মুকুরদীপি -- এ বঙ্গের অলংকার
জীবন পাইক
জীবন যুদ্ধের গল্প সিনেমার পর্দায় অনেক দেখেছি ৷উপন্যাস ,গল্পের পাতায় পাতায় পড়েছি অনেক নায়কের সদর্পে পাদচারণা ,স্বপ্ন জয়ের কাহিনি ৷ কিন্তু ,বাস্তবের মাটিতে নিজের চোখে দেখা এমন এক মহানায়কের উত্থান যেন সকল কল্প কাহিনির চরিত্রকে হার মানায় ৷
দুরন্ত জেদ আর অদম্য ইচ্ছা শক্তির বলে তিনি নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন বাস্তব আর কল্পনার কেন্দ্র বিন্দুতে ৷ তিনি একসময় নিঃশব্দে সাধনা করেছেন নিঃসঙ্গ একলব্যের মতো ৷ অথবা ,নির্জন অরণ্যানির মাঝে ধ্যানমগ্ন ঋষি কুমারের মতো ৷তিনি আর কেউ নন তিনি এ বঙ্গের অলংকার ক্যানসার গবেষণায় বিশ্বকে যিনি দেখাচ্ছেন আলোর পথের দিশা তিনি ডক্টর মেজর এম.ডি.রায় ৷প্রথিতযশা ক্যানসার গবেষক এই বাঙালি চিকিৎসক যাঁর গবেষণাকে কুর্নিশ জানিয়েছে বিশ্বের খ্যাতনামা চিকিৎসক মহল |এই বঙ্গদেশের ধুলি মলিন ধরণির বুকে তাঁর মতো মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানীর আবির্ভাব সত্যিই বিস্ময়কর |
এম.ডি.রয় আসলে অন্য অপর কেউ নন ৷ মহানগরের সুখ বিলাস তাকে স্পর্শ করে নি৷ বাংলার মাটির ঘরের মাটির মানুষ শ্রী মুকুরদীপি নস্কর ৷ গ্রাম বাংলার আলো,বাতাস ও বৃষ্টি ভেজা সোঁদা মাটির গন্ধে তিনি প্রাণ ভরে নিয়েছেন শ্বাস ৷
মুকুর দীপি রায় (নস্কর)১৯৭১সালে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪পরগনা জেলার অন্তর্গত ঢোলা হাট থানার কেদো রাম চন্দ্র নগর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন ৷বাবার নাম স্বর্গীয় মহিম চন্দ্র নস্কর ৷সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে তিনি এক প্রজ্জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি ৷সত্যি তিনি ভগবানের আশীর্বাদ ধন্য ৷তাঁর মতো সাধারণ ঘরের মানুষের পক্ষে সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিকে জয় করে দেশের সীমা অতিক্রম করে কিভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত হলেন তা সত্যি বিস্ময়কর ৷
মুকুরদীপি অজ পাড়া গাঁয়ের মানুষ ৷তাঁর শরীরে এখনো লেগে আছে এ বাংলার আলো,বাতাস,ধুলোমাটির স্পর্শ ৷ আমার পাড়ার মানুষ বলেই তাঁর সম্পর্কে ও তাঁর প্রাথমিক দিন গুলোর কথা আমার পক্ষে বলাটা খুব একটা কঠিন নয় ৷
শহর কোলকাতা থেকে ওনার জন্মস্থান প্রায় ১২০কিলোমিটার দূরে ৷সে সময় শহরের সঙ্গে আমাদের গ্রামের যোগাযোগ এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ছিল ৷মাইলের পর মাইল ছিল মেঠো পথ ৷গাড়ির বালাই ছিল না ৷ পায়ে হাঁটাই ছিল একমাত্র উপায় ৷বর্ষাকালে হাঁটু পর্যন্ত কাদা ৷উনি বর্ষাকালে হাঁটু কাদা মাড়িয়ে স্কুলে এসেছেন বছরের পর বছর ৷ বিদ্যুতের আলো তখন ও পৌঁছায় নি আমাদের গ্রামে ৷উনি পড়াশোনা করেছেন কেরোসিনের ল্যাম্প কিংবা হ্যারিকেনের আলোয় ৷ রাম চন্দ্র নগর এস এস হাইস্কুলের ছাত্র তিনি ৷নবম শ্রেণিতে চলে আসেন কেদারপুর রাম নন্দ হাই স্কুলে ৷তিনি যে উজ্জ্বল রত্ন তার প্রমান মেলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অভাবনীয় রেজাল্টে ৷১৯৮৬ সালে মাধ্যমিকে স্টার পেয়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছেন ৷
মুকুরদীপি ঐশ্বরিক পরিমন্ডলে বড়ো হয়েছেন ৷সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তাঁর হৃদয়ের সুকোমল বৃত্তিকে সুগঠিত করে ৷ একদিকে গগনচুম্বী তাঁর স্বপ্ন দেখা অন্য দিকে তার বাস্তবায়নে কঠোর শ্রমনিষ্ঠা তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়েছে জয়ের শিরোপা ৷তিনি নিজ জীবনের সাফল্য উৎসর্গ করেন শ্রীশ্রীঠাকুরের পাদ পদ্মে ৷
দেবনগর মোক্ষদা দিন্দা উচ্চবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য,দুর্দমনীয় ৷অশ্বমেধের ঘোড়ার মত তাঁর লাগাম বিহীন পথ চলা ৷এ চলায় বিরাম নেই ৷ বিশ্রাম নেই ৷ দুরন্ত দূর্নিবার গতি ৷হয়তো তাঁর মনের কোণে প্রতিনিয়ত বীজ মন্ত্র ধ্বনিত হত--"চরৈবেতি চরৈবেতি"৷
তিনি কোলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে MBBS পাশ করেন ৷এরপর একে একে তাঁর মাথার মুকুটে এসে শোভাবর্ধন করে অসংখ্য রঙিন পালক ৷দিল্লী এইমস থেকে করেনMS ইংল্যান্ডের গ্লাসগো থেকে করেন FRCS এরপর PhD(oncho AIIMS),FACS(USA), FICS(oncho),FIAS(ind) (Senior research fellow(oncho ICMR)
Senior cancer surgeon,department of surgical onchology,
Dr.BRA IRCH,AIIMS,New Delhi.
ডক্টর মুকুরদীপি রয় (নস্কর) ঈশ্বর অন্তপ্রাণ ,মানুষের মধ্যেই তিনি সর্বদা খোঁজেন ঈশ্বরকে ৷তাই মাস্টার অব সার্জারি পাশের পর তাঁর ডাক আসে কার্গিল সীমান্তে ভারত পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ময়দানে ৷ সালটা ১৯৯৯ ৷সেই কার্গিল যুদ্ধের ময়দানে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অতন্দ্র সৈনিক ৷না তিনি অস্ত্র ধারণ করেন নি ৷ তিনি শক্ত হাতে তুলে নিয়েছিলেন সারজিক্যাল সরঞ্জাম ৷মনের মধ্যে কঠিন বিশ্বাস,আত্মপ্রত্যয়, আর চরম দুঃসাহস আর এক নিষ্ঠ দেশপ্রেমে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর ৷ আহত সৈনিকের শরীর থেকে বের কর আনেন রক্ত মাখা বুলেট ৷ হাজার হাজার লাখো লাখো যোদ্ধার মতো তিনি ও সংগ্রাম করে গেছেন রক্তাক্ত কার্গিল সীমান্তে ৷
আজ ও তিনি সমানে লড়াই করছেন সংগ্রামের ময়দানে ৷তবে তাঁর সেই সংগ্রাম স্থল কার্গিল নয় ৷রক্তাক্ত কার্গিল থেকে ফিরে তিনি যোগ দিয়েছেন দিল্লি এইমস হসপিটালে ৷ অপ্রতিরোধ্য সৈনিকের মতো ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে তিনি সংগ্রাম করছেন ৷প্রতিনিয়ত তাঁর গবেষণা ৷নতুন নতুন তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতা ৷পাঁচ পাঁচটি তাঁর ক্যানসার অপারেশনের নতুন পদ্ধতি বিশ্বের চিকিৎসা মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে ৷তাঁর যুগান্তকারী পদ্ধতি রিভার ফ্লো সবাইকে স্তম্ভিত করে দেয় ৷ তাঁর এই পদ্ধতিতে কয়েক মাসের মধ্যে ১০৫টি অপারেশনে তিনি সফলতা পান ৷ডক্টর মুকুরদীপি রায় এও বলেন ,ক্যানসার পেশেন্টের ক্ষেত্রে অনেকের অপারেশনের পরে সেলাইয়ের জায়গা অনেক সময় সংক্রমনের ফলে গলে যায় |তাই ওই ক্ষত স্থান শরীরের অন্য স্থান থেকে ত্বক সহ মাংস পেশী এনে ভরাট করলে পেশেন্ট ও তার বাড়ির লোকের হয়রানি কমে |
তিনি এইমস হসপিটালে এক তরুণীর জরায়ূ থেকে আঠারো কিলোগ্রামের টিউমার অপারেশন করেন ৷ক্যান্সার আক্রান্ত ওই মহিলাকে তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির অভিনবত্বে ফিরিয়ে দিয়েছেন স্বাভাবিক ছন্দে ৷সারা বিশ্বে তাঁর হাতের যাদু স্পর্শের কথা ছড়িয়ে পড়ে ৷
মুকুরদীপি রায় মেজর,চিকিৎসক,অধ্যাপক বিজ্ঞানী,সুলেখক,সুবক্তা,আবার জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পী এবং তবলচি ৷ চিকিৎসা জগতে সমৃদ্ধি আনতে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য গ্রন্থ-"The gatewaye of surgery,cancer fact and fiction".
চিকিৎসা গ্রন্থ ছাড়াও ক্রমাগত ইংরাজী ও বাংলা সাহিত্য চর্চা তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রখেছে ৷তাঁর শতাধিক বাংলা ছোটগল্প বাংলা সাহিত্য ভান্ডার কে সমৃদ্ধ করেছে ৷ তাঁর MBBS প্রথম বর্ষ পড়ার সময় প্রকাশিত হয় "আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে "|
তাঁর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷রবীন্দ্র কাব্য,সঙ্গীত,গল্প, উপন্যাস তাঁর অন্তর জগতকে জাগরিত করতে প্রেরণা দান করেছে ৷ রবীন্দ্রনাথের বড় বড় কবিতা যেমন,"দেবতার গ্রাস,হঠাৎ দেখা " তিনি বড় মঞ্চে আবৃত্তি করে বিমুগ্ধ করেছেন সবাইকে ৷তিনি মানুষকে ভালোবাসেন ৷তিনি এ বিশ্বের এক ধর্মকে প্রাধান্য দেন ৷তা মানব ধর্ম ৷মানব ধর্মে উজ্জ্বল ডক্টর মুকুরদীপি রায় ৷তিনি বলেন ,ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য নীরব ঘাতককে প্রতিহত করতে নিম্ন মানের জীবন(poor life style) চর্চাকে পরিত্যাগ করা দরকার ৷ তিনি বলেন আমাদের প্রতিদিন EMS করা খুব দরকার ৷ Exercise,Meditation,Study.এ ক্ষেত্রে কোন অজুহাত নয় ৷
মুকুরদীপি চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনন্য অবদান ও মানব সেবার কারণে ২০২২ এ পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত হন ৷ ক্যান্সার জগতে সফল অস্ত্রপচারে অনন্য নজির সৃষ্টি করার জন্য ইন্ডিয়া বুক অব রেকর্ডস এ তাঁর নাম নথিভুক্ত হয় ৷
===================