বড়গল্প ।। উত্থান-পতন ।। শংকর ব্রহ্ম
উত্থান-পতন
শংকর ব্রহ্ম
(১).
উনিশ বছর বয়সে বলরাম শ্মশান থেকে একটা গীতা চুরি করেছিল। সেটা ছিল লাল কাপড়ে বাঁধাই করা। মাপে হাতের চেয়ে কিছুটা বড়। অনুবাদক ও ভাষ্যকার স্বামী বীতশোকানন্দ। সে তখন কলেজে পড়ে। যেখানে সে ঘুমাত, সেখানে বিছানার পাশের টেবিলে অনেকদিন ধরে পড়েছিল গীতাটা।
স্কুল পাশ করে কলেজে এসে ভর্তি হল যখন, তখন কখনও-সখনও মন বিবাগী হলে, পাড়ার বখাটে ছেলে অমিয়র সঙ্গে মাঝে মাঝে সে শ্মশানে গাঁজা খেতে যেত। একদিন, গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে বসে আছে, এমন সময় 'হরি' ধ্বনি দিয়ে একটা লাশ শ্মশানে এসে ঢুকল। বলরাম তাকে দেখে চমকে উঠল। এত রূপ ! সুন্দর ঢলঢলে মুখখানা কী মায়াবী ! বয়স বড় জোর কুড়ি বাইশ হবে। এমন এক রূপবতী যুবতীর কিনা আর মরার সময় পেল না?
বাড়ির আর যারা এসেছেন, মৃতদেহের সঙ্গে, তাদের দেখে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মনে হল।
বলরাম তাদের কথায় জানতে পারল মেয়েটি বিষ খেয়ে মারা গেছে। তার শবদেহের সঙ্গে অন্যান্য আরও জিনিষের সঙ্গে লাল মলাটের চকচকে একখানা গীতাও দিয়েছিলেন তারা।
অমিয় বাড়ি চলে গেল। বলরাম শ্মশানে বসে রইল একা অনেকক্ষণ , কি জানি কি ভেবে? মেয়েটির পারমাঙ্গলিক ক্রিযা-কর্ম সম্পন্ন করে পুরোহিত, তাকে একটা থান কাপড়ে দেহটা ঢেকে দিয়ে, দান সামগ্রী সব নিয়ে চলে গেল। আর গীতাপুস্তকটি এক কোনে ফেলে রেখে দিল। সেখানে আরও কতগুলি গীতা পড়েছিল। মেয়েটির দেহ দাহ হয়ে গেলে পরে ওদের বাড়ির লোকজনও চলে গেল।
তারপর বলরাম মেয়েটির সঙ্গে দেওয়া গীতাটা নিয়ে বাড়ি চলে এলো, কি কারণে সে নিজেও জানে না। হয়তো অবচেতন মনে তার মেয়েটির স্মৃতি সংরক্ষণের ইচ্ছে জেগেছিল।
বলরাম ঠিক জানে না, এটাকে চুরি করা বলে কিনা ! 'পরের দ্রব্য না বলিয়া গ্রহণ করাকে
চুরি করা বলে।' সেই অর্থে চুরি করা বলা যেতে পারত। কিন্তু এটা তো ঈশ্বরকে উৎসর্গকৃত দ্রব্য।
মহিলার সঙ্গে দেওয়া সমস্ত দ্রব্যগুলিই সেই অর্থে তাই। পুরোহিত সেগুলি আত্মসাৎ করায়, কেউ তাকে চোর বলে মনে করে না। আর গীতাটা তার কোন কাজে লাগবে না বলেই সে কীনা ফেলে রেখে গেছে। তবে আর সেটা নিয়ে আসায় বলরাম চুরি করেছে বলা বোধহয় সমীচীন হবে না।
কলেজ না থাকলে নিজের কাজ নিয়ে দিনের বেলাটা বলরামের সাধারণতঃ বাড়িতেই কাটে। সন্ধ্যাবেলা কোন কোন দিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেরোয়। কখনও গড়িয়ায় পিকলুর চায়ের দোকানে যায়, আবার কখনও আজাদহিন্দ লাইব্রেরীতে গিয়ে বসে দৈনিক খবরের কাগজ কিংবা ম্যাগাজিন পড়ে।
আজ বিকেল থেকেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সে তাই টেবিলে পড়ে থাকা গীতাটা তুলে নিয়ে কৌতূহল বশতঃ পড়তে শুরু করল। গীতাটা বের করে পড়তে গিয়ে প্রথমই সেই মৃত মেয়েটির মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠেছিল।
অর্জুনের বিষাদযোগ দিয়ে শুরু।
" ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করিলেন, হে সঞ্জয় পুণ্যভূমি
কুরুক্ষেত্রে দুর্যোধনাদি আমার পুত্রগণ এবং যুধিষ্ঠিরাধির পান্ডবগণ যুদ্ধার্থে সমবেত হইয়া কি করিল?
জন্মান্ধ কুরুরাজ ধৃতরাষ্টের আমাত্য কহিলেন, তখন রাজা দুর্যোধন পান্ডবসৈনসমূহকে ব্যূহাকারে অবস্থিত দেখিয়া আচার্য দ্রোণের নিকট গমনপূর্বক এই কথা বলিলেন।
হে আচার্য আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুন্ম এই ব্যূহ রচনা করিয়াছেন। আপনি পান্ডবদের এই বিপুল সৈন্যসমাবেশ দর্শন করুন।"
পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে পড়েছিল বলরাম। দৃশ্যকল্পটা যেন তার চোখের সামনে ভাসছিল।
বলরামের বাবা ছিলেন একজন অস্ত্রচিকিৎসক (Surgeon)। দক্ষিণা পেলে জ্যান্ত মানুষও কেটে ফেলতে পারতেন এবং তাদের অনেকেই মারা যেত - এই অভিযোগ ছিল বলরামের। তার মা লীলাবতী দেবী শান্তভাবে তাকে বুঝিয়ে বলতেন, তিনি আবার তাদের সেলাই করে দিতেন। তাদের অনেকেই সেরে উঠত। সব সময় তুমি একটু বাড়িয়ে কথা বল।
- আমি বাড়িয়ে বলি? মাকে জিজ্ঞাসা করল বলরাম।
মা এবার হেসে বললেন, না, তুমি ঠিক বাড়িয়ে বল না, বাড়িয়ে বলে তোমার ভাষা। তোমার এই ভাষা এবার বদলাবার সময় এসেছে। যাতে সংক্ষেপে বেশ গুছিয়ে তোমার ভাব প্রকাশ করতে পার, এমন ভাষা চাই। যা হবে খুব যুক্তিযুক্তপূর্ণ। ভাবালুতাপূর্ণ আবেগের ভাষা নয়।
এরপর বলরাম নিয়মিত গীতা পড়তে শুরু করে। সে ভাবে, সে কি কেবল মাইকেল রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ পড়বে, গীতা পড়বে না? গীতার কথা জানবে না?
এরপর থেকে গীতার চরিত্রগুলির মধ্যে যেন সে দিনরাত যাপন করতে লাগল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কুশীলবদের তার মনে হতে লাগল তারা যেন তাদেরই পরিবারের অংশ। সে বলরাম, কৃষ্ণ তার ভাই। সে সর্বত্রই পান্ডব কৌরবদের দেখতে লাগল। যে সব মানুষ ভালবাসতে জানে, যারা খুনি, যারা ব্যভিচারী বা সাধু প্রকৃতির। যারা সারা জীবন যুদ্ধ করে। যারা ভন্ড সাধুর পিছনে পিছনে ঘোরে। যারা সদাচারী কিংবা ঈশ্বরকে ভন্ড বলে মনে করে। যারা জুয়া খেলে, মদ খায়, নারী লোলুপ সবাই যেন রক্ত মাংসের শরীর হয়ে তার সামনে ঘোরা ফেরা করে। কেউ যুধিষ্টির কেউ অর্জুন কেউ দুর্যোধন, কেউ দুঃশাসন আবার তাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষও আছে, যারা মনে করে ঈশ্বর তাদের মতোই একজন মানুষ। তিনি তাদের মতোই কাজ করেন, কথা বলেন, তাদের সঙ্গেই বাস করেন, তিনি কেবল সাধু সন্ত ছাড়া, সকলের কাছে ধরা দেন না, ধরা দেন তাদের কাছে, যাদের তিনি নিজের প্রতীক বলে মনে করেন।
কলেজ পাশ করার পর, যখন নিজের জীবিকার জন্য চেষ্টা করতে লাগল, তখন কোন জীবিকা সে বেছে নেবে ভেবে, তা গীতায় খুঁজতে লাগল। সে একজন সাধু সন্ত হবে? একজন তরুণ সন্ন্যাসী হবে? নাকি সে হবে একজন যোদ্ধ? কিন্তু এর কোনটাই আধুনিক পেশা নয়।
মনে মনে সে ভাবলো, আমি একজন মনস্তাত্ত্বিক হবো। বলরাম তার বাবাকে সে কথা জানালো।
- খুব ভাল কথা। উত্তর দিলেন তার অস্ত্র-চিকিৎসক বাবা। তিনি বললেন, সমস্ত মানসিক অসুস্থতার পিছনে শারীরিক কারণ বর্তমান থাকে। প্রথমে চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন কর। আগে একজন অস্ত্র-চিকিৎসক হও। আমি কি বলছি তুমি বুঝতে পারছ?
- আমি মানুষকে কেটে খুলে না দেখে তাদের ভিতরটা জানতে চাই, বুঝতে চাই।
- মানুষকে নতুন করে আর জানা বোঝবার কী আছে? কিছু নেই। মাথা নাড়তে নাড়তে বলরামকে বললেন তার বাবা। জীবনে তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি পদার্থ বিজ্ঞানী হতে চাও নাকি রসায়নবিদ? কিংবা পরমাণু অথবা সেল নিয়ে পড়াশুনা করতে চাও? মনোবিজ্ঞান এমনই এক বিজ্ঞান যার কোন অস্তিত্ব নেই। আত্মা মন তুমি কি এসবে বিশ্বাস কর?
- মানুষকে আমি বিশ্বাস করি বাবা, মানুষে আমার বিশ্বাস। মানুষদের যে কোন জিনিষে তৈরী করে নেওয়া যায়। এমনকি ভালো মানুষও। তারা সকলেই অমৃতের পুত্র, ঈশ্বরের সন্তান।
- এই জন্যই তুমি কি গীতা পড় প্রতিদিন? আর যার সঙ্গে দেখা হয়, তাকেই সেই কথাগুলি বলো?
- ঠিক বলেছো বাবা, সেই জন্যই পড়ি। ওই সব জানলে মানুষকে আরও ভালো করে বেঁচে থাকার পথ দেখানো যায়।
- বোগাস! বলে বাবা বিরক্ত হয়ে, তার কাছ থেকে উঠে চলে যান।
(২).
এর কিছুদিন পর বলরামের বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। সংসারের দায় দায়িত্ব এসে পড়ে বলরামের উপর। এরপর বলরামের আর কিছু নিয়ে মাষ্টার ডিগ্রি করা হয়নি। কিছু হওয়া হয়নি তার। দু-চারটে ছাত্র ছাত্রী পড়িয়ে চলে তার এখন। তবু সে রোজ গীতা পাঠ করে। সে এটাকে মনোস্তাত্বিকদের পাঠ্যবই হিসাবে ভাবে। এইভাবে তার দিন গড়াতে লাগলো।
ছেলের বয়স হয়ে যাচ্ছে দেখে, একদিন লীলাবতী দেবী বলরামকে বলল, এবার একটা বিয়ে কর বাবা। তোর বাবা তো চলে গেল। আমি আর কতদিন আছি, কে জানে? আমি মরলে কে দেখবে তোকে?
বলরাম শুনে হেসে বলল,আগে একটা চাকরি-বাকরি জোগাড় করি। এখন আমি চাকরি-বাকরি কিছু করি না। আমায় কে আর মেয়ে দেব বলো?
শুনে লীলাবতী দেবী বললেন, তোর বন্ধু অমিয় তো এখন শাসক দলের একজন কেউকেটা। তাকে বলে দেখ না। যদি তোর জন্য কিছু একটা কাজ-বাজ জোগাড় করে দিতে পারে। ঠিক আছে তোকে বলতে হবে না। আমি তাকে একদিন বাড়িতে ডেকে, তার সাথে কথা বলে দেখবো।
এর কিছুদিন পর অমিয়র প্রচেষ্টায় একটা নার্সিং হোমে কাজ জুটে যায় বলরামের। সেখানে আট ঘন্টা হাড় ভাঙা খাটুনির পর , মাসের শেষে পেত মাত্র হাজার পাঁচেক টাকা। তবে সেটা টিউশনি করার চেয়ে অনেক ভালো ছিল।
একদিন একটি মেয়েকে নার্সিংহোমে এনে ভর্তি করা হয়, সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। ব্যর্থ প্রেমের কারণে এমনটা করেছিল সে। মাম্পিং করে তার বিষ বের করার পর সে সুস্থ হয়ে ওঠে। তাকে দেখে বলরামের মনে পড়ে যায় সেই শ্মশানে দেখা মেয়েটির কথা। সে মনে মনে ভাবে, আহা ! কী অসহায় এইসব মেয়েদের জীবন।
বলরামের মা কিছুদিন ধরেই তাকে বিয়ের তাগাদা দিচ্ছিল। 'এখন তো একটা চাকরি-বাকরি করছিস , এবার না হয় একটা বিয়ে কর বাবা, আমি দেখে যাই। আমি কবে আছি কবে নেই। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না ক'দিন ধরে। কাজ কর্মে আগের মতো আর তেমন যুত পাই না, ক্লান্ত লাগে। ঘরে একটা বউ এলে, আমি তার হাতে তোর সব দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে মরতে পারি।'
শুনে বলরাম প্রতিবাদ করে বলেছিল, মরার কথা তুমি আর কোনদিন বলবে না মা।
লীলাবতী দেবী শুনে নিঃশব্দে হাসেন। তারপর বলেন, পাগল ছেলে আমার, মরার কথা বললেই কি আর কেউ মরে যায়?
- মরুক, না মরুক, তুমি আর কখনও এ'কথা বলবে না
- আচ্ছা বাবা, আচ্ছা, আর বলবো না, এবার হলো তো?
বলরাম মনে মনে ভাবে এমন অসহায়, প্রেমে ব্যর্থ, মেয়েকেই সে বিয়ে করতে চায়। তার পাশে দাঁড়াতে চায় জীবন সাথী হয়ে।
মাকে মেয়েটির সব কথা খুলে বলে বলরাম। লীলাবতী দেবী তার সব কথা শুনে, মেয়েটির বাড়ির ঠিকানা চায়,তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য।
বলরাম পরদিন, নার্সিংহোমের রেজিষ্টার থেকে
মেয়েটির বাড়ির ঠিকানা একটা কাগজে টুকে এনে মাকে দেয়। দিন দু'একের মধ্যে নিজেই লীলাবতী দেবী মেয়েটির বাড়ি গিয়ে তাদের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলেন। লীলাবতী দেবী জানান তাদের কোন দাবী-দাওয়া নেই। মেয়েকে তারা একবস্ত্রে নিয়ে যেতে রাজী। একথা শুনে তারা রাজী হয়ে যান। তারপর একটা ভালদিন দেখে, রেজিষ্ট্রি করে তাদের বিয়ে হয়ে যায় অনাড়ম্ভর ভাবে।
বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই বলরাম তার বউ মালতিকে গীতা পড়ে শোনাত। প্রথম প্রথম খুব আগ্রহ নিয়ে গীতাপাঠ শুনত মালতি। ধীরে ধীরে তার আগ্রহ কমে যেতে থাকে। কাজ আছে বলে সে এড়িয়ে যায় আজকাল। বলরাম একা একাই গীতাপাঠ শেষ করে, বই বন্ধ করে তুলে রাখে।
লীলাবতী দেবী একদিন বলরামকে ডেকে বলল, বাবা তোদের বিয়ে তো অনেকদিন হয়েছে, এবার একবার বৌমাকে নিয়ে কোথায় গিয়ে ঘুরে আয়। মায়ের কথায় বলরাম চমকে উঠে বললো, মা এত টাকা আমি কোথায় পাবো, ঘুরতে যাওয়ার মতো।
- বাছা, আমি দেবো। আমার কাছে কিছু টাকা জমানো আছে।
তারপর মায়ের অনুরোধে দীঘা যাওয়া স্থির হয় তাদের। মালতির মন আনন্দে নেচে ওঠে। ভাবে শাশুড়ির মতো এমন মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বই কি!
বলরামের মনও আনন্দে ভরে যায়। মাততিকে নিয়ে এতদিন কোথাও যাওয়া হয়নি তার। দীঘা এই প্রথমবার যাবে সে। বাবা মারা যাওযার পর বন্ধুরা মিলে একবার দীঘা যাওযার কথা হয়েছিল। বন্ধুরা বলেছিল, চল না দীঘায় ক'দিন ঘুরে আসি। মনটা হাল্কা হবে তোর।
- নারে, মাকে একা বাড়িতে ফেলে রেখে যাওয়া হবে না আমর।
বন্ধুরা তার যুক্তি মেনে নিয়ে, যাওয়ার জন্য আর অনুরোধ করেনি। তাকে ছাড়াই ওরা সকলকে মিলে দীঘা চলে গিয়েছিল।
মালতি একটু একটু করে গুছিয়ে নিচ্ছিল
দীঘা যাওয়ার জন্য জিনিষপত্র। বলরাম, গীতাটা এনে বললো, এটাও ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নাও। মালতি আপত্তি করে বললো, না এটা নিয়ে গেলে, আমি যাব না। দীঘায় গিয়েও গীতা নিয়ে পড়ে থাকবে তুমি। তা হবে না।
শুনে বলরাম অপ্রতিভ হয়ে পড়ে মৃদুভাবে বলে, এটা নিয়ে গেলে, অসুবিধা কি তোমার?
- গীতার সাথে তো তোমার মনে ওই মেয়েটার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাকে কেন তুমি বহন করে নিয়ে যাবে আমাদের মধ্যে? এর আর কোন সদুত্তর দিয়ে দিতে পারে না বলরাম, গীতা নিয়ে সে ফিরে গিয়েছিল ঘরে।
সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এগারোটা সাড়ে এগারোটার মধ্যে দীঘা পৌঁছে যায় তারা।
বাস থেকে নেমে একটা দোকানে ঢুকে কচুরী খেয়ে টিফিন সেরে নেয় । তারপর সমুদ্রের তীরে গিয়ে বসে।
এর আগে ওদের দু'জনের কেউই দীঘা দেখেনি। প্রথমবার সমুদ্রের গর্জন শুনে আর জলের ঢেউ দেখে তারা মুগ্ধ হয়ে যায়। মনের ভিতরটা তাদের উচ্ছাসে ভরে ওঠে। মালতি বলরামের হাতটা টেনে নিয়ে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বলরামের এই মুহূর্তটিকে খুব ভাল লাগে। আর তা মনে মনে নিবিড়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ের কোনে কোনে। সে তা উপভোগ করে ভীষণভাবে।
এইভাবে কতক্ষণ বিভোর হয়ে বসেছিল তারা জানে না। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল, পিছন থেকে কেউ একজন ডাকল মালতিকে।
- এই মালতি।
ঘোর কাটিয়ে মালতি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল। সুদেব দা আর তার বউ। সুদেব তার প্রাক্তন প্রেমিক। যার বিয়ের কারণে সে বিমূঢ় হয়ে পড়ে, বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে গেছিল। মালতির বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল তাকে দেখে। তবু সে নিজেকে সামলে নিয়ে সংযত সুরে বলল, আরে সুদেবদা, তুমি এখানে? সঙ্গে তোমার বউ বুঝি।
- হ্যাঁ।
মালতিও গর্বিতভঙ্গীতে বলরামকে দেখিয়ে বলল,
এই যে আমার বর। এসো তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ওরা এসে তাদের পাশে দাঁড়াতেই, মালতি বলরাম কে বলল, সুদেবদা আমাদের পাড়ার পাশের পাড়াতেই থাকেন। আমাকে একসময় পড়াতেন। নাম সুদেব বসু।
সুদেব তাকে হাতজোড় করে নমস্কার জানালো, মালতি আমার কাছে কিছুদিন টিউশন পড়েছিল। তারপর সঙ্গের মহিলাকে দেখিয়ে বলল, এই আমার বউ রিমি। বরানগর থাকে।
বলরামও হাত জোড় করে বলল,আমার নাম বলরাম চক্রবর্তী। মালতির সঙ্গে কিছুদিন আগেই আমার বিয়ে হয়েছে।
আসুন বসুন না?
হ্যাঁ, বলে ওরা তাদের পাশে বসল। সুদেব বলরামকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি করেন?
- আমি একটা নার্সিং হোমে কাজ করি। আপনি?
- আমি হাই স্কুলে পড়াই।
একথা সেকথায় তাদের মধ্যে আলাপ জমে উঠলো। বেশ বেলা হয়ে যাচ্ছে দেখে, সুদেব তাদের বললো, আপনারা দুপুরের খাওয়া খেয়েছেন?
বলরাম বললো, না।
- তবে চলুল উঠি। কোথাও গিয়ে কিছু খাওয়া যাক।
- হ্যাঁ, চলুন। বলে বলরামরা উঠে পড়লো।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা এসে ঢুকল বিশ্ববঙ্গ হোটেলে।
খাবার খেতে খেতে সুদেব বলরামকে বলল, আপনারা কবে এসেছেন?
বলরাম বলল,আজই। আপনারা?
- আমরা কাল এসেছি। আপনারা কাল কোথায় যাবেন?
- এখনও ঠিক করিনি কিছু।
- তবে চলুন না কাল তাজপুর? আমরাও যাব। তাহলে একসঙ্গে যাওয়া যাবে।
বলরাম মালতির দিকে তাকিয়ে বললো, কি বলছে তোমার মাষ্টার মশাই,যাবে নাকি কাল তাজপুর?
- সে তুমি যা ভাল বুঝবে তাই করবে।
- তবে চলুন কাল তাজপুর। বলরাম বলল, সুদেবকে।
খাওয়া দাওয়ার পর সুদেব সকলের বিল মিটিয়ে দিতে গেলে, মালতি বলল, না না তা হবে না। আমাদের বিল আমরাই মেটাব। তার কথায় বলরামও সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ ঠিকই তো বলেছে মালতি।
(৩).
সুদেব মালতিকে পড়াতে এসে প্রথম প্রথম খুব আগ্রহ নিয়ে পড়াত। মালতিও তার পড়াবার আগ্রহ দেখে ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে তার প্রতি । তার মনে সুদেবের জন্য একটা জায়গা তৈরী হয় ধীরে ধীরে। কিন্ত সে তা প্রকাশ করতে পারে না। মনে চেপে রাখে গোপনে।
সেদিন বাড়িতে মা ছিল না। মা গেছিল মাসির বাড়ি। অন্য দিনের মতো সেদিনও সন্ধ্যার সময় সুদেব তাকে পড়াতে আসে। বাবা তখনও অফিস থেকে বাড়ি ফেরেনি। সুদেব তাকে 'শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা' পড়াচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। ঘরে মধ্যে ভূতের মতো অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়লো। মালতি ভয়ে সুদেবের বুকে এসে আশ্রয় নিলো।
সেই প্রথম, আর সেই শুরু। সুদেবও তার আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারলো না। জড়িয়ে পড়লো তার প্রেমের আকর্ষণে। সুদেব তখন কয়েকটি টিউশনি ছাড়া আর কিছুই করে না। স্কুল সারভিস কমিশনের্ পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের প্রেম চললো কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে । সুদেব একদিন এসে মালতিকে জানাল স্কুলে তার চকরিটা হয়ে যাবে।
মালতি সেদিন মনের খুশিতে নিজেকে নিঃসংকোচে সঁপে দিয়ে ছিল সুদেবের কাছে। চূড়ান্ত সুখ উপভোগ করেছিল দুজনেই। সেটাই বোধহয কাল হয়েছিল মালতির পক্ষে। তারপর মালতি অনুভব করল,ধীরে ধীরে সুদেবের থেকে আকর্ষণ কেমন আলগা হয়ে আসছে। সামনে মালতির মাধ্যমিক পরীক্ষা, সেই কারণ দেখিয়ে সুদেব আর আগের মতন তেমন মেশে না মালতির সঙ্গে। আগের মতো কারণে-অকারণে সঙ্গ দেয় না। পড়াবার দায়িত্বটুকু শেষ করে বাড়ি ফিরে যায়। মালতির বুকে লাগে সুদেবের এই আচরণ। তবু সে মুখ বুঁজে সব সহ্য করে চুপ করে থাকে। সুদেবকে কিছু বলে না মুখ ফুটে।
ভাবে পরীক্ষার পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সুদেব মনে মনে যে এমন মতলব এঁটেছে, মালতি আগে থেকে তা কিছুই বুঝতে পারেনি মোটে।
কিছুদিনের মধ্যে সুদেব চাকরীটা পেয়ে যায়।
তারপর তাকে কিছু না জানিয়েই আচমকা বিয়ে করে ফেলে রিমিকে। সে খবরটা তার কানে আসে অন্য এক বান্ধবী মারফৎ। শুনে প্রথমটায় সে বিশ্বাস করতে পারেনি। তারপর যখন ভাল করে খবর নিয়ে সত্যিটা সে জানতে পারল। সে মনে মনে খুব ভেঙে পড়ল। সুদেবের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। সুদেব তার ফোন নম্বর দেখে ফোন না ধরেই কেটে দিল।
তারপর যতবার ফোন করলো, দেখলো সুদেবের ফোন সুইচ অফ। তখন আর তার বাঁচার ইচ্ছে রইল না। এতোটা অপমান আর বিষাদ বেদনায় সে একেবারে মুষড়ে পড়ল। সে তা আর সহ্য করতে পারল না। বাড়ির সবাই রাতে ঘুমিয়ে পড়লে পর সে বাড়িতে থাকা ইঁদুর মারা বিষ জলে গুলে খেয়ে ফেলল। সঙ্গে টিক-টুয়ান্টি।
একটু পরেই মালতির মা বাথরুমে যেতে গিয়ে মেয়ের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে, মালতিকে ডেকে কোন সাড়া না পেয়ে, তার ঘরে ঢুকে দেখে, মালতি বিছানায় পড়ে আছে, আর তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে। তার চিৎকারে বাড়ির সকলে জেগে ওঠে, এম্বুলেন্স ডেকে তাকে ধরাধরি করে তুলে, কাছাকাছি একটা নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাম্প করে তার স্টমাক থেকে বিষ বের করে দেওয়া হয়।
পরদিন সকালে একটা গাড়ি বুক করে ওরা তাজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হল। মালতির তাজপুর আসার তেমন কোন ইচ্ছে ছিল না। একটা কারণেই সে এখানে এসেছে। সুদেবদার কাছে জানতে চাইবে সে কেন তাকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল। তাকে একবার জানাবার কথাটাও পর্যন্ত তার মনে হল না? ফোন কেন সে সেদিন ধরল না,বারবার কেটে দিল।
তাজপুরে যখন ওরা এসে পৌঁছাল,তখন সমুদ্র অনেক দূরে সরে গেছে। এখানে দেখার জন্য কিছু স্ট্যাচু আছে মুগ্ধ করার মতো। স্ট্যাচুগুলি নানারকম সামুদ্রিক জীবের। তারা সকলে ঘুরে ঘুরে তাই দেখল। নানারকম সমুদ্র পাখির স্ট্যাচু, নানারকম কাঁকড়ার স্ট্যাচু, নানারকম মাছের স্ট্যাচু। প্রখর রোদ উঠেছে। মালতি এসব দেখতে দেখতেই ঘেমে নেয়ে উঠেছে। বলরাম সেসব ভ্রুক্ষেপ না করে বলল, চলুন আমরা সামনে গিয়ে সমুদ্রের জল ছুঁয়ে আসি। বলরামের কথা শুনে রিমি উৎসাহের সুরে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ তাই চলুন।
মালতি বলল, না বাপু আমার সমুদ্রের জল ছোয়াঁর অত শখ নেই। আমি এখানে ওই দোকানের ছায়ায় একটু বসি। আপনারা সকলে ঘুরে দেখে আসুন। তার কথা শুনে সুদেব রিমিকে বলল, কি দরকার আবার অতোটা পথ পেরিয়ে সমুদ্র ছোঁয়ার?
রিমি জেদ ধরে বলল, না আমি যাব। তুমি না গেলে থাক এখানে।
- বেশ তাই ভাল। বলল, সুদেব।
বলরাম আর নিলি গেল দূরে সরে যাওয়া সমুদ্র ছুঁতে। মালতি এই সুযোগটারই অপেক্ষা করছিল।
মালতি দোকানটায় বসে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিলো। সুদেব বলল, ডাব খাবে?
- তুমি খাবে?
- হ্যাঁ
- তবে বল।
ডাবঅলা দুটো ডাব কেটে এনে তাদের হাতে দিল।
ডাবে চমুক দিতে দিতে সুদেব বলল, তোমার স্বামী কি জানে না যে তোমার সাথে আমার আগে ভাব ছিল?
- না
- বেশ ভাল। কেন বলোনি তাকে?
- এসব কথা কি ঢাক পিটিয়ে বলার কথা?
অভিমানে মালতির চোখ ছলছল করে উঠল। সে সুদেবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা একটা কথা বল তো, তুমি আমার সাথে এমন প্রতারণা করলে কেন? কি ছিল আমার অপরাধ?
- তোমার কোন অপরাধ ছিল না। সব অপরাধ আমার।
- মানে?
- আমার স্কুলের চাকরিটা পেতে দশলাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। সে টাকা আমার ছিল না। আর টাকা না দিলে চাকরিটা হত না। সে টাকা দিয়েছিল রিমির বাবা, এই শর্তে যে রিমিকে আমার বিয়ে করতে হবে। আমার কাছে আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই তার কথায় রাজী হতে হয়েছিল আমায়। আমার আর কোন উপায় ছিল না তখন।
- সে কথা তুমি আমায় জানাতে পারতে অন্ততঃ।
- কোন মুখে আর সে কথা আমি তোমাকে বলব?
- মোবাইল অফ করে রেখেছিলে কেন?
- সেও তোমার ভয়ে। জানি তুমি বারবার ফোন করবে।
- বেশ করেছো। জানোে,আমি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম।
- হ্যাঁ, পরে শুনেছি। শুনে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। আমিই তার জন্য দায়ী। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছিল তখন।
- মরে গেলেই ভাল হতো।
- ছিঃ এসব কথা বলতে নেই, বলে আবেগের বশবর্তী হয়ে সুদেব মালতীর পিঠে হাত রাখল।
মালতি শরীর মুচড়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বলল,
তুমি আর আমায় ছোঁবে না।
সুদেব সপ্রতিভ হয়ে মুহূর্তে তার হাত সরিয়ে নিল।
তারপর বলল, তুমি বিশ্বাস করবে না জানি, তবু বলছি, আজও আমি তোমায় খুব ভালবাসি।
- ওই সব ছেঁদো কথা ছাড়ো। আমাকে ভালবাসার কথা তোমার মুখে আর মানায় না। মালতি শ্লেষের সুরে বলল। যাকে বিয়ে করছো,তাকে আর আমার মতো দাগা দিয়ো না। তাকে মনদিয়ে ভালবেসো। তাকে হতাশ কোরো না।
(৪).
মনে অনেক দিনের চাপা পড়ে থাকা জটিল প্রশ্নের ভার যেন এখন কিছুটা লাঘব হয়ে গেছে। দম আটকানো চাপা ভাবটা যেন বুক থেকে নেমে, বুকটা অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছে এখন। মালতি মনে মনে হাল্কা বোধ করল বেশ।
মালতি ডাবঅলাকে ডাবের দাম কেটে নেবার জন্য তার হাতব্যাগ খুলে তার থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে দিতে গেলে, সুদেব বলল, তুমি দিয়ো না। আমি ডাবের দাম দেব। মালতি বলল, না আমিই দেব। আমি কারও কাছে আর ঋণী থাকতে চাই না আর।
ডাবঅলা দুটো ডাবের দাম ষাট টাকা কেটে রেখে, মালতিকে চল্লিশ টাকা ফেরৎ দিলো। মালতি টাকাটা তার হাতব্যাগে ঢুকিয়ে, হাত ব্যাগের চেনটা টেনে আটকে দিল।
সুদেবকে সে ক্ষমা করে দিল মনে মনে।
ওরা ফিরে আসছে সমুদ্র ছোঁয়ার উচ্ছাস নিয়ে।
ওরা কাছে এলে, মালতি রিমিকে বলল, তোমরা ডাব খাবে তো?
আমরা একটা করে ডাব খেয়েছি।
- তবে তো খাবই। রিমি হেসে উত্তর দিল।
মালতি ডাবঅলাকে আরও দুটো ডাব দিতে বলল। ডাবঅলা দু'টো ডাবের মুখ কেটে তাদের দিতে এলে, হাতব্যাগ খুলে ডাবঅলার দেওয়া চল্লিশ টাকার সঙ্গে আরও কুড়িটাকা যোগ করে মালতি ডাবঅলাকে দাম মিটিয়ে দিলো।
সেখান থেকে বেরিয়ে তারা মন্দারমণির উদ্দেশ্যে রওনা হল। মন্দারমণিতে নেমে দেখল সেখানে তেমন ভিড় নেই। আগে তারা একটা ভাল হোটেলে ঢুকে, দুপুরের খাওয়া সেরে নিল। তারপর সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে খানিকক্ষণ বসল। দেখল মটর-চালিত নৌকায় করে যাত্রীদের সমুদ্রের ভিতরে অনেকখানি করে ঘুরিয়ে আনছে। রিমি বলল, চল না আমরাও ওদের মতো নৌকায় করে ঘুরে আসি। মালতি বলল, ওদের ডেকে জিজ্ঞেস করে দেখতো
জন-প্রতি কত করে নিচ্ছে? রিমি নৌকাঅলাদের একজনকে ডেকে সে কথা জানতে চাইলে, সে বলল, তিনশ টাকা করে।
মালতি শুনে বলল, টাকা খোলামকুচি আরকি !
লোকটি বলল, ম্যাডাম একঘন্টা সমুদের ভিতর পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেখাব।
- তাকে কি? তা বলে পার-হেড তিনশ টাকা!
- আপনারা কত দেবেন?
- তুমি ঠিক করে দাম বল।
- ঠিক আছে পঞ্চাশটাকা করে কম দেবেন। চারজনে হাজার টাকা দেবেন।
- না, তাও অনেকবেশী।
- তবে আপনারা কত দেবেন বলেন, শুনে চলে যাই।
- আমরা দেড়শ টাকা করে দেবো। চারজনে ছ'শো টাকা।
- না ম্যাডাম, পারব না। বলে লোকটি চলে যাচ্ছিল।
তা দেখে, সুদেব বলল, ঠিক আছে। পার-হেড দু'শো টাকা করে দেব। রাজী থাক তো চল। না হলে যাও।
- আর পঞ্চাশটা টাকা বকশিস দিয়ে দেবেন স্যার। মোট সাড়ে আট'শ দেবেন।
- না, ওই আট'শ টাকাই দেব।
ওই টাকায় নৌকাঅলাকে রাজী করিয়ে তারা নৌকায় উঠল। কিছুটা যাওয়ার পরে ঢেউয়ে ঢেউয়ে নৌকা দোল খেতে লাগল। তা দেখে সকলেরই খুব ভয় করতে লাগল সমুদ্রে পড়ে ডুবে যাবার। রিমি ব্যালান্স না রাখতে পেরে, পড়ে গেল নৌকার উপর। মালতি শক্ত করে নৌকার ধারটা চেপে ধরে বসে রইল। তাতেও কি রেহাই আছে। তারও পড়ার উপক্রম হল টাল খেয়ে। আগে জানলে কে এমন আতঙ্কের নৌকায় চড়তে আসত। রিমি বলল, আর চড়ব না,ফিরে চল পাড়ে। মালতি বলল, টাকা খরচ করে এসেছি যখন। আতঙ্ক নিয়েই এই পাড়ি শেষ করব। কারও কথায় কোন কান না দিয়ে নৌকাঅলা তার মতো করে নৌকা চালাতে লাগল।
মালতি অনেকক্ষণ বসে থাকার পর একবার উঠে দাঁড়াতেই, ঢেউয়ের এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ল সুদেবের গায়ের উপর। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল আবার। অদ্ভুত এক শিহরণ জাগানো অনুভূতি হল তার মনে।
শেষপর্যন্ত সকলেই নিরাপদে এসে পাড়ে পৌঁছাল তারা।
তারপর সেখান থেকে তারা পুনরায় দীঘায় ফিরে এসে সমুদ্রের পাড়ে বসে আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে দেয়। সুদেব বলল বলরামকে, কাল আমরা শংকরপুর যাব। আপনারা যাবেন নাকি?
বলরাম, মালতিকে বলল,কি যাবে নাকি কাল?
মালতি শুনে বলল, না কাল আর যাব না। আজ সারাদিন খুব ধকল গেছে। কাল সম্পূর্ণ রেষ্ট নেব।
সারাদিন খুব আনন্দে কেটেছে তাদের।
রাতে বাড়ি ফেরার আগে তারা একটা হোটেলে ঢুকে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে, শেষে ঘরে ফিরে এলো।
মালতি তো বলরামের আদরে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু বলরামের চোখে ঘুম এলো না। রাত বারটা বেজে গেল। ঘুম নেই বলরামের চোখে। পুরনো দিনের কত কথা মনে পড়ছে তার। মালতির দিক থেকে ঘুরে উল্টো দিকে মুখ করে শুলো সে। ভাবল এবার ঘুম এসে যাবে। একটা রাতচরা পাখি তীক্ষ্ণ চিৎকার করে কোথায় উড়ে গেল। নানা কথা
ভাবতে ভাবতে একটা বেজে গেল। বলরাম ভাবল,আজ কি তবে বিনিদ্র রাত কাটবে?এমনটা তার হয় না। তবে আজ ঘুম আসছে না কেন? সে আবার পাশ ফিরে মালতির দিকে ঘুরলো। দেখল,মালতি কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ হচ্ছে। মুখটা নিষ্পাপ, সুন্দর। বলরাম অনেকক্ষণ মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কখন ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছে, নিজেও টের পায়নি।
শেষরাতে মালতি উঠে বাথরুম থেকে ঘুরে এলো। তারপর বলরামের পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তখন বলরামের ঘুমটা ফিকে হয়ে এলো। সেও মালতিকে জড়িয়ে ধরে, আবার চোখ বুজলো।
ঘুম ভাঙল তাদের বেশ বেলায়। তারা ঠিক করল, আজ দুপুরের খাওয়া সেরে তারা বেরোবে
'অমরাবতী' পার্ক দেখতে। আজ দেখা না হলে আর তাদের দেখা হবে না। কাল তাদের বাড়ি ফিরে যেতে হবে। সেই মতো প্রস্তুতি নিয়েই তারা ঘর থেকে বেরোল।
বলরাম কোনদিন কারও সঙ্গে প্রেম করেনি।
তবু আজ তার নিজেকে অনেকটা প্রেমিক প্রেমিক লাগল। সে কোনদিন যা করেনি আজ তাই করলো, মালতি একটা হাত টেনে নিয়ে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে হাঁটতে লাগল। আর ভাবতে লাগল, মালতি তার প্রেমিকা হলে কেমন হতো? বিয়ের আগে তারা কিছুদিন প্রেম করলে, এমন ভাবেই তো সে তার হাত ধরে হাঁটত?
মালতির হাতটা এইভাবে বলরাম হঠাৎ মুঠোর মধ্যে টেনে নেওয়ায় মালতি একটু বিস্মিত হলেও তার ভাল লাগল খুব। সেও প্রেমিকার মতো মনে মনে কিছুটা উচ্ছসিত হয়ে উঠল বইকি! সে তাই আবেগেপ্রবণ হয়ে অমরাবতী পার্কের ভিতরে খানিকটা হাত ধরে ঘোরাঘুরি করার পর বলরামকে একটা নির্জন জায়গা দেখিয়ে বলল, চলো না ওখানটায় একটু বসি।
বলরাম বলল, বসবে? চলো তবে যাই।
ওরা সেখানে গিয়ে বসলো।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর বলরামের মনে হলো, মালতিকে প্রেমিকার মতো জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেলে কেমন হয়?
মালতি তো তার আগের প্রেমিককে চুমু খেয়েছে নিশ্চয়ই। ওর বিয়ের আগেই চুমু খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। বলরামের তা নেই। তাই সে অনুভব করতে চায়, পার্কে নির্জন আড়ালে লুকিয়ে চুমু খেলে কেমন অনুভব হয়। তাই সে মালতির আরও সংলগ্ন হয়ে, তাকে আবেশে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায় আচমকা মালতির গালে। মালতি লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। কিছু বলে না মুখে। সেও বুঁদ হয়ে বসে থাকে প্রেমের আবেশে। তার মনে পড়ে যায় সুদেবের কথা।
মালতিকে অন্যমনস্ক দেখে বলরাম বলল,কি ভাবছো?
মালতি বলল, কিছু না।
- আমারটা শোধ করে দাও।
- কি?
- এই যে দিলাম
- কি দিলে?
- আহা ভুলে গেলে, বলে বলরাম মালতির অন্য গালে আর একটা চুমু দিলো। তারপর বলল, এবার তাহলে দুটো শোধ কর।
মালতিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে, বলরাম আবার বলল, কি হলো?
- আমার বড় লজ্জা করে।
- ওসব জানি না, আমারটা শোধ দাও।
এরপর বাধ্য মেয়ের মতো মালতি, বলরামের দু'গালে দুটো চুমু দিলো নিবিড়ভাবে।
বলরামের খুশিতে মন ভরে গেল। মনে মনে ভাবল এতদিনে সে তবে একজন যোগ্য প্রেমিক হয়ে উঠেছ। দীঘা থেকে বলরাম, যেন অন্য মানুষ হয়ে ফিরলো।
(৫).
আজকাল সে আর গীতা পড়ে সময় যাপন করে না। বরং নার্সিং হোমের কাজ শেষ কর্ম শেষ করে, বাড়ি ফিরে মালতিকে সময় দেয়। তার সাথে নানা রকম গল্প করে সময় কাটায়। তার জীবনের ছোটবেলার কথা বলে। তার কাজের জায়গার গল্প বলে।
মালতিরও আজকাল খুব ভাল লাগে, বলরামের সঙ্গে গল্প গুজব করে কাটাতে।
সেদিন নার্সিংহোম থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময়, একটু অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা বাইক এসে তার পায়ের উপরে উঠে পড়ে। বাইকের ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়ে বলরাম। বাইকটা তাকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। রাস্তা থেকে উঠতে গিয়ে বলরাম টের পায়, উঠে দাঁড়াবার মতো জোর পাচ্ছে না পায়ে। বোঝে পায়ের গোড়ালিটা ভালো ভাবেই যখম হয়েছে। একটা রিক্সা ডেকে, তাতে করে সে তার নার্সিং হোমে ফিরে যায়। সেখানে গিয়ে ডাক্তারকে দেখাতেই, ডাক্তার তার পা দেখে বলে, এক্সে করাতে হবে। বলরাম এক্সা করায়। ডাক্তার তা দেখে তাকে জানায়, গোড়ালির হাড় ভেঙেছে। তাকে প্ল্যাষ্টার করে ছেড়ে দেয়। পায়ে প্ল্যাষ্টার নিয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে।
বলরামের বাড়ি ফিরতে দেরী দেখে মালতি খুব চিন্তা করছিল। এমনটা দেরী তো সে কখনও করে না। তবে আজ এতো দেরী হচ্ছে কেন ফিরতে?
বলরামকে ওই অবস্থায় রিক্সায় করে ফিরতে দেখে মালতি কেঁদে আকুল হয়ে পড়ে। বলরামকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। পরে সব শুনে মালতি তাকে বলে, তুমি কিছু বললে না বাইকঅলাকে। বলরাম বললো, সে তো আমাকে ধাক্কা মেরে, রাস্তায় ফেলে দিয়েই পালিয়ে গেলো। কিছু বলার সুযোগই দেয়নি।
মালতি বলে, রাস্তায় আর কোন লোক ছিল না।
দু-একজন ছিল। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই
বাইকটা ঊর্দ্ধশ্বাসে পালিয়ে যায়।
বলরামের মা লীলাবতী দেবী বাতে শয্যাশায়ী, বিছানায় পড়ে থাকে প্রায়শই। সে-ও উঠে এসে বললামকে দেখে কেঁদে ফেলল। এইসব দেখে, বলরামের নিজেকে আরও অসহায় লাগে। তবু সে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, তুমি কেঁদো না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে আবার।
অনেকদিন তার বিছানায় পড়ে কাটলো।
প্রথম কিছুদিন পায়ের যন্ত্রণায় দিনে রাতে ঘুমাতে পারত না। একটু তন্দ্রার মতো এসেই যন্ত্রণার কারণে হটাৎ তন্দ্রা কেটে যেত। তখন শুধুই কষ্ট।
ব্যথা একটু কমলে আবার তন্দ্রার ঘোর আসতো।
এই ভাবে বেশ কিছুদিন কেটেছে তার।
তখন হঠাৎ হঠাৎ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে,
সে শুনতে পেতো, একটা রাতচরা পাখি কোথায় ডাকছে আকুল হয়। কাকে ডাকছে সে এভাবে? তার প্রণয়িনীকে? বলরাম ভাবতো মনে মনে।
আবার কোথাও কুকুর ডেকে উঠছে, কেউ কেউ স্বরে, যেন কেউ তাকে ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে। কে এত রাতে পথে ঘুরে বেড়ায়? ভবঘুরে নাকি চোর? এইভাবে কোনও কোনও দিন আবার তন্দ্রার মধ্যেই তার স্বপ্নের ঘোরে রাত কেটে যেতো। একদিন বলরাম দেখে, তার সে বাবার হাত ধরে বাজারে যাচ্ছে। পরনে তার হাফপ্যান্ট। গায়ে নীল রঙের গেঞ্জী। পায়ে নতুন কেনা চটি। সেটা পা দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার। সেদিকে ভ্রক্ষেপ না করে, বাবা তার হাত ধরে টানতে টানতে বাজারে ঢুকে একটা দোকান থেকে মায়ের পূজার জন্য ফুল কিনল। তারপর
তাকে ওই দোকানে দাঁড় করিয়ে রেখে কোথায় চলে গেল। আর ফিরে এলো না তার কাছে। হঠাৎ স্বপ্নটা ভেঙে যাওয়ায় তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তখন সকালের রোদ এসে তার পায়ে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।
খুব মন খাপাপ হলে সে মাঝে মাঝে সেই গীতাটা ড্রয়ার থেকে বের করে পড়ে।
বলরাম আজকাল রোজই গীতা পড়ে মন দিয়ে। বাতে শয্যাশায়ী মা। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। রোজ সন্ধ্যায় মায়ের কাছে বসে খানিকটা গীতা পাঠ করে আসে। মা শোনেন
আগ্রহ নিয়ে। এইভাবে দিনগুলি কাটছিলো তার।
পড়তে পড়তে গীতা তার মুখস্ত হয়ে গেলো। কিন্ত পা-টা সম্পূর্ণ সারল না। তবু আজকাল সে হাঁটা চলা করতে চেষ্টা করে। ভালোভাবে পারে না। তবুও কিছুটা পারে। আগে তো একদমই পারত না। মালতি কে ধরে বা লাঠিতে ভর দিয়ে বাথরুমে যেতে হতো। এখন আর তা করতে হয় না। একা একা নিজেই গিয়ে বাথরুমে বাথরুমের কাজ সেরে আসতে পারে। হেঁটে গিয়ে মায়ের ঘরে তাকে গীতা পাঠ করে শোনায়।
(৬).
মালতি আজকাল বাড়িতে দু'জন ছাত্রী পড়ায় নীচু ক্লাসের। মাসে হাজার টাকা আসে সংসারে। বলরাম বাড়িতে পা ভেঙে পড়ে আছে। কোন আয় নেই। কিন্তু পেট তো বাঁধ মানে না।
এইভাবে অনেক কষ্টে কাটলো তাদের ছ'মাস। এরপর যখন বলরাম রাস্তায় হাঁটার উপযুক্ত হয়ে উঠলে, একদিন তার কাজের জায়গায়, পুরনো নার্সিং হোমে দেখা করতে গেলো। গিয়ে শুনল তার কাজের জায়গায় নতুন লোক নেওয়া হয়ে গেছে। এখন আর তাকে সেখানে নেওয়া যাবে না। তবে পরে যদি কোনও কাজের জায়গা ফাঁকা হয়, তবে তাকে ডেকে পাঠাবে মালিক সতীনাথ বাবু।
এইকথা শুনে বলরাম মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। ভাবল মালতিকে কথাটা জানাবে। পরক্ষণেই মনে হলো, ওকে জানিয়ে লাভ কী হবে? বরং শুনে ও দুঃখ পাবে মনে , মন খারাপ হবে ওর। তাই বলরাম আর কাউকে কিছু জানাল না। বাড়ি ফিরে বলরাম স্নান খাওয়া সেরে, নিজের ঘরে এসে, বিছানায় বসে গীতাটা পড়তে শুরু করল।
গীতা পড়ে বলরামের মনে হল, বাস্তবতার সঙ্গে যখন আদর্শ ও ধর্মের বিরোধ বাধে তখন সাধারণ সৎ মানুষরা অসহায় হয়ে পড়ে। আর শেষপর্যন্ত বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মার্কসবাদীরা মনে করেন, 'মানুষের চেতনা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে না বরং বিপরীত দিক থেকে মানুষের সামাজিক সত্তাই তার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।' এইসব জেনে বুঝে বলরাম আজকাল খুব বিভ্রান্ত বোধ করে।
বলরাম সন্ধেবেলা যখন মার ঘরে গিয়ে, লীলাবতী দেবীকে গীতা পাঠ করে শোনায়, মালতি তখন তাদের ঘরে বসে টিভি দেখে। শব্দটা কমিয়ে দিয়ে, খবর শোনে। একদিন খবর শুনে জানতে পারলো, যারা ঘুষ দিয়ে ওএমআর শিট জাল করে চাকরি পেয়েছে, তাদের কারও চাকরী থাকবে না। খবরটা শুনেই মালতির হঠাৎ সুদেবদার কথা মনে পড়ে গেলো। সেও কি তাহলে এর মধ্যে আছে? কি হবে তাহলে তার?
যে চাকরীর জন্য সে মালতিকে ত্যাগ করল, নিষ্ঠুর ভাবে, তাকে করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়ে।
মালতি আর ভাবতে পারে না। তবে এখন সে বুঝতে পারে, সুদেবদার বিয়ের খবর শুনে অতটা আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে,ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করাটা তার ভুল হয়েছে। অবশ্য ভুলই বা বলে সে কি করে? আত্মহত্যার চেষ্টা না করলে, তাকে নার্সিংহোম আসতে হতো না। আর নার্সিং হোমে না এলে, বলরামের সাথে তার পরিচয় হতো না। বিয়ে তো দূর অস্ত। সে আর ভাবতে পারে না, তার মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করে ওঠে।
মায়ের ঘরে গীতাপাঠ শেষ করে বলরাম ঘরে এলে, মালতি উঠে গিয়ে, টিভিটা বন্ধ করে রান্না ঘরে ভাত বসাতে যায়। সকালের ডাল তরকারি গরম করে নেয়।
বলরাম আজকাল একা বসে বসে ভাবে,
ছোটবেলা কত আশা ছিল বুকে, স্বপ্ন ছিল মনে।
এখন সব কেমন ধূসর স্মৃতি মনেহয়। তখন একেবারে মসৃণ সমান্তরাল না হলেও, জীবন এতটা জটিল ছিল না। আজকাল দিন যাপনের গ্লানিতে সব আশা বুক থেকে হারিয়ে গেছে। সব স্বপ্ন মন থেকে মুছে গেছে নির্বিকার। এখন ভাল ভাবে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে উঠেছে তাদের। এরপর কি হবে উপায়? ভেবে ভেবে কোন কূল-কিনারা পায় না বলরাম।
(৭)
কিছুদিন পর লীলাবতী দেবী হার্ট-ফেল করে মারা গেলেন। মায়ের মৃত্যুতে বলরাম একদম মুহ্যমান হয়ে পড়ল। মনের ভিতরটা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল তার।
রোজ সন্ধ্যায় বলরাম মাকে গীতা পড়ে শোনাতো। বলরাম ভাবলো, মাকে দেবার মতো তার আর কী আছে। তাই সে ঠিক করল, শ্রাদ্ধের দিন সন্ধ্যায় সে মাকে গীতা পাঠ করে তাঁর আত্মার জন্য শান্তি স্বস্ত্যয়ন করবে। সে কথা জেনে মালতি পাড়ার সব ধর্মপ্রাণ মানুষদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এলো সেখানে উপস্থিত হবার জন্য। সকলেই লীলাবতী দেবীর সুব্যবহার আর মানবিক আচরণের জন্য পছন্দ করতো। তাই অনেকেই এসেছিলেন সেদিন গীতা পাঠ শুনতে। সে সময় তাদের অন্য কাজ থাকার জন্য কয়েকজন আসতে পারেননি।
বলরাম শুদ্ধ বস্ত্রে, শুদ্ধ মনে, মাকে স্মরণ করে, গীতা হাতে নিয়ে প্রণাম করে শুরু করলেন পড়া। শান্ত কন্ঠে ধীরে ধীরে , উদাত্ত সুরে, শুদ্ধ উচ্চারণে, সাবলীল বাচনভঙ্গীতে পড়া শুরু করতেই সমবেত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলারা সকলে আগ্রহ নিয়ে শুনতে শুরু করলো।
কিছুক্ষণ পড়ার পরেই তার শরীরে যেন কৃষ্ণ এসে ভর করলেন। সঞ্জয় যেমন দিব্যচক্ষে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বর্ণনা শুনিয়েছিলেন। বলরামও যেন দিব্যকন্ঠে সমবেত সকলের কাছে গীতার বাণী শোনাতে লাগলেন। সকলের চোখের সামনে যেন সচ্ছ ভাবে সব কিছু পরিস্ফূট হয়ে উঠছিল। কতক্ষণ গীতা পাঠ করেছিলো বলরাম জানে না। পাঠ শেষ হতে অনেকেই, 'জযগুরু' 'জয়শ্রীহরি' ধ্বনিতে আসর মুখোরিত করে তুললো। কারও কারও চোখে জলের ধারা লক্ষ্য করে বলরাম প্রণাম করে গীতাগ্রন্থটি সযত্নে লাল কাপড়ে মুড়ে রাখলো।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে সকলকে প্রণাম করলেন, বললেন, আপনারা সকলে এসেছেন, আমি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। আশীর্বাদ করবেন, মায়ের আত্মা যেন শান্তি পান।
অনেকেই তার গীতা পাঠের প্রশংসা করলেন, কেউ কেউ আবার বললেন, এমন গীতাপাঠ আমরা জীবনে শুনিনি। সকলেই খুশি মনে বলরামকে আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন।
জীবন কখনও থেমে থাকে না। এরপর স্বাভাবিক নিয়মেই বলরামের জীবনের গতি ধীরে এগোতে লাগল। মায়ের অভাব মনে মনে ভীষণ অনুভব করে সে। মাঝে মাঝে নিজেকে নিঃস্ব লাগে, বুকের ভিতরটা শূন্য মনেহয়, একেবারে ফাঁকা বলরামের।
পাড়ার নিবারণ বাবুর বাজারে একটা মুদি মশলার পাইকারী দোকান আছে। তার মা বাতে পঙ্গু চলাফেরা করতে পারেন না। তিনি পাশের বাড়ির শম্পার মার কাছে শুনলেন, সেদির বলরামের গীতা পাঠের কথা। তিনি যেতে পারেননি বলে, মনে মনে খুব আপসোস করলেন।
একদিন নিবারণকে ডেকে বললো, বাছা, একদিন বাড়িতে গীতা পাঠের ব্যবস্থা কর না বলরামকে দিয়ে। ওর গীতাপাঠ শুনতে আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে, শম্পার মার মুখে শুনে। নিবারণ বললো, এ আর বেশি কথা কী মা ! বৃহষ্পতিবার আমার দোকান বন্ধ থাকে, সামনের বৃহষ্পতিবার না হয় আমি বলরামকে আসতে বলবো।
মালতির ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা দু'জন বেড়েছে।
সকালে একব্যাচ পড়ায়,সন্ধ্যায় আর একব্যাচ।
মোট ছাত্র-ছাত্রী ছয়জন এখন। ফলে সংসারে আয়ও কিছুটা বেড়েছে। তাই দিয়েই সংসার চালিয়ে নেয় মালতি।
রবিবার সকালে দোকান খুলতে যাবার আগে নিবারণ বাবু, বাড়িতে এসে বলরামকে তাদের বাড়ি বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় গীতা পাঠ করতে যেতে বললেন। বলরাম তার আমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাব।
মালতি তখন ছাত্র-ছাত্রিদের পড়াচ্ছিলো। সে শুনে খুশি হলো কী না বোঝা গেল না।
সন্ধ্যার সময় বলরাম নিবারণ বাবুর বাড়ি গিয়ে দেখলেন, পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকেই তার গীতাপাঠ শোনার জন্য আগে থেকেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। নিবারণ বাবুর মা বলরামকে দেখে বলল, এসো এসো বাবা, বসো। তুমি কত বড় হয়ে গেছো। কত ছোট দেখেছি তোমায়। তোমার বাবা মারা যাওয়ার আগে লীলা কত আসত আমাদের এ বাড়িতে। তোমার বাবা মারা যাবার পর লীলা কেমন হয়ে গেল। ঘর থেকে আর বের হতো না। বলরাম শুনে মলিন হাসলো।
শ্রোতা-দর্শকের বসার জন্য মেঝেতে সতরঞ্জি পেতে দেওয়া হলো। বলরামের জন্য নিবারণ বাবুর স্ত্রী একটি সুন্দর সুতোর কাজ করা আসন পেতে দিলেন। বলরাম সেখানে গিয়ে বসে। গীতা বের করে প্রথমে প্রণাম করে সামনে রাখলো। তারপর লাল কাগড় মোড়া থেকে গীতা খুলে বের করলো। শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে গীতাপাঠ শুরু করলেন।
ধীর লয়ে নম্রসুরে পাঠ আরম্ভ করলেন। তার চোখের সামনে যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছিলো। সে যেন কৃষ্ণের মতো অর্জুনকে গীতার বাণী শোনাচ্ছে, এমন এক ভক্তিভাব তার মনে কাজ করছিল। বিভোর হয়ে গীতা পাঠ করছিল বলরাম। কতক্ষণ পাঠ করেছে তার খেয়াল নেই। যখন তার গীতা পাঠ শেষ হলো, সকলে ধন্য ধন্য করে উঠলো। বলরামের গীতাপাঠ শুনে মুগ্ধ সকলেই।
বলরাম, জয়গুরু বলে গীতা প্রণাম করে, লাল কাপড়ে মুড়ে রাখলেন। তখন বিবারণ বাবুর মা এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, বেঁচে থাকো বাবা। খুব বড় হও। আমার মন ভরে গেছে তোমার গীতাপাঠ শুনে, আমি খুব খুশি হয়েছি। তারপর তিনি ডাকলেন, নবু।
তার ডাক শুনে নিবারণ বাবু মায়ের কাছে এসে তার হাতে একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট দিলেন। তিনি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলরামকে দিতে গিয়ে বললেন, এটা তোমার উপহার। বলরাম দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে বললো, এসব আবার কেন মাসিমা। আপনি শুনে খুশি হয়েছেন, এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। আমি খুশি হয়ে তোমায় দিচ্ছি। না নিলে আমি খুব দুঃখ পাবো। আমি তোমার মায়ের মতো, তোমার মা কি তোমায় কিছু দিলে তুমি না করতে পারতে?
এরপর আর কিছু বলার থাকে না বলরামের। সে সংকোচে হাত পেতে প্যাকেটটা নিলো। নিবারণ বাবু পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে মায়ের হাতে দিলেন। তিনি নিবারণ বাবুর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে, বলরামকে দিয়ে বললো, এটা তোমার দক্ষিণা বাবা, রাখো। বলরামকে দ্বিধা-সংকোচে হাত পেতে টাকাটা নিতে হলো, নিবারণ বাবুর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। তারপর তাকে প্রণাম করে, সে'গুলি নিয়ে নিবারণ বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
মালতি টিউশনি পড়িয়ে, রান্না-বান্নার কাজ সেরে বসে ছিল বলরামের ফেরার অপেক্ষায়। বলরাম ঘরে ফিরতেই তার হাতে প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটটা দেখে বললো, এটা কী?
মাসিমা উপহার দিয়েছেন। মালতি প্যাকেটটা খুলে দেখলো, তাতে এক প্যাকেট মিষ্টি, আর নামাবলী লেখা একটা পাঞ্জাবী। মালতি তা দেখে খুশি হয়ে বললো, এই পাঞ্জাবীটা পড়েই এখন থেকে তুমি গীতা পাঠ করবে।
বলরাম, নাটকীয় সুরে বললো, যথা আজ্ঞা দেবী।
তারপর পকেট থেকে বের করে পাঁচশো টাকার নোটটা মালতির হাতে দিলো।
মালতি টাকাটা হাতে নিয়ে বললো, এটাও কি তিনি দিয়েছেন?
- হ্যাঁ, আমার গীতা পাঠের দক্ষিণা।
- মালতি হেসে বললো, বেশ ভালই হয়েছে তাহলে, মাসের শেষে টাকাটা পেয়ে , কাল ভাল মন্দ কিছু নিয়ে এসো বাজার থেকে।
বলরাম এবার মালতির চিবুক ছুঁয়ে চুমু খাওয়ার ভঙ্গীতে রঙ্গ করে বললো, বেশ বেশ তাই হবে সখি।
- আহা, ঢঙ। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে এসো, আমি খাবার বাড়ছি, বলে মালতি রান্না ঘরের দিকে এগোলো।
(৮).
মায়ের মৃত্যুর কিছুদিনের জন্য বলরামের জীবনটা স্থাণুবৎ হয়ে পড়েছিল। এখন আবার ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে। মাঝে অবশ্য মায়ের কথা মনে পড়ে খুব, মনটা খারাপ হয়ে যায়। বলরাম তখন গীতা পড়ে মন শান্ত রাখার চেষ্টা করে।
'ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন তং নেমে জনাধিপাঃ
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্ ।।'
( পূর্ব আমি কখনও ছিলাম না এমন নহে ; তুমি কখনও ছিলে না তাহাও নহে, দেহ ধারণের পূর্বে আমরা সকলেই নিত্য আত্মরূপে বিদ্যমান ছিলাম, দেহ ত্যাগের পরেও যে আমরা কেহ থাকিব না, ইহাও নহে।) পড়ে মনটা অনেক সান্ত্বনা পায় বলরামের। বল ভরসা পায় জীবনে।
দেখতে দেখতে মায়ের বাৎসরিক কাজ এসে গেলো। এর মধ্যে বেশ কিছু বাড়িতে গাতাপাঠ করে বেশ সুনাম অর্জন করেছে বলরাম। সঙ্গে ফল, মিষ্টি আর দক্ষিণাও কিছু জুটেছে। সামর্থ অনুযায়ী কেউ দুশো, কেউ পাঁচশো, কেউ আবার হাজারও দিয়েছে। এটা তার সংসারের পক্ষে একটা সুস্থির অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে।
তাই সে ঠিক করলো, মায়ের বাৎসরিক কাজের দিনটায়ও সে বাড়িতে গীতা পাঠের ব্যবস্থা করবে। প্রতিবেশীদের সকলকে গীতাপাঠ শোনার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে।
সেই মতো বলরামের প্রস্তুত হতে লাগল। মালতিও তার সহযোগী হয়ে, তাকে নানা শলা-পরামর্শ দিলো। মালতি সকলের বাড়ি গিয়ে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এলো দু'তিন দিন আগে।
এই ভাবে মায়ের বাৎসরিকের দিনটা এসে গেল। বাড়ির উঠোনে চাঁদোয়া টাঙিয়ে নীচে শতরঞ্জি পেতে শ্রোতাদের বসার ব্যবস্থা করা হলো।
আগের দিন গেরুয়া মাটিতে একটা থান কাপড় ছুপিয়ে রোদে মেলে দিয়েছিল মালতি।
লীলাবতী দেবীর ছবিটি সুন্দর করে চন্দন দিয়ে সাজিয়ে দিলো মালতি। একটা ছোট জলচৌকির উপর সাদা রঙের টেবিল ক্লথ পেতে,
যেখানে বসে বলরাম গীতাপাঠ করবে, সেখানে রাখলো। পাশে একটা মোটা রজনীগন্ধার মালা রাখলো।
বলরাম গেরুয়া থান কাপড়টা পরে, গায়ে নামাবলী লেখা পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে এসে বসলো আসনে। এই পোষাকে তাকে খুব মানিয়েছিলো। বলরাম মাকে প্রণাম করে, জলচৌকির উপরে রাখা সেই মালাটা মায়ের বাঁধানো ছবিতে পরিয়ে দিলো। তারপর লাল কাপড় মোড়া গীতা খুলে, সেটাকে প্রণাম করে, মনে মনে কৃষ্ণকে স্মরণ করে পাঠ শুরু করলো।
সকলেই সেদিন বলরামের গীতাপাঠ শুনতে এসে মুগ্ধ হলো। বাবার বন্ধু ডাক্তার অবিনাশ সরকারও তার মাকে নিয়ে এসেছিলেন। গীতাপাঠ শুনে, শেষে ফিরে যাবার সময় তিনি ও তার মা বলরামের গীতাপাঠের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তারপর সময় করে একদিন তাকে তার বাড়িতে দেখা করতে বললেন।
বলরাম কৃতজ্ঞচিত্তে বললো, আচ্ছা কাকাবাবু নিশ্চয়ই যাবো।
অন্যন্য যারা এসেছিল তারাও বলরামের গীতাপাঠের অনেক প্রশংসা করলো। শুনে বলরামের বুকের ভিতরটা ভরে উঠলো। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে গেল। মাকে মনে মনে আবার প্রণাম করলো।
এইভাবে দিন কাটছিল তাদের। মাসে দু'একটা গীতা পাঠের ডাক পাচ্ছিলো বলরাম।
তারা সাধ্য মতো উপহার, দক্ষিণাও দিচ্ছিলো।
বলরাম ভাবলো গীতাপাঠ তার একটা আয়ের উৎস হয়ে উঠছে।
একদিন সকালে বলরাম, অবিনাশ বাবুর বাড়ি গেলো। ডাক্তার বাবু তখন রোগী দেখছিলেন। নীচের ঘরে চেম্বার বানিয়ে,বাড়িতেই তিনি সকাল বেলা রোগী দেখেন । বলরামকে একটু বসতে বলে, রোগী দেখা শেষ করে তিনি বলরামকে নিয়ে উপরের ঘরে মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন । বলরামকে দেখে তার মা খুব খুশি হলেন। বললেন, বোসো বাবা। সেদিন তোমার গীতাপাঠ শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের বাড়িতে তোমাকে একদিন গীতা পাঠ করতে হবে।
শুনে বললাম বিনীত সুরে বললো, সে তো আমার সৌভাগ্য কাকিমা।
তুমি একটু বসো বলে তিনি উঠে রান্না ঘরের দিকে গেলেন।
অবিনাশ বাবু বললেন, আমার একজন সহকারী (Assistant) দরকার। যে ভোর বেলা এসে পেশেন্টদের নাম লিখে করে রাখবে একটা রেজিষ্টার খাতায়। আমি চেম্বারে বসি সকাল আটটা থেকে। ভোর থেকেই পেশেন্টরা আসতে শুরু করে। তারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে আমি চেম্বারে না বসা পর্যন্ত। তাই তাদের সুবিধার জন্য কেউ তাদের নাম খাতায় কালানুক্রম লিখে রাখলে তাদের অতক্ষণ দাঁড়াতে হবে না। তোমার কি ভোরে এসে তা করা সম্ভব হবে?
বররাম বললো, নিশ্চয়ই হবে কাকবাবু। আমি করব এই কাজ।
অবিনাশ বাবু শুনে খুব খুশি হয়ে বললেন, বেশ, বেশ। তাহলে তুমি কাল থেকেই কাজে লেগে যাও। প্রতি পেশেন্ট অনুযায়ী তুমি পাবে দশটাকা করে। সপ্তাহে সপ্তাহে আমি তোমায় পেমেন্ট করে দেবো। বলরাম বললো আচ্ছা। আমি কাল ভোর পাঁচটার মধ্যেই চলে আসবো। তার একটু পরেই অবিনাশ বাবুর মা ফিরে এসে বসলেন আবার।
বলরাম তাকে দেখে বললো, কবে গীতাপাঠ শুনবেন বলবেন, আমি সেই মতো এসে হাজির হবো।
- ঠিক আছে বাবা বেঁচে থাকো চিরকাল।
তখন একজন কাজের মেয়ে এসে ঢুকলো , এক প্লেলেট মিষ্টি আর একগ্লাস জল দু'হাতে নিয়ে। বলরামের সামনে এনে রাখলো।
অবিনাশ বাবুর মা বললেন, খেয়ে নাও বাছা। চা আসছে।
বলরাম, দ্বিধাগ্রস্থভাবে বললো, এসব আবার কেন কাকিমা?
- সকালবেলা এসেছো, একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে তোমায় ছাড়তে পারি ? তোমার বাবা বেঁচে থাকতে এ বাড়িতে কত আসতেন। খাও, খেয়ে নাও বাছা।
বলরাম মিষ্টি শেষ করে গ্লাসের জলে চুমুক দিতে দিতে দেখলো, চা এসে গেছে ততক্ষণে।
বলরামের সঙ্গে অবিনাশ বাবুও চা পান করলেন।
একরাশ খুশি নিয়ে অবিনাশ বাবুর থেকে বলরাম সেদিন বাড়ি ফিরলো। ঘরে ঢুকেই মালতিকে খুশির খবরটা দিলো।
খবর শুনে মালতি যেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে অক্টোপাশের আটশূরে বলরামকে আকড়ে ধরলো। বলরামও ছাড়াবার কোন চেষ্টা করলো না। মালতির আদর নিবিড়ভাবে উপভোগ করলো।
(৯).
পরদিন ভোরবেলা মালতিই ঘুম ভাঙিয়ে তাকে তুলে দিল বিছানা থেকে। এতো সকালে বলরাম কখনও ওঠে না ঘুম থেকে। তাই ঘুমের জড়তা চোখে নিয়েই সে বাথরুমের কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ল অবিনাশ বাবুর বাড়ির উদ্দেশে।
ভোরের বাতাস গায়ে লাগতেই শরীর জুড়িয়ে গেলো। কতদিন ভোরের আকাশ দেখা হয় না, বলরাম ভাবলো। আকাশটা যেন ছানার জলের মতো নীলাভ। চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে তার মন ভরে গেল। এসব দেখতে দেখতে ভোর পাঁচটায় সেখানে পৌঁছে দেখে, দু-তিন জন এরই মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বলরাম উপরে গিয়ে, চেম্বারের চাবি নিয়ে এসে, ঘর খুলে, রেজিষ্টার খাতা বের করে তাদের নাম ঠিকানা বয়স লিখে নিলো। পাঁচটা থেকে আটটা পর্যন্ত চললো নাম লেখার কাজ, তারপর আটটার সময় অবিনাশ বাবু চেম্বারে এসে বসার পর, বলরামের ছুটি হলো। রোগী মন্দ হয় না। আজ বারো জন এসে নাম লিখিয়েছে। মানে তিন ঘন্টায় আজ তার আয় একশো কুড়ি টাকা (১০×১২), মোটেও মন্দ নয়, এই সময়টা তো তার ঘুমিয়েই কেটে যেতো। ডাক্তার বাবু এসে চেম্বারে বসার পর, বলরাম তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে, ফুরফুরে বাতাস গায়ে মেখে বাড়ি ফিরে এলো। বলরামকে ফিরতে দেখে মালতি চায়ের জল চাপিয়ে দিয়ে, বলরামকে বললো, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে বসো, আমি আসছি। বলরাম তার কথা শুনে লুঙ্গি গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো। কিছুক্ষণ পরে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসে বলরাম দেখলো, একটা প্লেটে ধোঁয়া ওঠা দু-কাপ চা আর চারটে ব্রিটানিয়া বিস্কুট নিয়ে এসেছে মালতি।
চা নিয়ে দু'জনে পাশাপাশি বসে, মালতি চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, কেমন কাটলো আজ?
বলরাম বললো, দারুণ। বহুদিন পর ভোরের আকাশ দেখে আজ মনটা ভরে গেছে।
- আর ওখানকার কাজ?
- কাজ বলতে, ওখানে একটা রেজিষ্টারে পেশেন্টদের নাম ঠিকানা বয়স লিখে রাখা। হাল্কা কাজ।
মালতি বললো, বেশ ভালই হলো বলো, সপ্তাহে কিছু টাকা আসবে ঘরে।
- তা তো বটেই। আজ খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে, মা এসব দেখে যেতে পারলে খুব খুশি হতো।
মালতি বললো, হ্যাঁ তা আর বলতে?
কিছুক্ষণ এরকম নানা কথাবার্তার সাথে, দু'জনের চা পান শেষ হলো। তারপর মালতি খালি কাপ-ডিস নিয়ে রান্না ঘরে ফিরে গিয়ে, রান্না চাপালো গ্যাস ওভেনে।
এভাবে বলরামের দিন ভালই কেটে যাচ্ছিলো। ভোরে উঠে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করতে করতে ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছে যাওয়া, তারপর অপেক্ষমাণ রোগীদের নাম এন্ট্রি করতে করতে অবিনাশ বাবু চেম্বারে এসে বসলে, তাকে রেজিষ্টার বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরা। ফিরে এসে মালতির হাতের এককাপ চা আরে দুটো থিন অ্যারারুট বিস্কুটের স্বাদ তখন যেন অমৃত মনে হতে লাগলো।
রবিবার চেম্বার বন্ধ থাকতো। সেদিন ভোরে উঠে বলরাম মালতিকে নিয়ে হাঁটতে বের হতো। কোন দিন হাঁটতে হাঁটতে বাইপাশে ধরে চলে যেতো অনেক দূর। সেখানে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে, দু'জনে দু'কাপ চা নিয়ে বসতো। তখন বলরামের মনে হতো, জীবনটা যে এতোটা নিবিড় সুখের হতে পারে তা বলরামের আগে জানা ছিল না। এটাই যেন স্বর্গ।
চায়ের দোকান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আবার বাড়ি ফিরতো। বাড়ি ফিরতো মালতি একা, বলরাম বাজারের দিকে চলে যেতো কিছু কেনাকাটা করতে।
একসপ্তাহ পরে বলরামকে অবিনাশ বাবু
আটশো টাকা হাতে দিলেন। মানে ছয় দিনে আশিজন পেশেন্টের নাম বলরাম এন্ট্রি করেছে।
বাড়ি এসে বলরাম, মালতির হাতে টাকাটা তুলে দিলো। মাতলি গুণে দেখে বললো, মন্দ নয়, কি বলো?
মালতির চোখে মুখে খুশির ঝলক দেখে, বলরাম হেসে বললো, নিশ্চয়ই। কে দিতো আমাদের সপ্তাহন্তে এতোগুলি টাকা?
মাঝে মাঝে গীতাপাঠের ডাকও পেতো।
উপহার দক্ষিণা মিলে ভালোই চলে যাচ্ছিলো তাদের সংসার।
(১০).
বাইক এক্সিডেন্টে যখন পা ভেঙে ছিলো,বলরাম ভেবেছিলো, জীবনটা বোধহয শেষ হয়ে গেলো তার। সে বুঝি আর কোন দিনও উঠে দাঁড়াতে পারবে না। অনেকদিন ভুগে, চিকিৎসা করার পর যখন সে নিজে থেকে হাঁটতে শুরু করলো, তখন তার মনটা আনন্দে ভরে গেলো। জীবনের প্রতি আস্থা ফিরে এলো। তারপর আর কিছুদিনের মধ্যেই সে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে শিখলো। মাঝে মাঝে অমাবশ্যা পূর্ণিমার জোয়ারের সময়, ব্যথা হতো ঠিকই, তবে তা সহ্যের মধ্যে থাকতো। আজকাল বোধহয় প্রতিদিন ভোরে উঠে হাঁটার ফলে, সে ব্যথাটা আর টের পায় না বলরাম।
তারপর যেদিন নার্সিংহোমে গিয়ে সে জানতে পারলো, তার চাকরীটা আর নেই, মালিক সেখানে অন্য লোক নিযে নিয়েছে। মনে মনে সে তখন ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। সে যন্ত্রণা পায়ের যন্ত্রণার চেয়ে মোটেও কম ছিলো না। সংসারে অর্থনেতিক খাঁড়া নেমে এসেছিলো।
মনের ভিতরটা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভেঙে গুড়িয়ে গেছিলো। সে কষ্টের কথা সে বাড়ির কাউকে বুঝতে দেয়নি। একা একা সহ্য করেছিল। মালতি অবশ্য নিপুণ গৃহিনীর মতো সব সামলে নিয়েছে, নিজের উদ্যোগে পাড়ার কয়েকটি বাচ্চাকে পড়াতে শুরু করেছিলো।
যখন বড় আঘাতের ঢেউ এসে বলরামের উপর আছড়ে পড়ে ছিলো, বলরাম দিশেহারা হয়ে পড়েছিল সাময়িকভাবে। মাতলি তাকে সে সময় বল ভরসা জুগিয়ে ছিলো।
কারও জীবনই কখনও সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে চলে না। জীবনে চলার পথ বন্ধুর। চলতে গিয়ে পাহাড়ি পথের মতো অনেক চড়াই উৎরাই পেরোতে হয়। উত্থান পতন জীবনে থাকবেই, বলরাম একথা বুঝে গেছে। তাই তার ভয় হয় এই সুসময়টা বোধহয় আর বেশি দিন তার জীবনে সইবে না।
অবিনাশ বাবুর চেম্বার রবিবার বন্ধ থাকে। এক রবিবার অবিনাশ বাবুর বাড়ি গীতা পাঠের আয়োজন করা হলো। বলরাম সেখানে নামবলীঅলা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে, তার গীতাগন্থটি হাতে নিয়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো। গিয়ে দেখলো, অনেকেই তার গীতাপাঠ শুনতে আগে থেকেই এসেই উপস্থিত হয়েছেন।
তার মধ্যে বলরামের পুরনো নার্সিংহোমের মালিক, সতীনাথ বাবুও আছেন।
বলরাম আসনে বসে প্রথমেই মাকে স্মরণ করে, গীতায় মোড়ানো লাল কাপড় খুলে, গ্রন্থটি পাশে রাখলো। তারপর সাত্বিক মনে কৃষ্ণকে স্মরণ করে, গীতাখানি ভক্তি ভরে হাতে নিয়ে সুমধুর কন্ঠে পাঠ করতে শুরু করলেন। পাঠ করতে করতে এতটাই সে বুঁদ হয়ে গেলো, যে চারপাশের পরিবেশ সে ভুলে গেলো। তার চোখের সামনে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চিত্র সহসা ভেসে উঠলো। সে যেন সেখানে আশ্চর্যজনক ভাবে উপস্থিত হয়ে পড়েছে। কতক্ষণ এভাবে সে গীতাপাঠ করেছিল জানে না। পাঠ শেষ হতেই সকলের প্রশংসাসূচক ধ্বনিতে তার ঘোর কাটলো। সে লাল কাপড়ে গীতা মুড়ে প্রণাম করে পাশে রাখলো। অবিনাশ বাবুর মা তার কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন, দীর্ঘজীবী হও বাবা, সার্থক হোক তোমার জীবন। ধন্য হয়েছি তোমার গীতাপাঠ শুনে। বলরাম তাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। অবিনাশ বাবু একগাল হাসি মুখে নিয়ে এসে বলরামকে একটি প্যাকেটে কাপড়, ফল-মিষ্টি আর দু'টি পাঁচশো টাকা নোট তার হাতে দক্ষিণা দিয়ে বললেন, এটা রাখো বলরাম।
তখন সতীনাখ বাবু বলরামকে ডেকে বললেন , কেমন আছো বলরাম?
- এই আপনাদের সকলের কৃপায় ভাল আছি স্যার
- আমি আর তোমায় কৃপা করতে পারলাম কোথায়? একথা বলে আমায় লজ্জা দিয়ো না ।
- না, না স্যার আপনি আমার মালিক। বলে বলরাম, তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো।
একটু দূরে পাটা সরিয়ে নিয়ে সতীনাথ বাবু তাকে তুলে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ওখানে নয়, তোমার স্থান এখানে। তার কথা শুনে, তার বুকের স্পর্শ পেয়ে, বলরামের বুকটা জুড়িয়ে গেলো।
(১১).
তার কিছুদিন পরেই মালতির বাড়ি থেকে খবর এলো, মালতির বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বলরাম অনিমেশ বাবুকে খবরটা জানিয়ে , বললো, কাল তাই আমি যেতে পারবো না কাকাবাবু, আমাকে শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে।
পড়দিন সকালেই মালতিকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলো বলরাম। বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের মুখে শুনলো, দুশ্চিন্তার তেমন কোন কারণ নেই। মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছে। দিন দু'য়েক এখানে রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছেড়ে দেওয়া হবে। বলরাম খবরটা শুনে আস্বস্ত হয়ে, মালতিকে সেখানে রেখে, রাতেই বাড়ি ফিরো এলো। পরদিন ভোর পাঁচটায় গিয়ে হাজির হলো অবিনাশ বাবুর চেম্বারে, রেজিষ্টারে রোগীদের নাম এন্টি করার জন্য।
পরদিন বাবাকে হাসপাতালে দেখতে যাবার পথে সুদেবদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো মালতির। এ কী চেহারা হয়েছে তার ! চোখ মুখ বসে গেছে। মুখে একগাল দাড়ি। মাথা ভর্তি বড় বড় উস্কো-খুস্কো চুল। কতদিন চুল কাটেনি সে। প্রথম দেখে চিনতে পারনি মালতি। দিকভ্রান্তের মতো রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে সুদেবা। মালতিকে দেখতে পায়নি। মুখোমুখি হতেই মালতি বললো, সুদেবদা না?
মালতির কন্ঠস্বর শুনে, বিভ্রান্ত হয়ে, বিস্ময়ে চোখ তুলে তাকিয়ে, তাকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো, তারপর তার হাত দু'টি ধরে বললো, মালতি পারলে তুমি আমায় ক্ষমা কোরো। তোমার সাথে আমি ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছি, বড় পাপ করেছি আমি, তার শাস্তি পাচ্ছি এখন।
- কি হয়েছে তোমার, এমন দশা হয়েছে কেন?
- আদালতের নির্দেশে আমার চাকরিটা গেছে
- কেন?
- ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢোকার অপরাধে। তার কিছুদিন পর রিমি আমায় ছেড়ে তার বাপের বাড়ি চলে গেছে। আমি সব হারিয়ে নিঃস্ব এখন আমার ভুলের জন্য, আমার পাপের জন্য। তার মাসুল গুনছি আমি।
- হ্যাঁ শুনেছিলাম খবরে, ওয়েমার সিট জাল করে অযোগ্য প্রার্থিদের টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তুমিও তার মধ্যে একজন?
- হ্যাঁ, রিমির বাবা আমার চাকরির জন্য দশলাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিল, রিমিকে বিয়ে করার শর্তে।আর আমিও লোভে পড়ে, মোহের বশে তোমার কথা ভুলে গিয়ে, স্বার্থপরের মতো সেই শর্তে রাজী হয়ে গেছিলাম। আমি লোভে পড়ে পাপ করে ছিলাম, এখন তার ফল আমায় একা ভুগতে হচ্ছে।
মালতির বুকের ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো তখন। মনে পড়ে যাচ্ছিল সেদিনটার কথা। যেদিন জেনেছিল, বলরাম তাকে ছেড়ে অন্য আর একটি মেয়েকে বিয়ে করছে। বারবার সুদেবকে ফোন করে পাচ্ছিলো না সে, ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিল সুদেব। তখন কি করবে সে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। নারীত্বের কী ভীষণ অপমান ! এ জীবন আর সে রাখবে না। আত্মহত্যা করবে। কিভাবে আত্মহত্যা করবে সেকথাও তার জানা ছিল না। বাড়িতে ইঁদুর মারার বিষ ছিল দু'প্যাকেট। তাই জলে গুলে খেয়ে ফেলেছিল, তা'তে যদি না মরে ভেবে, টিক-টুয়ান্টির বোতল থেকে স্প্রে মেসিনটা খুলে, তাও খানিকটা খেয়ে ফেলে ছিল। তারপর . . . .
মালতি সুদেবকে বললো, আমি তো নিজেকে তোমার কাছে সঁপে দিয়েছিলাম, আর তুমি আমকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলে, এখন আর আমি কি করতে পারি বলো?
বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পরও, মালতি বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে এলো। সুদেবদার এমনটা হবে সে কখনও ভাবেনি। সে পরস্ত্রী, এখন তার আর কিছুই করার নেই। তবুও ছোটবেলার প্রেম মনের ভিতর এমনভাবে দাগ রেখে যায়, যে তা কখনও ভোলা যায় না। তাই মালতি সুদেবদাকে ভুলে থাকতে পারলো না। সংসারের কাজ করতে করতে মাঝে-সাঝে তার মনে পড়ে যায়, পুরনোদিনের কথা, তখন মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়।
দু'মাস পর সতীনাথ বাবু লোক দিয়ে বললামকে ডেকে পাঠালো নার্সিহোমে। বলরাম গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলো। সতীনাথ বাবু বললেন, তুমি এখন থেকে আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাব কাজ করবে এখানে। মাসে ছ'হাজার টাকা করে পাবে। দেখো রাজী কিনা?
বলরাম বলে, কি যে বলেন স্যার, খুব রাজী।
বেশ তবে কাল থেকেই চলে এসো সকাল দশটায়।
- আচ্ছা বলে, বলরাম তাকে হাত-জোড় করে প্রণাম জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
ফিরে এসে খুশি খুশি মনে মালতিকে খবরটা দিলো বলরাম। খবরটা শুনে মালতির যতোটা উচ্ছসিত হয়ে উঠে খুশি হয়ে ওঠার কথাছিলো, চোখে মুখে তার যতোটা ঝিলিক দেখতে পাবে আশা করেছিলো বলরাম, তা দেখতে পেলো না। আর তা না দেখতে পেরে মনে মনে কিছুটা হতাশ হলো সে।
বলরাম তো জানে না আর যে মালতি তখন অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছে সুদেবদার দুর্দশার কথা, তার মর্মান্তিক পরিণতির কথা।
সে কারণে মনটা তার অশান্ত ছিলো। স্থিতিশীল ছিলো না। ফলে তখন বলরাম কি বলছে, কান পর্যন্ত সেকথা পোঁছাচ্ছিলো না মালতির। মনের মাঝে যেন একটা সূক্ষ্ম ব্যবধান গড়ে উঠেছিলো।
ঘূর্ণিবাতাস যেমন সুমুদ্রের নৌকাকে নিয়ে টাল-মাটাল খেলা খেলে, মালতির মনটাও যেন আজ ভাবনার দুর্নিবার ঘূর্ণিবাতাসে লাট-মাটাল ভাবে দুলছে।
===========================
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
Kolkata - 700 084.
PHONE NUMBER - 98306 36623 (Whats App).
----------------------------------------------------------------------------