নতুন মা
কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)
"বাজলো তোমার......
....... আলোর বেণু......"
পুজো এসে গেছে। আকাশে নীল মেঘের টোপর, দোদুল্যমান কাশের মোলায়েম হাওয়াতে ভেসে আসা সাদা খামে বলাকার চিঠি, সবুজের মখমলে শিশিরের চন্দন, টলটলে দীঘির জলে পদ্ম, শালুকের খুনসুটি, মাঝে মাঝে ঢাকের মিষ্টি মল্লার মনে করিয়ে দিচ্ছে আগমনীর চেনা ছন্দ।
চৌধুরীবাড়ির পুজো এবারে একশ বছরে পড়ল। বাড়ির লোকেদের পুজো নিয়ে ব্যস্ততা তুঙ্গে। প্রতিদিনই চলছে এই নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক।
পুজো উপলক্ষ্যে সাড়া বাড়ি চন্দননগরের ঝলমলে আলোতে সেজে উঠেছে। বাড়ির আনাচে কানাচে, নোনাধরা দেওয়াল, সিঁড়িঘর সর্বত্রই যেন নতুন রঙের ছোঁয়া। পুজোর আবেগে টগবগ করছে।
পুজো নিয়ে সবচেয়ে বেশী আবেগ উথলে উঠছে চৌধুরীগিন্নীর। কে বলবে বুড়ির বয়স আশি পেরিয়েছে? এই বয়সেও সবার কাজে সতর্ক দৃষ্টি। পান থেকে চুন খসলেই মেজাজ সপ্তমে। উনার গরদের শাড়িতে শিউলি ভোরের আলপনা, সোনামুগ হলদে রোদের জলসা। চোখে শরৎ শিশিরের নৈবেদ্য।
পুজোর কটা দিন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে গোটা গ্রামের মানুষ এখানে আসে। মা অপর্ণার কৃপা পেতে। সবাই পাত পেড়ে খায়। হৈ হৈ করে। চৌধুরীগিন্নী কাউকে অভুক্ত রাখেন না।
এত আনন্দের মধ্যেও তবু বাড়ির এককোণে জমাট অন্ধকার। আদরের নাতনি ছোট্ট তাথৈয়ের মনে বিষাদের ছায়া। ও অনাথ। পুজোতে সবাই বাবা মায়ের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে যায়, এখানে ওখানে বেড়ায়। তাথৈয়ের সেই সব নেই। বাবা মা এক্সিডেন্টে মারা যাবার পর থেকে কারোর সাথে তেমন মেশে না। পুজোর চারটে দিন ও চুপ করে ঘরে বসে থাকে। পুতুল নিয়ে খেলা করে। আর চোখের জলে ভাসায়।
আজ ঘুম থেকে উঠেই চুপ করে বারান্দায় বসে পাখিদের দেখছে। একটা পাখি তার ছানাদের খাওয়াচ্ছে। তাথৈ কি যেন ভাবছে। ঠাকুমার সেদিক দৃষ্টি পড়তেই বলে উঠল," কি সোনামনি, ঘুম ভেঙ্গেছে?"
"হ্যাঁ, ঠাম্মি।"
"কি দেখছ অমন করে?"
"ঠাম্মি দেখবে এস, কি সুন্দর পাখি!"
"ও মা! তাই তো, কি সুন্দর! ঠিক আমার তাথৈ সোনার মতন।"
তবসুম বাসন মাজতে মাজতে চৌধুরীগিন্নী আর তাথৈয়ের কথা শুনছিল। ওর মনের অবস্থাও অনেকটা তাথৈয়ের মত। একটা সময়ে ও পুজোর আনন্দ সবার সাথে ভাগ করে নিত। গিন্নীমাকে পুজোর কাজে সাহায্য করত। মনেই হতনা ও অন্য সম্প্রদায়ের। এ বাড়ির কাজের লোক। তানবীর মারা যাবার পর থেকে পুজোর চারদিন ঘরবন্দি রাখে। আর ভেজা চোখে পুরানো মধুর দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে। এতেই ওর আনন্দ।
তবসুমের এই উৎসবের দিনে নিজেকে আড়াল রাখার আরো একটি কারণ আছে। ও নিঃসন্তান। তাথৈ সোনাকে ও জন্ম থেকে দেখে আসছে। দুটোতে ভীষণ ভাব। তাথৈও বোঝে তবসুম আন্টির দুর্বল জায়গাটা। উনার ভিতরের কষ্ট। পুচকেটা মাঝে মাঝে আড়ালে তবসুমকে কাঁদতেও দেখেছে। ও জানে তবসুম আন্টি ছোট ছোট বাচ্চাদের নিজের সন্তানের মতন ভীষণ ভালবাসে।
চতুর্থীর দিন সকালে তাথৈ তবসুমকে নিজের ঘরে এনে বসিয়ে অনেক্ষণ গল্প করেছে। আন্টির সাথে খেলেছে। দুটোতে আলোচনাও হয়েছে এক প্রস্থ। তাই দেখে চৌধুরীগিন্নীর মুখে খুশীর আতর।
"তাথৈ সোনার পুতুলের পুজোতে কটা জামা হল?"
"ঠাম্মি, পাঁচটা হয়েছে। তবসুম আন্টি বলেছে আরও একটা দেবে।"
"তাই না কি? বেশ, তাহলে তোমার পুতুলের মত আমাকেও একটা দিতে হবে। তা না হলে আমি ভীষণ......"
কথা শেষ হয়না। তাথৈ এক ছুটে ঠাম্মির কাছে চলে যায়।
************
দেখতে দেখতে পুজোর দিন ঘনিয়ে এল। সপ্তমী পার হয়ে আজ অষ্টমী। পুজো বসেছে। একটু পরেই অঞ্জলি শুরু হবে। দুর্গা দালান লোকের ভিড়ে উপচে পড়ছে। শহর থেকেও অনেকে এসেছ পুজোর স্বাদ নিতে। ধূপের গন্ধে, ফুলের সজ্জায় মা অপর্ণার মুখ জ্বল জ্বল করছে।
অঞ্জলি শুরু হতেই তাথৈ তবসুমের কোলে চেপে মণ্ডপে এসে হাজির। আজ বহু বছর পরে তবসুম পুজোর গন্ধ গায়ে মাখল। এমনিতেই ও পুজোর দিনে....। আজ ওকে দেখে সবাই ভীষণ অবাক হবার থেকে খুশীই হয়েছে।
তাথৈ সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে তবসুম তার "নতুন মা।" তবসুমের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে তাথৈয়ের মার পরা মসৃণ তসরটা বেশ মানিয়েছে। শাড়ির ভরাট গন্ধে, ঝলমলে আবেগে বারে বারে তাথৈয়ের মা কমলিকা ফিরে ফিরে আসছে।
তবসুমের মধ্যে সবাই আজ কমলিকাকে খুঁজে পাচ্ছে। ঠিক যেন মা অপর্ণা। কমলিকাও এমন ভাবে পুজোর দিনে সবাইকে মাতিয়ে......। কমলিকা নেই। তবসুম বহু বছর পরে স্বমহিমায় ফিরল। ধূপের গন্ধ, ঢাকের বাদ্য, ফুলের সাজ সব কিছু আজ যেন নতুন করে কমলিকার ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে। বহু দূর থেকে ভেসে আসছে বীরেন্দ্রকষ্ণ ভদ্রের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর......
" ...... আশ্বিনের শারদ প্রাতে
বেজে উঠেছে......
ধরণীর.........
......... ..........
জাগো দুর্গা.......
তুমি জাগো........."
সন্ধিপুজোর ১০৮টা প্রদীপ জ্বলে উঠতেই তবসুমের চোখ খুশীতে ঝলমল করে উঠল। চন্দননগরের আলোর রোশনাই তসরের শাড়ি বেশ মোহময়ী রূপ ধারণ করেছে। পাশে তাথৈ সোনা বসে আইসক্রীম খাচ্ছে। ওর কোলেও ওর পুতুলটা রয়েছে। কচি কচি আঙুলে পুতুলটার মুখেও মাঝে মাঝে আইসক্রিম তুলে দিচ্ছে। তবসুমের চোখের নোনাপানিতে শ্রাবণ পূর্ণিমার ভরা কোটাল।
তার দু চার ফোঁটা চৌধুরীগিন্নীর শাড়ির লাল পাড়েও এসে পড়ল। মা উমা হাসছেন। সবার অলক্ষ্যে। মণ্ডপে মণ্ডপে সমানে চলছে শঙ্খ, ঢাকের বন্দিশ।
"শঙ্খ শঙ্খ মঙ্গল গানে.....
...... ........ জননী এসেছে দ্বারে......"
=====================================
Address: 85, Kalibari Road, Nalta
Near Air Port Auto Stand
PO: Italgachha
Kolkata -28
North 24 Parganas