বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। নারীত্বের অপমান ।। দীনেশ সরকার


  

 নারীত্বের অপমান  

 

   দীনেশ সরকার

 

 

গরিবের ঘরে রূপ নিয়ে জন্মানো যে কি বিড়ম্বনা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দেবী । মা-বাবা দেবীর মতো দেখতে বলে বড় সাধ করে নাম রেখেছিল দেবী ।  রূপসী না হয়ে খেঁদি-পেঁচি হলেই বোধহয় ভালো ছিল । এত বিড়ম্বনা সইতে হ'তো না । স্কুলে  আসা-যাওয়ার পথে ছেলে-ছোকরাদের টিপ্পনি, কুবাক্য, বাঁকা চাহনি না হয় সহ্য করা যায়, কিন্তু বাবার বয়সী আধবুড়ো লোকগুলো যখন হা-করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে বড় অস্বস্তিতে পড়ে দেবী ।মাথা নীচু করে চলে যায় । ক্লাসের বন্ধুরাও তো কম টিকা-টিপ্পনি কাটে না, 'আমরা তো আর তোর মতো রূপের ডালি নিয়ে জন্মাইনি যে সবাই আমাদের দিকে চেয়ে থাকবে । তুই ভাগ্যবতী, দেখিস্‌ একদিন এক রাজপুত্র এসে পক্ষীরাজে চাপিয়ে তোকে ঠিক উড়িয়ে নিয়ে যাবে', বলেই সবাই বিদ্রুপের হাসি হাসতে থাকে । অস্বস্তিতে পড়ে যায় দেবী, বলে, 'যাঃ, তোরা কি সব বলিস্‌ না ।'

                  বাবা-মারও দুশ্চিন্তার শেষ নেই । দেবীর আরও একটা ছোট বোন আছে মিনু,  তাকে নিয়ে বাবা-মার অত চিন্তা নেই যতটা চিন্তা দেবীকে নিয়ে । দিনকাল মোটেই ভালো নয় । মেয়ে বড় হয়েছে, কখন যে কি হয়ে যায় । দেবীর মা মনে মনে ভগবানকে ডেকে বলে, ' ভগবান, গরিবের ঘরে দেবীকে এত রূপ দিয়ে কেন পাঠালে ? আমার মিনুর মতো করে কেন পাঠালে না । ওই রূপের আগুন আমি কি করে আঁচল দিয়ে আড়াল করে রাখবো !'   

                    পাশের গাঁয়ের হরেন ঘটকও দেবীর পিছনে পড়ে যায় । দেবীর বাবাকে ডেকে বলে, 'রমাপদ, মেয়ে তো বড় হয়েছে এবার বিয়ের ব্যবস্থা করো । আমার হাতে ভালো পাত্র আছে । মিলিটারীতে কাজ করে । একেবারে দাবীহীন পাত্র শুধু সুন্দরী পাত্রী চাই । তোমার মেয়ে খুব সুখে থাকবে । পাত্র পক্ষকে আসতে বলবো নাকি ।'

                  রমাপদ বলে, ' আমার মেয়ে তো এখনও ছোটো হরেনকাকা । এগারো ক্লাসে পড়ে । বয়স ষোলো । তুমি তো জান হরেনকাকা, আঠারো বছর না হলে মেয়ের বিয়ে দেওয়া উচিৎ নয় । আমার দেবীমা এখন পড়ছে  । আগে আঠারো বছর হোক,  উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করুক, তারপর বিয়ের কথা ভাববো ।'  

                     হরেন ঘটক জিজ্ঞেস করে, ' তা কবে তোমার মেয়ের আঠারো পূর্ণ হবে ?'

                   দেবীর মা রান্নাঘর থেকে উত্তর দেয়, 'সামনের ফাল্গুনের পরের ফাল্গুনে আমার দেবীর আঠারো পুর্ণ হবে ।'  

                   'ততদিন কি আর ছেলের বাবা বসে থাকবে । ছেলের অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেবে । তবে ভেবো না, আমার হাতে অনেক পাত্র আসবে, তোমার মেয়ের বিয়ে আমি সময়মতো দিয়ে দেবো ।' 

                    আপাতত হরেন ঘটক বিদেয় হয় । কিন্তু তাতেও কি স্বস্তি আছে । একদিন আর এক ঘটক বীরেন মুখুজ্জ্যে হাজির, 'কই গো রমাপদ, বাড়ি আছো নাকি ? '

                   দেবীর মা ঘোমটা টেনে বাইরে এসে বলে, ' না, কাকা, দেবীর বাবা চাষের কাজে গেছে । তা কি বলবেন বলুন ।'

                  'কি আর বলবো বউমা, মেয়ে বড় হয়েছে, তার বিয়ে দিতে হবে তো । তার উপর তোমার মেয়ের যা রূপ, কোন্‌দিন কি অঘটন ঘটে যাবে তার ঠিক নেই । তাই সময় থাকতে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হও । আমার হাতে ভালো পাত্র আছে, যেমন ঘর, তেমন বংশ । তোমার মেয়ে রাজরানি হয়ে থাকবে ।'  

                   'দেবীর বাবা বলছিলো, আমার দেবীমার আঠারো পূর্ণ না হলে বিয়ে দেবে না । আঠারো পূর্ণ হোক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিক তারপর আপনি আসবেন । দেবীর  বাবার সাথে কথা বলবেন ।'

                   'না, আমি বলছিলাম, দেখাশোনাটা এখন করে রাখলে ক্ষতি কি ? বিয়েটা না হয় পরে হবে । তুমি বউমা রমাপদকে একটু বুঝিয়ে ব'লো ।'

                 'কিছু মনে করবেন না কাকা, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না হ'লে আমারা ওর বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছি না । এখন বিয়ে বিয়ে করলে ওর পরীক্ষার ক্ষতি হবে ।'

                  'যা ভালো বোঝো তোমরা ।'  ঘটক বীরেন মুখুজ্জ্যে বিদেয় হয় ।   

                  দেবীর আঠারো পূর্ণ হয় আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাও শেষ হয় । একদিন হরেন ঘটক উদয় হয়, 'এই যে রমাপদ, তোমার কাছেই এলাম । মেয়ের পরীক্ষা তো শেষ হয়েছে । তা এবার তো বিয়ের কথা ভাববে ? একটা খুব ভালো পাত্র আছে ।  রূপ-গুণ –বংশ শুনলে তুমি ভিরমি খাবে । তাদের শুধু একটাই কথা  সুন্দরী মেয়ে চাই । তা আমার হাতে তো তোমার মেয়ের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে আর কেউ নেই । তাই তোমার কাছে চলে এলাম । পাত্র কে শুনবে ? মহিষপোঁতার জমিদার বাড়ির ছেলে । এখন অবশ্য জমিদারী নেই কিন্তু জমিদারের রক্ত তো শরীরে বইছে । সেই ঠাট-বাট এখনও বজায় আছে । আর অবস্থা ? আশে-পাশের চার-পাঁচটা গ্রামে তাদের মতো ধনী আর একজনও নেই ।  একমাত্র ছেলে । ছেলের ধান-চালের আড়ৎ, পাটের গুদাম আরও কি সব ব্যবসা আছে । তারউপর জমিজমা তো আছেই । থানার দারোগাবাবুর সাথে কর্তামশাইয়ের খুব ভাব । শুনে এলাম, প্রতি মাসেই দারোগাবাবু কর্তামশাইয়ের কাছে আসেন । তাদের বাড়ির রাঁধুনি ঠাকুর আমাদের গাঁয়ের লোক । সেই এসে আমায় খবর দিলো । কর্তামশাই ছেলের বিয়ে দেবেন, তোমার হাতে যদি সুন্দরী মেয়ে থাকে তুমি কর্তামশাইয়ের সাথে দেখা করতে পারো ।  তাই আমি কর্তামশাইয়ের সাথে দেখা করে জানলাম তাদের শুধু একটাই দাবী, সুন্দরী মেয়ে চাই । কোনো পণ নয়, কোনো দাবীদাওয়া নয় । কর্তামশাই আর গিন্নিমার মেয়ে পছন্দ হলেই সোনায় মুড়ে তোমার মেয়েকে নিয়ে যাবে । তোমার মেয়ে রাজরানির মতো থাকবে । কুটো গাছটিও নাড়তে হবে না । চাকর-বাকর, দাস-দাসী তারাই সব কাজ করে । তুমি যদি রাজি থাকো তো আমি কর্তামশাইকে গিয়ে খবরটা দিই, কবে তারা মেয়েকে দেখতে আসবেন আমি তোমায় জানিয়ে যাবো ।'

                   রমাপদ বলে, 'একটু ভেবে দেখি হরেনকাকা, তারপরে বলবো ।'

                 'বলি, এতে ভেবে দেখার কি আছে ? এমন সম্বন্ধ লাখে একটা হয় । একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে দুবার আর আসে না, বুঝলে রমাপদ ।'

                  'তবু, মেয়ের বিয়ে বলে কথা, একটু তো ভাবতে হবে । মেয়ের মায়ের সাথে আলোচনা করতে হবে, মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে ।'    

                 'ঠিক আছে । তুমি আজ কথাবার্তা যা বলার বলে নাও । আমি কাল সকালে এসে তোমার মত জেনে যাবো ।' হরেন ঘটাক বিদায় নেয় ।

                 গরিব কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতা । মেয়ের এখন বিয়েতে মত না থাকা সত্ত্বেও ঘটককে জানিয়ে দেয় পাত্রপক্ষকে নিয়ে আসতে ।  কারণ, গরিব ঘরে মেয়ের মতামতের কোনো দাম নেই ।   

 

                খুব ধুমধাম করে দেবীর বিয়ে সম্পন্ন হয় । এলাহি কান্ড । সব খরচ কর্তামশাইয়ের । জমিদারের ছেলের বিয়ে বলে কথা ! জমিদারী যদিও নেই, কিন্তু জমিদারের দম্ভ ষোলো আনা । বিয়ের এক সপ্তাহ আগে লোক-লস্কর মেয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় । তারাই  বিয়ের সমস্ত আয়োজন করে । শুধু সারা গ্রাম নিমন্ত্রণ করা ছাড়া রমাপদর বিশেষ কোনো কাজ থাকে না । গ্রামের দু-একজন প্রাজ্ঞ মানুষ শুধু বলেন, 'জমিদার বাড়িতে সম্বন্ধ করছো, শেষ রক্ষা করতে পারবে তো রমাপদ । সাদি-বিয়ে কিন্তু সমান সমান না হলে পরে ভুগতে হয় ।'

                রমাপদ হাতজোড় করে বলে, 'কি করবো কাকাবাবু । জমিদারবাবুর আমার মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছে । তাই তো এ বিয়েতে রাজি হলাম ।'

              বিয়েতে খাওয়া-দাওয়ার অঢেল আয়োজন । গ্রামবাসীরা কর্তামশাইয়ের গুণকীর্তনে ব্যস্ত । এমন বিয়ে তারা কোনোদিন দেখেনি । এমন ভোজ তারা কোনোদিন খায় নি । যাওয়ার সময় রমাপদকে বলে যায়, 'তোমার মেয়ে কপাল করে জন্মেছিলো বটে । তার কপালজোরে তোমারও কপাল খুলে গেল রমাপদ । নিখরচায় মেয়ে পার করে দিলে ।'

                  পাড়ার মা-কাকীরা দেবীকে বলে, 'বড়  কপাল নিয়ে জেন্মেছিলি দেবী । রাজপুত্রের মতো বর, অত বড় ঘর , আর কি চাই তোর দেবী !'

                  দেবী কিছু বলে না , শুধু ভাবে, সত্যিই কি সে ভালো কপাল নিয়ে জন্মেছে !    

                 গা-ভর্তি স্বর্ণ অলংকারে ভূষিতা হয়ে দেবী শ্বশুরবাড়িতে পা রাখে । দেবীর শাশুড়িও অপরূপা সুন্দরী ।   দ্বিরাগমন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল । দ্বিরাগমন থেকে ফিরে আসার পর দেবী তার স্বামীর স্বরূপ একটু একটু করে উপলব্ধি করতে থাকে । প্রায়ই রাত করে বাডি ফেরে । দেবী জিজ্ঞেস করে, ' কি গো, এত রাত করে ফিরলে ?'

                   দেবীর স্বামী উত্তর দেয়, 'কাজ ছিল । আমাদের কত ব্যবসা, কত কাজ তোমার কোনো ধারণা নেই ।'  দেবী মেনে নেয় ।

                  মাঝেমাঝেই দেবীর স্বামী নেশা করে টলতে টলতে মাঝরাত্রে ঘরে ফেরে । দেবী চুপচাপ বসে থাকে । একদিন থাকতে না পেরে প্রশ্ন করে, 'আজও তুমি নেশা করেছ ?'

                 দেবীর স্বামী জড়ানো গলায় উত্তর দেয়, 'করেছি, বেশ করেছি । তোর বাবার পয়সায় তো করিনি । এই রজত মুখুজ্জ্যে কাউকে কৈফিয়ত  দেয় না ।'  টলতে টলতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে ।

                 দেবী বুঝতে পারে তার কপাল পুড়ছে । কিন্তু কি করবে দেবী ? চুপচাপ মেনে নেবে না প্রতিবাদ করবে ?

                 একদিন রাত্রে রজত বাড়ি ফেরে না । দেবী রাত জেগে বসে থাকে । ভাবে, কোথাও কাজে গিয়ে আটকা পড়েছে তাই ঘরে ফিরতে পারেনি ।

                কিন্তু এ রকম মাঝে মাঝেই হতে থাকে । সকালে উসখু-খুস্খু হয়ে ঘরে ফেরে । দেবী আর সহ্য করতে পারে না । শাশুড়ির কাছে প্রতিবাদ জানায়, 'মা, আপনার ছেলে কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি ।'

                    শাশুড়ি শান্তভাবে উত্তর দেয়, 'আমি জানি বউমা ।'

                   'আপনি জানেন মা ?  তবু আপনার ছেলেকে কিছু বলবেন না !'

                   'কোনো লাভ নেই বউমা ।  এরা কেউ তোমার আমার কথা শুনবে না ।'

                   'কি বলছেন মা !'

                   'হ্যা, বউমা । সব কিছু মেনে নাও ।'

                   'মেনে নেবো ! কি বলছেন মা !'

                   'ঠিকই বলছি বউমা । তোমার স্বামী আজ যা যা করছে তোমার শ্বশুরমশাইও ঠিক তাই তাই করতো । একই রক্ত শরীরে বইছে তো । এটা এদের রক্তের দোষ । জমিদারীর দম্ভ আর জমিদারের রক্ত ।'

                   'আপনি প্রতিবাদ করেন নি ?'   

                 'হ্যা, করেছি । কিন্তু কোনো লাভ হয় নি । আমার শাশুড়িও তো ভুক্তভোগী । তাই সেদিন আমার শাশুড়ি আমাকে যে কথা বলেছিলেন আজ আমিও সেই একই কথা তোমাকে বলছি, সব কিছু মেনে নাও মা ।  আসল কথা কি জানো মা, এরা গরিব ঘরের সুন্দরী মেয়েদের বাড়ির বউ করে নিয়ে আসে যাতে তারা প্রতিবাদ করতে না পারে । সংসার ছেড়ে চলে যেতে না পারে । আমার বাবাও তোমার বাবার মতো গরিব ছিল, তাই আমাকে মুখ বুঁজে সব কিছু সহ্য করতে হয়েছে । তাই বলছি মা, সব কিছু মেনে নাও ।'   

                   শিক্ষিতা দেবী সব কিছু মুখ বুঁজে মেনে নিতে পারে না । কর্তামশাইয়ের কাছে গিয়েও সোচ্চার হয় । কর্তামশাই উল্টে তাকেই দোষারূপ করে, 'দেখো বউমা, তোমাকে ছেলের বউ করে এনেছি ছেলেকে ঘরে বেঁধে রাখতে পারবে বলে । তুমি যদি ছেলেকে ঘরে ধরে রাখতে না পারো সে দায় তো তোমার ।'

                 দেবীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় যখন ধোপাকে রজতের জামাকাপড় দিতে গিয়ে  দেখে তার জামায়, পাঞ্জাবীতে লিপস্টিকের দাগ, সিন্দুরের দাগ । রাগে ফুঁসতে থাকে দেবী ।

                  সে রাত্রে মোটামুটি প্রকৃতিস্থ অবস্থায় ঘরে ফেরে রজত । দেবী নিজের সমস্ত পোশাক খুলে নগ্ন হয়ে রজতের সামনে দাঁড়ায় । রজতের চোখে চোখ রেখে বলে, 'ভালো করে দেখো, দেখে বলো কি আমার নেই । আর যাদের কাছে তুমি যাও তাদের আমার থেকে কি বেশী আছে ।  বলো, তোমাকে বলতেই হবে ।'

                 রজত রেগে বলে,  'কাপড় পরে নাও দেবী । আমার মাথা গরম করে দিও না ।'

                দেবীরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, বলে, 'না, তোমাকে আজ বলতেই হবে  । আমি তোমাকে কোন্‌ সুখ দিতে পারি নি যার জন্য তুমি অন্য নারীর কাছে যাও ।'

                 রজত আবারও বলে, 'কাপড় পরে নাও দেবী ।'

                 দেবীরও মাথায় আগুন চড়ে যায়, বলে, 'না, তোমাকে আজ বলতেই হবে ।'

               রজতের মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়, বলে, 'তাহলে, শোনো, রোজ রোজ এক নারীসঙ্গ আমার ভালো লাগে না ।'

                 দেবী চেঁচিয়ে ওঠে, 'তাহলে আমায় বিয়ে করেছিলে কেন ?'   

                রজত বলে,  'কে্নো, বিয়ে করেছি বংশ রক্ষার জন্য । কোন্‌ অভাব তোমার পূরণ হয় নি ? সোনাদানায় ভরিয়ে দিয়েছি । বিলাস-ব্যসনে দিন কাটছে । দিব্যি আছো । বলো, তোমার আর কি চাই ?'

                 দেবী ডুকরে কেঁদে ওঠে ।  রজতের পা জড়িয়ে ধরে বলে, 'ওগো, আমার কিচ্ছুটি চাই না । শুধু তুমি আমার কাছে থাকো । রোজ রাত্রে তুমি ঘরে ফিরে এসো, আমার কাছে থেকো । আর কিচ্ছু আমার চাই না ।'

               রজত ধাক্কা দিয়ে দেবীকে ফেলে দিয়ে এক ঝটকায় পা সরিয়ে নেয়, বলে, 'বউয়ের আঁচল ধরে থাকা আমার পোষাবে না । আমি জমিদার বংশের বংশধর । জমিদারের রক্ত আমার শরীরে । বউয়ের নেওটা হওয়া আমার কাজ নয় ।'    

              দেবী উপলব্ধি করে তার নারীত্ব এখানে পদে পদে উপেক্ষিত । স্ত্রী এদের কাছে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয় । স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা এদের কাছে অর্থহীন শব্দ মাত্র । তবু দেবী তার ভালোবাসা দিয়ে রজতকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয় । তার  স্বামীর উপেক্ষা, তার নারীত্বের অপমান দেবী মেনে নিতে পারে না । নারীত্বের অপমান হজম করে ভোগবিলাসের জীবন সে চায় না । 

                দেবী এক কাপড়ে তার বাবা-মার কাছে ফিরে যায় । যাওয়ার সময় শাশুড়িকে জানিয়ে যায়, 'নারীত্বের অসম্মান সে বয়ে বেড়াতে পারবে না তাই চলে যাচ্ছে । যেদিন আপনার ছেলে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করবে সেদিন আমার খোঁজ করবেন ।'

                গরিব বাবা-মা দেবীর এই প্রত্যাবর্তনে বিরক্ত হয় । দেবীকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায় । দেবীর মা বলে, 'একটু মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারলি না মা । বড় আশা করে জমিদার বাড়িতে তোর বিয়ে দিয়েছিলাম, তুই একটু মানাতে পারলি না । সব ছেড়েছুড়ে চলে এলি ! এখন আমরা পাড়ায় মুখ দেখাবো কি করে ?'  দেবী সব কিছু মাকে খুলে বলে । শরীরে দু-একটা ক্ষতও মাকে দেখায় । বলে, নিজের সাথে যুদ্ধ করে আমি আর পারছি না মা । আমি আরও পড়বো মা । আমি নিজের পায়ে দাঁড়াবো । তোমরা যদি আমাকে দুমুঠো খেতে দিতে না পারো তো বলে দিও । আমি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাবো । তবু আমি পড়বো ।'

               উচ্চ মাধ্যমিকে ভালোই রেজাল্ট করে দেবী তাই কলেজে ভর্তি হতে কোনো সমস্যা হয় না।  পাড়া-পড়শিদের টিকা-টিপ্পনি কুকথা গায়ে না মেখে অবিচল লক্ষ্যে এগিয়ে চলে দেবী ।

 

  -------------------------------------------

                

দীনেশ সরকার

১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,

প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ---- ৭২১৩০৬

                       

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.