আদিম প্রেম
মাখনলাল প্রধান
গোটা একটা বছর খুঁজেছে মোতিয়াকে । আশানতলির বাড়ি তেমনি ছিল পড়ে । চারদিকে পাহাড় জঙ্গল ঘেরা ,সাত ডাকে মানুষের সাড়া পাওয়া ভার । পাথুরে মাটি ,দুচারটা শাক-সবজির গাছও জন্মায় না ওই মাটিতে । বৃষ্টি যেন ভিক্ষার দান , শীতে পাহাড় থরথর করে কাঁপে আর গ্ৰীষ্মে মরুভূমি । গ্ৰাম যেটা আছে ভূশন্ডির মাঠ বললেই হয় ,দূরে দূরে বাড়ি , সম্পর্ক যে নেই তা নয় । ভেড়া আর নিকৃষ্ট জাতের কিছু পশু চরে বেড়ায় রুক্ষ্ম ঢালে । কিছু জঙলি ফলমূল খুঁজে খুঁজে কোনো কোনো সময় পাওয়া যায় , কাঁটা ঝোপ আর সাপের সঙ্গে লড়াই করে কেউ কেউ খুঁজে পায় সে সব । রোজ রোজ পাহাড়ে পাহাড়ে আঁদাড়ে পাঁদাড়ে খোঁজা ছাড়া সেসব পাওয়া যায় না । সেটা পুরুষ মানুষের কাজ নয় । তারা চলে যায় দূরে বহুদূরে , দুমাস তিন মাস চার মাস কাজের জন্য ।তারপর বাড়ি ফেরে হাতে কিছু টাকা জমলে হয়তো দু'এক মাস থাকে আবার বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে ,কাজের সন্ধানে ।এটাই তো এই আশানতলি ,মেসাই ,সুন্দরিয়া গড় অঞ্চলের মানুষের জীবন ইতিহাস ।
ঘরে ঘরে বউরা একা একা থাকে , হয়তো ছেলে-মেয়ে ,এমনকি নতুন বিয়ে করা বউ ।এমনই বিরজুদের জীবন কথা । বাপটা সাপের কামড়া খেয়ে মরে গেল ,মাও একদিন তাকে ছেড়ে চলে যায় ।এক বুড়ি তাকে রাস্তার থেকে নিয়ে মানুষ করে ছিল ,বড় করে ছিল । বুড়ির ছেলে তাকে নিয়ে যেত দূরের গাঁয়ে ,শহরে চেলা হিসেবে , এই করতে করতে সে পয়সা কামাতে শেখে । বিরজুটা ভীষণ পরিশ্রমী এবং সে শিখে গেছে এখানকার জীবন হিসেবের ধারাপাত ।টাকা জমিয়ে বাড়িটা দাঁড় করিয়ে ছিল ।শরীর মানে পেটাই লোহার তাগড়াই যৌবন ।এরা সময়কালে সাদি করতে ভয় পায় না । খুঁজে খুঁজে সুন্দরিয়া থেকে মোতিয়াকে পছন্দ করে সাদি করে এনেছিল । এ কালাকালির সংসারে সে ছিল শ্যামলা ,ছিপছিপে চেহারা ,কোঁকড়া চুল ,নাকে ফাসি , শাড়িটা জড়িয়ে পরলে একেবারে নাচের আসরের শ্যামাঙ্গী । বিরজু বড্ড ভালো বেসে ফেলে ছিল ।ছেড়ে যেতে মন তার চায়নি । খুব কথা শোনে মোতিয়া ,মান্যি করে ,সুন্দর হাসে ,পাহাড়ি মেয়ের সরল হাসি ,খুশি হলেই সে হাসে ।
সংসারে টান পড়ার আগেই বেরিয়ে পড়তে হয় ।আর মোতিয়াকে একাই থেকে যেতে হয় সেই গ্ৰামে সেই ঘরে । চিঠি চাপাটি নেই ,ফোন টোন নেই , হঠাৎ মাস তিনেক পরে যেন ছুটতে ছুটতে আসে বিরজু । মোতিয়া যেন আবার দীর্ঘ শীত ঘুমের পর সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জেগে ওঠে । চলে পাহাড়ের এখানে ওখানে নাচা-গানা । দুজনে মিলে ফল পাড়ে ,কাঠ কুড়ায় । যৌবনে যেন তাদের ধুম লেগে যায় ।পাহাড় মেতে ওঠে উৎসবে । অনেকেই দেখে তাদের নহবত ভাঙা গানের খোয়াব । পাড়ায় পাড়ায় কত কিসসা ছড়িয়ে পড়ে । পরবের দিনে তাদের জুড়িকে দেখে কত লোক চেয়ে চেয়ে থাকে ,কত লোক হাসে ,ঈর্ষা করে -কত কথা বলে । বিরজু ওদের সঙ্গে কম মেশে ,মেশার সময় কোথায় তার ? নেশা-টেশাও করে না ।
পুরুষেরা মোতিয়াকে দেখে বেশি , সে যখন ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নেয় তখন তার নাকের পাতা উঠে আর পড়ে আর ফাঁসিটা মৃদু মৃদু দোলে ।তখন তাকে খুব সুন্দর দেখায় । ছেলেদের কথা শুনে মোতিয়া এমন সুন্দর হাসে যে সেটাই ছবি হয়ে গেঁথে যায় । তার চলনও মন কাড়ে । যাকে ভালো লাগে তার সবই ভালো মনে হয় ।
সেবার পরবের পর বিরজু চলে যায় ।সেটা শীতের শেষের দিকে ,ওদিকে গ্ৰামে ফসল কাটার সময় এসে গেছে । এরপর কাজ আর পাওয়া যাবে না ।যথারীতি কিছু টাকা ,মোটামুটি কিছুটা সঞ্চয় রেখে সে আবার কর্মস্থলের উদ্দ্যেশে রওনা হয় । এখানে ঠা ঠা রোদের দিনে খাবার জলও মেলে না , কোন দূরের পাহাড়ের ঝর্না থেকে জল আনতে হয় ।কিন্তু এমন আকালের দিনে বিরজু রোজগার করে দিব্যি সুখে চালিয়ে যায় জীবন । বছর খানেক হল সাদি হয়েছে তাদের ,বেশ ঘন হয়ে উঠেছে তাদের সম্পর্কের বাঁধন । আপনজনের জন্য কার না মন কেমন করে , ছুটতে ছুটতে বিরজু আসে প্রায় মাস পাঁচেক পরে ।কিছু না জমলে কী নিয়ে ফিরবে ঘরে । সেটা তখন চৈত্র মাসের শেষ , বাড়ি ফিরে দেখে বাড়িতে তালা ঝুলছে । মোতিয়া নেই , মনুষ্য বাসের চিহ্নও নেই । ধারে কাছে খোঁজ নেয় সে , এগ্ৰামে ,ওগ্ৰামে যায় । কেউ জানে না ,কিচ্ছু জানে না ।সুন্দরিয়া গ্ৰামও নির্বাক । পাখি কিভাবে যে উড়ে গেল কেউ জানে না ।
নারী কী পুরুষের নম্রসহচর ,অনন্তকাল তার ইচ্ছার দাস হয়ে থাকবে ? সাদি মানেই কী পুরুষের সুখের জন্য সারাজীবন নিজের সুখ-আহ্লাদ , বাসনা-বিলাস বিসর্জন দিয়ে এক পুরুষ ধ্যানে বসে থাকতে হবে ? নির্জন ঘর জেগে দিনের পর দিন রাতের পর রাত অর্ধাহারে-অনাহারে তপস্যায় অটল থাকতে হবে ? শরীরে মনে অসম্ভব ক্ষুধা নিয়ে কতকাল মানুষ একাকি দিনগুনতে পারে ?ক্ষমতার . সীমাহীন স্বেচ্ছাচার কতদিন মানুষ মেনে চলতে পারে ? তাই বোধহয় পুরুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষ আপনি ফেটে পড়ে । অন্তরের অদম্য বাসনাই একদিন তাকে বাঁচার মতো বাঁচতে পথ করে দেয় । নারীর কোনো নিজস্ব তন্ত্র থাকতে নেই ? মোতিয়া কী তারই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চলে গেল ? মুস্কিল হল এরা স্পষ্ট করে কিছু বলে যায় না ।
বিরজুর অস্থির বুকের মধ্যে ভীষণ অভিমান জমে ওঠে । মরে তো যায়নি । পালিয়েই গেছে । কেউ কেউ বলেছে তাকে , চিড়িয়া উড়গিয়া । এ উড়গিয়ার মানে সে জানে ।কিন্তু মানতে পারে না । মোতিয়া যে ছিল তার প্রাণ ! এত ভালোবাসত যে কাজের মধ্যে সব সময় যেন তার হাসি শুনতে পেত ,হাসি ভরা মুখটা সে এখনও দেখতে পায় । সে ঘুমাতে পারে না , খেতে পারে না , বসে থাকতে পারে না ,কোনো কিছু ভাবতে পারে না ।বাড়ি ঘর ফেলে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।মোতিয়াকে না পেলে সে বাঁচতে পারবে না । রাত বলে কোনো সময় যে আছে তার মনে হয় না ,ঘুম তার চোখে নেই । রাত-দিন এক ধ্যানে একমনে খুঁজে চলেছে ,নাওয়া-খাওয়ার কথা তার মনে থাকে না । গ্ৰামের পর গ্ৰাম ,পাহাড়-পর্বত ,নদী-নালা ,উঠান , খানা-খন্দ উজাড় করে খুঁজে বেড়াচ্ছে । শহর থেকে শহরে ,অন্য কোনো শহরে -এইভাবে একটা বছর সে পাগলের মতো কাটিয়ে দিয়েছে । খোঁজা সে ছেড়ে দেয়নি ,সে জানে মোতিয়া মরতে পারে না । কী এমন চেয়ে ছিল মোতিয়া যা সে দিতে পারেনি ! কেন তাকে এভাবে ঠকিয়ে চলে গেল !
নারীরা কেবল নিজের সুখের কথাই ভাবে , পুরুষের হৃদয়-অন্তরের খোঁজ তারা রাখে না ।কত কষ্ট করে একটা পুরুষ ,একটা নারীকে সুখী করার জন্য জীবনটাই ঢেলে দেয় ।তা নাহলে তার এই ছুটে আসা , মোতিয়ার চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকা -তাকে ঠকিয়ে চলে গেল মোতিয়া ।একবার ভাবল না পর্যন্ত ,একটু মন কষাকষি , কলহ ,হয়তো মারামারি -একবারও ঘটেনি । ভাবতে চাইল না এমন একটা নারীকে সে জীবন সঙ্গী করে ছিল । কী আশ্চর্য নারীর মন ! একটা মানুষ কীভাবে কঠোর পরিশ্রম করে সংসারের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার জন্য । এ সংসার কখনও বোঝে না ,বোঝে নিজের খেয়াল ,সুখ সুবিধা ,নিজের স্বার্থপরতা - নিষ্ঠুর এ সংসার ! সংসার মরু সাধনা , পাথর ভাঙা ,পাহাড় বেয়ে পথ চলা , প্রাণহীন-বোধহীন পাহাড়ের পদযাত্রা । না মোতিয়ার মতো মেয়েদের শেখার দরকার , এখন তার জীবনের একটাই ধ্যান-জ্ঞান -মোতিয়া দর্শন ।
জীবনে বসন্তের উৎসবে যে বান ডাকে তাতেই মানুষ মুহূর্তে ভেসে যায় । ভাসতে ভাসতে যেখানে ঠেকে সেখান থেকে ফেরার কথা কজন ভাবে । শূন্য ঘরের যন্ত্রণা ,সমাজের নিয়মকানুন ,বোধবুদ্ধি একটা প্রাণবন্ত সত্তাকে বাঁধতে পারে না । জীবন তো ভাসবার জন্য , পাথর তো নয় ।এ ভাসা যে অসংখ্য ডুবজলের ঘরানায় ।সুখ-দু:খ সবই তাকে ছুঁয়ে গেছে । কখনও কখনও বিরজুর কথা মনে পড়ে ,তবে বেশিক্ষণ নয় । ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা ,পাহাড়ময় এ পৃথিবীটাকে সে খুব জানে না । এখানে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার নয় ,এটাই একটা ভরসা ।
বিরজু ঘুরতে ঘুরতে একদিন নতুন একটি পাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হয় । পাথর ভাঙার কাজ চলছে ।সে জুটে যায় ,দুদিন কাজ করে আবার বেরিয়ে পড়বে । হঠাৎই সে মোতিয়া কে আবিষ্কার করে ফেলে । পাহাড়তলির ছোট্ট একটা কুঠিতে থাকে ।তার কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে । নিজেই গিয়ে আলাপ করে মোতিয়ার নতুন সোয়ামির সঙ্গে । নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চায় । কিন্তু মোতিয়া তাকে বিরজুর সঙ্গে মিশতে মানা করে । মোতিয়া না চেনার চেষ্টা করলে বিরজু ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে । সে ধীরে ধীরে যেন জেগে ওঠে । তার ভেতরের সব যন্ত্রণা হঠাৎই যেন মূর্ত হয়ে ওঠে । রাগ ,ঘৃণা ,জিঘাংসা তাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় । কাউকে সে ছেড়ে দেয়নি । সব হিসেব সে মিটিয়ে নিতে চায় । কোনো কথা বলার সুযোগ আর দেয়নি ।
বিচারকের জিজ্ঞাসার জবাবে সে তার অতৃপ্ত যন্ত্রণার সঙ্গে হিংস্র অভিব্যক্তি এমনভাবে প্রকাশ করেছিল যে বিচারকও ভয় পেয়ে যায় । নিষ্ঠুরতার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই ,দু:খ নেই , মোতিয়াকে হারানোর আফশোস নেই । কিন্তু ক্রোধের তৃপ্তি হয়নি ,এখনও সে মোতিয়াকে পেলে টুকরো টুকরো করে ফেলবে ।
জানা যায় , বিরজু লোকটা শুধু পরিশ্রমী নয় , কথাবার্তা ভালো বলে ,গল্পের মতো ।তার আশানতলির কথা , মরে যাওয়া ঝর্নার কথা ,পাহাড়ি ঢালে মোষ ভেড়া চরাবার মজার কথা বলে ।শীতের শেষে কী সুন্দর ফুল ফোটে , সেসব কথা গুছিয়ে বলতে পারে আর পারে ভালো রান্না করতে । জেলে কখনও কখনও নিজেই রান্না করতে লেগে যায় । পুদিনা পাতা দিয়ে কাঁচা আমের চাটনি তৈরি করে সবার মন চুরি করে নেয় ।
কিন্তু মোতিয়ার প্রসঙ্গ এলেই হঠাৎ তার চোখ লাল হয়ে ওঠে , মুখ থমথমে হয়ে পড়ে , হাত দুটো আপনাআপনি গুটিয়ে জোড়বদ্ধ হতে থাকে , ঠোঁট দুটো সিংহ দরজার মতো ধীরে ধীরে চেপে বন্ধ হয় । আর চিৎকার করে ওঠে--ওকে পেলে আমি টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলব ।হৃৎপিণ্ড উপড়ে নেব ,নখ দিয়ে উপড়ে নেব চোখ----
=======================
ঠিকানা
মাখনলাল প্রধান
সুকান্ত পল্লী
পো: বোড়াল
কোল: 7০০154