ছোটগল্প ।। ফাটল ।। দীপক পাল
ফাটল
দীপক পাল
সন্দীপ সান্যাল দুপুরে একচোট ঘুম দিয়ে ধরফর করে উঠে পড়লেন। রোজ দুপুরে খবরের কাগজ অথবা গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘণ্টা খানেক ঘুমোনো তার প্রায় প্রতিদিনের অভ্যাস। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন খাটের ওপর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন চারটে বেজে গেছে। খাট থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকলেন। অল্পক্ষণ পরেই বেরিয়ে এসে তিনি যে ঘরে শুয়েছিলেন তার পাশের ঘরটায় দেখলেন স্ত্রী মনিকা নিঃশব্দে ঘুমোচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে তার বুকটা অল্প ওঠানামা করছে। তার পাশের দরজাটা ভেজানো, অল্প খোলা। বৌমা মনীষা তার ছেলেকে নিয়ে শুয়েছে নিশ্চয়। চুপ করে একটু দাঁড়ালেন সনদীপবাবু। কিছু একটা ভাবলেন বোধহয়। তারপর ঘরে ঢুকে জামা প্যান্ট পড়ে দেওয়ালে ঝোলানো চাবির গোছাটা নিয়ে গ্রীলের তালা খুলে বাইরে বেরিয়ে বাইরে থেকে গ্রীলের ভিতর দিকে তালা লাগিয়ে চাবির গোছাটাকে যতটা সম্ভব ভিতরের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। সিঁড়ির প্যাসেজে নেমে বক্স থেকে চটি বার করে পায়ে গলিয়ে নিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে সদর দরজা খুলে রাস্তায় নামলেন। দরজাটা ভেজাতে ভুললেন না।
গলির রাস্তা পেরিয়ে ট্রাম রাস্তায় গিয়ে পড়লেন তারপর বামদিকের রাস্তার ফুটপাতে উঠে সোজা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকলেন। কিছুটা হাঁটার পর একটা চার রাস্তার মোড় পড়লো। বাম দিকের রাস্তার মোড়ের দোকানে তখন সিঙ্গারা, কচুরি ও জিলিপি ভাজা হোচ্ছে সম্পূর্ন ফুটপাথ জুড়ে খদ্দেরের ভীড়। মধ্য কলকাতার এই এলাকাটা এক বৃহত ব্যবসা কেন্দ্র। তাই এই দোকানটায় সব সময় ভীড় লেগেই থাকে। ফুটপাথের লাগোয়া ঠিক নিচে দুপাশে দুদিকে দুটো বড়ো বড় ড্রাম থাকে শালপাতা ও ভাঁড় ফেলার জন্য। সে দুটো ড্রাম ভর্তি হয়ে উপছে পড়ছে, নিচে সব নোংরা। সন্দীপ সান্যাল ফুটপাথের নিচে নামলেন না। একটু ঠেলে ঠুলে এগিয়ে এসে বাম দিকের ফুটপাথ ধরে এগিয়ে গেলেন। কিছুটা এগিয়ে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালেন। চায়ের দোকানটা নেহাতই ছোট। থরে থরে সাজানো সারি সারি বয়াম , তাতে আছে নানা স্বাদের বিস্কুট আর কেক। দোকানের বাইরে দুপাশে দুদিকে দুটো বেঞ্চ পাতা। মোড়ের ওই চালু দোকানের পাশে এই দোকান কিছুই না। তবু এই এলাকার সিনিয়র সিটিজেনরা এই দোকানটায় এসে চা খায় আর আড্ডা মারে। ওরা নৃপেনকে খুব পছন্দ করে, ভালোবাসে। এই সময় এখনো কেউ আসে নি। সন্দীপ বাবু হাঁকলেন,
- ' কিরে নৃপেণ, কেউ তো আসেনি এখনো। আজকেও আমি সবার আগে।' নৃপেণ হেসে বলে,
- ' এখুনি সবাই এসে যাবে। ততক্ষণে আমি আপনাকে বড়ো ভাঁড়ে একটা সুন্দর করে চা বানিয়ে দিচ্ছি। আপনি বিস্কুট দিয়ে চা খেতে খেতে দেখবেন সবাই এসে গেছে।'
- ' ঠিক আছে তাই দে।'
আসলে এই সময়টায় বয়স্ক লোকেদের একটা জমাটি আড্ডা বসে চা খেতে খেতে নৃপেনের এই দোকানের বেঞ্চে। সবার অবশ্য জায়গা হয়না একসাথে। পালা করে বসে সবাই। তিন প্রস্থ চা চলে একেবারে সন্ধ্যে পর্য্যন্ত। তারপর আড্ডা ভাঙ্গে। একে একে সবাই বাড়ি ফিরে। নৃপেনেরও বেশ বয়স হয়েছে। চেহারাটাও রোগা বেশ, গাল ভাঙ্গা, মাথায় একমাথা চুল। চলে না দোকানটা ঠিকঠাক। এই দোকানটা বেশ কয়েক বছর হলো সে কিনেছে খুব সস্তায় একজন বিশেষ পরিচিত লোকের কাছ থেকে। সেটা বলতে গেলে অনেকটা তার পাওয়াই হলো। তাই সে বিশেষ লাভ না হলেও দোকান খোলে রোজ। আসলে রোজ বিকেলে বয়স্ক লোকেদের আড্ডায় বয়স্ক লোকরা যে সব আলোচনা করে তা নৃপেনের বড়ই ভালোলাগে শুনতে। এতে যেমন রাজনীতির কথা থাকে, সেটা অবশ্য কম হয়, তা বাদে সাহিত্য চর্চা, ক্রিকেট, ফুটবল, লন টেনিস, হকি, দাবা ইত্যাদি খেলাধূলার নানা আলোচনা, নানা দেশ বিদেশের কথা, ভ্রমণ এসব নিয়ে আলোচনা হয়। চা বানানোর ফাঁকে নৃপেণ সে সবকিছু কান পেতে শোনে আর ভাবে এদের কত অভিজ্ঞতা কত কি জানে। কখনো কখনো নৃপেণও ওর অভিজ্ঞতার কথা শোনায় তাদের। তারাও ওর কথা আগ্রহ সহকারে শোনে, গুরুত্বও দেয় খুব। নৃপেণ তাতে খুব গর্ব অনুভব করে। নাহলে ও তো কিছুই না এদের কাছে। এটা সে মনে মনে অনুভব করে ভালো রকম।
সন্দীপবাবুরা বাড়ি ফিরে যাবার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সেও দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে নৃপেনের স্ত্রী আছে এখন একা। একটু বেশি করে দু কাপ চা বানিয়ে একটা ছোট্ট ফ্লাস্কে ভরে নিলো। বাড়িতে ফিরে স্ত্রী সুধার সাথে একসাথে বসে খাবে। তারপর সে চায়ের দোকানে আজকের দিনের বিশেষ বিশেষ শোনা কথা সুধাকে বলবে। তারপর নিজেদের দুটি মেয়ের কথা ও নাতি নাতনীদের নিয়েও আলোচনা হয়। তারপর সুধা উঠে পড়ে। তার কত কাজ পরে আছে যে। ওদের দুটি মেয়ে। ছেলেরা বিয়ে করে আর মেয়েদের বিয়ে হয় এই কথাটা মিথ্যে প্রমাণ করে নৃপেনের মেয়েরা দেখে শুনে নিজেরাই বিয়ে করেছে। খুব সুখে আছে ওরা। নৃপেণ ঠাকুরকে মনে মনে বলে ওরা যেন চিরকাল সুখে থাকে।
ঘর হতে বেরোলেই বাজার। সন্দীপ সান্যাল তবু রোজ বাজারে যান না। আজ বাজারে বেরিয়েছিলেন। বাজার থেকে ফেরার পথে দেখেন নৃপেনের দোকানের সামনে শাচিনবাবু, অচিন্তবাবু আর বিপিনবাবু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উত্তেজিত ভাবে কিছু আলোচনা করছে। অবাক হলেন সন্দীপ সান্যাল।। নৃপেনের থেকে এক কাপ চা নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
- ' কি হয়েছে নৃপেণ? শচীনবাবুরা এত উত্তেজিত কেন?'
- ' ওই মেট্রোর আন্ডার গ্রাউন্ড কাজের জন্য বিপিন বাবু আর সচিন বাবুদের ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে।'
- ' বলিস কিরে, কেমন ফাটল? কি সাংঘাতিক?'
চায়ের কাপ হাতে নিয়েই দ্রুত ওদের কাছে যান।
- ' কি সচিন বাবু, আপনার আর বিপিন বাবুদের ঘরে নাকি ফাটল ধরেছে। কেমন সে ফাটল?'
- ' আর বলেন কেন, আমার শোয়ার ঘরের সিলিং থেকে এঁকেবেঁকে অনেকটা নিচে নেমেছে ফাটল। আর বিপিন বাবুর রান্না ঘরের দেওয়ালের দু জায়গায় ফাটল ধরেছে।'
এর মধ্যে অজয় বাবু , প্রশান্ত বাবু আর নির্মল বাবু এসে হাজির। প্রত্যেকের হাতে বাজারের ব্যাগ। আর তার থেকে নানা শাক সবজি উঁকি মারছে। সবাই একটু উত্তেজিত কারণ অজয় বাবুর খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে ফাটল অনেকটা। সবাই তাই খুব চিন্তিত। আরও কত জনের বাড়িতে এরকম ফাটল ধরেছে কে জানে। আজ কত পুরুষ ধরে তারা এসব বাড়িতে বাস করছে তার কোনো ঠিক নেই। তাদের জন্মও এই বাড়িতে। সবার বয়স সত্তরের বেশি। অবশ্য যে সব বাড়ির মালিকরা আজও বেঁচে আছে। বেশির ভাগ বাড়ির মালিকের ছেলে বা মেয়েরা থাকে বাইরে বা বিদেশে। চাকরি বাকরি ও বৈবাহিক সূত্রে তারা ওখানেই সংসার পেতে আছে। সন্দীপ বাবুর ছেলে বিশ্বজিৎ অবশ্য তার সাথেই থাকে। সে একজন আধা সরকারি অফিসের একজন মাঝারি গোছের অফিসার। অনেক বাড়ির নিচের তলায় থাকে ভাড়াটে। এছাড়া আছে দোকান, ডাক্তারখানা, ওষুধের দোকান, ছাপাখানা ইত্যাদি। কেউ কেউ সে দোকান তাদের নিজেদের খরচে শোরুম বানিয়ে ভেতরটা সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছে।
সন্দীপ বাবুরা সবাই ঠিক করলো যাদের যাদের বাড়ি এফেক্ট হয়েছে তারা সবাই একটা করে মেট্রোর হেড অফিসের ডিরেক্টরকে ফাটলের কথা জানিয়ে পত্র লিখবেন। মোবাইলে ফাটলের ছবিও তুলবেন। তারপর আজই দুপুরে চৌরঙ্গী অফিসে গিয়ে জমা দেবেন এবং ধরনা দেবেন। যতজনকে পারবেন নিয়ে যাবেন ধরনার জন্য। সবারই তো ভয় আছে এরপর কাদের পালা আসবে কে জানে।
দুপুরে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে সন্দীপ সান্যাল ঘর থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইতিমধ্যে বারো জন লোক এসে হাজির হয়ে গেছে। তাঁকে নিয়ে তেরোজন হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আরও জনা বারো এসে যেতেই ওনারা রওনা দিলেন মেট্রো ভবনে। সেখানে পৌঁছে জনা বারো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। বাকিরা সব দরজার বাইরে থাকলো। একসাথে এতগুলো লোক দেখে অফিসের স্টাফরা ঘাবড়ে গেল। সন্দীপ বাবু আর সচিন বাবু এগিয়ে গেলেন তাদের দিকে। সব কথা গুছিয়ে বললেন তাদের। স্টাফেরা ওদের বসতে বললেন ভালো করে সব কিছু শোনার জন্য। ওদিকে বিপিন বাবু আর অজয় বাবু সব পত্রগুলো একসাথে করে এনে পেশ করলেন তাদের। সচিন বাবু আগেই পেশ করেছেন ওনার পত্র আর তার সাথে মোবাইলের ছবিগুলো বার করে।
অফিসের দুজন অফিসার সবার representation গুলো দেখলেন এবং গুনলেন মোট দশটা। তারপর সব পত্র গুলো আর দুটো মোবাইল নিয়ে একটা চেম্বারে ঢুকলেন। অন্য অফিসার, দুজন কাউকে থাকতে বলে বাকিদের বাইরে দাঁড়াতে বললো। সচিন বাবু আর বিপিন বাবুকে রেখে বাকিরা সব বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। সন্দীপ বাবু একসময় বললেন, ' পনেরো মিনিটের বেশি হয়ে গেলো যে, এখনো কিছু জানা গেলো না।' ঠিক এই সময় চেম্বার থেকে দুজন লোক গম্ভীর হয়ে কাগজ পত্র গুলো নিয়ে বেরিয়ে এসে সচিন বাবুদের কাছে ডাকলেন। সচিন বাবুরা কাছে যেতেই তাদের মধ্যে একজন বললেন,
- ' আপনার সব এখন বাড়ি ফিরে যান, ডিরেক্টর সাহেব সব দেখলেন, দেখে তিনি আপনাদের এলাকায় আন্ডার গ্রাউন্ডের কাজ ইমিডিয়েটলি বন্ধ করার আদেশ দিয়ে দিয়েছেন। আপনারা গিয়ে দেখবেন কাজ এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। কাল সকালে কোনো এক সময় ইঞ্জিনিয়ার ও ফটোগ্রাফাররা ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর তদারকিতে যাবে। তারপর ডিরেক্টরের কাছে নোট পাঠাবে। কোনো চিন্তা করার কারণ নেই রেলওয়ে কতৃপক্ষ খুব সহানুভূতিশিল এই ব্যাপারে।'
সবাই আবার কিছুটা নিশ্চিতে এলাকায় ফিরে এলো। গলির মোড়ে এসে সবাই জড়ো হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলো। রাতে যেনো সবাই সজাগ থাকে কিছু হলেই যেন তক্ষুনি সবাইকে বার্তা পাঠানো হয়। তিনজন হেলমেট পরিহিত লোক বাইকে চেপে সন্দীপ বাবুদের রাস্তার ভিতর ঢুকে বাইক দাঁড় করিয়ে ওদের জটলার মধ্যে এসে জিজ্ঞাস করলো,
- ' আমরা মেট্রো রেল থেকে আসছি। আন্ডার গ্রাউন্ড কাজের কারণে আপনাদের কোনো কোনো বাড়িতে কি ফাটল ধরেছে? আমাদের কাজ বন্ধ করার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। আমাদের সব বাড়ির ফাটলগুল দেখে এসে রিপোর্ট করতে বলেছে এখন।'
- ' আসুন আসুন ' অনেকেই একসাথে বলে উঠলো।
মেট্রোর ওই তিনজন অফিসার ক্ষাতিগ্রস্ত্র সব বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখল ফোটো তুললো, কিছু ডায়ারীতে নোট করলো। বললো, ' মোট দশটা বাড়ির ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ভয়ের কোনো কারণ দেখছিনা আমরা। শুনলাম কাল সকালে হেড অফিস থেকে কয়েকজন পর্যবেক্ষক দেখতে আসবে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী সব ঠিক হবে পরবর্তী কর্মকাণ্ড। আচ্ছা আমরা তাহলে এখন আসছি।মেট্রো ভবনে যেতে হবে এখুনি।' ওরা বেরিয়ে গেলো। ওদের পেছন পেছন সন্দীপ বাবুরা কেয়েকজন নৃপেনের চায়ের দোকানে গিয়ে হাজির। নৃপেণ খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলো। বললো,' কি হলো সন্দীপদা মেট্রো ভবনে গিয়ে? কিছু কি সুরাহা হলো?'
সন্দীপ সান্যাল গুছিয়ে অনুপূর্বক সব নৃপেনকে বললেন। ' যাক কিছু তাহলে আশার কথা আছে। ' নৃপেণ যেনো এই বয়স্ক লোকেদের আত্মার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে একেবারে। তাই সেও যেন নিশ্চিন্ত।
- ' বড়ো খাটুনি গেছেরে নৃপেণ আজকে। সবাইকে বড় ভাঁরে চা বিস্কুট দে। ক্ষীদেও পেয়েছে সবার।'
- ' আজ্ঞে ক্ষিদে তো পাবেই। সেই দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে মেট্রো ভবনে গিয়ে তারপর ফিরে এসে ওই অফিসারদের নিয়ে গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়ে দেখানো, এ কি কম কথা?'
পরদিন সকাল দশটার পরে মেট্রো অফিস থেকে হোমরা চোমরা কয়েকজন অফিসার এসে উপস্থিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলো খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো নোট করলো ফটো তুললো এবং মোটামুটি দশটা বাড়িকে টার্গেট করলো এবং ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়ে গেলো। এরপর কয়েকদিন পরেই তারা হাতে ক্ষতিপূরণের পত্র পেলো। দশজন বাড়ির মালিককে পাঁচ লক্ষ টাকা আর দোকানিদের এক লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু বাড়ি মেরামতি কাজের জন্য সেই দশটি বাড়ির ফ্যামেলি ও তাদের ভাড়াটেদের ফ্যামেলির সবাইকে বাড়ি ছাড়তে হবে। সেজন্য নিকটস্থ কয়েকটি হোটেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই সচিন বাবু, বিপিন বাবু ও অজয় বাবুদের নির্দিষ্ট হোটেলে শিফট করতে হলো। সন্দীপ বাবু, অচিন্ত বাবু ও নির্মল বাবুরা তাদের সাথে সেই সব হোটেলে গিয়ে দেখে এলেন ফিরলেন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। তারা তিনজন সোজা এল নৃপেনের দোকানে।
- ' জানিস নৃপেণ, সচিন, বিপিন, অজয় বাবুদের আমরা হোটেলে রেখে এলাম। কি খারাপ লাগছে যে আমাদের কি বলবো তোকে।' সন্দীপবাবু তার দুঃখ ব্যক্ত করলেন।
- ' আমার কি কম কষ্ট হচ্ছে। তারা আমার নিয়মিত কাষ্টমার হলেও তার ওপরেও তো কিছু আছে নাকি বল?
- ' তাতো আছেই। এরপর যদি আমাদেরও ঘর ভাঙ্গে।'
- ' ও কথা বলবেন না সন্দীপদা।'
কিন্তু ঠিক এক বছর পর সন্দীপ সান্যালের কথা একেবারে ঠিক ঠিক ফলে গেলো। বাড়ি মেরামতের পর সচিন বাবুরা আবার ফিরে আসায় এলাকার জীবনযাত্রা আবার চেনা ছন্দে ফিরে এসেছিল। নৃপেণও খুশি আবার বিকালের আড্ডায় সবাইকে পেয়ে। মেট্রোর কাজও শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু আবার একটা দূর্ঘটানা বৃহদাকারে। ৫০ টিরও বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবার। পুরনো বাড়িও আবার ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বাদ গেলো না সন্দীপ সান্যালের বাড়ির সিঁড়ি গুলোর দেওয়াল। অচিন্ত, নির্মল, অজয় বাবুদের বাড়িগুলোতে ফাটল ধরেছে। পুরনো বাড়ি গুলোর অবস্থা খুবই সংকট জনক। এই ৫০ টার ওপর বাড়ির মালিক ও তাদের ভাড়াটেদের বলা হলো এলাকা ছাড়তে। মোট ১০০ র ওপর ফ্যামেলি আর প্রায় ৭০০ জনের কাছাকাছি মানুষের জন্য কয়েকটি হোটেলে দুটো করে ঘর পার ফ্যামেলির থাকার ব্যবস্থা করে দিলো মেট্রো কতৃপক্ষ। কিছু ফ্যামেলি নিজেরাই নিজেদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করে নিলো। তারপর কতৃপক্ষ রাস্তাগুলো সিল করে দিলো।
সন্দীপ বাবুর আর অচিন্ত বাবুর হোটেল একই। উপর নিচ করে। শিয়ালদহ স্টেশনের ১ নং প্ল্যাটফর্মের উলটো দিকের ফুটপাথে। পাশাপাশি দুটো ঘরে দুটো খাট পেতে আর বেশির ভাগ ফার্নিচার গুটিয়ে রেখেও পা ফেলার জায়গা হয় না প্রায়। ছেলে বিশ্বজিতের খাটটা একটু বড় হওয়ায় বেশিরভাগ আসবাব সন্দীপবাবুর ঘরে স্থান পেয়েছে। ঘরে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে। সন্দীপ বাবু স্ত্রী মনিকা দেবীর সাথে বারান্দায় চেয়ারে বসে নিচে জনারণ্যের দিকে চেয়ে থাকেন। বাস ট্রাম ট্যাক্সি গাড়ির আসা যাওয়া দেখেন। এখান থেকে শিয়ালদা স্টেশনটা বেশ দেখা যায়। রাস্তা থেকেই কেউ কেউ রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে স্টেশনের সিঁড়িগুলো টপাটপ টপকে ভিতরে ঢুঁকতে দেখা যায়। ভিতর থেকে বেরোনো যাত্রীদের সাথে ধাক্কাও লাগে প্রায়ই। যার সাথে ধাক্কা লাগে সে হয়তো রুখে উঠলো কিন্তু সে ততক্ষণে লাফ দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। মাঝে মাঝে এক সুন্দর চেহারা পাদ্রী সাহেবকে দেখা যায় যিনি মাথায় টুপি আর সাদা ওভার কোট পড়ে এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে আর এক হাতে কি একটা বই, বাইবেল হতে পারে, এক মনে পড়তে পড়তে ভীড় কাটিয়ে কাটিয়ে চলে যান। এই ঘটানাটি তাদের খুব অবাক করে। আজকেও তিনি এই মাত্র সূর্য্য সেন স্ট্রিট ক্রস করে চলে গেলেন। এমন সময় ছোট্ট নাতিটা মুখ ভার করে এসেই দাদুর কোলে বসলো। সন্দীপ সান্যাল হেসে বললেন,
- ' কি হলো আমার টুটুল সোনার, মুখ ভার কেন?'
- ' মা মেরেছে, আমি আর মায়ের কাছে যাবনা কক্ষন।'
ওনারা দুজনে হো হো করে হেসে উঠলো।
- ' শুধু শুধু তো আর মা মারবে না, কি করেছিস তুই?' মনিকা দেবী জিজ্ঞেস করেন।
- ' তুমি চুপ কর। তোমাকে বলবো না।' সন্দীপবাবু বলেন,
- ' ঠিক আছে তুমি কি আমাকেও বলবে না?'
- ' তোমাকে বলবো। আমি মার কথা শুনিনি, ঝাঁটা দিয়ে সব ঝাট দিচ্ছিলাম বলে আমায় মা মেরেছে। আমি আর কক্ষন মায়ের কাছে যাব না, তোমার কাছে থাকবো।'
- ' কিন্তু দাদুভাই রাত্তিরবেলা যদি মায়ের কথা মনেপড়ে?'
- ' পরবে না।' আবার দুজনে হো হো করে হেসে ওঠে।
অচিন্ত্য বাবুর সাথে রোজই প্রায় দেখা হয়। হয় তিনি আসেন না হয় সন্দীপ বাবু যান। সে সূত্রে তাদের স্ত্রী মনিকা আর কাবেরীদের মধ্যেও বেশ ঘনিষ্টতা হয়েছে। চা টা সহযোগে তাদের মধ্যে বেশ আড্ডা জমে। দুঃখের সময়ের সাথে সুখের সময়কার কথাও অনেক হয়। তবে দুটো ফ্যামেলিরই ভীষণ আফসোস পূজোর মুখে এই দুর্দশাটা না হলেই ভালো হতো।
এদিকে নৃপেনের আজকাল চায়ের দোকান খুলতে ইচ্ছে করেনা। পরিচিত লোকেদের আর এখন আর দেখা যায়না। দোকানের বিক্রি অবশ্য কিছু বেড়েছে। বেশির ভাগ লোকই এই এলাকায় বাড়ি ভাঙার দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে আসে। রাস্তায় নো এন্ট্রি থাকাতে তারা দুর থেকে উঁকি ঝুঁকি মেরে ফিরে যায়। কেউ কেউ নৃপেনের দোকানে চা খেতেও আসে। নৃপেণ ভাবে কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ! নো এন্ট্রির কাছে পুলিশ পোস্টিং আছে তো ঢুকবে কি করে। মেট্রো রেলওয়ের ওপর তার ভীষণ রাগ। মেট্রোর কারণেই তো স্বজনদের কত কষ্ট। আজ আর তাদের সাথে দেখা যায় না। তবু সে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে মেট্রো কর্তৃপক্ষ তো কথা দিয়েছে তাদের সামনের বছর আগস্টের মধ্যে তাদের সবার বাড়ি ঠিক আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে। সেও তো বহুদিন বাকি। তাছাড়া সরকারি কাজে চব্বিশ মাসে বছর। তাই ওই সময়ের মধ্যে হবেনা তা বালাই বাহুল্য।
একদিন তো শেষ রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার বুকটা খুব ধুকপুক করছিলো। টাটকা স্বপ্নটা তার মনে পড়লো। সন্দীপদারা কয়েকজন মিলে দোকানের রাস্তাটা দিয়ে হন হন করে কোথায় চলেছে। প্রথমে নৃপেণ ভাবলো, সবাই ওর দোকানে চা খেতে আসছে। কিন্তু তারা না থেমে দোকানের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ নৃপেনের দিকে ফিরেও তাকালো না। তবুও নৃপেণ একবার বলে উঠেছিল - ' কি চা খাবেন না গরম গরম?' কেউ সে কথা শুনল না। কিন্তু নৃপেণ লক্ষ করলো রাস্তাটা যেনো একটু দূরে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। রাস্তাটা তো আগে এরকম ছিল না। বিনা মেঘে হঠাৎ একটা প্রচন্ড বজ্রপাত হলো। দেখল সামনের
রাস্তাটাতে একটা বিরাট ফাটল ধরে দুটো দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে একেবারে সন্দীপদাদের সামনে আর সন্দীপদা আর তার পাশের লোকটা ফাটলের গর্তে পড়ে গেলো।নৃপেণ ' সন্দীপ দা.........' বলে চিৎকার করে উঠতে গেল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলো না। উঠতে গিয়ে কিছুতেই উঠতেও পারলো না। পাশ থেকে বউ সুধা জোরে একটা ঠেলা দিতেই ধর মর করে বিছানায় উঠে বসেছিল। বিছানার পাশে রাখা জলের বোতল তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে খানিকটা জল খেয়ে নিল। সুধা জিজ্ঞেস করলো,
- ' স্বপ্ন দেখেছ তুমি?' নৃপেণ বলে,
- ' শুধু স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন!'
- ' তা কি দেখলে?'
- ' ফাটল, মস্ত বড় ফাটল।'
- ' সে আবার কি?'
- ' সুধা, আজ আর দোকান খুলবো না। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।'
- ' বেশতো থাকনা শুয়ে। রোজ রোজ দোকান খুলে যা ধকল যায় তোমার শরীরের ওপর। আজ বরং বিশ্রাম নাও শুয়ে আর ঘুমোতে চেষ্টা কর একটু। আমি বরং চা আর কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি।' চলে যায় সুধা।
ঘুম কি আর আসে। মনে যে স্বজনের জন্য দুঃখ। তার মনেও যে এক গভীর ফাটল ধরেছে। ছোট্ট জানলার বাইরে খোলা আকাশের দিকে সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কেবল।
-০-০-০-০-০-০-০--০-
Address:-
---------
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8 Flat-1B,,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.