আলোচনা ।। পত্রিকা : মিঠাই (২য় বর্ষ - শারদীয়া - ১৪৩০) ।। আলোচক : গোবিন্দ মোদক
মিঠাই : প্রকৃত অর্থে
শিশু-কিশোরদের উপযোগী পত্রিকা
-- গোবিন্দ মোদক
মিঠাই কে না ভালোবাসে! তিন থেকে তিরানব্বই সব্বাই এর ভক্ত। কেননা "মিঠাই" নামক যুক্তাক্ষর বর্জিত তিন অক্ষরের এই আপাত নিরীহ শব্দটিতে মিশে আছে ঘন মিষ্টত্ব। আর সেই মিঠাই যখন প্রথম প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততাকে ছাপিয়ে আবারও সঞ্চিতা দে-র সুযোগ্য সম্পাদনায় সাহিত্যিকা সাহিত্য পরিবারের "শিশু-কিশোর পত্রিকা" (২য় বর্ষ- ১৪৩০) হিসাবে দ্বিতীয় বর্ষ পার করে করে তখন স্বাভাবিকভাবেই তা ভিন্নমাত্রা পায়। বস্তুতপক্ষে বাজার চলতি যে সমস্ত শিশু-কিশোর পত্রিকা দেখা যায় তা প্রকৃত অর্থে পুরোপুরি শিশুদের উপযোগী নয়। কিন্তু মিঠাই তার উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। ছোটদের জন্য এমন পত্রিকা যতো বেশি হবে ততো যে শুধু শিশু-কিশোর সাহিত্যের মঙ্গল তাই নয় — সার্বিক বাংলা সাহিত্যেরও মঙ্গল।
বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে যেখানে শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে স্মার্টফোন, সেখানে বই পড়ার অভ্যাস প্রায় নেই বললেই চলে — আর সেই প্রেক্ষিতে মিঠাই-এর হৈ-হৈ করে দ্বিতীয় বর্ষের পদার্পণ এবং প্রকাশ নিঃসন্দেহে একটি সদর্থক প্রয়াস। চমৎকার মনোগ্রাহী প্রচ্ছদের এই পত্রিকাটিতে স্বনামধন্য গুণীজনেরা যেমন ছোটদের মতো করে লিখেছেন — তেমনই রয়েছে ছোটদের ভাবনা, ছোটদের আঁকি-বুকি যা তুলে ধরেছে ছোটদের মনের উদার আকাশকে। পত্রিকাটিতে ছড়া-কবিতা, অণুগল্প এবং প্রবন্ধ জুড়ে যেমন রয়েছে ছবি হাসি মজা, তেমনই রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা, জানবার কথা, রূপকথা, কল্পবিজ্ঞান কাহিনী, ভৌতিক কাহিনী, সামাজিক কাহিনী প্রভৃতি বিষয়।
একজন সনিষ্ঠ পাঠক মিঠাইয়ের দ্বিতীয় বর্ষের এই সংখ্যাটিকে একটু নেড়েচেড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন কতোখানি পরিশ্রম করে সম্পাদিকা গড়ে তুলেছেন মিঠাইয়ের অবয়ব। স্বনামধন্য লেখক, কবি, ছড়াকার, সাহিত্যিক ছাড়াও স্বল্পখ্যাত এবং নবীন কলমচিও এতে কলম ধরেছেন। শিশু-কিশোর উপযোগী নানা স্বাদের বৈচিত্রপূর্ণ লেখায় মিঠাইয়ের দ্বিতীয় বর্ষের পত্রিকাটি একেবারে জমজমাট। মিঠাই-এ যেমন রয়েছে প্রখ্যাত ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের 'আজব দেশ, গরিব শেষ', প্রদীপ আচার্যের 'বোনের কথা', দীপ মুখোপাধ্যায়ের 'বাঘ আর শামুকের ছড়া', চন্দন নাথের 'দূত হবে কে?', রতনতনু ঘাঁটির 'গুগল ম্যাপের চক্করে', শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের 'আকাশ', অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়ের 'চোখের সামনে রবীন্দ্রনাথ', অনির্বাণ জানার 'ক্রিকেট খেলা বিকেল বেলা', আনসার উল হকের 'পাখি', পবিত্র চট্টোপাধ্যায়ের 'নব আনন্দে", শংকর দেবনাথের 'ঘুম ভাঙানি ছড়া', ড. নির্মল করণের 'ও খুকু তুই', অরুন্ধতী নন্দীর 'তুলির চাওয়া', সুব্রত চৌধুরীর 'খুশির ঝিলিক' .... তেমনই রয়েছে কবি-ছড়াকার শক্তিপদ পন্ডিত, সবুজ মোদক, শ্রাবন্তী রায়, সুপ্রীতি বিশ্বাস হালদার, রণজিৎ বালা, বিউটি বাগচী সরখেল, প্রবীর দেবনাথ, নূপুর আঢ্য, গোবিন্দ মোদক, সঞ্জয় দে, মোহনলাল দাস, সোমা সোম, সৌম্যদীপ সাহা, রীনা পাল, লিলি সেন, পারমিতা মজুমদার, হিমেন্দু দাস, অর্জুন কুমার ঘোষ, মৌমিতা সরকার, বিকাশচন্দ্র সরকার, সঞ্জয় বৈরাগ্য, রীনা চক্রবর্তী, স্বপন কুমার রায়, অঞ্জনা চক্রবর্তী, কাবেরী দাস মহাপাত্র, সুনীল সরকার, উমা মুখার্জী সহ আরও অনেক কবি-ছড়াকারের ছড়া-কবিতা।
এছাড়া ভূত বিষয়ক অনবদ্য কয়েকটি ছড়া-কবিতা উপহার দিয়েছেন তুষারকান্তি মুখোপাধ্যায় (ভূতের ভয়), সাধন প্রামাণিক (ভূতের মামা বাজায় ধামা), কাশীনাথ হালদার (তেপান্তরের মাঠে) প্রমুখ কবি-ছড়াকার। মিঠাই বিষয়ক ছড়া-কবিতায় মন কেড়েছেন কাকলী ভট্টাচার্য্য, উৎপল কুমার ধারা, স্বপন কুমার বিজলী, সত্যরঞ্জন, রুমা মন্ডল, শর্মিলা ঘোষ, কল্যাণ কুমার সরকার, শিখা বসাক, অরুণিমা নাথ, তিথিশ্রী দে, বিপুল কুমার ঘোষ, সরিতা বিশ্বাস প্রমুখ কবি-ছড়াকার।
পত্রিকার গদ্য বিভাগটিও অত্যন্ত বলিষ্ঠ যেখানে বরুণচন্দ্র পাল, রবিশংকর দাস, সৌম্যকান্তি মুখার্জি, সঞ্চিতা দে, অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত, অপর্ণা রায় দাস, সঞ্চিতা সিকদার, শুক্লা দাস, দেবদুলাল কুন্ডু, রূপসা দত্ত, চন্দন চক্রবর্তী, হিমবন্ত দত্ত, রঞ্জনা বসু, সুমিতা চৌধুরী, বন্দনা পাত্র, শিবানী চ্যাটার্জী, মৌসুমী সরকার, সৌমেন কুমার চৌধুরী প্রমুখ গল্পকার উপহার দিয়েছেন ফিরে পড়বার মতো সুন্দর সব গল্প এবং অণুগল্প। প্রবন্ধ বিভাগে বলিষ্ঠ লেখনীর স্বাক্ষর রেখেছেন প্রবন্ধকার রতন কুমার দাস (শিশু সাহিত্য ও রায় পরিবারের তিন প্রজন্ম), সৌমেন চক্রবর্তী (কোপার্নিকাসের আকাশ), সোমনাথ মুখোপাধ্যায় (ভূতের রাজা দিল বর), দেবপ্রসাদ জানা (শৈশবের একাল সেকাল)। সময়োপযোগী নিবন্ধ উপহার দিয়েছেন নিবন্ধকার সুদর্শন দত্ত, প্রশান্ত দাস, শর্মিলা ঘোষ। পত্রিকার একমাত্র ভ্রমণ গল্পে (নেতারহাট ভ্রমণ) মন কেড়েছেন গৌরী মন্ডল।
পত্রিকার সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিভাগটি হলো "ছোটদের ভাবনা" যেখানে মাননীয় সম্পাদিকা মহাশয়া কচিকাঁচাদের দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন অনেক সুন্দর সুন্দর লেখা। ছোটদের পত্রিকার এই অংশটি প্রকৃত অর্থেই সবুজে সবুজ যেখানে শুভান্বিতা দে (আমাদের চকলেট), অন্তরীপ দাস (আধুনিকীকরণ), সুবর্ণা মুখোপাধ্যায় (মিঠাই), আয়ুষী মন্ডল (বনের রাজা), বিপাশা মজুমদার (ফেরারী মন), রাজশ্রী চৌধুরী (মিঠাই তোমার জন্য), আরাত্রিকা বিশ্বাস (দুই মামা), গোধূলি দাস (গরম কাল) — এদের মতো কচিকাঁচারা তাদের কাঁচা হাতের সুন্দর সুন্দর সৃজনশীলতায় সাজিয়েছে তাদের নিজস্ব লেখালেখির ছড়া-কবিতা বিভাগটি। অদিত্রী দাস লিখেছে 'মোটা ও রোগা' নামক চমৎকার একটি অণুগল্প। পৌলমী বিশ্বাসের প্রবন্ধের (শৈশবের একাল ও সেকাল) হাতটিও চমৎকার।
ছোটদের আঁকিবুকি বিভাগটি সেজে উঠেছে অভিনব মন্ডল, সংবিৎ সরকার, রিনিতা বিশ্বাস, সানাভি রায়, ইমন ঘোষ, মনীষ দাস, রিধিমা বিশ্বাস, বিতান সর্দার, মৃত্তিকা মিত্র, প্রথম প্রতিশ্রুতি, কৃষ্ণকলি বিশ্বাস, অনিরুদ্ধ প্রামাণিক ও অভিজ্ঞান সাহার পেন্সিল ও তুলির টানে।
পাতায় পাতায় ছবিতে ভরা সুসম্পাদিত ১৩২ পৃষ্ঠার মিঠাই-এর দ্বিতীয় সংখ্যাটি পড়তে পড়তে (বলা ভালো মিঠাইয়ের মিষ্টি স্বাদ চাখতে চাখতে) একটা কথা মনে হলো — সেটি হলো "ছোটদের ভাবনা" বিভাগটি আরও বড়ো হওয়া দরকার। মাননীয়া সম্পাদিকা মহাশয়কে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি সংখ্যা উপহার দেবার জন্য। আর বলতে দ্বিধা নেই যে — মিঠাইয়ের দ্বিতীয় সংখ্যাটি এতোটাই চমৎকার যে এর বহুল প্রচার কামনা করাই যায় এবং মিঠাইয়ের পরবর্তী সংখ্যার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করাই যায়।