নরক দর্শন
প্রদীপ বিশ্বাস (অকৈতব)
মা পই পই করে বলেছিলেন - - বিকু শিয়ালদা ইস্টিশানে নেমেই দত্ত'র দোকানে একটা ফোন করে জানিয়ে দিস্ ঠিকমত পৌঁছেছিস কী না।
- আট প্লাটফর্মের সামনে দেখবি টয়লেটে মুখে টেলিফোন বুথগুলো রয়েছে। আমি কতবার তোর মাকে ওখান থেকে খবর পাঠিয়েছি, বাবা বলেছিলেন।
- এক টাকার একটা বড় কয়েন সাথে রাখিস ওটা লাগবে।
বিকাশের মনে আছে সব। সবে বারো ক্লাসের গন্ডি পেরিয়েছে সে। একা একা এভাবে বাড়ির বাইরে পা রাখেনি এতদিন। বাড়ি থেকে স্কুল আর স্কুল থেকে বাড়ি। তাও বন্ধু বান্ধবের সাথে। একা একা কোথাও যেতে হলে তার হৃদকম্প হয়। এই দুর্বলতার কথা বাড়ির সবাই জানে। আড়ালে আবডালে তাকে ক্যাবলা বলেও টিটকারি করে। দূর সম্পর্কের পিসির মেয়ের বিয়ে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে। সবাই কাজে ব্যস্ত, কারো সময় হবে না যাবার। শেষ পর্যন্ত বিকাশকেই ডাকা হলো।
- ক্যাবলা যাবে নেমন্তন্নে! সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিল।
বিকাশের জেদ চেপে বসল। সে যাবেই, আর একাই যাবে। ক্যাবলা নাম তার ঘোচাতেই হবে।
মায়ের অমত ছিল তাকে একা পাঠানোয়। কিন্তু বিকাশের জেদের হার মানতে হয়েছিল তাঁকে।
বাবা বলেছিলেন - - শিয়ালদা থেকে বেরিয়ে উত্তরমুখো
এ, জে, সি রোড ধরে হাঁটা পথে পনেরো মিনিট। বাড়ির নম্বর তো লেখাই আছে, মিলিয়ে নিলেই হবে। তবে টেলিফোন করতে ভুলিসনে যেন।
সামনের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল - - দাদা, এখান থেকে টেলিফোন করার কোনো ব্যবস্থা নেই?
- কেন থাকবে না। এগুলো তো বছরের অধিকাংশ সময় অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। ওই দিকে দেখুন, সব ব্যবস্থা করা আছে। পয়সা অবশ্য একটু বেশি লাগবে।
বিকাশ দেখল অদূরে দশ-বারো জন লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কাচের ঘরের মধ্যে রিসিভার কানে একজন। বুঝে নিল ওটাই টেলিফোন বুথ।
- ওটাও তো সরকারি?
- দাদা-গো-দাদা, যেগুলো বন্ধ হয়ে আছে সেগুলো সরকারি। আর যেগুলো চালু আছে সেগুলো বেসরকারি, বলেই লোকটা হনহন করে এগিয়ে গেল।
শত প্রশ্ন বিকাশের মাথায় কিলবিল করছে। কিন্তু কে তার জবাব দেবে! সরকারিগুলো বিকল হয়ে পড়ে আছে আর বেসরকারিগুলো দিব্যি চলছে!
বিকাশের টেলিফোন করা হলো না। উড়ালপুলের নীচ দিয়ে সে এগোল। এ, জি, সি বোস রোডের বদলে সে বি, বি, গাঙ্গুলি
স্ট্রিটের দিকে চলে গেল। লোকজন সব স্রোতের মত চলেছে।
ফুটপাথ ধরে হাঁটবার জো নেই। পসরা সাজিয়ে সব বসে আছে। নানা রকম হাঁকডাক চারিদিকে। সবাই কম দামে ভালো জিনিস বিক্রি করছে (তাদের কথায়)। দুচোখ ভরে দেখছে বিকাশ।
হঠাৎ একটা জামা তার কাঁধের উপর এসে পড়ল। জামাটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকায় সে। দেখল কয়েকটা জামা নিয়ে কাছেই একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকেই তাকিয়ে আছে। - - নিন জামাটা নিন, আমার কাঁধে এসে পড়েছে, বিকাশ লোকটাকে বলল।
- সে কি মশাই! একশো তিরিশ টাকা ছাড়ুন!জামার দাম আরও বেশি, নেহাৎ বউনির টাইম, তাই তিরিশেই ছাড়লাম।
- কিন্তু, আমার তো জামার দরকার নেই! আর আমি কিনতেও চাই নি।
- দরকার নেই তো জামায় হাত দিলেন কেন মশাই?
- আমি তো - - - - ।
- আরে ছাড়ুন মশাই, দিয়ে দিন টাকাটা। কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলল। না হ'লে মারধোরও খেতে পারেন। দেখছেন না এদিক ওদিক সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটুখানি চেঁচালেই সব হাজির হবে। তখন আর পার পাবে না। তার চেয়ে মানে মানে টাকাটা দিয়ে কেটে পড়ুন।
- কিন্তু, আমার কাছে তো অত টাকা নেই!
- যা আছে তাই বের করুন, আর হাতের ঘড়িটা রেখে যান। পরে টাকা দিয়ে নিয়ে যাবেন।
জামাটা কাগজে মুড়ে একজন তার হাতে গুঁজে দিল, আর একজন নিল ঘড়িটা। বিকাশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। রুক্ষ স্বরে কে যেন বলল - - ঝান্, দাঁড়িয়ে থাকবেন না। ভিড় করবেন না শুধু শুধু।
ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলল বিকাশ, কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে।
একজন বাঙালি বাবু খৈনি ডলতে ডলতে তার সামনে হাঁটছেন আর হাতে তালি মেরে খৈনির ধুলো ঝাড়ছেন ।চুন মেশানো তামাকের ধুলো বিকাশের চোখে মুখে এসে লাগছে।
বেদম কাশি পায় বিকাশের। কাশতে কাশতে বলে - - দাদা, একটু সাবধানে ঝাড়ুন। চোখে মুখে আসছে।
- কেনো বে! চোখ মুখ ঢেকে রাখলেই তো হয়! একটু আয়েশ করে নেশা করব তাও এদের জন্য হবে না! কেনো যে রাস্তা ঘাটে বেরোয় এরা!!
বিকাশ বুঝতে পারে না সে কী অন্যায় করেছে!
একজন খোট্টা ফুটপাথে পা ছড়িয়ে বসে আছে। দু'পাশে খৈনির পিচ্ ফেলে আস্তাকুড় বানিয়ে রেখেছে। আনমনে চলতে গিয়ে বিকাশ তার পা মাড়িয়ে দিয়েছে। আর যায় কোথায়!
- এই বাঙালি বাবু, থোড়া দেখকে চলো।হামভি তো আদমি আছে! আদমিকো কদর করো!
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিকাশ। ঐ লোকটা নিজেই তো অন্যায় করেছে ফুটপাথ নোঙরা করে। অথচ সেই এতগুলো কথা তাকেই শুনিয়ে দিলো!
'স্যরি' বলে এগিয়ে গেল বিকাশ
মাঝে মাঝে লাইটপোস্টে পোস্টারে লেখা 'ফুটপাথে হাঁটুন' ।কিন্তু ফুটপাথ কোথায়, সবাই তো দখল হয়ে গেছে।
ট্রাফিক আইল্যান্ডের মোড়ে ফুটপাথ জুড়ে চা-এর ব্যাবসা রমরমিয়ে চলছে। খরিদ্দারের উপচে পড়া ভিড়। ফুটপাথ জুড়ে চা পানে ব্যস্ত তারা। চা খেয়ে মাটির ভাড় ছুড়ে ফেলছে পাশে রাখা ভাঙা ড্রামটার মধ্যে। কোনোটা ড্রামে পড়ছে কোনোটা বা নর্দমাতে। নোঙরা জল ছিটে ছিটে লাগছে পথচারীদের জামা-কাপড়ে।
একমুখী রাস্তা। যানবাহনের শেষ নেই। ফুটপাথে হকার, রাস্তায় যানবাহন। সাধারণের হাঁটবার জায়গা নেই! পাশকাটিয়ে এঁকেবেঁকে অতি সাবধানে না চললে হয় হকারের তড়পানি শুনতে হবে নইলে গাড়ির চাকার তলায় পড়তে হবে।
- ও দাদা, সরুন! সরুন!!
- মাগো! গেছিরে!!
ক্যাচক্যাচ শব্দ করে পরপর গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সামনের গাড়ির চাকার তলায় এক পথচারীর পা ঢুকে গেছে।
চায়ের ভাড় রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে এলো। নোটবুকে গাড়ির নম্বর লিখে রাখল। একটা পান মুখে দিল। কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভারের লাইসেন্স সীজ করল। তারপর আহত মানুষটার দিকে নজর দিল।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিকাশ।
========================
২০৬ সুভাষনগর রোড, দমদম ক্যান্টনমেন্ট,
কোলকাতা - ৭০০০৬৫