সাহিত্যে রম্যগল্প (তৃতীয় পর্ব) ।। রনেশ রায়
সাহিত্যে রম্যগল্প
(তৃতীয় পর্ব)
রনেশ রায়
বিয়ের পাত্র
সুমন বাবুর সুন্দরী বিবাহযোগ্যা মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেছে। পাত্রের বাবা মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। জানা গেছে সুপাত্র। মাসে পাঁচ কোটি টাকা রোজগার করে। প্রতিষ্ঠিত পাত্র। এই বয়সেই বিশ্বের একটা নামকরা বহুজাতিক সংস্থার সি ই ও (CEO)। ওদের মেযে পছন্দ হয়েছে। বেশ কিছু দাবি আছে। সেটায় আপত্তি নেই সুমনবাবুর। একই মেয়ে। ব্যবসায়ী মানুষ।
সুমন বাবু ছেলের বাবার সঙ্গে চূড়ান্ত কথা বলতে এসেছেন। ছেলের বাবার কাছে জানতে চান:
ছেলে কোথায়? একবার মেয়েকে দেখুক। আর আমরাও ছেলেকে দেখি।আপনাদের সব দাবিদাওয়াই ঠিক আছে। পাঁচ কোটি টাকা নগদএ আপত্তি নেই।
ছেলের বাবা : এখন ও অফিসের কাজে ব্যস্ত। সময় করে সেটা করা যাবে।আর আমাদের পছন্দই ওর পছন্দ।
অনেক কথাবার্তার ফাঁকে সুমনবাবু জানতে পারেন ছেলে ফ্রান্সে থাকে। সুমনবাবু নমস্কার জানিয়ে বলেন ঠিক আছে। পরে বিয়ের দিন ঠিক হবে। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। বাইরে গাড়িতে বসে স্ত্রীকে বলেন এখানে বিয়ে দেওয়া যাবে না। স্ত্রী জানতে চান কেন। এতদিন তো তারা এরকম পাত্রই খুঁজছিলেন। সুমনবাবু বলেন :
জান না এই করোনার বাজারে বিয়ের স্টক মার্কেটে বিদেশি পাত্রের দাম তলানিতে। এত দাম দিয়ে জামাই কেনা যাবে না।
গরু না গাধা
রোজকার মত রন্টু আজও বাজারে গেছে। সবজি মাছ ছাড়াও আজ অনেক কিছু কেনার। স্ত্রী মিনতি লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। এক এক করে ধরে ধরে সব কিনতে হয়।সে যখন মাছের দোকানে তার আগেই একজন তারই বয়সের বেশ পরিপাটি মানুষ এসেছেন। মনে হচ্ছে পাড়ায় নতুন।আগে রন্টু উনাকে দেখে নি।যথেষ্ট বিত্তশালী বলেই বোধ হচ্ছে।সাহেবি কায়দা। কভিড তেমন নেই তাও মুখে মুখোশ। দু তিনরকম মাছ কেনার জন্য উদগ্রীব।রন্টু ছোট ক্রেতা হলেও রোজের কারবারি। বাজারটা তার নখদর্পণে। সে উপস্থিত হতেই বিক্রেতা তাকে স্বাগত জানায়।মাছ কেনা ছাড়াও মাছ কাটতে কাটতে বিক্রেতা রন্টুর সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে আলোচনায় ঢোকে। উপস্থিত ভদ্রলোক যেন বিরক্ত বোধ করেন।ভাবটা যেন মাছওয়ালার সাথে এত পীরিত কি ! মাছ কিনবে চলে যাবে তা নয় । একটু বিরক্ত হয়ে মাছ বিক্রেতাকে বলেন:
---- আমার তাড়া আছে। আগে এসেছি। আমাকে দিয়ে তারপর যত খুশি খেজুরে আলাপ করুন।
মাছ ওয়ালার তৎপর উত্তর:
দেখছেন তো আপনার মাছটাই কাটছি।
ভদ্রলোক আর কিছু বলতে পারেন না। রন্টু বিরক্ত হয়। ভদ্রলোকের মাছ কেনা হয়ে গেলে উনি ওজন করিয়ে দাম মিটিয়ে মাছ নিয়ে ঘুরলে রন্টুর মুখোমুখি হন। মুখে মুখোশ পড়া।চেনা মুস্কিল। আগে দেখেছে বলে মন্টুর তেমন মনে হয় না।আবার কেমন যেন চেনা চেনা লাগে। স্মৃতি নামে রন্টুর মাথার পোকাটা জেগে ওঠে। সে কিলবিল করে।যেন চিনিয়েই ছাড়বে। কিন্তু বিশেষ সাহায্য করতে পারে না।ভদ্রলোক চলে যান। রন্টুরও বিরক্তি আসে। সেও বোঝে তাকে উদ্দেশ্য করেই ভদ্রলোক খেজুরে আলাপ কথাটা ব্যবহার করেছেন। একজন অচেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে চোখাচোখি আলাপটা কেমন যেন অম্লমধুর। কে এই সাহেবকে বোঝাবে যে এই মধ্যবিত্ত সাবেকি পাড়ায় একজনের সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের যা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বাঁধা থাকে না। সে যেই হক। এই সব সাহেবি নতুন আসা মানুষদের সে বোধ নেই। যাই হোক বিরক্তির সঙ্গে সে মাথার পোকাটাকে সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটি করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় । পোকাটা জাগলে তার মাথায় অন্য সব কিছু ভুলিয়ে দেয় । ভুলো মন নিয়ে সে বাড়িতে ঢোকে। ব্যাগটা স্ত্রীর হাতে দেয় ।
ঘরে এসে তার মাথায় বেড়িয়ে বেড়ায় স্মৃতি। সে খুঁজে বার করার চেষ্টা করে ভদ্রলোককে কোথায় দেখেছে। তারপর ভাবে পৃথিবীতে কত মানুষ আছে। একজন আরেকজনের মত হতেই পারে। তার জন্য স্মৃতির এত ব্যস্ততা কেন। আবার ভাবে স্মৃতির ব্যস্ততার নিশ্চয় কারণ আছে। এর মধ্যে স্ত্রী মিনতির ঘরে ঢুকে হামলা।এটা আননি সেটা আননি ইত্যাদি।রন্টু বোঝে এ সবই স্মৃতির অসময়ে ঘুম ভাঙ্গার জন্য।ওই হতচ্ছাড়িই এর জন্য দায়ী। একটা মনে করিয়ে দিতে দশটা ভুলিয়ে দেয়।আর সে শালী এখনও মাথায় চড়ে বসে, যাবার নাম করে না। মিনতি আর তার সতীন স্মৃতির দ্বিমুখী আক্রমণে রন্টু পর্যুদস্ত।
এর পর মাস দুয়েক পরে রন্টু বাজারে। সেই ভদ্রলোকের প্রায় মুখোমুখি। আবার রন্টুর মাথায় স্মৃতির বিচরণ। সে জেগে গেছে।পোকাটা কিলবিল করা শুরু করেছে।মাথায় একটা অস্থিরতা। কভিড বিদায়ের ক্ষণে। আজ ভদ্রলোকের মুখে মুখোশ নেই। আগের দিন থেকে তিনি স্পষ্ট রন্টুর স্মৃতিকল্পে। ভদ্রলোকও যেন থমকে। রন্টুর দিকে তাকিয়ে।হঠাৎ রন্টুর ভদ্রলোককে মনে পরে। আজ আর স্মৃতি ব্যর্থ নয়। ধরে নিয়ে এসেছে। সেই ছোটবেলার বন্ধু ধীরাজ না ! কলেজে একসঙ্গে পড়ত।দুজনের গলায় গলায় বন্ধুত্ব। ভদ্রলোকের চোখে মুখে যেন সম্মতি সূচক বিস্ময়। রন্টুর সেদিনের সেই অপদস্ত হওয়ার বিরক্তিটা কোথায় উধাও হয়ে যায়। বাল্য প্রীতি জেগে ওঠে। মুখে মুখোশ না থাকায় সামাজিক দূরত্বটা শিথিল হয়েছে। মুখোমুখি রন্টু প্রশ্ন করে :
------ কিছু মনে করবেন না। আপনি ধীরাজ না !
ভদ্রলোক সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরে বলে:
-------তুই রন্টু তো। সেদিন চিনতে পারি নি। আজ এখন চিনেছি।তুই এখানে এখনও থাকিস।
রন্টু বলে:
------- হ্যাঁ আমি সেই বাড়িতেই। তো তুই কোথায়? আমিতো জানি তুই আমেরিকায়, পরিবার নিয়ে ওখানেই স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিস। তা এখানে কবে এলি? কোথায় থাকিস ?
কথা বলতে বলতে দুজনে সামনে চায়ের দোকানটায় বসে। রন্টুর মনে হলো সেদিন দেখে লোকটা সম্পর্কে যেমন ভেবেছিল ঠিক তা নয়।ও সেই পুরোন ধীরাজ বন্ধুই রয়ে গেছে। আর কভিড তেমন নেই, মুখের মুখোশটাও নেই।সামাজিক দূরত্ব কমে নৈকট্য বেড়েছে। তার সঙ্গে বাল্য স্মৃতি। রন্টুর মনে হলো দূরের হয়েও কত কাছের তুমি।সেদিনের সেই অম্ল মধুরের জায়গা নিয়েছে মধুরেন সমাপ্যেয়ত। দুজনের মধ্যে স্মৃতিমধুর বাক্যালাপ।প্রায় পঞ্চাশ বছর পর। দুজনেরই বয়স পঁচাত্তর বা তার সামান্য কম বেশি।
রন্টু বলে:
------ তুই এখানে পাততাড়ি গুটিয়ে সপরিবারে এসেছিস না কদিনের জন্য বেড়াতে? এখানে কোথায়?
ধীরাজ জানায়:
------ হ্যাঁ পাততাড়ি গুটিয়েই এসেছি।স্ত্রীকে নিয়ে। ঠিক সপরিবারে নয়। ছেলে বউ ওদের পরিবার নিয়ে ওখানেই থেকে গেছে। আমি কয়েকদিন হলো এসেছি। তোর কথা ভাবছিলাম।তবে এখানে আছিস কি না বুঝতে পারছিলাম না। আর এই ছিম ছাম সেদিনের গাছ পুকুর মাট ঘাটের পল্লীটা আজ জনঅরণ্য। গাছ কেটে সাফ পুকুর ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে বহুতল।একটা ঘিঞ্জি শহর। পুরনো স্মৃতিকে ধরে এখানে একটা থাকার জন্য অনেকদিন আগেই ফ্ল্যাট কিনে রেখেছিলাম। তখন তোদের বাড়ি এসেছি।জায়গাটা ভালো লেগেছিল। কিন্তু আজ চিনতেই পাচ্ছি না। তাও ভাবছিলাম খুঁজবো যদি তোকে পাওয়া যায়। তা দেখা হয়ে গেল। তুই এবার আয় আমার এখানে।তোর কথা শুনি বল।
রন্টুর এবার বলার পালা:
------- আমি তো বরাবরই এখানে।সামান্য একটা চাকুরীতে সংসার। জানিস তো পড়াশুনায় অস্থরম্ভা। কোনরকমে পাশ করা মাল। খেলতাম। পায়ে চোট পেয়ে আর এগোতে পারি নি। সামান্য চাকুরীটা জোগাড় করে সংসার ধর্ম।ঘরে নাতি নাতনি ছেলে ছেলের বউ।ছেলেও সরকারি অফিসে চাকরি করে।সবাইকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তা এত অভাব অভিযোগ জর্জরিত দুর্দশাগ্রস্ত হতভাগ্য দেশে তুই আবার ফিরে এলি এত স্বাচ্ছন্দ ছেড়ে। ভালই তো ছিলি।এখানে এই দুরবস্থার মধ্যে মানিয়ে নিতে পারবি? বয়েস হয়েছে।
------- হ্যাঁ সমস্যাতো আছেই। ছেলে আসতে দিচ্ছিল না। আর জানিস তো ওখানকার জীবন যাপন। ছেলে এমনিতে যত্নশীল হলেও ওখানকার জীবনযাপন অনুসরণ করে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। আমাদের সমাজ বলতে তেমন কিছু নেই। আর ওখানে তো শিকড়ের টান নেই। বহুতলের বারান্দায় পুনর্জন্মে বেড়ে ওঠা গাছের কি শিকড় থাকে? আমাদের শিকড়টা যে এখানেই, এই মাটিতে। বুড়ো বয়সে টানটা বাড়ে। এ যেন মধ্যাকর্ষণ শক্তি। এখানকার আকাশ বাতাস মানুষ নিজের সমাজ টানে। তাই চলে এলাম।দেখা যাক।তবে এখানটা আগের মত নেই-----
বন্ধুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রন্টু বলে:
-------- নেই মানে ! একেবারেই নেই।সেই সামাজিক বন্ধনটাই ভেঙে গেছে। আর বাঙালিরা তাদের নিজের সত্তা হারাতে বসেছে । এমনকি নিজের ভাষাটাও ভুলতে বসেছে।কেমন যেন নিজের ঘরেই আমরা যেন পরবাসী।
দীর্ঘ আলাপ চারিতার পর আজের নতুন করে পরিচয়পর্ব শেষ। দুজনেই অতীতের সোনালী দিনগুলোর রেশ নিয়ে বাড়ি ফেরে। এর পর থেকে দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ।নিয়মিত যাতায়াত।
একদিন দুজনে বসেছে ধীরাজের বাড়িতে। রন্টুর স্ত্রীও সেখানে ধীরাজ এর স্ত্রীর সঙ্গে ভেতরের ঘরে। আর দুই বন্ধু বারান্দায়। সেই কলেজ জীবনের দুই বন্ধু। একজন ঘষে মেজেও পাশ করে না আরেকজন তুখোড় বুদ্ধিতে বাজি মাত। কলেজ জীবনের পর একজনের মেহনতি জীবন আর আরেকজন সমাজে সন্মানজনক ব্যক্তিত্ব। বুদ্ধি বেঁচে খাওয়া পরা। বিদেশ ফেরত। দুজন দুই মেরুতে। বহুদিন দেখা হয় না। এখন বার্ধক্যে দুজনের আবার মিলন। দেখা সাক্ষাৎ আড্ডা। পূরোণ প্রেমটা জিগিয়ে উঠেছে। খুব আন্তরিক ঠাট্টা ইয়ার্কি। রন্টুর সেই পুরোন পেছনে লাগার অভ্যেসটা যায় নি। ভাবে আগের দিনগুলো ফিরে এসেছে। কেউই বদলাবো বদলাবো করেও নিজেকে বদলাতে পারে নি। আর বাল্য স্মৃতি দুজনকে এই বার্ধক্যেও বাল্যেই নিয়ে যায়। রন্টুর ক্ষেত্রে সেটা একটু বেশি সত্যি। রন্টুর পাল্লায় পড়ে ধীরাজও কম যায় না। ঠাট্টা চলতে থাকার মধ্যে বুদ্ধির কারবারি ধীরাজ মেহনতি রন্টুকে বলে:
আচ্ছা তোকে এক কালে সবাই গাধা বলত। আজ কি হল সবাই গরু বলে কেন?
মেহনতি বন্ধুর উত্তর :
তখন গতর ছিল সবার বোঝা বইতে পারতাম। এখন বয়েস হয়েছে পারি না। মাঠে মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়াই তাই।
এবার মেহনতি বুদ্ধিমান বন্ধুকে পালটা প্রশ্ন করে:
একদা তোকে সবাই খচ্চর বলত আজ ঘোড়া বলে কেন?
বন্ধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলে:
বলত নাকি? জানি না কেন ?
মেহনতি বন্ধু বলে:
পারলি না তো বলতে। তবে শোন। তুই আগে টিকিটিকির মত সবার পেছনে থাকতি আর আজ সবাইকে পেছনে ফেলে জোরে দৌড়ে পালাস তাই।আর আমরা তোর পেছনে।
দুজনে হেসে ওঠে।