ইলিয়াস। কত নাম যে আর মনে করতে পারি না! ছিলামও বেশ মুখচোরা। পড়াশুনায়ও আহামরি কিছু নয়। চাষি পরিবারের ছেলে পুরো একাদশ-দ্বাদশ কাটিয়ে দিলাম জামা আর পায়জামায়! বিদ্যালয় ছাড়ার কাছেপিঠের সময়ে বোধহয় হল একটি— যাকে বলা হত স্যুট প্যান্ট।
দিলীপবাবু আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। তিনি সম্ভবত একটি ছাতা বা ছাতার বাঁট জাতীয় ছড়ি নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন। মনে আছে তাঁর বিশিষ্ট উচ্চারণে ব্রাউনিংয়ের 'হাউ দে ব্রট দ্যা গুড নিউজ ফ্রম ঘেন্ট টু এক্স' কবিতা পড়ানো। ছিলেন সুকুমার স্যার।
এই বিদ্যালয়ের প্রথম বছরেই, আমরা তখন ক্লাসে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির তাঁর নিজেরই দেহরক্ষীর গুলিতে হঠাৎ মৃত্যুর খবর চাউর হয়ে গিয়েছিল (বলা বাহুল্য, দিনটি ছিল ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪)। আমাদের স্কুল দ্রুত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেন-না কোথায় কোন অশান্তি হয়! আমরা সাইকেলে বাড়ি ফিরেছিলাম নির্বিঘ্নে। পরে দেশের বিভিন্ন অংশে দেখেছিলাম তার অভিঘাত।
সীমিত স্মৃতির ভাঁড়ার ক্রমশ হালে পানি হারাচ্ছে! মাত্র দু-বছরের স্মৃতি, তার মধ্যে ছুটিছাটা বাদ দিয়ে ক'দিনই বা! জীবনের কোনও বিশেষ বিশেষ অভিজ্ঞতা বা কালপর্বের কথা সম্বন্ধে বলা হয়ে থাকে যে সদ্য সদ্য তা লিখলে অনেক কিছু খুঁটিনাটি এসে যায়, অনেক বিস্তৃত হতে পারে; কিন্তু তাতে অনেক ভুসি থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই সময়ের হাতে সেসব অভিজ্ঞতা বা সময়পর্বকে পরীক্ষিত হতে দিতে হয় বা ঝাড়াই-বাছাই হওয়ার জন্যে থিতু হতে দিতে হয়। যা থাকার তা স্মৃতিতে থেকে যাবে, যা না থাকার তা আপনিই যাবে ঝরে। কিন্তু কতদিন কতকাল তা ফেলে রাখা হবে! দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে মূল্যবান স্মৃতিরই অনেকখানি তো হারিয়ে যেতে পারে! তাই একেবারে সদ্য ঘটে-যাওয়া কোনোকিছু সদ্য সদ্য লেখায় যেমন বাহুল্যের ভয়, নিছক সংবাদরূপ পরিগ্রহ করার ভয়; তেমনই ঢের বিলম্বে বহু কিছু হারাবারও থাকে ভয়, জীবন ও জগৎ সম্বন্ধীয় বোধের ক্ষেত্রে অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারত— একদা-ঘটা এমন কোনও কোনও উপাদানের জন্যে তখন হয়তো আকুলতাই সার হয়। এক্ষেত্রেও মধ্যপন্থাই শ্রেয় বোধহয় তাই, অর্থাৎ স্মৃতি মোটামুটি টাটকা থাকতে থাকতে লিখে ফেলা। স্মৃতিচিত্রণের ক্ষেত্রে 'লোহা গরম থাকতে থাকতে...' ব্যাপারটা বোধহয় ঠিক খাপ খায় না তার তাৎক্ষণিক চরিত্রের জন্যে, কিন্তু স্মৃতিকে দীর্ঘ ভার বহন করতে বাধ্য করলে, অজান্তে সে কিছু কিছু ত্যাগ করে ফেলতে পারে যা হয়তো মূল্যবান বলে পরিগণিত হতে পারত। তার থেকে এমনকি দিনলিপি জাতীয় লেখা অনেক মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে। তাই এক্ষেত্রেও, স্মৃতিজাগানিয়া কিছু কিছু উপাদান পেলে, দু-বছরটাও যে নিতান্ত নগণ্য নয় তা প্রমাণিত হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।
কিন্তু আপাতত থামার আগে দুটি বিষয় অবশ্য-উল্লেখ্য। একটি জীবিকা সম্বন্ধীয়, অন্যটি জীবনসম্পৃক্ত। একটি এই বিদ্যালয়ের ভিতরে, একটি বাইরে। কিন্তু দুটিই এই দক্ষিণ বারাশতপর্বে এবং দুটিই জীবন-অবধি। পরস্পরের খানিক পরিপূরকও তারা।
বেণীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক না থাকায় এখানে ভর্তি হওয়া, তা বাবার পরামর্শ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে টাইপ শেখার। সুতরাং ভর্তি হওয়া মন্টুদার বি অ্যান্ড কে কমার্শিয়াল কলেজে, বাজারের ভিতর দিয়ে পুবমুখো স্টেশন রোডের দখিন গায়ে, জায়গা-জমির রেজিস্ট্রেশন অফিসের পাশে। রেমিংটন, হালদার, গোদরেজে সেই asdfg ;lkjh ইত্যাদি। ছোটখাটো শরীরের ইন্দ্রলুপ্ত ভদ্র মানুষ মন্টুদা বেশ ভালবাসতেন এই ছাত্রটিকে। বাবার পরামর্শটা কাজ দিল। আক্ষরিক অর্থেই। মাস্টার্সে পা রাখার আগেই, সাম্মানিক স্নাতক হতে-না-হতেই স্টাফ সিলেকশন কমিশনের দৌলতে লিখিত পরীক্ষায় উতরানোর পর টাইপে পাশ করে চাকরি পাওয়া কেন্দ্রীয় সরকারে ক্লার্ক/টাইপিস্ট পদে। ভাবতে ভাল লাগে যে কর্মস্থলে কেবল টাইপ বা সাইক্লোস্টাইল মেশিনে পঁচিশ-পঞ্চাশ-একশো-দুশো কপির জন্যে স্টেনসিল কাটিং-ই নয়, হাজার হাজার কপির প্রয়োজনে অফসেট মেশিনের জন্যে অ্যালুমিনিয়ামের প্লেটেও টাইপ করেছি অনেকদিন (খুব মনোযোগ আর যত্নের প্রয়োজন হত প্লেটকাটিং-এ)। দেখতে দেখতে সে চাকরি তেত্রিশ পার! সে 'বাক্সো পেটানো' বহুদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে। টাইপ রাইটারের টিকির নাগাল পাওয়া ভার অফিস-কাছারিতে। টাইপ রাইটার, ইলেকট্রনিক্স টাইপ রাইটার প্রভৃতি পেরিয়ে এখন ছেয়ে গেছে কম্পিউটার, স্ক্যানার, ফটোকপিয়ার ইত্যাদি (মেইল আসিয়া ফ্যাক্সও লইয়া যায়-যায়)। আজ কেবল বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও কেউ কেউ বসেন টাইপ রাইটার নিয়ে। কিছুদিন আগে এক দরকারে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে গিয়েছিলাম, এক বয়স্ক মানুষকে টাইপ করতে দেখে, না থাকতে পেরে অনুমতি নিয়ে ছবি তুলেছিলাম হারিয়ে-যাওয়া বহুদিনের সঙ্গীর।
বিদ্যালয়ের পুবদিকে নিচের তলার মাঝ বরাবর গ্রন্থাগারটি দেখে আমার বিস্ময় না জেগে পারেনি। আগের বিদ্যালয়ে কোনো গ্রন্থাগার ছিল না। আমার গ্রামের সরকার পোষিত গ্রামীণ সাধারণ পাঠাগার গোকর্ণী কালীপ্রসাদ-কমলাকান্ত ইনস্টিটিউটের প্রতিও তখনও তেমন করে আকর্ষিত হইনি। এক-আধটি বই সবে পড়েছি মাধ্যমিকের পরে বোধহয়। দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'নাম তার ভাবা', আর একটি 'ব্লাড ব্যাঙ্কার' (বোধহয় ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের)। শেষেরটি বা সম্ভবত দুটিই পাশের গ্রাম ঘনশ্যামপুরের সহপাঠী ও বন্ধু বহুপাঠী পরেশ নস্করের মাধ্যমে। এসবের আগে অবশ্য মাটির ঘরের পাশের দিকে অবস্থিত একটু উপরভাগের ছোট জানালার কোলে টিনের ছোট্ট ট্রাঙ্কে খাতা-কাগজপত্র ইত্যাদির মধ্যে রক্ষিত আকর্ষণীয় সম্ভবত ভৌতিক এক গল্প সংকলন পড়েছি, নামটা আজ আর মনে নেই আর পুরো ট্রাঙ্কের বইপত্র একদা বল্মীকেরা সযতনে উপর অক্ষত রেখে ভিতর সম্পূর্ণতই সাবাড় করে দিয়েছিল। এ গ্রন্থাগারে দেখি শরৎচন্দ্র, তো তাঁর সমগ্র রচনা; সৈয়দ মুজতবা আলি, তো তাঁর পুরো রচনাবলি; শরদিন্দু, তো উপর-উপর সাজানো তাঁর পুরো অমনিবাস— আরিব্বাস্!
গ্রন্থাগারিক শ্রীপতিবাবু, শ্রীপতি হালদার। একটু বেঁটে করে, হালকা চেহারা, ধুতিপাঞ্জাবিশোভিত মানুষটি। একটি পা সক্রিয় নয়, ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটেন। প্রথম যেদিন বই নিই, তিনি হয়তো জিজ্ঞাসা করেছিলেন কী বই নিতে চাই। ধাঁধিয়ে-যাওয়া-চোখে হয়তো তাঁর প্রস্তাবমতো বা তড়িঘড়ি নিজেই শরৎচন্দ্র নির্বাচন করেছিলাম। কিন্তু শরৎ চাটুজ্জে আমার অনেক স্বাধীন সময়ে ভাগ বসালেন, কোনও কোনওদিন সারারাত জাগিয়ে রাখলেন! কাজকর্মের ফাঁকে, পড়াশোনার ফাঁকে চলল আর-এক পড়াশোনা। পড়ার বইয়ের বাইরে পড়া। শেষে এমন হল, গ্রন্থাগারে বই ফেরত দিতে গেলে শ্রীপতিবাবু বলতেন কী পুরকাইত, আজ শরৎচন্দ্রের কোন বই দেব? শরৎচন্দ্রের পরে শুরু হল অন্যান্য লেখকের নানান বই পড়া। এদিকে একসময় সদস্য হয়েছি পাশের পাড়ায় অবস্থিত আমাদের গ্রামের গ্রন্থাগারটির। ফল, উচ্চমাধ্যমিক থেকে সাউথ সিটির হেরম্বচন্দ্র কলেজ— যেখানে একটা তলজুড়ে রাশি রাশি বই— থেকে স্নাতক পরীক্ষায় নম্বরের ক্রম-অধোগতি! আগের স্কুলে নিমাই স্যার বলেছিলেন একটুখানি খাট তোর ফার্স্ট ডিভিশন হয়ে যাবে। কথাটা এতটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল সেটাকে আর গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনই মনে হয়নি। পরীক্ষার ফল যখন বেরলো মাধ্যমিকের, দেখা গেল সত্যিই আর একটু খাটলে প্রথম বিভাগেই উত্তীর্ণ হওয়া অসম্ভব ছিল না! শিবদাস আচার্য্যতে যখন ভর্তি হতে গিয়েছিলাম, যিনি ফর্ম দিচ্ছিলেন, নম্বর দেখে বললেন, 'তোমার তো বিজ্ঞান হয়ে যাবে, কমার্স নিচ্ছ কেন?' আমি শশব্যস্ত হয়ে বললাম, 'না-না, আমি কমার্সেই পড়ব। আমার অঙ্কে ভয়।' অঙ্কে আমার বিশাল ভীতি! তার উপরে মেজদা কমার্স নিয়ে পড়েছিল, তার বইগুলো পাওয়া যাবে যে! সুতরাং পড়াশুনা চলল বাণিজ্য বিভাগে। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম কলা বিভাগই যেন আমার উপযুক্ত ছিল। কিন্তু যাই নিয়ে পড়ি না কেন, কলা বিভাগের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল এই বিদ্যালয়ই। বাণিজ্য বিভাগের স্নাতক স্তরে পড়ার সময় অন্যান্য বইপত্র পড়তে পড়তে এক সময় মনে হল যে আমারও কিছু বলার আছে, আমারও নিজস্ব কিছু কথা আছে, আমার মধ্যেও কিছু বিতর্ক আছে! শুরু হল মনের কথাকে কলমে ধরা। আস্তে আস্তে যা ওতপ্রোত হয়ে গেল জীবনের সঙ্গে।
দুটি বছর অন্তে আবার আমরা ঝাঁকের কই হিসাবে বেরিয়ে কে কোন অন্য ঝাঁকে মিশেছি কে জানে! সেখান থেকে জীবনের কে কোন ঘাটে! কে জানে কার জীবন ইতোমধ্যে কোথায় থেমে গেছে, কার কোথায় থামবে! হ্রস্ব-দীর্ঘ জীবনে ক'জনের খবর থাকে পরস্পরের কাছে! এখন তবু সামাজিক মাধ্যম ইত্যাদির দৌলতে কিছু কিছু যোগাযোগ সম্ভব হয়। সচরাচর কোনও একমাত্র বিদ্যালয়ে শিশুশিক্ষা থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষাশেষে বেরোনো— সম্ভব হয় না, তাই প্রাথমিক থেকে উচ্চ বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়— যাত্রা আনন্দ-বেদনামেশা। একত্র থেকে বিচ্ছিন্ন, পুরোনো বৃত্ত থেকে নববৃত্ত, পরিচয়ের ইতি থেকে আরম্ভ, তারই মধ্যে কোনও কোনও সম্পর্কের দীর্ঘ অন্তরঙ্গ পথচলা— কতকিছুই না শেখায় ছোটবেলা থেকে, শিক্ষাসত্রের এক-একটি ঘাট! আর জীবনের অনিবার্য গীতই তো যেন — 'তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।' এই বছরেরই প্রথম সপ্তাহে (৬, ৭ ও ৮ জানুয়ারি) বিলম্বিত পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান (কোভিডের কারণে) পার-করা আমার জীবনের কম সময়ের কিন্তু বহুমূল্যের এই ঘাটটির পাদপীঠে প্রণতিস্বরূপ আপাতত এইটুকুই।
তার মঙ্গল হোক, অক্ষুণ্ণ থাক তার সমৃদ্ধ জয়যাত্রা।
===================
অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক — গোকর্ণী,
থানা — মগরাহাট,
জেলা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।