বারিদ বরন গুপ্ত
আমাদের সারা জীবন ধরে কত মানুষের সাথে ওটা বসা করতে হয়, নানান কাজের সূত্রে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হতে হয়, তার কি কোন হিসেব আছে? অবশ্যই নেই! আর থাকার কথা ও নয়। সারা জীবন মানুষকে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে লিপ্ত থাকতে হয়, কত মানুষের সাথে কত ধরনের যে আলাপ আলোচনা হয়, তার যেন শেষ নেই। আর এই আলাপচারিতা সূত্রে এমন দুই একজন মানুষ জীবনে এসে যায় যাদের কথা জীবনে ভোলা যায় না, কথা প্রসঙ্গে বারে বারে উঠে আসে সেই সব নামগুলো। এরকমই এক অতি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার বা আলাপচারিতায় আমার জীবনে উঠে এসেছে ভবানন্দ অর্থাৎ ভবনানন্দ চৌধুরী, তার সাথে মাত্র কয়েক ঘন্টা আলাপচারিতায় আমার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক কিছু বদলে দিয়েছে, মানুষ সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা আমার মনকে দীর্ঘদিন ধরে গ্রাস করছিল তার অবসান ঘটিয়েছে এই ভবানন্দ ওরফে ভবনানন্দ চৌধুরী।
ভবানন্দের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে আকস্মিকভাবে এক চায়ের দোকানে। প্রথম দর্শনেই সে আমার মন কেড়ে নেয়। ভবানন্দ, নামটি বেশ, সব সময় নিজের ভাবের দেশেই বিচরণ করে, কিন্তু এলাকার বা দেশ-বিদেশের অনেক কিছু খবরা-খবরও রাখে! মাথাটা একটু বিগড়ে গেছে এই যা, কিন্তু চেনা জানা বা অপরিচিত মানুষের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। একটা কথা কি , ভবানন্দ একবার ধরলে তার হাত থেকে ছাড়ান পাওয়া খুবই
মুশকিল, এটা, ওটা, রকমারি বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপিত করে ঘন্টার পর ঘন্টা একটা মানুষকে আটকে রাখার ক্ষমতা সে রাখে! এটা অবশ্যই ওর একটা বিশেষ গুণ বা ক্ষমতা। এ তল্লাটে হোটেল ওয়ালা চা ওয়ালা পান ওয়ালা প্রায় সকলেই ওকে চেনে, ভালোও বাসে, তাই থাকা খাওয়ার অভাব ভবানন্দের কোনদিনই হয় না!
ভবানন্দের প্রকৃত নাম ভবনানন্দ চৌধুরী, এক সময় ওদের বাংলাদেশে জমিদারি ছিল। স্বাধীনতার দু'বছর বাদেই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ওরা এপার বাংলায় চলে আসে, পূর্বস্থলী পারুলিয়া অঞ্চলে বসবাস গড়ে তোলে, তাছাড়া বেশ কিছু জমি জায়গাও কেনে! ভবানন্দরা বেশ কয়েক ভাই বোন, এবং সকলেই প্রায় প্রতিষ্ঠিত, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর, ভবানন্দ তাদের বিয়ে দেয়, এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গড়ে তুলে তাদের প্রতিষ্টিত করে। যাইহোক এসব গুরু দায়িত্বে জড়িয়ে ভবানন্দের আর বিয়ে করা হয়নি ! অনেকদিন ভাইদের সংসারেই ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে বনিবনা না হওয়ার জন্য, বা ভাইদের কাছে প্রতারিত হওয়ার জন্য ভবানন্দ রাগে বাড়ি ছাড়ে, গয়া কাশী বৃন্দাবন তারাপীঠ বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরতে থাকে। এখনো যায়, কিন্তু মায়ার টানে মাঝে মাঝে পূর্বস্থলীতে ফিরে আসে, কিন্তু ভাইরাও যে ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করে না তা নয়, কিন্তু ওই দুই চার দিন! তারপর ভবানন্দ আবার বিবাগী, কাউকে কিছু না বলে লোটা কম্বল নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে এদিক ওদিক সেদিক, এই ভাবেই আজ ভবানন্দের দেখা মিলল পূর্বস্থলীর কুশগড়িয়ায় এক চায়ের দোকানে। দেখলাম ভবানন্দ জাঁকিয়ে গল্প করছে।
খড়িনদী বা এই অঞ্চলের বিভিন্ন তথ্যের জন্য এই চায়ের দোকানে মাঝে মাঝে আসি, সেই সূত্রে চা ওয়ালা আমার পরিচিত। গাড়ি থামাতেই চা ওয়ালা বললো--'আপনাকে আজ কোথাও ঘুরতে হবে না, তথ্যের ভান্ডার ভবানন্দ হাজির!' আমিও চা ওয়ালার কাছে একভাড় চা নিয়ে সটান গিয়ে বসলাম ভবানন্দের পাশে!
ঝোলা থেকে ডাইরি কলম বার করতেই, গল্প থামিয়ে ভবানন্দ আমার দিকে বার কয়েক তাকালো, বয়স ৬০ পেরিয়ে গেলেও ভবানন্দের শরীরে কিন্তু বার্ধক্যের ছাপ পড়েনি। স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট সতেজ! জুড়ে দিলো মেরতলা ভাতছালা ভাতুরিয়া দামোদর পাড় খড়িনদীর বিভিন্ন গল্প! শুনলাম খড়ি নদী নাকি এক সময় দামোদরের
পাড়ের পাশ দিয়ে সোজা ভাগীরথী তে পড়তো, তখন তো ভাগীরথ পূর্বস্থলী মেড়তলা চুপি কাষ্টশালী প্রভৃতি জনপদের পাশ দিয়ে বইতো, যা এখন ছাড়ি গঙ্গা নামে পরিচিত!
ভবানন্দ গড়গড় করে বিবরণ দিয়ে যাচ্ছে, আমিও দ্রুত ডাইরির পাতা ভর্তি করছি। ঘড়ির কাটা, দুটোর ঘর ছুতে চলেছে, চায়ের দোকান ধীরে ধীরে ও ফাঁকা হয়ে আসছে, চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে আমি আর ভবানন্দ পাশাপাশি, এদিকে চা ওয়ালা ও ঝাপ বন্ধ করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে , ভবানন্দ বললেন --'আমাদের ও তো উঠতে হবে! চলুন ভাতুরিয়া, মেরতলার দিকে, আপনাকে অনেক কিছু প্রতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখাবো, তথ্য ও দেব, যা আপনি কোনদিন পাননি!'
ভবানন্দকে নিয়ে চললাম ভাতুরিয়া, ভবানন্দ বললেন খুব প্রাচীন জনপদ এই ভাতুরিয়া, দেখলাম অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য এখনো পড়ে রয়েছে! ওর মুখে শুনলাম যে সুর রাজাদের এক সময় অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই ভাতুরিয়া! এর পাশ দিয়ে একটা রয়েল রূট ছিল, হয়তো তাই! তবে জনপদটি যে প্রাচীন তা পুরাতাত্ত্বিক কিছু ঐতিহ্য থেকেই বোঝা যায়! তবে হাঁ! এখানেও ভবানন্দ যথেষ্ট জনপ্রিয়! সকলই তাকে একটু পাশে পেতে চায়, একটু গল্প করতে চায়, একটু আনন্দ করতে চায় ! ভবানন্দ আমাকে অনেক কিছু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখালো এবং যথোপযুক্ত বর্ণনা ও দিল, বোঝাই যায় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে ভবানন্দের যথেষ্ট জ্ঞান আছে । এদিকে ঘড়ির কাঁটা কখন যে তিনটের ঘর পেরিয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই, ভবানন্দ আমার হাত ধরে বলল--' বেলা তো পড়ে এলো, পেটে তো কিছু দিতে হবে?' আমি বললাম হাঁ অবশ্যই-'চলো হোটেলে!'
মেরতলা বাজারের সামনে হোটেল! তখনো দেখলাম দুই একজন খাচ্ছে! এখানেও ভবানন্দ! হোটেল ওয়ালা ভবানন্দ কে দেখে বলল--
' খাবার শেষ!' ভবানন্দ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল- 'খাবার শেষ তো কি আছে, তোমার খাবারটাই খাব!' তারপর দুজন হো হো করে হাসতে লাগলো! আমি মনে মনে ভাবছি
একজন লোক পাগল হোক আর যাই হোক কিভাবে সকলের কাছে জনপ্রিয় হয়, কিভাবে সকলের সহানুভূতি বা ভালোবাসা আদায় করে নেয়! নিশ্চয়ই ভবানন্দের মধ্যে এমন কিছু গুন আছে , যা হয়তো ঐতিহ্যবাহী বা অনেক মেহনত করে তাকে সে গুণ রপ্ত করতে হয়েছে! এদিকে ভাতের প্লেট সাজানো হয়ে গেছে! আমি তখনও হোটেলের দরজায়! ভবানন্দ ডাক দিল- 'আসুন,'
আমি ধীরে ধীরে ভবানন্দের পাশে গিয়ে বসলাম! খেতে খেতে বিদ্যানগর,ভাতশালা, মেরতলার বিভিন্ন গল্প! গল্প জানো আর ফুরায় না! কয়েক ঘন্টার মধ্যে একজন অপরিচিত লোক, কত কাছের, কত আপনজন হয়ে উঠলো, আজও মানুষ আছে, হারিয়ে যায়নি, হয়তো একটু খুঁজে নিতে হবে!
খাবার টেবিল থেকে উঠে, হাত মুখ ধুয়ে, হোটেল ওয়ালাকে খাবারের বিল মেটাতে যাচ্ছি, ভবানন্দ এসে হাতটা ধরল! হোটেলের বিল মেটানো আছে, আপনি আজ আমার অতিথি! এটুকু তো করতেই হয়! হোটেল ওয়ালা আমাকে বললো- আপনি যে ভবনানন্দ চৌধুরীর সাথে এসেছেন, আজ এই অঞ্চলের অনেকেই ওর জন্য করে খাচ্ছে। সেই অধম আমি একজন!'
হোটেল থেকে বেরিয়ে ভবানন্দ বললো - 'আপনাকে তো ফিরতে হবে, অনেকটা পথ যেতে হবে। আর দেরি করবেন না! সাবধানে যাবেন, ভালো থাকবেন!' হ্যাঁ অবশ্যই ! 'আপনিও ভালো থাকবেন'- আমি বললাম। ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা বাজতে যাচ্ছে! ভবানন্দ পিঠে বোচকা ঝুলিয়ে এক দৃষ্টিতে এগিয়ে চলেছে বিদ্যানগরের দিকে, হয়তো কোন মন্দিরে রাতটা কাটাবে।আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি আর ভাবছি! একজন সত্যিকারের মানুষ, মাথাটা একটু বিগড়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু এতটুকু মনুষত্ব হারিয়ে যায়নি, যতদূর দৃষ্টি যায় তাকিয়ে দেখি, ধীরে ধীরে ভবানন্দ আমার চোখ থেকে হারিয়ে গেল------
জানিনা আবার দেখা হবে কিনা! কিন্তু আমায় যে দেখা করতেই হবে! তাকে যে খুবই দরকার! এমন মানুষকে যে হারানো যায় না! গাড়ি স্টার্ট দিয়েও যেন এগুতে পারছিনা, মন উথাল পাথাল করছে, মনে হচ্ছে ওকে গিয়ে নিয়ে আসি! হায়রে জীবন! ভবানন্দরা শুধু মানুষের অন্তর কাঁদিয়ে শেষ হয়ে যাবে!
==============
বারিদ বরন গুপ্ত
পূর্ব বর্ধমান।
লেখক পরিচিতি: পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার বাসিন্দা, কবি লেখক প্রাবন্ধিক, গবেষণা মূলক লেখালেখিতে যুক্ত আছেন!!