আনসিঙ্কেবল লেডি
সুচন্দ্রা বসু
৬০ বছর বয়সে জেসপ যাত্রী সেবিকার চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তিনি চেয়ারে বসে ভাবছিলেন অতীত জীবনের কথা। তার জীবনে সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো এতো ঢেউ আছড়ে পড়েছে, তাতে তিনি হাবুডুবু খেলেও ডুবে যান নি।
শৈশবে তিনি বাবাকে হারান।মা সাত ভাইবোনকে নিয়ে চলে আসেন ইংল্যান্ডে।সন্তানদের বাঁচাবার
তাগিদে জাহাজে স্টুয়ার্ডের চাকরি নেন।জেসপ তখন স্কুলের ছাত্রী। মা ও খুব বেশিদিন বাঁচেন নি।
ফলে তাকে পড়াশোনা ছেড়ে ছয় ভাইবোনকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হয়।সেও মায়ের মতো ঢোকে স্টুয়ার্ডের কাজে,মাত্র ১৮ বছর বয়সে।প্রথমে সে 'অলিম্পিয়া' জাহাজে স্টুয়ার্ডের চাকরি
নেয়।যাত্রা শুরুর পরেই জাহাজটির একটি যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।জাহাজ ডুবতে
ডুবতে কোন মতে তীরে এসে পৌঁছালে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান।এই প্রথম নয় মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে
নিতে আরও আগে একবার এসেছিল শিশুকালে। সাত আট বছর বয়সে মারাত্মক যক্ষারোগ হয়েছিল।ডাক্তার সেবার নিদান দিয়েছিল বাঁচার আশা নেই।তার মা শুনে খুব কান্নাকাটি করেছিলেন।মহাত্মা যীশুর কাছে প্রার্থনা করে জীবন ভিক্ষা করেছিলেন।সে যাত্রায় জেসপ বেঁচে যান।
এরপর ২৪ বছর বয়সে তিনি ১৯২১ সালের ১০ এপ্রিল টাইটানিকে স্টুয়ার্ডস হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। যাত্রা শুরুর ৪ দিন পর ১৪ এপ্রিল জাহাজটি একটি হিমশৈলে আঘাত লেগে বিধ্বস্ত হয়। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি জাহাজের যাত্রীদের উদ্ধার করেন।তার মধ্যে একটি শিশুও ছিল। উদ্ধার করা যাত্রীদের নিয়ে তিনি কার্থাপিয়া জাহাজে করে পাড়ে এসে পৌঁছায়।
এরপর ব্রিটানিক নামক একটি জাহাজের ক্রু হিসেবে নিযুক্ত হলেন। হঠাৎ একদিন জাহাজে আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে।ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় তিনি সাগরে লাফিয়ে পড়ে।
লাইফ জ্যাকেট পড়ে থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এরপর উদ্ধারকারীরা তাকে লাইফবোটে উঠিয়ে নেন।এইভাবে মৃত্যু তাকে বারবার ছিনিয়ে নিতে এসেছে।সে হার মানেন নি।
৬০ বছর বয়সে অবসর নেওয়ার পর তিনি একটি অচেনা নন্বর থেকে ফোন কল পান।
ফোন টা তুলে কানে নিতেই তিনি শুনতে পান ওপ্রান্ত থেকে কেউ বলছে, - আমি কি মিসেস জেসপের সঙ্গে কথা বলছি?
- হ্যাঁ আমি জেসপ।
- আপনার মনে আছে,আপনি টাইটানিক জাহাজে একটি শিশুকে বাঁচিয়েছিলেন?
জেসপ উৎসাহিত হয়ে বলে ওঠেন, হ্যাঁ মনে আছে।
- আমি সেই শিশুটি,আমার নাম মারিয়া। আমি একদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
শুনে জেসপের গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। সে আগ্রহ ভরে বলে ওঠে - হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আগে ফোন করে
যেদিন খুশি চলে আসুন।
- যেদিন যাব ফোন করেই যাব।
জেসপ চেয়ারে বসে ভাবছিলেন এইতো জীবনের বড় প্রাপ্তি।
এইসব ভাবতে ভাবতে তিনি অতীতে ডুবে গেছিলেন।কখন অন্ধকার নেমে এসেছে টের পাননি।পরিচারিকা ঘরে এসে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বলল।কিগো দিদি কি ভাবনায় ডুবেছিলে।
জেসপ মৃদু হেসে বলেন মৃত্যু আমায় ডোবাতে পারেনি সমুদ্রে।অথচ স্মৃতি আমায় অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে।এইজন্য সবাই তাকে আনসিঙ্কেবল লেডি বলে। মৃত্যু যার প্রাণ নিতে পারেনি, হৃদরোগ তাকে
৮১ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে কেড়ে নিয়েছে।
---------------------------